Inqilab Logo

বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

ভারতে গরু নিয়ে রাজনীতি

প্রকাশের সময় : ৬ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুনশী আবদুল মাননান
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গরু গণনা শুরু করেছে আরএসএসের ভাবধারাপুষ্ট গো-রক্ষা সমিতি। এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। প্রশ্ন করেছেনঃ গরু গণনা ছাড়া কি কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো কাজ নেই? গত সোমবার সংখ্যালঘু কল্যাণ দফতরের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেনঃ বিজেপির মতলব শুধু প্ররোচনা দিয়ে দাঙ্গা বাধানো। সতর্ক বাণী উচ্চারণ করে তিনি আরো বলেনঃ বিজেপির কথায় কান দেবেন না। ওরা দাঙ্গা বাধাতে চাইছে। সারাক্ষণ টুইটার ফেসবুকে ধর্মের নামে সুড়সুড়ি। তার স্পষ্ট কথা ঃ আমরা প্রগতি চাই, দাঙ্গা চাই না। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ দাঙ্গা ক্ষমা করে না।
গরু, বলাই বাহুল্য, ভারতের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে উঠে এসেছে। মমতা ব্যানার্জির কথা থেকে বোঝা যায়, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে গুরু নিয়ে রাজনীতি জমিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। বিজেপি যেমন আরএসএসের ভাবধারাপুষ্ট রাজনৈতিক সংগঠন তেমনি গো-রক্ষা সমিতিও। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর গো-রক্ষা সমিতি নতুন করে গো-রক্ষা আন্দোলন জোরদার করেছে। গো-রক্ষা সমিতির আন্দোলনের মুখেই বিজেপি প্রভাবিত বা বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে গরু জবাই ও গরুর গোশত খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিজেপি যে এই আন্দোলনের পেছনে আছে এবং প্রবলভাবে সমর্থন করছে তা বিশদ তথ্য-প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। সরকারি দল ও সরকারের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েই গো-রক্ষা সমিতি আন্দোলন করে যাচ্ছে এবং ক্রমাগত তার সন্ত্রাসী চরিত্রের উন্মোচন ঘটাচ্ছে। শুরুতে গো-রক্ষা আন্দোলনের কর্মীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল মুসলমানরা, এখন তা অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায় এমনকি স্ব-ধর্মীয় দলিতদের ওপরও সম্প্রসারিত হয়ে পড়েছে।
অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, গত বছর উত্তর প্রদেশের দাদরিতে ফ্রিজে গরুর গোশত রাখার অভিযোগে এক মুসলিম পরিবারের ওপর হামলা চালানো হয় এবং পরিবার প্রধান আখলাক আহমেদকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। সেই থেকে এ পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গরুকেন্দ্রিক ঘটনায় কত মুসলমান যে অপমানিত ও নির্যাতিত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। অতি সম্প্রতি মধ্য প্রদেশের এক রেলস্টেশনে দুই মুসলিম নারীকে পুলিশের সামনেই গরুর গোশত রাখার অভিযোগে ব্যাপক মারধর করা হয়। পরে তাদের কাছে গরু নয়, মহিষের গোশত পাওয়া যায়। গরু মুসলমানদের হালাল খাদ্য। খ্রিস্টান ও অন্য ধর্মাবলম্বীদেরও প্রিয় খাদ্য। এমনকি হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে বিশেষত দলিতরা গরুর গোশত পছন্দ করে এবং কখনো কখনো খেয়ে থাকে। কিন্তু গো-রক্ষা সমিতির এক কথা : গো হত্যা করা যাবে না। গুরুর গোশত খাওয়া যাবে না। এ দাবিতে গো-রক্ষা সমিতির কর্মীরা গোটা ভারত বিশেষ করে মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট প্রভৃতি রাজ্যে হামলা, অত্যাচার ও নির্যাতনের তা-ব সৃষ্টি করেছে। ধর্মীয় বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা এর ফল উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
