যেভাবে ৫০০
ক্লাব ফুটবলে গোলের প্রায় সব রেকর্ডই তার দখলে। এবার সেই লিওনেল মেসি উঠে গেলেন আরেক উচ্চতায়। বার্সেলোনার জার্সি গায়ে ৫০০ গোলের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন মেসি।
ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে এতক্ষণে আলোর রোশনাই আর সাম্বার তালে পর্দা ইঠে গেছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ক্রীড়াযজ্ঞ অলিম্পিক গেমসের এবারের আসরের। শত বছরেরও বেশি পুরোনো এই ক্রীড়া আসরে বিশ্বের সেরা অ্যাথলেটরা প্রতীক্ষায় থাকেন নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে পদক জিততে। পিছিয়ে নেই বাংরাদেশও। ১৯৮৪ সালে লস অ্যাঞ্জেলস অলিম্পিক গেমসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদরা অংশ নেন। সাফল্য না পেলেও এরপর ধারাবাহিকভাবে অলিম্পিকের প্রতিটা আসরেই তারা লাল-সবুজ নিয়ে হাজির হন। রিও অলিম্পিকে বাংলাদেশ খেলবে পাঁচটি ডিসিপ্লিনে। এগুলো হলো- অ্যাথলেটিক্স, সাঁতার, গলফ, আরচ্যারি ও শুটিং। এই পাঁচ ডিসিপ্লিনে লাল-সবুজের ৭ ক্রীড়াবিদ লড়বেন। যাদের মধ্যে দেশসেরা গলফার সিদ্দিকুর রহমান সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। বাকীরা ওয়াইল্ড কার্ডের মাধ্যমে অলিম্পিকে খেলছেন। রিও অলিম্পিকে খেলতে যাওয়া বাংলাদেশের সাত ক্রীড়াবিদরা হলেন- সিদ্দিকুর রহমান (গলফ), আবদুল্লাহ হেল বাকি (শুটিং), মেজবাহ আহমেদ ও শিরিন আক্তার (অ্যাথলেটিক্স), মাহফিজুর রহমান সাগর ও সোনিয়া আক্তার টুম্পা (সাঁতার) এবং শ্যামলী রায় (আরচ্যারি)। তাদের ৭ কাহন নিয়ে লিখেছেন- জাহেদ খোকন
সিদ্দিকুরে ইতিহাস
দীর্ঘ দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে গলফের সঙ্গে যুক্ত সিদ্দিকুর রহমান। ২০০৫ সাল পর্যন্ত অ্যামেচার গলফার হিসেবে এশিয়ায় ১২টি ইভেন্টে শিরোপা জিতেছেন তিনি। যার মধ্যে বাংলাদেশে পাঁচটি, দু’টি করে পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও নেপাল এবং একবার ভারতে শিরোপা জেতেন। ২০০৬ সালে পেশাদার গলফ জগতে প্রবেশ করেন সিদ্দিকুর। অংশ নেন ভারতের প্রফেশনাল গফল ট্যুরে। এরপর কেবলই এগিয়ে যাওয়ার পালা পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতার এই গলফারের। ক্যারিয়ারে দু’টি এশিয়ান ট্যুরের ট্রফিও জেতেন ১৯৮৪ সালে জন্ম নেয়া সিদ্দিকুর। ২০১০ সালের ১ আগস্ট ব্রুনাই ওপেন এবং ২০১৩ সালের ১০ নভেম্বর ভারতের হিরো ইন্ডিয়ান ওপেন এশিয়ান ট্যুর শিরোপা জেতেন তিনি। প্রথম পেশাদার গলফার হিসেবে লাল-সবুজের পতাকা উড়ান বিদেশে। এক সময় ‘বাংলার টাইগার উডস’ নামেও আখ্যায়িত হন। সেই সিদ্দিকুরেই হলো ইতিহাস।
