বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
যুগ ও কালের ঘূর্ণাবর্তে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ বর্তমানে এক চরম সঙ্কটকাল অতিক্রম করছে। একদিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার দিন দিন বেড়েই চলেছে এবং অপরদিকে বন্যার তিন দফা করাল স্রোতে বহু সংখ্যক অঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এতে করে বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট, মসজিদ, মাদ্রাসা স্কুল-কলেজ, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু স্থাপনা সার্বিকভাবে কোথাও বা আংশিকভাবে বিধ্বস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর সাথে যোগ হয়েছে নদী ভাঙনের তীব্র আঘাত।
যার ফলে বহু ঘর-বাড়ি, জমি জিরাত নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বন্যাকবলিত এলাকার সর্বত্রই ধ্বংসের অল্প বিস্তার চিহ্ন নজরে পড়ে। সে এক হৃদয় বিধারক দৃশ্য। তবে, কি পরিমাণ প্রাণহানি ঘটেছে এবং সহায় সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে তাঁর যথাযথ হিসাব তাৎক্ষণিকভাবে তুলে ধরা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আর সম্ভব নয় বলেই, আমরা দেশ ও জাতির বিত্তবান ও মহৎপ্রাণ ব্যক্তিবর্গের প্রতি সবিনয় নিবেদন করছি যে, আপনারা দুঃস্থ জনগণের জান-মাল রক্ষা এবং ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মেরামত ও পুনঃনির্মাণের জন্য দানের হস্তকে সম্প্রসারিত করুন। দেশ ও জাতিগঠনের অন্যতম উপাদান মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজ ও অন্যান্য অপরিহার্য প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনির্মাণ ও মেরামতের কাজে এগিয়ে আসুন। আপনাদের এ মহৎ কাজ ও দান সাদাকায়ে জারীয়া বা আল্লাহর রাস্তায় স্থায়ী দান হিসেবে পরিগণিত হবে।
সাদাকায়ে জারীয়ার কাজে অর্থ-কড়ি, জান-মাল, শক্তি-সামর্থ ব্যয় করার প্রতি মহান রাব্বুল আলামীন আল কোরআনে নির্দেশ প্রদান করেছেন। ইরশাদ হয়েছে: ‘আর তোমরা আল্লাহর রাস্তায় দান করো এবং নিজে হাতে নিজেদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না। আর তোমরা পুণ্যকর্ম সম্পাদন করো। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশালীদেরকে ভালোবাসেন’। (সূরা বাকারাহ : আয়াত-১৯৫)।
আল্লাহর পথে কতটুকু সম্পদ দান করা শ্রেয় সে দিক নির্দেশনাও কোরআনুল কারীমে প্রদান করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে: ‘আর লোকেরা তোমায় জিজ্ঞেস করে তারা কী পরিমাণ দান করবে, বল, যা প্রয়োজনের অতিরিক্ত তাই। (সূরা বাকারাহ : আয়াত-২১৯)।
সাদাকায়ে জারীয়ার খাতে যা দান করা হয়, তাঁর পুণ্যময় প্রতিফল ক্রমাগতভাবে বাড়তেই থাকে। তাঁর উপমা আল কোরআনে এভাবে বিবৃত হয়েছে: ‘যারা আল্লাহর পথে তাদের অর্থ-সম্পদ দান করে, তাদের উপমা একটি বীজের বা শস্যদানার মতো, যা সাতটি শীষ উৎপন্ন করল। প্রতিটি শীষে রয়েছে একশত দানা। আর আল্লাহ যাকে চান তাঁর জন্য বাড়িয়ে দেন। অবশ্যই আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ”। (সূরা বাকারাহ : আয়াত, ২৬১)।
পিয়ারা নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) তিনটি পুণ্যকর্মের বিনিময় ফল মানুষের মৃত্যুর পর অব্যাহত থাকবে বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন: ‘মানুষ যখন মৃত্যু বরণ করে তখন তাঁর আমল বা কাজ করার ক্ষমতা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তিনটি পথে তাঁর পুণ্য লাভের ধারা অব্যাহত থাকে। যথা: (ক) সাদাকায়ে জারীয়ার মাধ্যমে (খ) রেখে যাওয়া উপকারী জ্ঞান প্রবাহের মাধ্যমে এবং (গ) নেক বা পুণ্যবান সন্তানের দোয়ার মাধ্যমে’। (মোসনাদে আহমাদ)। সুতরাং সাদাকায়ে জারীয়ার খাতে দান করা যে, দীর্ঘকাল যাবত পুণ্যলাভের পরিচায়ক তা সহজেই অনুধাবন করা যায়।