গরু জবাই ও গরুর গোশত খাওয়া নিষিদ্ধই কেবল নয়, ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, বাংলাদেশে ভারত গরু রফতানিও বন্ধ করে দিয়েছে। সরকারের তরফে সীমান্তে কড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেন একটি গরুও বাংলাদেশে পাচার হয়ে যেতে না পারে। গরু নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গেও ভারত মস্ত বড় রাজনীতির খেলা খেলেছে। বাংলাদেশ ভারতের গরুর ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল ছিল। বাংলাদেশে গরু রফতানি করে ভারত প্রতিবছর বিপুল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করত। এই আয়-বঞ্চনা স্বীকার করেই সে গরু রফতানি বন্ধ করে দেয়। এই সিদ্ধান্ত যে ঠিক হয়নি, আত্মঘাতী হয়েছে ভারতীয় মিডিয়াতে সে কথা ফলাও করে প্রকাশ করা হয়। আসলে বাংলাদেশে গরুর গোশত খাওয়া বন্ধ করার মতলব থেকেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে অনেকে মনে করেন। সে মতলব অবশ্য সিদ্ধ হয়নি। বাংলাদেশে গরুর গোশত খাওয়া বন্ধ হয়নি। সাময়িকভাবে কিছুটা অসুবিধা হয়েছে এবং গোশতের দাম বেড়েছে বটে; তবে এ সিদ্ধান্ত বড় কোনো বিপাকে ফেলতে পারেনি বাংলাদেশকে। ইতোমধ্যে পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হয়েছে। গরুর কোনো অভাব বা ঘাটতি দেখা দেয়নি। এই সুবাদে বরং লাভই হয়েছে। গরু পালন ও গরুর খামার বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতীয় গরু এখন না হলেও চলবে। এতে ভারতের যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নেয়ার উপায় নেই তার। গরু নিয়ে রাজনীতিটা এখানে বড় দাগে মার খেয়েছে।
খোদ ভারতেও গরু-রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের এবং তাদের মতাদর্শগত মিত্রদের সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। দিন দিন পরিস্থিতি ভিন্ন দিকেই মোড় নিচ্ছে। গরু আর গরুর গোশত নিয়ে গো-রক্ষা সমিতি যেভাবে তুলকালাম করছে, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে তাতে ভারতীয় সমাজের অভ্যন্তর থেকেই প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। গো-রক্ষা সমিতির কর্মীদের হাত মুসলমানদের ওপর তো বটেই, একই সঙ্গে খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকদের ওপর উঠছে। দলিতরা পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না। লক্ষ্যণীয়, অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে ফুঁসে উঠেছে, রুখে দাঁড়িয়েছে দলিতরা। এটা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রাজ্য থেকে শুরু হয়েছে। গত ১১ জুলাই মরা গরুর চামড়া ছড়ানোর অপরাধে দলিত সম্প্রদায়ের কয়েকজনকে নগ্ন করে গাড়ির সঙ্গে বেঁধে মারধর করে গো-রক্ষা সমিতির কর্মীরা। এতে সমগ্র ভারতের দলিত সম্প্রদায় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা মরা গরু সৎকারের কাজ বন্ধ ঘোষণা করে। মিডিয়া ও বিদ্বৎসমাজে এর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হয়। সংসদেও ঝড় ওঠে। উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের