বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
মানুষের দুনিয়ার জীবন সীমিত ও ক্ষণস্থায়ী। এই জীবনে মানুষ চায় সকল দিক হতে আড়ম্বরপূর্ণ ও জৌলুশ সহকারে জীবন পথ অতিক্রম করতে এবং সুখ-সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের ছায়ায় বিশ্রাম গ্রহণ করতে। এটা মানুষের প্রিয়তম চাহিদা হলেও সে উপলব্ধি করে না যে, এত সাধের দুনিয়া তাকে আল্লাহবিমুখ হওয়ার দিকেই ধাবিত করছে। আসল সফলতা ও কৃতকার্যতার কথা বিস্মৃত করে দিচ্ছে। তাই মহান রাব্বুল আলামীন নশ্বর পৃথিবীর জীবনের স্বরূপ উদঘাটন করে মানুষকে বার বার সতর্ক করেছেন।
এতদ প্রসঙ্গে আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : (ক) ‘হে মানবমন্ডলী! নিশ্চয়ই আল্লাহর অঙ্গীকার সত্য; সুতরাং দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদের কিছুতেই প্রতারিত করতে না পারে; আর বড় প্রতারক। (শয়তান) যেন তোমাদের প্রতারণার সুযোগ না পায়।’ (সূরা ফাতির : আয়াত ৫)।
(খ) ‘প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদের বিভ্রান্ত করে রেখেছে, যতক্ষণ না তোমরা কবরের সাক্ষাৎ করবে। কখনো নয়, শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে; কখনো নয়, অতিসত্বর তোমরা অবহিত হবে; কখনো নয়, তোমরা যদি নিশ্চিত জ্ঞানে জানতে।’ (সূরা তাকাছুর : আয়াত ১-৫)। (গ) ‘ আর এ দুনিয়ার জীবন খেল-তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয় এবং নিশ্চয়ই আখেরাতের নিবাসই হলো প্রকৃত জীবন, যদি তারা জানত’। (সূরা আনকাবুত : আয়াত ৬৪)।
উল্লিখিত আয়াতে কারীমায় দুনিয়ার জীবনের যে স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে তা নিম্নরূপ। যথা- (ক) দুনিয়ার জীবন এক দক্ষ প্রতারক। এই প্রতারকের সাথে সহযোগী হয়ে বড় প্রতারক শয়তান সুকৌশলে প্রতারণার জাল বিস্তৃত করে। (খ) প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা মানুষকে মোহাচ্ছন্ন করে তোলে এবং এমন এক পর্যায়ে উপনীত করে যখন তার কোনো হিতাহিত জ্ঞান থাকে না।
(গ) দুনিয়ার জীবন খেল-তামাশার আড্ডাখানা। এই খেল-তামাশায় মোহাচ্ছন্ন হয়ে মানুষ তার আসল পরিচয় ভুলে যায়। এজন্য পিয়ারা নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) দুনিয়ার হাকিকত অত্যন্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন : (ক) ‘দুনিয়াটা একটা শ্যামল সবুজ পরিপুষ্ট বস্তু। আল্লাহপাক এখানে তোমাদের প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়েছেন এবং তোমাদের কর্মকান্ড প্রত্যক্ষ করছেন।
সুতরাং তোমরা এ দুনিয়ার লোভ-লালসা থেকে আত্মরক্ষা করো এবং মহিলাদের ফিতনা সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন করো। কেননা, বনী ইসরাইলদের মধ্যে প্রথম ফিতনা স্ত্রীলোকদের থেকেই শুরু হয়েছে।’ (সহীহ মুসলিম : ৮/৪৯২৫ : বর্ণনায় হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.); অধ্যায় আকছারুআহলিল জান্নাতি আল ফুকারাউ)।
(খ) রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন দোজখবাসীদের মধ্যে হতে সর্বাধিক প্রাচুর্য প্রাপ্ত ব্যক্তিকে হাজির করা হবে এবং খুব জোরে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তারপর তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, হে আদম সন্তান! তুমি কি কখনো কোনো খায়ের বা কল্যাণ দেখেছ, তুমি কি কখনো প্রাচুর্যে কাল যাপন করেছ? সে বলবে না, আল্লাহর শপথ! হে আমার প্রতিপালক!
আবার জান্নাতীদের মধ্য হতেও এক ব্যক্তিকে হাজির করা হবে, যে পৃথিবীতে সবচাইতে বেশি দুর্দশা ও অভাবগ্রস্ত ছিল। তারপর তাকে অতি দ্রুত জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। তারপর জিজ্ঞেস করা হবে, তুমি কি কখনো কোনো অভাব দেখেছ? তুমি কি কখনো দুর্দশা ও অভাব-অনটনের মধ্যে দিন অতিবাহিত করেছ? সে বলবে, না, আল্লাহর শপথ! আমি কখনো অভাব-অনটন দেখিনি এবং আমার ওপর দিয়ে তেমন কোনো দুর্দশাও অতিবাহিত হয়নি।’ সহীহ মুসলিম : ৪/২৮০৭; বর্ণনায়-হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা.); অধ্যায়-সাবগু আনয়ামি আহলিদ দুনইয়া ফিন্নারি)।
অপর এক হাদিসে এসেছে : (গ) ‘এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে হাজির হয়ে আরজ করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে এমন কোনো আমল বলে দিন, যা করলে আমাকে আল্লাহ ভালোবাসবেন এবং মানুষও ভালোবাসবে। উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন : ‘তুমি দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত হও, তাহলে আল্লাহপাক তোমাকে ভালোবাসবেন। আর মানুষের হাতে যা রয়েছে, তার প্রতিও অনাসক্ত হও, তাহলে মানুষও তোমাকে ভালোবাসবে।’ (সুনানে ইবনে মাযাহ : ২/৪১০২; বর্ণনায়-হযরত সাহল ইবনে সাদ সায়েদী (রা.); অধ্যায় যুহদুফিদ দুনইয়া)।
হাদিস শরীফে আরও এসেছে : (ঘ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমার কাঁধ ধরে বললেন : ‘দুনিয়াতে তুমি এমনভাবে অবস্থান করো, যেন মনে হয় তুমি একজন মুসাফির কিংবা পথচারী।’ (সহীহ বুখারী : ৮/৬৪৯৬; বর্ণনায় : হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.); অধ্যায়- কুনফিদ দুনইয়া কাআন্নাকা গারিবুন আও আবিরি সাবিলীন)। সুতরাং অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়া ও দুনিয়ার প্রতারণার ফাঁদে আটকা না পড়াই হোক আমাদের জীবন চলার পথের একমাত্র পাথেয়, আমীন!
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।