আল্লাহর পথে ব্যয় করার ফলাফল সম্পর্কিত আরও একটি উদাহরণ আল কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে: আর যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও নিজেদেরকে (সত্যপথে) সুদৃঢ় রাখার লক্ষ্যে সম্পদ ব্যয় করে তাদের উপমা উচুঁ ভূমিতে অবস্থিত বাগানের মতো, যাতে পর্যাপ্ত বৃষ্টির পানি পতিত হয়েছে। ফলে তা দ্বিগুন ফল-ফলাদি উৎপন্ন করেছে। আর যদি তাতে প্রবল বৃষ্টিপাত নাও হয়, তবে হালকা বৃষ্টিই যথেষ্ট। অবশ্যই আল্লাহ তোমরা যা আমল কর সে সম্বন্ধে সম্যক দ্রষ্টা। (সূরা বাকারাহ : আয়াত ২৬৫)।
বস্তুত: দেশ ও জাতির চলমান সঙ্কটকালে সামর্থ অনুপাতে সকলেরই উচিত সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করা। বিশেষ করে ঈমানদারদের জন্য চিরস্থায়ী পুণ্যময় ফল লাভের এটি একটি পরম সুযোগ ও বটে। এতদসম্পর্কে নূর নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘একজন মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। সে না তাঁর ওপর জুলুম করতে পারে, আর না তাকে শত্রæর হাতে সোপর্দ করতে পারে। যে লোক মুসলিম ভাই এর প্রয়োজন পুরনে সচেষ্ট হয়, মহান আল্লাহপাক তাঁর প্রয়োজন পূর্ণ করে দেন।
যে লোক কোনো মুসলমানের কোনো অসুবিধা দূর করে দেয়, আল্লাহপাক এর বিনিময়ে কেয়ামতের দিন তাঁর কষ্ট ও অসুবিধা দূর করে দেবেন। যে লোক কোনো মুসলমানের দোষ গোপন রাখে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাঁর দোষ গোপন রাখবেন’। (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম) হাবীবে কিবরিয়া মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন: ‘যে লোক কোনো মুসলমানের পার্থিব কষ্টসমূহের মধ্য হতে একটি কষ্ট দূর করে দেয়, মহান আল্লাহপাক কেয়ামতের দিন তাঁর কষ্ট দূর করে দেবেন। যে লোক কোনো অভাবীর অভাবের কষ্ট লাঘব করে দেয়, মহান আল্লাহপাক দুনিয়া ও আখেরাতে তাঁর অভাবের কষ্ট লাঘব করে দেবেন।
যে লোক কোনো মুসলমানের দোষ গোপন রাখে, মহান আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তাঁর দোষ গোপন রাখবেন বান্দা যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর অপর মুসলিম ভ্রাতার সাহায্য করতে থাকে আল্লাহপাক ও ততক্ষণ পর্যন্ত তার সাহায্য সহায়তা করতে থাকেন। যে লোক জ্ঞান অন্বেষণ করার উদ্দেশ্যে কোনো পথ অবলম্বন করে মহান আল্লাহপাক এর বিনিময়ে তাঁর জান্নাতের একটি পথ সহজ করে দেবেন। যখন কোনো একদল লোক আল্লাহ পাকের ঘর মসজিদ সমূহের মধ্যে থেকে কোনো একটি মসজিদে একত্রিত হয়ে আল্লাহর কিতাব (আল কোরআন) পাঠ করতে থাকে এবং পরস্পর এর আলোচনা করতে থাকে, তখন তাদের ওপর শান্তি ও স্বস্তি নাযিল হতে থাকে। রহমত তাদেরকে আচ্ছাদিত করে ফেলে।
ফিরিশতাগণ তাদেরকে পরিবেষ্টন করে রাখে এবং মহান আল্লাহপাক তার সামনে উপস্থিত নৈকট্যপ্রাপ্তদের কাছে তাদের কথা আলোচনা করেন। মোট কথা, যার আমল ও কার্য-কলাপ তাকে বিছিয়ে দেয়, তবে তাঁর বংশ মর্যাদা তাকে এগিয়ে দিতে পারে না। (সহীহ মুসলিম)। এতে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় সে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের পথে এগিয়ে যাওয়ার মোক্ষম উপায় হচ্ছে সাদাকায়ে জারীয়ার কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রাখা। এই কর্ম প্রেরণা মানুষের মাঝে যত বেশি জাগরুক থাকবে, ততই কল্যাণ ও মঙ্গল লাভের পরিসর বৃদ্ধি পেতে থাকবে, এতে কোনোই সন্দেহ নেই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।