উদ্দেশ্যে দলিতদের পক্ষ থেকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়ঃ গরু তোমাদের মা। রাস্তাঘাটে ও গোয়ালে মরে থাকা গরু তোমরা সরাও। দলিতদের এই সিদ্ধান্ত ও অবস্থানের কারণে গুজরাটের বাড়িঘরে শত শত গরু মরে পড়ে থাকে। মরা গরুতে পচন ধরায় সবত্র দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। পরিবেশে নেমে আসে মারাত্মক বিপর্যয়। মরা গরু সরানোর জন্য স্থানীয় প্রশাসন গরুপ্রতি এক হাজার টাকা দিতে চাইলেও দলিতরা সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং একটি প্রতিনিধিদল পাঠান দলিত সৎকার সমিতির কাছে। মরা গরুর সৎকার করার জন্য রীতিমতো হাতেপায়ে ধরে ওই প্রতিনিধিদল। তাতেও কাজ হয়নি। দলিতদের কথাঃ মিথ্যা অভিযোগে অত্যাচার করা হয়েছে। যতক্ষণ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হচ্ছে ততক্ষণ তারা মরা গরু সরাবে না।
এই সুযোগে দলিতরা সমঅধিকারের পুরনো দাবিও সামনে এনেছে। দলিতরা সুদীর্ঘকাল ধরে সমঅধিকারের দাবি জানিয়ে আসছে। বর্ণবাদী সমাজ সে অধিকার তাদের দেয়নি। তারা বর্ণ হিন্দুদের কাছে অচ্ছুত, অপাঙ্তেয়, নিগৃহীত। নাগরিক অধিকারের প্রশ্নেও তারা চরম বৈষম্যের শিকার। তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে গণ্য। অত্যাচার-নির্যাতনের প্রতিবাদে সৃষ্ট আন্দোলনে সমঅধিকারের বিষয়টি যোগ হওয়ায় এবার দলিতদের আন্দোলন ভিন্ন মাত্রায় উন্নীত হয়েছে। তারা বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।
দলিত সম্প্রদায়ের ওপর বর্ণহিন্দুদের জুলুম-নির্যাতন অশেষ। শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্য তাদের ললাট লিখনে পরিণত হয়েছে। গরু নিয়ে রাজনীতিরও তারা শিকার। তারা বংশ পরম্পরা মরা গরু সৎকার করে থাকে এবং মরা গরুর চামড়া ছাড়িয়ে তা চামড়া শিল্পে সরবরাহ করে থাকে। এখন তাদের এই ব্যবসারও যায় যায় অবস্থা। অন্যদিকে চামড়া শিল্পও পড়েছে অস্তিত্ব সংকটে। সাম্প্রতিককালে দলিতদের ওপর নির্যাতনের বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। তামিলনাড়– রাজ্যে দলিতদের মন্দিরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি তারা অচ্ছুত বলে। এ ঘটনার জেরে ২৫০টি দলিত পরিবার ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে এবং কয়েকটি পরিবার ইতোমধ্যে ইসলামে দিক্ষিত হয়েছে। এর আগে উত্তর প্রদেশের বামহেটা গ্রামে দলিত সম্প্রদায়ের এক স্কুলছাত্রীর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়। পরে এই ছাত্রী গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করে। এ নিয়ে ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দেয় এবং তখন এই গ্রামের এক হাজার দলিত সম্প্রদায়ের লোক ইসলাম গ্রহণের হুঁশিয়ারি প্রদান করে। দলিত সম্প্রদায়ের নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন ভারতে অতি সাধারণ ঘটনা। জানা যায়, প্রতিদিন সেখানে গড়ে একজন দলিত নারী ধর্ষণের শিকার হয়। রাষ্ট্র দলিতদের উন্নয়ন ও সুরক্ষায় কিছু করে না। তাদের ওপর পরিচালিত অন্যায়-অত্যাচার-নির্যাতনের কোনো বিচার করে না। কারণ, রাষ্ট্র পরিচালিত হয় বর্ণ হিন্দুদের দ্বারা। বর্ণ হিন্দুরা দলিত সম্প্রদায়ের লোকদের কী চোখে দেখে, কতটা অপবিত্র ও অস্পৃশ্য মনে করে গত মাসে বিহারের একটি ঘটনায় তার সম্যক পরিচয় পাওয়া যায়। দিল্লির নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সভাপতি