নিজ যোগ্যতা বলে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ক্রীড়া আসর ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ খ্যাত অলিম্পিক গেমসে সরাসরি খেলার সুযোগ পেলেন কৃতি এই গলফার। বিশ্ব গলফ র্যাংকিংয়ে ৫৬তম অবস্থানে থেকে ব্রাজিলের রিও অলিম্পিকে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করলেন সিদ্দিকুর। এবারের অলিম্পিকে ৬০ জন গলফার সরাসরি খেলতে পারবেন। যার মধ্যে অন্যতম সিদ্দিকুর। বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই ক্রীড়া আসরে খেলার সুযোগ পেয়ে তিনিই হলেন প্রথম বাংলাদেশী যিনি ওয়াইল্ড কার্ড পেয়ে নয়, নিজ যোগ্যতায় সরাসরি অলিম্পিকে খেলার অনন্য রেকর্ড গড়লেন। দীর্ঘ ৪৫ বছর আগে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও এমন কৃতিত্ব কেউ দেখাতে পারেননি। স্বাধীনতার পর সবক্ষেত্রের মতো ক্রীড়াঙ্গনেও এগিয়েছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আসরে সংখ্যায় কম হলেও লাল-সবুজের ক্রীড়াবিদরা সাফল্যের ধারাবাহিকতায় রয়েছেন। দাপটের সঙ্গেই দক্ষিণ এশীয় গেমস থেকে শুরু করে কমনওয়েলথ গেমস পর্যন্ত সব আসরেই পদক জিতেছেন তারা। তবে অলিম্পিক গেমসে বরাবরই ওয়াইল্ড কার্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদরা অংশ নেয়ার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু সেই ধারা ভেঙ্গে এবার সরাসরি রিও অলিম্পিকে অংশ নিচ্ছেন দেশসেরা গলফার সিদ্দিকুর রহমান। সরাসরি অলিম্পিকে খেলার সুযোগ পেয়ে গর্বিত সিদ্দিকুর নিজের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন এভাবে, ‘স্বপ্ন পূরণ হওয়ায় খুব আনন্দ লাগছে। যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এমন বড় আসরে খেলার জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে আমাকে। বেশি খুশী লাগছে এই কারণে যে, রিও অলিম্পিকে প্রথমবার খেলতে যাচ্ছি, অথচ কোন ওয়াইল্ড কার্ড নয়, সরাসরি যোগ্যতাবলেই খেলার সুযোগ পেয়েছি। ব্রাজিলে আমি নিজের সেরাটা দিয়েই চেষ্টা করবো দেশের মান বাড়াতে। আমার ধারণা আমি কিছু একটা করে দেখাবো।’ তিনি আরো বলেন, ‘১৯৯৬ সালে যখন থেকে গলফ খেলা শুরু করেছিলাম তখন থেকেই স্বপ্ন ছিল অলিম্পিকে খেলবো। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণে যে এতটা পথ পাড়ি দিতে হবে, তা আগে ভাবতে পারিনি। প্রায় ২০ বছর অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে আমাকে। অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়েছে। তবে আমার একজন পার্টনার পেলে ভালো হতো। একা একা কেমন লাগবে জানি না।’
গলফে এতোটা পথ পাড়ি দেয়া সিদ্দিকুরের জন্য সহজ ছিলো না। এ প্রসঙ্গে তার কথা, ‘এই অবস্থানে আসতে কম কষ্ট করতে হয়নি আমাকে। আমার অতীত সবাই জানেন। আল্লাহ কোথা থেকে আমাকে কোথায় এনেছেন। আসলে কষ্ট না করলে কিছুই পাওয়া যায় না। আমি কষ্ট করেছি। যার প্রতিদানে আল্লাহ আমাকে অনেক কিছুই দিয়েছেন। সৌভাগ্যও দিয়েছেন তিনি। আশা ছিলো গলফার হবো। তা হয়েছি। ভারতে খেলার স্বপ্ন ছিলো সেটা পুরণ হয়েছে। এশিয়ান ট্যুরের আশা ছিল। তাও দু’বার জিতেছি। আসলে খেলতে খেলতেই স্বপ্নের জাল বুনেছি এবং তা বাস্তবে রুপ দিয়েছি। আমার সাফল্যে বাবা-মা খুব খুশী। তাদের কল্পনায়ও ছিলো না আমি এতোটা ওপরে উঠতে পারবো। আমাকে নিয়ে এখন তারা গর্ব করেন।’ রিও অলিম্পিকে খেলার সুযোগ পেয়ে উচ্ছ্বসিত এই গলফার দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এবার আমি গলফ থেকে সরাসরি অলিম্পিকে খেলবো। আশাকরি আগামীতে দেশের অন্য ডিসিপ্লিনের ক্রীড়াবিদরাও এ যোগ্যতা অর্জন করতে পারবেন। আমিসহ ওয়াইল্ড কার্ড পেয়ে বাংলাদেশের যে সব ক্রীড়াবিদ এবারের অলিম্পিকে খেলতে যাচ্ছেন তারা সবাই যেন দেশের মান রাখতে পারি সেজন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই।’ ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে আগামী ৫ আগস্ট বসছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ক্রীড়াযজ্ঞ অলিম্পিক গেমসের এবারের আসর। শত বছরেরও বেশি পুরোনো এই ক্রীড়া আসরে বিশ্বের সেরা অ্যাথলেটরা প্রতীক্ষায় থাকেন নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে পদক জিততে। তারা যোগ্যতার মাপকাঠিতেই অলিম্পিকে অংশ নিয়ে থাকেন। বাংলাদেশের গলফার সিদ্দিকুর রহমান তাদেরই একজন। তিনি নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেই সরাসরি অলিম্পিকে খেলার সুযোগ পেয়েছেন। যা বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে অনন্য এক রেকর্ড।
এই ইতহাস গড়া সিদ্দিকুরের হাতেই অলিম্পিকের মার্চ পাস্টে উড়বে গর্বের লাল-সবুজ পতাকা। এ তথ্যটি জানান বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসেসিয়েশনের (বিওএ) দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা। বিষয়টি সিদ্দিকুরকে জানালে তিনি মুঠোফোনে ইনকিলাবকে বলেন, ‘সত্যিই আমি ভাগ্যবান। লাল-সবুজ পতাকা হাতে আমি অলিম্পিক স্টেডিয়ামে হাঁটছি, এ দৃশ্য কল্পনা করতেও গর্বে মাথা উঁচু হয়ে যায়। আমি গর্বিত অলিম্পিকের মতো এতো বড় আসরে দেশের পতাকা বহন করার সুযোগ পেয়ে। এর চেয়ে বড় পাওনা আর কি হতে পারে।’
এর আগে ১৯৮৪ সালে লস অ্যাঞ্জেলস অলিম্পিক গেমসে অ্যাথলেট সাইদুর রহমান ডন, ১৯৮৮ সালে সিউল অলিম্পিকে অ্যাথলেট শাহ আলম বাংলাদেশের পতাকা বহন করেছিলেন। তারপর অলিম্পিক গেমসের চার আসরে বাংলাদেশের পতাকা বহনের কৃতিত্ব পান শুটাররা। ১৯৯২ সালে বার্সেলোনায় শুটার কাজী শাহানা পারভীন, ১৯৯৬ সালে আটলান্টায় শুটার সাইফুল আলম রিংকি, ২০০০ সালে সিডনিতে শুটার সাবরিনা সুলতানা, ২০০৪ সালে শুটার আসিফ হোসেন খান লাল-সবুজের পতাকা বহন করেন। ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিকে সাঁতারু রুবেল রানা এবং সর্বশেষ ২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিকে আরেক সাঁতারু মাহফিজুর রহমান সাগর গেমসের মার্চপাস্টে বহন করেন বাংলাদেশের পতাকা।
অবশেষে অ্যাথলেটিস্ক
সব শঙ্কা দূরে ঠেলে অবশেষে রিও অলিম্পিক গেমসে যাচ্ছেন বাংলাদেশের দ্রুততম মানব মেজবাহ আহমেদ ও মানবী শিরিন আক্তার। আন্তর্জাতিক অ্যামেচার অ্যাথলেটিক ফেডারেশন (আইএএএফ) এক ইমেল বার্তায় বাংলাদেশ অ্যাথলেটিক ফেডারেশনকে বিষয়টি নিশ্চিত করে। ফলে স্বস্তি ফিরে আসে দেশের অ্যাথলেটিক্স অঙ্গনে। রিও অলিম্পিকে খেলতে ব্রাজিল যাওয়া নিয়ে গেল ক’দিন অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলেন দুই অ্যাথলেট মেজবাহ ও শিরিন। নির্ধারিত সময় ওয়াইল্ড কার্ড না আসায় বেশ দুঃশ্চিতায় ছিলেন বাংলাদেশ অ্যাথলেটিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম চেঙ্গিসসহ অন্য কর্মকর্তারা। দেরিতে হলেও সেই দোদুল্যমান অবস্থা থেকে মুক্তি পেলেন তারা। অ্যাথলেটিক্সের অনিশ্চয়তা কেটে যাওয়ায় দারুণ খুশি নৌ-বাহিনীর দুই অ্যাথলেট মেজবাহ ও শিরিন। গতকাল থেকেই অনুশীলনে মনোনিবেশ করেছেন তারা।
