হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
যে দিনটি আমাদের জীবন থেকে অতীত হয়ে যায়, সে দিনটিকে আমরা সাধারণত ভালো বলি। এ জন্য একটি কথা বেশ প্রচলিত ‘যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ’। এ থেকে বোঝা যায়, আগামী দিনগুলো কুদিন হিসেবে আমাদের জীবনে আসে। অথচ আগামী দিনটিও ‘আজ’ হয়ে আসে এবং এই দিনটিতে বসেই আমরা প্রচলিত কথাটি বলছি। এ হিসেবে যায় বা আসে দিন খারাপ, এ কথাটি সর্বাংশে সত্য নয়। এটি একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। একেকজনের কাছে একেক রকম হয়ে ধরা দেয়। অনেকে একে হতাশাবাদীদের চিন্তা বলে অভিহিত করেন। জীবনে তারা কোনো আশা দেখেন না। আবার অনেকে প্রচলিত কথাটি বলেন পরিবর্তনের ভয় থেকে। তারা বুঝতে চান না পরিবর্তন অনিবার্য। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু বদলায়। পুরনো ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন এবং এর সঙ্গে নতুন কিছু যুক্ত হয়। তবে পুরনো ও প্রথাগত চিন্তাভাবনা থেকে বের হয়ে আসা বা পরিবর্তন মেনে নেয়া সহজ কাজ নয়। অনেকেই এ চিন্তাভাবনাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চান। পরিবর্তন দেখলে বা তাদের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে, তারা একে ‘কলিযুগ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এ যুগকে পাশ কাটিয়ে চলতে চান এবং অন্যকেও বিরত রাখতে চেষ্টা করেন। তবে তাদের এ ধ্যান-ধারণার মূল ভিত্তি একেবারে অমূলক নয়। যুগের সঙ্গে এই ভিত্তির পরিবর্তন-পরিবর্ধন হতে পারে, তার মানে এই নয় পুরো মূলটিকেই উপড়ে ফেলতে হবে। যদি তাই করা হয়, তবে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনের যে ধারা তা কখনই সমান্তরালে চলতে পারবে না। জনগোষ্ঠী তখন আর গোষ্ঠীভুক্ত থাকবে না। এক অরাজক ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। ফলে জনগোষ্ঠীকে নির্দিষ্ট শৃঙ্খলার মধ্যে রেখে তাদের জীবনযাপন সহজ ও ব্যক্তি অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন তত্ত্ব ও পদ্ধতি জ্ঞানী-গুণী মানুষরা আবিষ্কার করেছেন এবং করছেন। ‘গণতন্ত্র’ এসব আবিষ্কারের জনপ্রিয় একটি আবিষ্কার। আজ থেকে আড়াই হাজারেরও বেশি সময় আগে যখন কিছু মানুষ যারা নিজেদের এলিট বা অভিজাত হিসেবে ভাবতেন এবং অন্যদের ক্রীতদাস হিসেবে শাসন করতেন। সাধারণ মানুষকে এলিট শ্রেণির এ শাসন ব্যবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্য, গ্রিক দার্শনিক ক্লিসথেনিস ‘পাওয়ার অব পিপল’ বা ‘রুল অব পিপল’ নামে একটি থিওরি দেন। নাম দেন ডেমোক্রেসি। তার এই ডেমোক্রেসি ‘অ্যাথেনিয়ন ডেমোক্রেসি’ হিসেবে পরিচিতি পায়। মানুষকে যে আর ক্রীতদাস হিসেবে শাসন করা যাবে না, এ বিষয়টি সে সময় এলিট শ্রেণি উপলব্ধি করে এবং একটি ভালো পদ্ধতি হিসেবে ডেমোক্রেসিকে গ্রহণ করে। সেই থেকে ডেমোক্রেসি এত বছর ধরে মানুষের কাছে পরম কাক্সিক্ষত হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। গণতন্ত্রকামী মানুষ তার অধিকার রক্ষার প্রয়োজনে একে বিভিন্নভাবে মডিফাই করেছে। নতুন নতুন তত্ত্ব ও পদ্ধতি যুক্ত করেছে। বিশ্বের খ্যাতিমান রাজনীতিকরা মানুষের আরও অধিক কল্যাণকে সামনে রেখে গণতন্ত্রের সংজ্ঞারও পরিবর্তন করেছেন। সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞাটি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন। তিনি গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করে বলেছেন, ‘গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল।’ এ সংজ্ঞায় জনগণকে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করা হয়েছে। আর সরকার জনগণের সেবক। তার এই গণতন্ত্রের সংজ্ঞা মেনেই বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশ শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করছে। এভাবে পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত হয়ে গণতন্ত্র এখন অনেক বেশি পরিশীলিত এবং সাধারণ মানুষের অধিকারকে আরও বেশি সুরক্ষিত করেছে। বলা হয়, আমরা খুবই গণতন্ত্রপ্রিয় জাতি। গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম ও জীবন দিয়েছি। গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা ধারণ করেই স্বাধীন হয়েছি। আমাদের দেশের বয়স এখন ৪৫ বছর। এই বয়সে এসে আমাদের গণতন্ত্রের অবস্থা কী? এ প্রশ্নের মূল্যায়ন করা দরকার।
দুই.
আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যারা পালাক্রমে ক্ষমতায় এসেছে, গণতন্ত্রের প্রশ্নে তাদের কখনই আন্তরিক হতে দেখা যায়নি। ক্ষমতায় থাকতে নিজেদের শাসন ব্যবস্থাকেই সর্বাধিক গণতান্ত্রিক হিসেবে মনে করেছে। ক্ষমতার বাইরে থাকলে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা নেই বলে রাজনীতির মাঠ গরম করেছে। স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর গণতান্ত্রিক মনোভাব প্রদর্শন করে সময়ের প্রয়োজনে প্রত্যেকটি দলই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়টি সানন্দে গ্রহণ করে। যেহেতু প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলই সর্বসম্মতভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি মেনে নেয়, তাই এ পদ্ধতি নিশ্চিতভাবেই গণতান্ত্রিক। গণতন্ত্রের সূচনাকাল থেকেই যেহেতু গণতন্ত্রের সংজ্ঞা বদলেছে এবং তাতে বিভিন্ন তত্ত্ব ও পদ্ধতি যুক্ত ও বিযুক্ত হয়েছে, তাই গণতন্ত্রের মৌলিক নির্যাস বজায় রেখে আমাদের মতো করে গণতন্ত্রকে চলতে তত্ত্বাবধায়ক তত্ত্ব যুক্ত হওয়া দোষের কিছু ছিল না। অনেক দেশ এ পদ্ধতি গ্রহণও করে। গণতন্ত্রে নতুন এই সংযোজন দেশ শাসনের পদ্ধতি নয়। এর কাজ শুধু একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখতে এ পদ্ধতিতে দেশ বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিল। সবকিছু গড়বড় হয়ে গেল সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। রায়ের এক অংশ গ্রহণ করে অন্য অংশ বর্জন করে সরকার তা বাতিল করে দেয়। সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যেও গণতন্ত্রে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্বাচন পদ্ধতিটি যুক্ত করা হয়েছিল, তা বাতিল করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কয়েক বছর ধরে বিস্তর যুক্তি-তর্ক হয়েছে, এখনও হচ্ছে। বেশির ভাগ মানুষই এ পদ্ধতির পক্ষে। এর বিপরীতে সরকারের তরফ থেকে বরাবরই বলা হচ্ছে, গণতন্ত্রের সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সাংঘর্ষিক। গণতন্ত্রে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে হয়। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করে বলা হচ্ছে, সেখানে গণতন্ত্রের এই ধারাই বজায় রয়েছে। তবে এ তুলনার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। উন্নত দেশগুলো তাদের মতো করে গণতন্ত্রকে ধারণ করেছে এবং তাতে তাদের জনগণ খুশি। এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। অর্থাৎ সেখানে ‘পিপলস রুল’ অনুযায়ীই গণতন্ত্রকে মানা হচ্ছে। তাদের জনগণ যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিতে নির্বাচন চাইত, তাহলে নিশ্চয়ই তারাও এই পদ্ধতিতেই নির্বাচন করত। এ পদ্ধতিতে তাদের নির্বাচন করার প্রয়োজনীয়তা নেই এ কারণে যে, তাদের জনগণ দেখছে, ক্ষমতায় যে দল থাকে তাদের অধীনে নির্বাচন হলে কোনো সমস্যা নেই। