Inqilab Logo

সোমবার, ০৮ জুলাই ২০২৪, ২৪ আষাঢ় ১৪৩১, ০১ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

বিশাল জনগোষ্ঠীর রোষানলে সরকার : আসছে কঠোর কর্মসূচি

প্রকাশের সময় : ৬ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আবু হেনা মুক্তি, খুলনা থেকে : সুন্দরবনের রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ চুক্তি বাতিলের দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখী কর্মসূচি বানচালের পর বিদ্যুৎকেন্দ্রবিরোধী সংগঠনের শীর্ষ নেতারা এবার প্রেসিডেন্টের শরণাপন্ন হতে পারে। গতকাল তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে এমনই আভাস পাওয়া গেছে। একই সাথে নেয়া হতে পারে কঠোর কর্মসূচি। এমনকি লাগাতার কর্মসূচিও আসতে পারে খুব শিগগিরই।
সূত্রমতে, প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিতব্য ব্যাপক আলোচিত রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণচুক্তি বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছে তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটিসহ বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন। এ নিয়ে অবরোধ, হরতাল, মানববন্ধন, লং মার্চ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও প্রভৃতি কর্মকাÐ অব্যাহত থাকলেও সরকার তাদের রোডম্যাপে অনড় রয়েছে। ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এই কেন্দ্রটিতে ২০১৯ সালে উৎপাদন শুরুর সম্ভাবনা প্রবল। বিশ্ব ঐতিহ্য ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট সুন্দরবন ও পরিবেশকে বিপন্ন করে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন এখন আমজনতার গলার কাঁটা। আর সরকারের কাছেও যেন বিষফোঁড়া। বিশিষ্টজনেরা বলছেন, সরকার প্রকল্পটি যেমন বন্ধ করতে পারছে না তেমনি বাস্তবায়ন করতে হলে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর রোষানলে পড়তে হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবন থেকে সরকারি হিসাবে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে লক্ষ লক্ষ টন কয়লা পোড়ানো হবে তা থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া, ছাই, রাসায়নিক পদার্থ ইত্যাদি আশপাশের বায়ু, পানি, মাটিকে দূষিত করবে। এই দূষণ পানি ও বাতাসের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোপ বনাঞ্চল সুন্দরবনকে বিপন্ন করবে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল পরিমাণ কয়লা বহনকারী জাহাজ আসা-যাওয়া করবে বনের ভিতর দিয়ে। বহুল সমালোচিত এই প্রকল্প নিয়ে ইতিমধ্যে শুধু দেশে নয়, ইউনেস্কো-রামসারসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাও প্রশ্ন তুলেছে।
আবার এই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বিদ্যুৎ খাতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সহযোগিতার স্মারক। কেন্দ্রটি স্থাপনের জন্য বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ও ভারতের সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কোম্পানির (এনটিপিসি) যৌথ উদ্যোগে গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল)। বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎসচিব এই কোম্পানির চেয়ারম্যান। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনটিপিসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
সূত্র মতে ২০১০সালের ডিসেম্বর থেকেই রামপালে ১৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ এবং মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়। সব বিরোধিতা উপেক্ষা করে ২০১৩ সালের ৫ আগস্ট রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিবেশগত ছাড়পত্র দিয়েছে পরিবেশ অধিদফতর। গত ৫ অক্টোবর ’১৩ প্রকল্প থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় কেন্দ্রটি উম্বোধন করা হয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র-প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য ঠিকাদার নির্বাচিত হয়েছে ভারত হেভি ইলেকট্রিক লিমিটেড (ভেল)।