রিও’তে লাল-সবুজের অ্যাথলেটরা খেলার সুযোগ পাওয়ায় খুশি অ্যাথলেটিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম চেঙ্গিসও। হাসি মুখে চেঙ্গিস মিডিয়াকে বলেন, ‘১৪ জুলাই শেষ দিনেও যখন ওয়াইল্ড কার্ড আসেনি, তখন অনেকটাই হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। এরপরও কোন খবর দিতে পারছিল না বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (বিওএ)। ফলে শনিবার রাতে আমি নিজেই সরাসরি আন্তর্জাতিক অ্যামেচার অ্যাথলেটিক ফেডারেশনের (আইএএএফ) সঙ্গে যোগাযোগ করি। আইএএএফ সভাপতি সেবাস্তিয়ান গো’য়ের কাছে চিঠি পাঠাই। যার ফল হিসেবে এই দু’টি ওয়াইল্ড কার্ড পেলাম। খুব ভালো লাগছে ব্রাজিলে আমার অ্যাথলেটরা যেতে পারবে বলে।’
সময় মতো ওয়াইল্ড কার্ড না আসায় হতাশ ছিলেন দেশের দ্রুততম মানব মেজবাহ আহমেদও। যিনি ২০১৩ সাল থেকে টানা চারবারের দেশের দ্রুততম মানব (তিনটি জাতীয় ও একটি সামার মিট)। তিনি বলেন, ‘১৪ জুলাই ওয়াইর্ল্ড কার্ড না আসায় অনেকটাই হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। এত কষ্ট করেও কি অলিম্পিকে খেলতে পারবো না। স্বপ্নর্পূরণ হবে না? তবে সোমবার রাত সাড়ে বারোটায় শিরিনের কাছ থেকে খবরটি পাই। তখনি যেন বুকের উপর থেকে কষ্টের পাথরটি নেমে গেলো।’ মেজবাহ আরো বলেন, ‘খবরটা শোনার পরই মা (শাহিনা বেগম) ও বাবাকে (মোকাম্মেল হোসেন) জানাই। উনারাও খুব খুশি।’
বাগেরহাটের চিতলমারীর সন্তান মেজবাহ এখন ব্রাজিলের লাল ট্র্যাকে দৌঁড়ানোর অপেক্ষায়। তার কাছে ব্রাজিল খুবই প্রিয় নাম। এ প্রসঙ্গে মেজবাহ’র কথা, ‘বিশ্বকাপ ফুটবলে আমি ব্রাজিলের সমর্থক। সেই ব্রাজিলের ট্র্যাকেই খেলতে যাবো। এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে। তবে এবার রিওতে আরেকটি স্বপ্ন থাকবে আমার। উসাইন বোল্টের সঙ্গে ছবি তোলা। আগে দু’বার শ্যালি-অ্যান ফ্রেজার প্রাইসের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। দু’বারই ছবি তুলেছি। আসলে অলিম্পিকে খেলাটা একটি স্বপ্নের মতো। সেই স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। আমার সঙ্গে মা-বাবাও খুব খুশি।’ অলিম্পিকে নিজের লক্ষ্যের কথা জানাতে গিয়ে মেসবাহ বলেন, ‘আমার সেরা টাইমিং ১০.৭২ সেকেন্ড। এবার যদি ১০.৭০ সেকেন্ডও করতে পারি, তাহলেই অনেক কিছু পেয়েছি বলেই মনে করবো।’
রিও অলিম্পিকে খেলার স্বপ্ন ছিল দেশের দ্রুততম মানবী শিরিন আক্তারেরও। ফুটবলে তারও প্রিয় দল ব্রাজিল। তাই স্বপ্নের দেশে বিশ্বসেরা গেমসে ট্র্যাকে দৌঁড়ানোর সুযোগ পেয়ে উচ্ছ্বসিত এই অ্যাথলেট। শিরিন বলেন, ‘ব্রাজিল গিয়ে ট্র্যাকে দৌঁড়ানোর সুপ্ত বাসনাটা আমার মনে অনেক আগে থেকেই ছিল। এটাই আমার শেষ, এমনটা ভেবেই রিও অলিম্পিকে দৌঁড়াবো। নিজের সেরা টাইমিং নিয়ে দৌঁড়াতে চেষ্টা করবো। যদিও এক সময় আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু সোমবার রাতে যখন ঘুমাতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখনি স্যার (ইব্রাহিম চেঙ্গিস) আমাকে ফোনে খবরটা জানান। একবার মনে হচ্ছিল আমি ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু নিজের হাতেই চিমটি কেটে দেখলাম না সত্যি।’