কানাইয়া কুমারকে জানে না এমন লোক ভারতে নেই। তাকে নিয়ে অনেক কা- হয়েছে। সে সুবাদে বিশ্বেও তার একটি পরিচিতি রয়েছে। গত মাসে কানাইয়া কুমার বিহারের বেগুসরাইয়ে এক অনুষ্ঠানে যান। এ উপলক্ষে তিনি যেসব স্থানে যান সেসব স্থান বিজেপির ছাত্র শাখা এবিভিপির কর্মীরা গঙ্গার পানি ছিটিয়ে পরিশুদ্ধ করে। সেখানকার শহরে তিনি যে তিন মহান ব্যক্তির মূর্তিতে মালা পরান সেখানে গঙ্গার পানি দিয়ে শুদ্ধ করা হয়। দাবি করা হয়, কানাইয়া কুমারের আগমনে বেগুসরাইয়ের মাটি অপবিত্র হয়ে গেছে। মানুষের প্রতি মানুষ যে এরকম বিদ্বেষ ও অবজ্ঞা প্রদর্শন করতে পারে, তার নজির ভারত ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। দলিত সম্প্রদায়ের লোকেরা যুগ যুগ ধরে এহেন বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়ে আসছে। কোনো প্রতিকার ও প্রতিবিধান তাদের জন্য নেই। বিভিন্ন সময় দলিত সম্প্রদায়ের লোকেরা এই ভাগ্য বিড়ম্বনা থেকে রক্ষা পেতে ভিন্ন ধর্ম গ্রহণে বাধ্য হয়েছে। ভারতের সংবিধানের প্রণেতা হিসেবে খ্যাত বিআর আমেদকার দলিত সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন। তিনিও তার সম্প্রদায়ের জন্য কিছু করে যেতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত তিনি ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছিলেন। শোনা যায়, তিনি মুসলমান হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গান্ধীজির অনুরোধে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। এ যাবৎ দলিত সম্প্রদায়ের বহু লোক মুসলমান ও খ্রিস্টান হয়ে গেছে। তারপরও দলিতদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন, জুলুম, পীড়ন ও বৈষম্যের অবসান ঘটেনি। তবে ধীরে ধীরে দলিতদের মধ্যে আত্ম-সচেতনতা ও অধিকার-চেতনা বাড়ছে। দলিতদের সাম্প্রতিক বিক্ষোভ ও আন্দোলন তার পরিচয় বহন করে।
গো-রক্ষা সমিতি কিংবা সংঘবদ্ধ গো-রক্ষা আন্দোলন ব্রিটিশ আমলেও ছিল। এর পেছন ধর্মীয় কারণ যাই থাক, সাম্প্রদায়িক কারণও ছিল। মুসলমানরা হালাল খাদ্য হিসেবে গরুর গোশত খায়। কোরবানির পশু হিসেবেও গরুর কদর বরাবরের। সে সময় হিন্দু জমিদারদের অনেকের এলাকায় গরু জবাই ও কোরবানি নিষিদ্ধ ছিল। গো-রক্ষা সমিতি গরু জবাই ও গরুর গোশত খাওয়া বন্ধের আন্দোলন করার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বহু জায়গায় দাঙ্গাহাঙ্গামার ঘটনা ঘটে। তবে ভারতে এখন যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তখন অবস্থা এতটা গুরুতর হতে পারেনি শাসকদের পৃষ্টপোষকতার অভাবে। হিন্দু ধর্মের ইতিহাস থেকে যতদূর জানা যায়, প্রাচীন ভারতে ষাড় দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেয়া হতো এবং তার গোশত খাওয়া হতো। তবে গাভী জবাইয়ের ক্ষেত্রে বিধি নিষেধ ছিল। বেদে গাভীকে দেবতা ও দেবের মাতা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। হিন্দু ধর্মে গরুকে খাদ্যের উৎস ও জীবনের প্রতিরূপ হিসাবে গণ্য করা হয়। গো-পূজার প্রচলনও কোথাও কোথাও লক্ষ্য করা যায়। সমাজ গবেষকদের অনেকে মনে করেন, কোনো এক সময় হয়তো মড়কে বা অন্য কোনো কারণে গরুর সংখ্যা হ্রাস পায়। এতে হালের বলদ ও গরুর দুধের সংকট দেখা যায়। এই প্রেক্ষাপটে গরু জবাই ও তার গোশত খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ বা কার্যকর করার জন্য ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করা হয়।
