Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বেপরোয়া মোটরসাইকেল

সড়কে প্রাণহানি বাড়াচ্ছে : আগস্টে ৩০২টির মধ্যে ১২১টিই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঢাকায় প্রতিদিন নিবন্ধিত হয় ৪১৫টি : অ্যাপভিত্তিক চালুর পর অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:০০ এএম

সারাদেশে সড়ক ও মহাসড়কে বিশৃঙ্খলা ও প্রাণহানির বড় কারণ বেপরোয়া মোটরসাইকেল। গেল আগস্ট মাসে সারা দেশে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে মোটরসাইকেলের কারণে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান মতে, আগস্ট মাসে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৭৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে আরো ৩৬৮ জন। ৩০২টি দুর্ঘটনার মধ্যে ১২১টিই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বলে জানিয়েছে সংগঠনটি। গত বছর সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় জড়িত যানবাহনের মধ্যে মোটরসাইকেল ছিল দ্বিতীয় স্থানে।

মোটরসাইকেল এখন ঢাকা মহানগরে ‘মরণযান’ হিসেবে পরিচিত। অ্যাপভিত্তিক মোটরসাইকেল সেবার পাশাপাশি ঢাকার সড়কে চুক্তিতে যাত্রী পরিবহন করছে হাজার হাজার মোটরসাইকেল। বড় গাড়ির চেয়ে মোটরসাইকেলের নিবন্ধন ঢাকায় প্রায় ২২ গুণ বেশি। বিআরটিএ-এর হিসাব মতে, সারা দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের ২৫ শতাংশই ঢাকায়। দুই বছর আগে ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে ৩১৫টি প্রাইভেট কার নিবন্ধিত হতো। এখন সেটা নেমে এসেছে ৫০টিতে। অন্যদিকে এখন মোটরসাইকেল নিবন্ধিত হচ্ছে প্রতিদিন গড়ে ৪১৫টি।

দেশের দক্ষিণাঞ্চলে দুর্গম এলাকায় যাত্রী পরিবহনের জন্য মোটরসাইকেলের ব্যবহার হয়ে আসছে বহু আগে থেকেই। রাজধানীতে এখন অ্যাপভিত্তিক মোটরসাইকেল ছাড়াও মহাসড়কেও চলছে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-আরিচা, ঢাকা-মাওয়া, ঢাকা-ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যাত্রী পরিবহনে ব্যবহার করা হচ্ছে মোটরসাইকেল। মহাসড়কে চলাচলকারি এসব মোটরসাইকেলের চালকরা খুবই বেপরোয়া। সময় বাঁচাতে তারা কোনো নিয়ম না মেনে বেপরোয়াভাবেই গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছুটে চলে। এতে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। বিশেষ করে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে বেপরোয়া মোটরসাইকেলের দাপটে চালক, যাত্রী সবাই অতিষ্ঠ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনার সংক্রমণে যান চলাচল বন্ধ থাকার সময় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে মোটরসাইকেলে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী পরিবহন করা হয়েছে। রাজধানীর পোস্তগোলা এলাকায় সে সময় শত শত মোটরসাইকেল যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করতো। সে সময় দুজন করে যাত্রী ঢাকা থেকে মাওয়া ঘাট পর্যন্ত গেলেই মোটরসাইকেল চালকরা পেতো কমপক্ষে ১২শ’ টাকা। এতে সময় লাগতো মাত্র ৩৫ মিনিট। করোনার মধ্যে বেকার হয়ে পড়া অনেকেই সে সময় নতুন মোটরসাইকেল কিনে যাত্রী পরিবহন করেছে। আলাপকালে ওই পথে যাত্রী পরিবহনকারি চালক খোকন জানান, সে সময় একেকজন যাত্রী কমপক্ষে ৬শ’ টাকায় পরিবহন করা গেছে। সেই থেকেই এই রুটে ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা বেড়েছে। এখনও তা বহাল আছে। খোকন জানান, এখন যাত্রীপ্রতি দেড়শ থেকে দুশ’ টাকা করে ভাড়া আদায় করা হয়। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে নিয়মিত চলাচলকারি বাস চালক খোরশেদ জানান, ফাঁকা মহাসড়কে মোটরসাইকেল চালকরা খুবই বেপরোয়া। এরা কোনো লেন মানে না। এলোমেলো চলে। আবার কাউকে সাইডও দিতে চায় না। এক সাথে ২০-২৫টি মোটরসাইকেল প্রতিযোগিতা করে গতি বাড়িয়ে চলে। এতে করে অন্যান্য গাড়িগুলো ঝুঁকির মধ্যে থাকে। ইলিশ পরিবহনের চালক শাহাদত বলেন, আমি নিজে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা দেখেছি। বেপরোয়া চলতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে এক সাথে দুজনকে ঘটনাস্থলে নিহত হয়ে পড়ে থাকতে দেখেছি। প্রতিদিনই কোনো না কোনো স্পটে দুর্ঘটনা ঘটছেই। গতকাল শুক্রবার বিকালেও দেখা গেছে শত শত মোটরসাইকেল দলবেঁধে প্রতিযোগিতা করে বেপরোয়া গতিতে ছুটে চলেছে।