স্বপ্নের অলিম্পিকে সুযোগ পেয়ে নিজের পারফরম্যান্সের উন্নতি ঘটাতে চান শিরিন। তিনি বলেন, ‘গৌহাটি-শিলং এসএ গেমসে আমার টাইমিং ছিল ১১.৯৯ সেকেন্ড। অলিম্পিকে যদি ১১.৩৫ করতে পারি, তাহলেই ভাববো কিছু অর্জন করতে পেরেছি। ভবিষ্যতে চেষ্টা করবো ওয়াইল্ড কার্ড নয়, যেন সরাসরি অলিম্পিকে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারি।’ শিরিন যোগ করেন, ‘গ্লাসগো কমনওয়েলথ গেমসে দ্রুততম মানবী শেলি আনফ্রেজের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমাদের দু’জনের উচ্চতাও এক। আসলে উনাকে দেখেও আমি অনুপ্রাণিত হই। উনি যদি বিশ্বসেরা হন, তাহলে আমার উচিত পারফরম্যান্সের দিক দিয়ে অন্তত উনার কাছাকাছি থাকা। আমি চেষ্টা করবো ব্রাজিলে নিজের সেরাটা দিয়ে দেশের মান বাড়াতে।’
শিরিনের জন্ম সাতক্ষীরা জেলার দহকোলায়। তিনি দহকোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার সময় থেকেই আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতায় সাফল্য পাওয়া শুরু করেন। প্রাথমিক স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে যখন কারিমা মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হন তখন আশ-পাশের সব জায়গায় তার প্রতিভার কথা ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিনের দৃষ্টিতে পড়েন শিরিন। উনার সহযোগিতায় ভর্তি হন বিকেএসপিতে। বাবা শেখ আবদুল মজিদ ও মা আঙ্গুরা বেগমের চার মেয়ে সন্তানের দ্বিতীয় শিরিন।
বিকেএসপিতে ভর্তি হয়েই জাতীয় পর্যায়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে দেখা দেন এই কৃতি অ্যাথলেট। জাতীয় পর্যায়ে দ্রুততম বালিকা ও কিশোরীর পর ২০১৪ সালে জাতীয় অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতার ১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশের দ্রুততম মানবীর খেতাব দখলে নেন। দেশে পরপর তিনবার দ্রুততম মানবীর খেতাব জেতা সহ শিরিন ইতোমধ্যে লাভ করেন বিদেশে বেশ কটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা। ২০১৩ সালে জুনিয়র সাফ গেমসের চার গুণিতক ১০০ ও চার গুণিতক ৪০০ মিটার রিলেতে তৃতীয়স্থান পান। ২০১৪ সালে তিনি স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত কমনওলেথ গেমস, একই বছর থাইল্যান্ডের ফুকেটে অনুষ্ঠিত এশিয়ান বিচ গেমস, ২০১৫ সালে চীনের গুয়াংজু শহরে অনুষ্ঠিত এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণের সুযোগ লাভ করে নিজের অভিজ্ঞতার ভা-ারকে সমৃদ্ধ করেন। এর আগে ২০১৩ সালে ভারতের পুনেতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশীপ, ২০১৩ সালে রাচিতে জুনিয়ার সাফ গেমস ও ২০০৯ সালে ইয়থ গেমসে অংশ নিয়ে ক্রীড়ার মাধ্যমে দেশকে বিশ্ব মঞ্চে পৌছে দেয়ার দীক্ষা নেন শিরিন। তার একটাই দুঃখ। আর তা হলো, দেশ বা বিদেশে কোন আসরে খেলার আগে প্রশিক্ষণের জন্য রাষ্ট্রিয় বা কর্পোরেট ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কোন আর্থিক সহযোগিতা পাননা ক্রীড়াবিদরা। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন তিনি। বাবা একজন গরীব কৃষক হবার কারণে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে শিরিনকে। নৌ-বাহিনী র ক্রীড়াবিদ হওয়ার সুবাদে সেখান থেকে প্রাপ্ত বেতনের সামান্য কিছু অর্থ ছাড়া আর কোন আয় নেই তার। খেলোয়াড়ি জীবন শেষ করে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান দেশের দ্রুততম এই মানবী। রিও অলিম্পিকে খেলতে যাওয়ার আগে শিরিন দেশবাসীর কাছে দোয়া চান।
কার লড়াই কবে কোথায়
বহুল কাক্সিক্ষত রিও অলিম্পিক শুরু হয়ে গেছে। বোল্ট, প্রাইস, পাওয়েল, ফারাহ, সেরেনা, জোকোভিচদের ভিড়ে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রে থাকবে লাল-সবুজের পতাকার দিকেই। বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করা ৭ অ্যাথলেটের কে কোথায় লড়ছেন সেটিও জেনে রাখা দরকার। রিও অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী দিন ৫ আগস্ট লড়াইয়ে নামবেন বাংলাদেশের তরুণ নারী তীরন্দাজ শ্যামলী রায়। ব্রাজিলের সাম্বাড্রাম স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ সময় রাত আটটায় রিকার্ভ বো ইভেন্টের ব্যাক্তিগত র্যাংকিং রাউন্ডে খেলবেন তিনি। এই বাধা টপকাতে পারলেই শ্যামলী খেলবেন ১/৩২ অ্যালিমিনেশন রাউন্ডে। লাল-সবুজের এই নারী তীরন্দাজের সেরা স্কোর ৬১৮ পয়েন্ট। শ্যামলী চার বছর আগে দক্ষিণ কোরিয়ার কি-কোবে আন্তর্জাতিক আরচ্যারি চ্যাম্পিয়নশিপে ৬৭১ পয়েন্ট অর্জন স্বর্ণ জিতেছিলেন।
৮ আগস্ট এবারের অলিম্পিকের তৃতীয় দিনে শুটিং রেঞ্জে দাঁড়াবেন বাংলাদেশের কৃতি শুটার আবদুল্লাহেল বাকি। অলিম্পিক শুটিং রেঞ্জে পুরুষদের ১০ মিটার এয়ার রাইফেলের কোয়ালিফিকেশন রাউন্ডে লড়বেন গ্লাসগো কমনওয়েলথ গেমসে রৌপ্যপদক জয়ী এই শুটার। বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ছয়টায় তার ইভেন্টটি অনুষ্ঠিত হবে। এই রাউন্ডে সাফল্য পেলে বাকি খেলবেন ফাইনাল রাউন্ডে। বাকীর ক্যারিয়ার সেরা স্কোর ৬২৭/৬২৮ পয়েন্ট। কিছুদিন আগে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ৬২২.৮ স্কোর করে তিনি ৩০তম স্থান অর্জন করেছিলেন। দেশসেরা এই শুটার যদি তার এই স্কোর অব্যাহত রাখতে পারেন, তাহলে তিনি হয়তো বাছাই রাউন্ড পেরিয়ে ফাইনাল রাউন্ডে পৌঁছতে পারবেন। তবে পদক অনেক দূরে। কারণ গত অলিম্পিকে লন্ডনে রোমানিয়ার অ্যালিন মোলদিভিয়ানু ৭০২.১ স্কোর করে স্বর্ণ জিতেছিলেন। আর র্যাংকিংয়ের অষ্টম স্থানে থাকা ড্যানিশ শুটার মাগনুস বাকেনের স্কোর ছিল ৬৯১.৫।