এখন ভারতে গরুর কোনো অভাব নেই। সমাজ বাস্তবতাও আর আগের জায়গায় নেই। তবে ধর্মের নির্দেশনাটি আছে। এই নির্দেশনাটি হিন্দুরা তাদের সমাজে মানতেই পারে। তাতে অন্য কারো আপত্তি তোলার কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু অন্য ধর্ম বা সমাজের অন্তর্গত লোকেরা তা মানতে যাবে কেন? তাদের ওপর জোর করে এই নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয়া হবে কেন? কেউ তা মানতে না চাইলে জোরজুলুম করা হবে কেন? ভারত যখন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র তখন রাষ্ট্রীয়ভাবেই বা নির্দেশনা প্রদান করা হবে কেন? এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই।
অনেকেই মনে করেন, এর পেছনে রাজনীতিই মুখ্য। বিজেপি হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাসী। হিন্দুত্ববাদের উদগাতা সংগঠন আরএসএস ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানাতে চায়। এ জন্য হিন্দু জনসমাজে হিন্দুত্ববাদের প্রসার ও প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। গো-রক্ষা সমিতি হিন্দুত্ববাদকে জোরদার করার জন্যই গো-রক্ষা আন্দোলনে নেমেছে। এর পেছনে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষও সক্রিয়। বিশিষ্ট বাম চিন্তক বদরুদ্দীন উমর তার এক নিবন্ধে লিখেছেন ঃ ‘ভারতে এসব সংস্কারের বাইরে অসংখ্য মানুষ আছেন। নিজেরা গরু না খেয়েও তারা অন্যের গরু খাওয়ার বিরোধী নয়। উপরন্তু অন্যদের এই অধীকারের জন্য অনেকে সংগ্রামও করেন। কিন্তু ভারতে চরম সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল বিজেপি সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে এখন ভারতে সব রকম ধর্মীয় কুসংস্কার শুধু জিইয়ে রাখা নয় আরো বিস্তৃত ও শক্তিশালী করার নীতিই কার্যকর করছে। মুসলমান, খ্রিস্টান, নিম্নবর্ণের হিন্দুদের গো-মাংস খাওয়ার বিরুদ্ধে ধর্মের জিগির তোলা তাদের নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের হীন প্রচেষ্টারই অন্যতম দৃষ্টান্ত।
সাম্প্রতিক কালে গো-রক্ষা সমিতির তৎপরতা, হামলা, সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার পেছনেও রাজনীতিটাই রয়েছে মুখ্য ভূমিকায়। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাব বিধান সভা নির্বাচনকে সামনে রেখে গো-রক্ষা সমিতি বর্ণ হিন্দুদের ভোট হাতানোর অভিসন্ধি থেকেই এ রকম বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। অবশ্য এই অভিসন্ধি খুব কাজে আসবে বলে মনে করছেন না তারা। তারা বরং এমনটাই আন্দাজ করছেন যে, এটা হিতে বিপরীত হতে পারে। উত্তর প্রদেশে মুসলমান ও দলিতরা যদি একাট্টা হয়ে যায় এবং মায়াবতীকে সমর্থন করে তাহলে তার বিজয় সুনিশ্চিত। উত্তর প্রদেশে ভোটারদের ২০ শতাংশ দলিত। এই সঙ্গে মুসলমান ভোটার তো আছেই। একই কথা পাঞ্জাবের ক্ষেত্রেও। সেখানে ভোটারদের অন্তত ৩০ শতাংশ দলিত। তারা বিজেপির বিপক্ষে চলে গেলে দলটির বিজয় লাভের কোনো সম্ভাবনাই থাকবে না। এ নিয়ে বিজেপির মধ্যেও মতভিন্নতা ও দ্বিধা-বিভক্তি দেখা দিয়েছে। যখন দলিতদের বিক্ষোভের আগুন জ্বলছে ঠিক তখনই বিজেপির উত্তর-প্রদেশের সহসভাপতি বহুজন সমাজ পার্টি নেত্রী মায়াবতী সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য করায় দলে একটা বিব্রতকর অবস্থা দেখা দিয়েছে। তাকে অবশ্য দল থেকে বহিষ্কার এবং গ্রেফতার করা হয়েছে। তাতেও শংকা কাটেনি।
