হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
আবদুল আউয়াল ঠাকুর
পশ্চিমবঙ্গের নাম বদলে ফেলতে চাচ্ছে রাজ্য সরকার। দিল্লীর অচ্ছুত ধারণা বদলে দিতেই নাকি মমতা সরকারের এই উদ্যোগ। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ বা ওয়েস্ট বেঙ্গল নামে আর ডাকা হবে না এই রাজ্যকে। এ সংক্রান্ত বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নাম থেকে পশ্চিম শব্দটি মুছে ফেলে নতুন নামকরণ করার জন্য একটি প্রস্তাব ওই রাজ্যের মন্ত্রিসভা পাস করেছে। ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের বদলে রাজ্যের নাম বাংলায় ‘বঙ্গ’ বা ‘বাংলা’ এবং ইংরেজিতে ‘বেঙ্গল’ রাখা হোক। রাজ্যের পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর এ কথা জানিয়ে বলেছেন, আমাদের রাজ্যের মানুষের স্বার্থে ও এ রাজ্যের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থেই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তিনি আরও দাবি করেছেন, এই নতুন নাম ভারতের জাতীয় স্তরেও তাদের রাজ্যের স্বার্থ রক্ষায় সহায়ক হবে। মন্ত্রিসভায় গৃৃহীত এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার জন্য আগামী ২৬ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়েছে। ২৯ ও ৩০ আগস্ট বিধান সভায় এই নতুন নাম নিয়ে বিতর্কের শেষে সকলে যাতে তা মেনে নেন, তার জন্যও আগাম আর্জি জানিয়ে রেখেছেন মি চ্যাটার্জি। বিধান সভায় পাস হলে এই নতুন নামের প্রস্তাব তারপর দিল্লীতেও পাঠাতে হবে। কারণ ভারতে কাঠামোতে কোন রাজ্যের নাম পরিবর্তন করতে হলে তাতে পার্লামেন্টের অনুমোদন প্রয়োজন।
অতীতেও পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তনের দাবি উঠেছিল একাধিকবার। তবে তা বাস্তবায়িত হয়নি। ভারতের অনেক ঐতিহাসিক তখন বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ নামের মধ্যে ‘পশ্চিম’ শব্দটি দেশভাগের ‘করুণ’ ইতিহাসের স্মৃতি বহন করে। সেটা অযথা মুছে ফেলার কোন মানে হয় না। রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি রাজ্যের ইংরেজি নাম ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল’ নিয়ে বেশ বিরক্ত বলেই জানা গেছে। আর সেটা রাজ্যের নাম পরিবর্তনের একটা প্রধান কারণ। বলা হচ্ছে, রাজ্যের নাম ইংরেজিতে ওয়েস্ট বেঙ্গল হওয়ার কারণে দিল্লীতে যখন সব রাজ্যকে নিয়ে কোন সম্মেলন হয় তখন ইংরেজি বর্ণানুক্রমে রাজ্যগুলিকে ডাকা হয় বলে ডব্লিউ দিয়ে শুরু ওয়েস্ট বেঙ্গলের নাম আসে সবার শেষে। এই জন্য পশ্চিমবঙ্গকে দিল্লীতে অনেক অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে বলেই মমতা ব্যানার্জি সরকার মনে করছে। রাজ্যের নাম বেঙ্গল রাখা হলে ইংরেজি বর্ণানুক্রমে সেটি তালিকায় অনেক ওপরের দিকে উঠে আসবে, বিকল্প নাম প্রস্তাব করার ক্ষেত্রে সেই ভাবনাটিও কাজ করেছে। রাজ্যের অন্যতম বিরোধী দল বিজেপির যে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আছে, বিশিষ্ট নেতা ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় অবশ্য ইতিমধ্যেই এই নাম বদলের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে তিনি এটাও বলেছেন, ‘বঙ্গ নামটা কেমন যেন বাদ্যযন্ত্রের মতো শোনায়, তার চেয়ে বাংলা হলেই অনেক ভাল হয়।’
ভারতের একটি রাজ্যের কি নাম হবে বা হবে না এটা একান্তই তার নিজস্ব ব্যাপার। এ নিয়ে কোন কথা বলার প্রয়োজনীয়তা নেই বা থাকতে পারে না। এটি নীতির কথা। আলোচ্য ক্ষেত্রে নাম পরিবর্তনের যে বিষয়টি এসেছে তাকে নিছক নাম পরিবর্তনের ফ্রেমে দেখা বোধহয় সংগত নয়। পশ্চিমবঙ্গ এমনিতে যেভাবে দীর্ঘদিন থেকে রয়েছে তাতে কোন সমস্যা হবার কথা নয়। ভারতের নেতৃবৃন্দই এ রাজ্যটির নাম পশ্চিমবঙ্গ ঠিক করে নিয়েছিলেন। বাংলাতো অবিভক্তই ছিল। বাংলা নিয়ে পেছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে, সুবে বাংলা। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা। অর্থাৎ ভারতবর্ষ যখন মুগলদের শাসনে ছিল তখন ঢাকা ছিল বাংলার রাজধানী। এরপর বাংলার রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদ। মুর্শিদ কুলিখাঁ দিল্লীর স¤্রাটকে জানিয়ে দিওয়ানী বিভাগ মখসুদাবাদে সরিয়ে নেন। বহু বছর পরে মুর্শিদ কুলিখাঁর নামানুসারে এই নগরির নাম হয় মুর্শিদাবাদ। মুর্শিদাবাদ বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজধানী থাকাকালেই এ দেশিয় বিশ্বাসঘাতকদের কারণে বাংলার স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়েছিল। সেটাই ছিল স্বাধীন বাংলার মস্ত ট্রাজেডি। বিশ্বাসঘাতকতার মধ্যদিয়ে যে ইংরেজ শাসন প্রথমে বাংলায় ও পরে সারা ভারতে স্থান করে নেয় তার ¯্রষ্টা কোলকাতাকেন্দ্রিক কায়েমী স্বার্থবাদীরা। কোলকাতায় ‘বাবুদের’ উত্থান হয় দখলদার ইংরেজদের আনুকূল্যে ও পৃষ্ঠপোষকতায়। সেটাই শেষ কথা নয়, বৃটিশরা তাদের প্রশাসনিক সুবিধার জন্য পূর্ববঙ্গ ও আসামকে নিয়ে যে প্রদেশ গঠন করেছিল তার রাজধানী করা হয়েছিল ঢাকাকে। এই নতুন প্রদেশের কারণে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের কিছুটা সুবিধা হয়েছিল বিধায় সেটি মেনে নিতে পারেনি কোলকাতাকেন্দ্রিক দাদারা। বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ হয়েছে বলে তারা বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধিতা করে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় তখন ভারতের উঠতি সুবিধাভোগী হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণি, শিল্পপতি, উকিল, জমিদার, সাংবাদিক, রাজনীতিকসহ প্রায় সবাই বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা শুরু করে। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ভারতে বিশেষ করে বাংলায় হিন্দু-মুসলিম রাজনৈতিক বিভাজন পরিষ্কার হয়ে ওঠে। বঙ্গভঙ্গ রোধে সন্ত্রাসের পথ বেছে নেয় একটি ্উগ্রবাদী গোষ্ঠী। এটাই ছিল ভারতবর্ষে প্রথম রাজনৈতিক সন্ত্রাস। বঙ্গভঙ্গ রহিত করতে ১৯০৬ সাল থেকেই অনুশীলন সমিতি সন্ত্রাসবাদী ভূমিকায় নেমে পড়ে। হিন্দু মাসলম্যান তৈরির জন্য সম্ভবত ১৯০৪ সালের দিকে বালিগঞ্জে লাঠি, ছোড়া, তলোয়ার পরিচালনা শিক্ষা দেয়ার জন্য একটি সমিতি খোলা হয়েছিল। । হিন্দু ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠাই ছিল অনুশীলন সমিতির উদ্দেশ্য। গুপ্ত এ সংগঠনের মুখপত্র ছিল যুগান্তর। কলিকাতায় অনুশীলন সমিতির সদর দপ্তর ছিল। ঢাকায় পুলিন দাসের অধীনে একটি সদর অফিস ছিল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ঢাকা, খুলনা, ময়মনসিংহ, বরিশাল, মাদারিপুর, চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর, রাজশাহীতে আলোচ্য সন্ত্রাসীরা খুবই তৎপর ছিল। এই সন্ত্রাসীদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে ইংরেজরা বঙ্গভঙ্গ রদ করেছিল। মূলত বঙ্গভঙ্গের মধ্যদিয়ে যেটুকু সুবিধা এ অঞ্চলের মুসলমানদের পাওয়ার অবস্থা তৈরি হয়ে সেটি বন্ধ করতেই ঢাকা কেন্দ্র্রিক প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রুখে দেয়া হয়। ইতিহাস বলছে, ১৯০৫ সালে বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ ঠেকাতে দেবতার সামনে যেসব হিন্দু নেতা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তাদের উত্তরাধিকাররাই ভারত বিভাগের আঁচ করতে পেরে বঙ্গভঙ্গের দাবি করেন । ভারতীয় হিন্দু মহাসভা নেতা ডা. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭ সালে এক বিবৃতিতে বঙ্গভঙ্গ দাবি করেন এবং তদানুযায়ি এ সালের ৫ এপ্রিল তারেকশ্বরে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলোকে নিয়ে হিন্দুবঙ্গ প্রদেশ গঠনের দাবি উত্থাপন করেন। এই দাবির ভিত্তিতেই নিখিল ভারত কংগ্রেস সভাপতি আচার্য কৃপালিনী ‘৪৭ সালের মার্চ মাসে বঙ্গভঙ্গ দাবির সমর্থনে প্রকাশ্য বিবৃতি দান করেন। এই আলোচনা এ জন্য যে, আজকে যে পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে সেটি মূলত কোলকাতাকেন্দ্রিকতারই ফসল। এর পিছনে যে ইতিহাস রয়েছে সেকথা সেখানকার ঐতিহাসিকরা স্বীকার করলেও দেশবিভাগের করুণ ইতিহাসের যে প্রসঙ্গ তোলা হয়েছে সেটি সত্যিই বর্তমান প্রেক্ষাপটে গভীর বিশ্লেষণের দাবি রাখে। সেদিকে যাবার আগে আমাদের নিজেদের কথাও একটু বলা দরকার।