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে জোরজবরদস্তির মাধ্যমে ভোট ছিনিয়ে নেয়ার বিন্দুমাত্র আশঙ্কা নেই। ক্ষমতাসীন দল হেরে গেলেও তা সানন্দে মেনে নেয়। ক্ষমতাসীন দল ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল মনেপ্রাণে জনগণের রায়কে প্রাধান্য দেয়। আমাদের দেশে কি জনগণের এ চাওয়া বা পিপলস রুল মানা হচ্ছে? এখনও যেখানে দেশের ৬৮ ভাগ জনগণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন চাচ্ছে, সরকার কি তা মানছে? মানছে না। হ্যাঁ, গণতন্ত্র অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়াই উচিত। এটি গণতন্ত্রের একটি ধারণা। এ ধারণা গণতন্ত্রে যুক্ত করা হয়েছে। এ ধারণা আবার একেক দেশে একেক রকম। যেমন আমেরিকায় যে প্রক্রিয়ায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়, ইংল্যান্ড বা ভারতসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে সে প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হয় না। তারা তাদের জনগণের রায়কে শক্তিশালী করার জন্য তাদের মতো করে পদ্ধতি যুক্ত করে নিয়েছে। গণতন্ত্রে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে এ কারণে যে, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে জয়-পরাজয় মেনে নেয়ার ইতিবাচক ও পারস্পরিক আস্থার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য। উন্নত বিশ্বে এ আস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলেই, তারা এ ধারণা বহাল রেখেছে। এটি যে পরিবর্তন করা যাবে না, এমন কোনো কথা নেই। পরিবর্তন-পরিবর্ধন, সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেয়ার মধ্য দিয়েই এটি বিশুদ্ধ হয়। যেমন গণতন্ত্রের সূচনাকালে পত্র-পত্রিকা বা গণমাধ্যম বলে কিছু ছিল না। ফলে গণতন্ত্রে ‘ফ্রিডম অব প্রেস’ যুক্ত করার প্রয়োজন হয়নি। সেখানে ‘ফ্রিডম অব স্পিচ’ বা বাকস্বাধীনতা যুক্ত হয়েছিল। পরবর্তীতে পত্র-পত্রিকা ও গণমাধ্যমের প্রসার ঘটায় গণতন্ত্রে ‘ফ্রিডম অব প্রেস’ বিষয়টিও যুক্ত করা হয়। অর্থাৎ এতে জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা এবং প্রয়োজনীয়তাকে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন বিষয় সংযোজন ও বিয়োজন করতে হয়। গণতন্ত্রের উপাদানে অ্যাবসলিউট বা অপরিবর্তনীয় বলে কিছু নেই। এই ধারাবাহিকতায় সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক যদি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন না চায়, তাহলে অসুবিধা কি? এতে যে গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত হয়ে যাবে, এমন তো না। গণতন্ত্র তো জনগণের ইচ্ছা ও অনিচ্ছার ওপরই নির্ভর করে চলে। এটাই গণতন্ত্রের মূল বিষয়। দুঃখের বিষয়, যেখানে আমাদের দেশের জনসাধারণ ’৯১-এর জাতীয় নির্বাচনের পর কখনোই দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন চায়নি এবং চাচ্ছে না, সেখানে ক্ষমতাসীন দল গোয়ার্তুমি এবং এলিট শ্রেণির কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাব দেখিয়ে জনসাধারণের মতামতকে উপেক্ষা করে চলেছে। তারা বুঝতে চায় না, গণতন্ত্রে রাজা বলে কিছু নেই। জনগণের ইচ্ছাই সবকিছু। জনগণের এ ইচ্ছা বাস্তবায়নে সরকারকে শুধু সেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হয়।
তিন.