এখানে বিশেষভাবে বলা দরকার, ভারতের সংসদে যতজন দলিত সম্প্রদায়ের সদস্য রয়েছেন তাদের মধ্যে বিজেপির সদস্য সংখ্যাই অধিক। তারা গরুকে কেন্দ্র করে দলিতদের ওপর হামলা ও নির্যাতনে গো-রক্ষা সমিতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। একজন সংসদ সদস্য বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী উন্নয়ন ও সদ্ভাবের কথা যখন বলছেন, তখন গো-রক্ষা সমিতির কার্যকলাপ সেই বার্তাকেই বিলোপ করছে। আরেকজন সংসদ সদস্য গো-রক্ষা সমিতি নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন। আরেক সংসদ সদস্য বলেছেন, গো-রক্ষা সমিতি ভারতের নামেই বদনাম করছে। দলিত সংসদ সদস্যের কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের গো-রক্ষা সমিতির কঠোর ভাষায় নিন্দা করা উচিত বলে দাবি জানিয়েছেন। এখন পর্যন্ত অবশ্য তারা কেউ এ ব্যাপারে টুঁ শব্দটি করেননি।
বিজেপির রাজনৈতিক লাভের গুড়ে বালি পড়তে বসেছে। যদি এখনই গো-রক্ষা সমিতিকে থামানো না যায় তাহলে তার বড় খেসারত বিজেপিকেই দিতে হবে, এমনটাই মনে করছেন পর্যবেক্ষক ও বিজ্ঞজনেরা। ওদিকে গরু জবাই ও গরুর গোশত খাওয়া নিষিদ্ধ করার কারণে অর্থনৈতিকভাবে ভারত ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। গরু রফতানি-আয় বন্ধ হয়ে গেছে। চামড়া শিল্প বসে গেছে। এমনকি গরুর গোশত রফতানিও কমে গেছে। এও এক বিস্ময়কর বৈপরীত্য যে, বিভিন্ন রাজ্যে গরু জবাই ও গরুর গোশত খাওয়া নিষিদ্ধ করা হলেও ভারত গরুর গোশত রফতানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। তবে আগের তুলনায় রফতানি কমতে শুরু করেছে। কৃষক এবং গরুর খামারীরাও বড় রকমের বিপাকে পড়েছে। গরু বিক্রী কমে যাওয়ায় তারা বয়স্ক গরু নিয়ে বিপাকে পড়েছে। গরু পালনের খরচ বেড়ে গেছে আমৃত্যু গরু পালনের কারণে। আরও একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে। গরুর খাদ্য যোগানোর জন্য চাষের জমিতে হাত পড়েছে। এতে খাদ্য উৎপাদনের ওপর বিরূপ প্রভাবের আশংকা দেখা দিয়েছে। বলা যায়, গরু নিয়ে রাজনীতি বুমেরাং হয়ে দেখা দিয়েছে।



 

Show all comments
  • PhilipMof ২ ডিসেম্বর, ২০১৭, ৪:৪৫ এএম says : 0
    ome people, especially those running on busy daily schedules tend to use the pills to help maintain weight since they can not afford to follow all the diet programs. This is not advised. It is recommended that one seek advice from a professional in this field before using the pills. This can save one from many dangers associated with the misuse. The diet pills should always be taken whole. Some people tend to divide the pills to serve a longer period of time. This is not advised and can lead to ineffectiveness. If it is required that one takes a complete tablet, it means that a certain amount of the ingredients are required to achieve the desired goal. It is also recommended that one does not crush the pill and dissolve it in beverages. Chemicals found in beverages have the potential of neutralizing the desired nutrients in the pill thereby leading to ineffectiveness. The best way to take the tablets is swallowing them whole with a glass of water.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারতে গরু নিয়ে রাজনীতি
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