এদিকে বামমোর্চার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, শুরু থেকে সরকার ও তাদের পক্ষের কিছু বিশেষজ্ঞ প্রচার চালাচ্ছে যে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি করবে না। কয়লার কারণে পরিবেশ দূষণ না হলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ভারত-চীনের পরিবেশ রক্ষা দফতরগুলো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণের কথা বলছে কোন যুক্তিতে? রামপালে কয়লা পুড়বে বছরে ৪৭ লাখ ২০ হাজার টন, প্রতিদিন ১৩ হাজার মেট্রিক টন। এতে ছাই হবে প্রতিদিন প্রায় ৬০০ মেট্রিক টন।
সূত্রমতে, ১৩২০ মেগাওয়াটের একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বছরে উাপাদিত বায়ু দূষণকারী উপাদানগুলো হলো-৭৯ লক্ষ টন কার্বন ডাই অক্সাইড যা প্রায় ৩৪ কোটি গাছ কেটে ফেলার সমান। ৫২ হাজার টন সালফার ডাই অক্সাইড। এই সালফার ডাই অক্সাইড এসিড রেইনের কারণ এবং অন্যান্য উপাদানের সাথে বাতাসে ক্ষুদ্র কণিকার পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে যার ফলে ফুসফুস ও হার্টের রোগসহ বিভিন্ন অসুখ-বিসুখ হয়। ৩১ হাজার নাইট্রোজেন অক্সাইড। এই নাইট্রোজেন অক্সাইড ফুসফুসের টিস্যুর ক্ষতি করে। ১৩০০ টন ক্ষুদ্র কণিকা যার ফলে ব্রংকাইটিস সহ ফুসফুসের বিভিন্ন রোগ বেড়ে যায়। ১৯০০ টন বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইড। ৪৪০ পাউন্ড মারকারি বা পারদ। ২৫ একর আয়তনের একটা পুকুরে এক চা চামচের ৭০ ভাগের একভাগ পারদ পড়লে সেই পুকুরের মাছ বিষাক্ত হয়ে খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে। পারদের কারনে ব্রেন ড্যামেজসহ স্নায়ুতন্ত্রের নানান রোগ হয়। ৫৯০ পাউন্ড বিষাক্ত আর্সেনিক যার ফলে আর্সেনিকোসিস এবং ক্যানসারের বিস্তার ঘটায়। ৩০০ পাউন্ড সীসা, ১০ পাউন্ড ক্যাডমিয়াম এবং পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অন্যান্য ভারী ধাতু। কয়লা পুড়িয়ে ছাই তৈরী হয় এবং কয়লা ধোয়ার পর পানির সাথে মিশে তৈরী হয় আরেকটি বর্জ্য। ছাই এবং এই তরল উভয় বর্জ্যই বিষাক্ত কারণ এতে বিষাক্ত আর্সেনিক, মার্কারি বা পারদ, ক্রোমিয়াম এমনকি তেজস্ক্রিয় ইউরোনিয়াম ও থোরিয়াম থাকে। কয়লা বিদ্যুৎকেন্দের কঠিন ও তরল বর্জ্য বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে, সংরক্ষণ আধার থেকে চুইয়ে নানানভাবে গ্রাউন্ড ও সারফেস ওয়াটারের সাথে মিশে পানি দূষণ ঘটায় যার ফলে পানির মাছ, জলজ উদ্ভিদ ইত্যাদি হুমকির মুখে পড়ে। কয়লা বিদ্যুৎকেন্দের টারবাইন, কমপ্রেসার, পামপ, কুলিং টাওয়ার, কনস্ট্রাকশনের যন্ত্রপাতি, পরিবহনের যানবাহনের মাধ্যমে ব্যাপক শব্দ দূষণ ঘটে থাকে। এই প্রকল্পে প্রতিদিন কয়লা ধোয়ার জন্য ২৫ হাজার কিউরিক মিটার স্বচ্ছ পানি ভূগর্ভস্থ স্তর থেকে উত্তোলন করতে হবে। ২৫ বছর এই প্রকল্পের আয়ুস্কাল ধরা হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এর পরিনতিতে সুন্দরবন অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে যাবে।
সূত্রমতে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের দামের বিপরীতে স্থানীয় উন্নয়নের জন্য তিন পয়সা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিআইএফপিসিএল। এতে বছরে প্রায় ২৭ কোটি টাকা হবে। এই টাকা স্থানীয় রাস্তাঘাট, হাসপাতাল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় করা হবে।

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিশাল জনগোষ্ঠীর রোষানলে সরকার : আসছে কঠোর কর্মসূচি
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