১১ আগস্ট রিও অলিম্পিকের গলফ কোর্সে ব্যক্তিগত স্ট্রোক প্লেতে খেলতে নামবেন প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ থেকে সরাসরি অলিম্পিকে খেলার সুযোগ পাওয়া গলফার সিদ্দিকুর রহমান। বাংলাদেশ সময় বিকাল সাড়ে চারটায় লড়াইয়ে নামবেন তিনি। অলিম্পিক র্যাংকিংয়ে ৫৬তম স্থানে থেকে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে অলিম্পিকে কোয়ালিফাই করা সিদ্দিকুরের বর্তমান বিশ্ব র্যাংকিং ৩১০। তার চেয়ে র্যাংকিংয়ে এগিয়ে থাকা বহু গলফারই খেলবেন ১১২ বছর পর অলিম্পিক গেমসে ফেরা গলফে। তবুও যেহেতু গলফ হবে ব্যক্তিগত ইভেন্টে, তাই কিছুটা হলেও আশাবাদী সিদ্দিকুর।
এবারের আসরের উদ্বোধনী ভেন্যু অলিম্পিক স্টেডিয়াম। মাদার ইভেন্ট অব গেমস খ্যাত অ্যাথলেটিক্সের বিভিন্ন ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হবে এ স্টেডিয়ামের ট্র্যাকে। ১২ আগস্ট বাংলাদেশ সময় রাত ৮টা ৫৫ মিনিটে মহিলাদের ১০০ মিটার স্প্রিন্টে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে ট্র্যাকে নামবেন বাংলাদেশের দ্রুততম মানবী শিরিন আক্তার। ২২ সেকেন্ডের এই প্রিলিমিনারি রাউন্ড পেরুলে তার জায়গা হবে রাউন্ড-১ এ। শিরিনের ক্যারিয়ার সেরা টাইমিং ১১.৯৯ সেকেন্ড। এর পরদিনই ট্র্যাকে নামবেন লাল-সবুজের দ্রুততম মানব মেজবাহ আহমেদ। বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় প্রিলিমিনারি রাউন্ডে খেলবেন তিনি। রিও’তে পুরুষদের ইভেন্টে ৭১ ও মহিলাদের ইভেন্টে ৫৬ জন অ্যাথলেটের নাম নিবন্ধন হয়েছে বলে জানা গেছে। লন্ডনে উসাইন বোল্ট ৯.৬৩ সেকেন্ড সময় নিয়ে স্বর্ণ জিতেছিলেন আর অষ্টম স্থান অধিকারী আসাফা পাওয়েল নিয়েছিলেন ১১:৯৯ সেকেন্ড। মেজবাহর সেরা টাইমিং ১০.৪৩ সেকেন্ড। তবে এটা হ্যান্ড টাইমিং। যা ইলেক্ট্রোনিক্স টাইমিংয়ে আরও আধা থেকে এক সেকেন্ড বেড়ে যাবে। অলিম্পিক হিটের নিবন্ধন মান পুরুষদের ক্ষেত্রে ১০.১৬ সেকেন্ড এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ১১.৩২ সেকেন্ড। ফলে এক্ষেত্রে বলাই যায়, বাংলাদেশের এই দু’অ্যাথলেট অনেক পিছিয়ে রয়েছেন। গেমসের ষষ্ঠ দিনে ১১ আগস্ট অলিম্পিক অ্যাকোয়াটিকস স্টেডিয়ামে সাঁতারে পুরুষদের ৫০ মিটার ফ্রিস্টাইল হিটে বাংলাদেশ সময় রাত দশটায় পুলে নামবেন মাহফিজুর রহমান সাগর। ২০১২ সালে সাগর লন্ডনে ২৪.৬৪ সেকেন্ড সময় নিয়ে ৫৮ জন সাঁতারুর মধ্যে ৩৯তম হয়েছিলেন তিনি। আর নিজ হিটে হয়েছিলেন চতুর্থ। বর্তমানে তার সেরা টাইমিং ২৪.০২ সেকেন্ড। এ ইভেন্টে ফ্রান্সের ফ্লোরেন্স মানডাউ ২১.৩৪ সেকেন্ড নিয়ে অলিম্পিকে স্বর্ণ জিতেছিলেন। আর লন্ডনে যিনি অষ্টম হয়েছিলেন সেই অষ্ট্রেলিয়ান ইমন সুলিভান সময় নিয়েছিলেন ২১.৯৮ সেকেন্ড। বর্তমানে বিশ্ব চ্যাম্পয়নশিপে এটি ২১ সেকেন্ডের কাছাকাছি চলে এসেছে। সাগর পুলে নামার পরদিনই মহিলাদের ৫০ মিটার ফ্রিস্টাইল হিটে সোনিয়া আক্তার টুম্পা একই সময়ে লড়বেন হিটে। টুম্পার সেরা টাইমিং ৩০.৮৫ সেকেন্ড। যা দিয়ে প্রাথমিক পর্ব পার হওয়ার আশাও করা যায় না। কারণ লন্ডন অলিম্পিকে মহিলাদের সর্বনিম্ন টাইমিং ছিল ২৪.৬৯ সেকেন্ড। তাই অলিম্পিকে এখন পর্যন্ত হিট পেরুনটাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের সাঁতারুদের জন্য।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।