গণতন্ত্রকামী দেশে গণতন্ত্রের স্বাভাবিক ফল্গুধারা যদি বইতে দেয়া না হয়, তবে অনেক সমস্যা ও জটিলতার সৃষ্টি হয়। এটি অনেকটা মানুষের দেহের রক্তপ্রবাহের মতো। এই রক্তপ্রবাহ যদি কোনো কারণে বিঘিœত বা সীমিত হয়ে পড়ে, তখন মানুষ হার্টঅ্যাটাকসহ নানা অসুস্থতার মধ্যে পড়ে, এমনকি মৃত্যুবরণও করে। এ কারণে দেহের ব্লাড লাইন সবসময় মানুষকে সচল রাখার জন্য সতর্ক থাকতে হয়। অর্থাৎ ব্লাডলাইন অচলও করা যাবে না, আবার সীমিতও করা যাবে না। গণতন্ত্রের বিষয়টিও এরকম। এখানে খ-িত, সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত করার সুযোগ নেই। হয় একে পুরোপুরি চলতে দিতে হবে, না হয় বন্ধ করে দিতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলেই দেশে নানা নেতিবাচক উপসর্গ দেখা দেয়। দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ তো বটেই, বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশও তাতে অসন্তুষ্ট হয়। এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেশে ও বিদেশে দেখা দেয়। আমাদের দেশের মানুষ যে সীমিত গণতন্ত্র নিয়ে অসন্তুষ্ট, তা বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে, এখনও হচ্ছে। কান পাতলেই তার গুঞ্জরণ শোনা যায়। গুঞ্জরণের কথা এ কারণে বলছি যে, প্রকাশ্যে বলার মতো পরিস্থিতি এবং উপযুক্ত প্লাটফর্ম জনসাধারণের জন্য এখন নেই বললেই চলে। ফলে তাদের গুঞ্জরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হচ্ছে। তবে তাদের মনের কথা, মাঝে মাঝে বিদেশিদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়। এই যেমন বিশ্বখ্যাত মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তার সাম্প্রতিক প্রকাশিত ‘বিশ্ব প্রতিবেদন-২০১৬’তে বলেছে, বাংলাদেশে গত বছর মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর প্রচ- আঘাত এসেছে। গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের কর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন চালানোর পাশাপাশি সরকার আদালত অবমাননার অভিযোগ বা অস্পষ্ট আইনের আওতায় তাদের বিচারের মুখোমুখি করেছে। সরকার ক্রমেই বেশি কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এ প্রতিবেদনের পর বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কী অবস্থা তা বোধকরি পাঠকদের বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন নেই।
গণতান্ত্রিক ধারা পুরোপুরি বলবৎ না করে স্লোগান-সর্বস্ব গণতন্ত্রের কথা কেউই পছন্দ করে না। তখন দেশের টেকসই উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হওয়াসহ নানা জটিলতা দেখা দেয়। উন্নয়ন একটি গোষ্ঠীর মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়ে যায়। তারা ফুলেফেঁপে উঠে। এর কারণ এ শ্রেণিটি দেশের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকে। নিরঙ্কুশ ও জবাবদিহিবিহীন আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তারা যা খুশি তা করার সুযোগ নেয়। দুর্নীতি ব্যাপক আকার ধারণ করে। এবারের টিআইবির প্রতিবেদনেও বাংলাদেশে দুর্নীতি পরিস্থিতির কোনো হেরফের হয়নি। আগের মতোই রয়েছে। অর্থাৎ দুর্নীতি তার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। এর কারণ যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং জবাবদিহিতার অভাব, তাতে সন্দেহ নেই। যেখানে গণতন্ত্র ন্যুব্জ হয়ে পড়ে জবাবদিহিতা থাকে না, সেখানে একটি শ্রেণির দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল অর্থবিত্তের মালিক হওয়া স্বাভাবিক। কিছু মানুষের উন্নতি কোনোভাবেই সামগ্রিক উন্নতির সূচক হতে পারে না এবং এতে আত্মতুষ্টিতে ভোগা দেশের সাধারণ মানুষকে উপহাস করার শামিল। বলাবাহুল্য, নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের সুষম উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ ধরনের শাসন ব্যবস্থা কেউই পছন্দ করে না। বিশ্বের প্রভাবশালী গণতান্ত্রিক দেশগুলোরও পছন্দ হওয়ার কোনো কারণ নেই। তারা সরাসরি তাদের অপছন্দের কথা না বললেও কূটনৈতিক উপায় ও বিভিন্ন সহযোগিতার পাইপ লাইন সীমিত করে দিয়ে তা প্রকাশ করে। এর প্রতিক্রিয়ায় দেশ যেভাবে অগ্রসর হওয়ার কথা, সেভাবে এগোতে পারে না। সবচেয়ে বড় কথা, গণতন্ত্রহীনতা, সীমিত গণতন্ত্র বা খর্বকৃত গণতন্ত্র দিয়ে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায় না। এতে কিছু বড় বড় স্থাপনা গড়ে উঠতে পারে, তবে তা সার্বিক উন্নয়নের প্রতীক হতে পারে না। যদি হতো, তবে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলোতে এখনো সেই সীমিত ও কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন ব্যবস্থাই বলবৎ থাকত। তারা মুক্ত গণতন্ত্রে ফিরে আসত না।
চার.