কোলকাতাকেন্দ্রিকতার কারণে বাংলা বিভক্ত হলেও বাংলাদেশ নামে আমরা যে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি, এ অঞ্চলের যেকোন দেশের চেয়েই এর অবস্থান খানিকটা ভিন্ন। ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি সবকিছুর বিবেচনাতেই এর স্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান। ধারণা করা হয়, পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মতোই বাংলাদেশে আদিম সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল। বৈদিক ধর্মাবলম্বী আক্রমণকারী আর্যগণ যখন পঞ্চনদে বসতি স্থাপন করে তখন এবং তার বহুদিন পরেও বাংলার সাথে তাদের কোন সম্পর্ক ছিল না। বাংলাভাষা বিশ্লেষণ করে প-িতগণ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, আর্য আক্রমণকারীদের এদেশে আসার পূর্বে বিভিন্ন জাতি এদেশে বসবাস করতো। নৃতাত্ত্বিকগণও বর্তমান বাংলার অধিবাসীদের দৈহিক গঠন পরীক্ষা করে এ সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছেন। মনে করা হয়, বর্ণাশ্রয়ী ধর্মের প্রতিভূ প্রচ- জাতবিদ্বেষী আর্যদের ব্যাপারে বাংলাদেশি জনগণের প্রবল আপোষহীনতা এবং আরবের সেমিটিক জনগোষ্ঠী ও তাদের একাত্মবাদী ধর্মের সাথে যেন সহজাত একাত্মতা ছিল এ অঞ্চলের মানুষের। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বর্ণাশ্রয়ী আর্যদের জুলুম, নিপীড়নে জর্জরিত বাংলার মানুষ মুক্তি পেতে ও মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতেই ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছিল। ইতিহাসের নানা চড়াই-উৎরাই পার হয়ে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে মগধে ব্রাহ্মণ্যবাদী গুপ্ত সা¤্রাজ্যের উদ্ভবের মধ্যদিয়ে উত্তর ভারতে ব্রাহ্মণ্যবাদ দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছিল। সরাসরি গুপ্ত শাসনাধীন আজকের পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ব্যাপক পরিহার ভূমিদান পদ্ধতির মাধ্যমে চিরস্থায়ি সার্বভৌমত্ব দিয়ে ব্রাহ্মণ বসতি স্থাপন করা হয়। আজকের বাংলাদেশ অনেকটাই ব্রাহ্মণমুক্ত থেকে যায়। সাত শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রাহ্মণ ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে স¤্রাট হর্ষবর্ধনের মৃত্যু ও তার মন্ত্রী অর্জুনের ক্ষমতা দখলের পর সারা উত্তর ভারতে ব্যাপকহারে বৌদ্ধ নিধন করা হয়। ফলে সেখানে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বৌদ্ধরা রীতিমত নগণ্য হয়ে পড়ে। কয়েকশ’ বছরের বর্ণবাদী নির্যাতনের মূলে ছিল বৌদ্ধ সমাজকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়া। বৌদ্ধদের আর্থিক মেরুদ- ভেঙে দেয়া। তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য মুছে ফেলা। সময় নিয়ে মত পার্থক্য থাকলেও বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন চর্যা গীতিকার পান্ডুলিপি যে নেপালের রাজ দরবারে পাওয়া গিয়েছে এনিয়ে কোন মতপার্থক্য নেই। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের রচিত এই নিদর্শন নেপালে পাওয়ার মধ্যদিয়েই প্রমাণিত হয় , সে সময়ে দেশে নির্যাতনের মাত্রা কতটা তীব্র হলে অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে ভিক্ষুরা নেপাল গিয়েছিল বা যেতে বাধ্য হয়েছিল। এ অঞ্চলের এই সংকটের অবসান হয়েছিল মূলত সুফী-সাধকদের আগমনে। আরবীয় বনিকদের এ অঞ্চলে ব্যবসা করতে আসার মধ্যদিয়ে যে যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছিল সেটিই মূলত এ অঞ্চলের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে বড় ধরনের প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং আলাদা মাত্রা দিয়েছিলে। এই বিভাজনেরই সুনির্দিষ্ট ফলাফল মূলত পাকিস্তানের সাথে সংযুক্তি এবং পরে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। যে মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সমর্থনের কথা এত জোরেশোরে বলা হচ্ছে, সেই গৌরবৌজ্জ্বল ঐতিহাসিক ঘটনাকে ভারতীয়রা বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের দাদারা কীভাবে দেখেছেন তার বিবরণ তারা তাদের সে সময়ের লেখনীতেই তুলে ধরেছেন। ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবসকে যুগান্তর বলে ‘নিয়াজির নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ : বৃহস্পতিবার ঢাকায় দলিল স্বাক্ষর’। সেদিনের আনন্দবাজারের শিরোনাম ছিল, ‘পাকিস্তান নত’। শুধু এই একটি বা দুটি শিরোনাম নয় বাস্তবত গোটা নয় মাস ধরেই ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেসব রিপোর্ট, প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের ও ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক পার্থক্য বিদ্যমান। মূলত তারা পাকিস্তানের পরাজয়কেই বড় করে দেখার চেষ্টা করেছে। আমরা স্বাধীনতার বিষয়টিকে বড় করে দেখার চেষ্টা করেছি। এই দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যের আজো অবসান হয়েছে। বোধকরি সেকথা জোর দিয়ে বলা।
রাজনৈতিক বৈরিতা সত্ত্বেও রাজ্যের নাম পরিবর্তনে বিজেপি এবং তৃণমূলের একমত হওয়ার বিষয়টি লক্ষণীয়। শুরু থেকেই ওয়েস্ট বা প দিয়েই তো পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কাজ চালিয়ে আসছেন। আজ হঠাৎ করে কেন মনে হলো বা হতে শুরু হলো এর ফলে তিনি অচ্ছুত হয়ে গেছেন। তাকে সময় কম দেয়া হচ্ছে। দিল্লী যদি তাকে বঞ্চিত করতে না চায় তাহলে তার জন্য আরো দুমিনিট সময় নির্ধারণ করা কোন ব্যাপার বলে মনে হবার নয়। আজ সময় পাননি তো আগামীকাল পাবেন। এটা নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের জন্য কোন কার্যকর যুক্তি হতে পারে না। বাংলা আমাদের। রক্ত দিয়ে আমরা বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা করেছি। মহান শহীদ দিবসকে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। বাংলা নামের দেশ প্রতিষ্ঠা করেছি আমরা। বিশ্বের দরবারে যে বাংলার পরিচিতি রয়েছে তার নির্মাতা প্রতিষ্ঠাতা, রূপায়নকারী আমরা এবং আমাদের পূর্বপুরুষগণ। মহান আত্মত্যাগের পথ ধরে বাংলা আজ বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত। সেই বাংলা নিয়ে টানাটানি কেন? ব্যাপারটি এমন সময়ে ঘটতে যাচ্ছে যখন দেশের কোন কোন মহল ভারতীয় অনুগ্রহের ওপর নির্ভর করছে। মাত্র সেদিন আসামের পার্লামেন্টে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার আহ্বান জানানো হয়েছে। ভারতীয় বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের আকাশ সংস্কৃতিতে ছেয়ে আছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আকাশ। পানির ন্যায্য হিস্যা না পেলেও ভারত তার সব সুবিধা নিয়ে নিচ্ছে অকাতরে। ২০১৪ সালের অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আর্কিটেক্ট হিসেবে ভারতীয় ভূমিকা এবং অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যে ডামাডোল চলছে তার প্রকৃত সুবিধা গ্রহণ করছে ভারত। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, অনুরূপ বা তার চেয়েও খারাপ আরো একটি নির্বাচন করার প্রক্রিয়া চলছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন অনেকটাই ভারতনির্ভর হয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোন না কোনভাবে ভারতীয় প্রভাব রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ তো অনেকটাই প্রত্যক্ষ করার মত। এই বাস্তবতায় পশ্চিমবঙ্গের নাম পরির্তন করে বাংলা রাখার বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই বরং একে ভারতীয়দের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির অংশ হিসেবে দেখার যথেষ্ট কারন রয়েছে। যারা মনে করছেন, দেখি কী হয়, তাদের বোধহয় একটু ভাল করে চোখ পরিষ্কার করে দেখার চেষ্টা করা ভাল।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।