এদিকে, রাজধানীর প্রধান সড়ক ও অলিগলিতে মোটরসাইকেল চালকদের কারণে পথচারী ও যাত্রীরা ত্যক্তবিরক্ত। বেশির ভাগ মোটরসাইকেল চালকই অন্য যানবাহনকে অতিক্রম যাওয়ার চেষ্টা করে সব সময়। সে ক্ষেত্রে তারা নিয়ম না মেনে উল্টোপথে, ফুটপাত দিয়েও বাহনটি চালিয়ে যায়। বাজাতে থাকে হর্ন। রাইড শেয়ারিং অ্যাপ ব্যবহার ছাড়াও চুক্তিতে মোটরসাইকেল চলছে রাজধানীতে। সে কারণে মোড়ে মোড়ে যেন মোটরসাইকেলের বাজার বসে। রাজধানীর বনানী, গুলশান, কুড়িল, বাড্ডা, ধানমন্ডি-২৭, মৌচাক, মালিবাগ, শাহবাগ, সায়েদাবাদ, তেজগাঁও সাতরাস্তা, মগবাজার, বিমানবন্দর রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন স্থানে ডেকে ডেকে যাত্রী তোলে মোটরসাইকেল চালকরা। শুধু তাই নয়, রাজধানীর প্রতিটি এলাকার ছোট ছোট রাস্তায় এখন মোটরসাইকেলের কারণে হাঁটাই যায় না। বেপরোয়া গতিতে চলাচলকারি এসব মোটরসাইকেল চালকরা কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করে না।

দুর্ঘটনার কারণে মোটরসাইকেল এখন অনেক পরিবারের কাছে ‘প্রাণঘাতি ভয়ঙ্কর যান’ হিসেবে পরিচিত। মোটরসাইকেলের কারণে অনেক পরিবার থেকে হারিয়ে গেছে সম্ভাবনাময় সতেজ প্রাণ। তারপরেও পাড়া-মহল্লায় মোটরসাইকেলের সংখ্যা না কমে দিন দিন বাড়ছেই। যাত্রাবাড়ীর চৌরাস্তার মোড়ে এলাকায় কয়েকদিন আগেও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন এক ব্যবসায়ী। পরবিারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ডেমরার কোনাপাড়ার বাসিন্দা ওই ব্যবসায়ীর পরিবার এখন নিঃস্ব। গেল রমজানে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান দনিয়া পোস্ট অফিস গলির বাসিন্দা আব্দুল হকের বড় ছেলে। ছেলের শোকে এক সপ্তাহের মাথায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান পিতা আব্দুল হক। বিশাল বিত্তবৈভবের হক সাহেবের পরিবারও এখন নিঃস্ব।
চলতি বছর প্রকাশিত বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন অনুসারে, গত বছর পাঁচ হাজার ৫১৬ সড়ক দুর্ঘটনায় সাত হাজার ৮৫৫ জন নিহত ও ১৩ হাজার ৩৩০ জন আহত হয়েছে। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের তুলনায় প্রাণহানি ৮.০৭ শতাংশ বেড়েছে। সংঘটিত দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেলের সংশ্লিষ্টতা ছিল দ্বিতীয় স্থানে, ২১.৪ শতাংশ। প্রথম স্থানে ছিল ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান ২৯.৮১ শতাংশ। তৃতীয় স্থানে ছিল বাস, ১৮.৯৯ শতাংশ। অন্যান্য যানবাহনের মধ্যে দুর্ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা ছিল কার-জিপ-মাইক্রোবাস ৫.২২ শতাংশ, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ৯.৩৫ শতাংশ, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজি বাইক ৮.০৪ শতাংশ, নছিমন-করিমন-মহেন্দ্র-ট্রাক্টর ও লেগুনা ৭.৩২ শতাংশ।২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর সড়কে শৃঙ্খলা আনতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দেওয়া ১৮ নির্দেশনার মধ্যে মোটরসাইকেল চালনায় সতর্কতা অবলম্বনের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে হেলমেট বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। তার আগে থেকেই তিন আরোহী নিষিদ্ধ করা হয়। এমনকি হেলমেটবিহীন চালকের মোটরসাইকেলে জ্বালানী তেল দেয়াও নিষিদ্ধ করা হয়। সে সময় হেলমেট পড়া নিয়ম মানতে দেখা গেছে ঢাকাসহ সারাদেশে। কিন্তু নজরদারি না থাকায় যতোই দিন যাচ্ছে নিয়ম ভাঙার প্রবনতাও ততোই বাড়ছে।

গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতাসহ ১০টি কারণ তুলে ধরেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনতে দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ, চালকের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্টসহ ১০টি সুপারিশ করা হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনারোধে নিরাপদ সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ এবং গণপরিবহন খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন বলে মনে করছে প্রতিষ্ঠানটি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সড়ক


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