এ কথা সর্বজনবিধিত, গণতন্ত্রই বিশ্বে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। মানুষ তার অধিকার নিশ্চিতকরণে গণতন্ত্রকেই একমাত্র উপায় হিসেবে অবলম্বন করে চলেছে। গণতন্ত্রের পরে অনেক তন্ত্র নিয়েই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে, শেষ পর্যন্ত সেগুলো টিকে থাকেনি। এমনকি যারা স্বৈরশাসন কায়েম করেছিল, তারাও জনগণের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার কাছে পরাভূত হয়েছে। আবার অনেক স্বৈরশাসকও গণতান্ত্রিক ধারা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। আমাদের দেশেই এর উদাহরণ রয়েছে। যে স্বৈরশাসক এরশাদ নয় বছর স্বৈরশাসন চালিয়েছেন, সেই এরশাদও পতনের পর গণতন্ত্রকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এখন তার মুখে গণতন্ত্রের কথা অহরহ শোনা যায়। আমরা যদি একগুঁয়ে, রগচটা, নিষ্ঠুর, স্বৈরাচার হিটলারের কথা ধরি তাহলেও দেখা যাবে, গণতন্ত্রের প্রতি তার আকাক্সক্ষা ছিল। ছোটবেলায় হিটলার তার খেলার সাথীদের বলতেন তাকে ‘প্রেসিডেন্ট’ বলে স্লোগান দিতে। এর বিনিময়ে তিনি তাদের মিষ্টি খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিতেন। মিষ্টি খাওয়ার লোভে তার খেলার সাথীরাও মিছিল করে হিটলারকে প্রেসিডেন্ট বলে স্লোগান দিত। হিটলার খুশি হয়ে তাদের মিষ্টির দোকানে নিয়ে যেতেন। তাদের মিষ্টি খাওয়াতেন। মিষ্টি খাওয়ানোর পর দোকানদার পয়সা চাইলে হিটলার বলতেন, দ্যাখছো না, ওরা আমাকে প্রেসিডেন্ট বলছে! প্রেসিডেন্টকে মিষ্টির দাম দিতে হয় না। ১৯৩৪ সালে যখন হিটলার জার্মানির প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, তখন এক সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার প্রথম কাজ কী হবে? জবাবে হিটলার বলেছিলেন, আমার প্রথম কাজ হবে ছোটবেলা যে মিষ্টির দোকানদারকে পয়সা দেইনি, তার পয়সা দেয়া। হিটলারের ছোট্ট এই ঘটনা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, তিনি যতই নিষ্ঠুর হোন না কেন, তার দেশের মানুষের ন্যায্য পাওনা ও অধিকারের ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। গণতন্ত্রের নির্যাস তার অবচেতন মনেও ছিল। আসলে গণতন্ত্র এমনই, যারা তা যতই অপছন্দ করুক না কেন, অলক্ষ্যেই গণতন্ত্র তাদের মনে ছায়া ফেলে। গণতন্ত্রের সৌন্দর্য এখানেই। সময়ের আবর্তে জনগণের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে গণতন্ত্রে অনেক চিন্তাভাবনাই যোগ-বিয়োগ হতে পারে। মানুষের অধিকার সুরক্ষিত করতে তা করতেই হবে। তার অর্থ এই নয়, গণতন্ত্রকে বাদ দিতে হবে এবং জনগণ যা চায় না, তা যোগ বা বিয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যেহেতু এখনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন চায়, তাই এই পদ্ধতিতেই নির্বাচন ব্যবস্থা করা উচিত। এটাই হবে জনসাধারণের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে গণতান্ত্রিক মনোভাবের পরিচয় দেয়া।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।