বিএনপির মানববন্ধন আজ, পাল্টা কর্মসূচি আওয়ামী লীগ
সারা দেশের মহানগর ও জেলা পর্যায়ে আজ মানববন্ধন করবে বিএনপি ও তার মিত্ররা। আর এ
তিন মাসের মধ্যে দ্রুত বিচার আদালতের মাধ্যমে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যার বিচার সম্পন্ন ও দোষীদের ফাঁসি দাবি করেছে সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সংগঠন রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (রাওয়া)। গতকাল বিকালে রাওয়া’র হেলমেট হলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এই দাবি জানান। সেইসঙ্গে পুলিশ বাহিনীকে সুশৃঙ্খল বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য জবাবদিহিমূলক আইন প্রণয়ণ করে পুর্নগঠন করাসহ ১১টি দাবি জানান তারা। মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান (অব.) হত্যার বিচারের দাবিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন মেজর (অব.) খন্দকার নুরুল আফসার। তিনি বলেন, আমরা সুশৃঙ্খল বাহিনীর সদস্য। ইচ্ছে করলেই রাস্তায় নেমে উচ্ছৃঙ্খলা দেখাতে পারিনা। কিন্তু এই বিষয়ে দাবি আদায় না হলে আমরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হব। উঁচু গলায় কথা বলবো। তিন বাহিনীর প্রাক্তন প্রধানদের নিয়ে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে বিচার দাবি করবো।
দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- তিন মাসের মধ্যে দ্রুত বিচার আদালতের মাধ্যমে ন্যায় বিচার সম্পন্ন করতে হবে এবং দোষীদের ফাঁসি কার্যকর করতে হবে। অনতিবিলম্বে সকল আসামিকে (তদন্তে যাদের নাম আসবে তারাসহ) মামলার স্বার্থে গ্রেফতার করে জেল হাজতে রাখতে হবে। কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার (এসপি)-কে অনতিবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। এই ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা, তথ্য গোপন করে মিডিয়াতে মিথ্যা বিবৃতি দেয়া ও একমাত্র চাক্ষুস স্বাক্ষী সিফাতের বিরুদ্ধে দুটি কাল্পনিক ও বানোয়াট মামলার রুজু করার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ওসি প্রদীপকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠাতে হবে। সিফাত, ট্রাক চালকসহ সকল স্বাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অনুররূপ একটি ভিন্ন মন্ত্রণালয় (ভ্যাটারান মন্ত্রণালয়) গঠন করে সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের নিরাপদ ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন জীবনযাপনে সার্বিক সহায়তা করতে হবে।
রাওয়া’র প্রেসিডেন্ট মেজর (অব.) খন্দকার নুরুল আফসার বলেন, আমরা পুরো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দ্রুত বিচার চাই। তা না হলে আমরা আন্দোলনে যাব। আমাদের এরকম আন্দোলনের কোনো নজির নেই। কিন্তু সহকর্মীকে হত্যার বিচারের দাবিতে আমরা আন্দোলনে যেতে বাধ্য হব। তবে আমাদের আন্দোলনও হবে সুশৃঙ্খল। এ ঘটনার তদন্তে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নকে (র্যাব) নিয়োজিত করার দাবি জানিয়েছে রাওয়া। এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে খন্দকার নুরুল অফসার বলেন, পুলিশ ও সিআইডি যেভাবে তদন্ত করে, সেটা তো করবেন। আমরা চাই, র্যাবও এর তদন্ত করুক। সবগুলো তদন্ত মিলিয়ে নিরপেক্ষ ও প্রকৃত প্রতিবেদন বেরিয়ে আসুক।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, গত ৩১ জুলাই রাত ৯টার দিকে টেকনাফ থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক দিয়ে নিজস্ব প্রাইভেটকারে কক্সবাজারের দিকে যাচ্ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান। এ সময় তার গাড়িতে সিফাত নামের আরেকজন ছিলেন। সিনহার বাবা অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপসচিব মুক্তিযোদ্ধা মরহুম এরশাদ খান। সিনহা ৫১ বিএমএ লং কোর্সের সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমিশন লাভ করেন। ২০১৮ সালে সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে তিনি স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় নিয়োজিত স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সে (এসএসএফ) দায়িত্ব পালন করেন। গত ৩ জুলাই ঢাকা থেকে কক্সবাজার যান তিনি। ‘জাস্ট গো’ নামের ইউটিউব চ্যানেলের জন্য ট্রাভেল ভিডিও নির্মাণের জন্য সেখানে গিয়েছিলেন তিনি। এ সময় তার সঙ্গে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের চারজন ছিলেন।
লিখিত বক্তব্যে আরো জানানো হয়, তারা প্রায় এক মাস কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে শুটিং সম্পন্ন করেন। গত ৩১ জুলাই বিকেলে সিফাতকে সাথে নিয়ে মেজর সিনহা কক্সবাজার থেকে টেকনাফের শামলাপুর পাহাড়ে যান। এ সময় সাবেক এই সেনা কর্মকর্তার পরনে সামরিক পোশাক (কম্ব্যাট টি-শার্ট, কম্ব্যাট ট্রাউজার ও ডেজার্ট বুট) ছিল। সন্ধ্যা ও রাত্রিকালিন শুটিং শেষ করে তারা রাত সাড়ে আটটার দিকে পাহাড় থেকে নেমে আসার সময় স্থানীয় কয়েকজন লোক ডাকাত ডাকাত বলে চিকিৎকার দেন এবং শামলাপুর পুলিশ ফাঁড়িতে খবর দেন। এ সময় পাহাড় থেকে নেমে মেজর সিনহা সিফাতকে নিয়ে নিজস্ব প্রাইভেটকারে ওঠেন। রাত ৯টায় দিকে তারা শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে পৌঁছান। এ সময় মেজর সিনহা গাড়ি থেকে হাত উঁচু করে নামার পরপরই পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত তাকে তিনটি গুলি করেন। গুলি করার পরপরই রাত পৌঁনে ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন স্থানীয় জনগণ ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাঠকর্মী সার্জেন্ট আইয়ূব আলী। তখন গুলিবিদ্ধ সেনা কর্মকর্তাকে জীবিত অবস্থায় দেখেন তারা। সার্জেন্ট আলী ঘটনার ভিডিও রেকর্ড করতে গেলে পুলিশ সার্জনের পরিচয় জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু পরিচয় দেওয়ার পর পুলিশ সার্জেনের হাত থেকে মুঠোফোন সেট ও তার পরিচয়পত্র ছিনিয়ে নেয়।
লিখিত বক্তব্যে সংবিধানের ধারা উল্লেখ করে বলা হয়, আমাদের এই রাষ্ট্রে আইনের শাসন পরিচালনায় নির্বাচিত সরকার, রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ‘সক্ষমতা’ সমূহ; যেমন: প্রশাসন এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সমূহকে ব্যবহার করবেন, তা সকল সু-নাগরিকেরই কাম্য। তবে দীর্ঘদিন যাবত বিচার বহির্ভূত ‘ক্রসফায়ারে মৃত্যু’ বা ‘হারিয়ে যাওয়ার’ মাধ্যমে ব্যক্তিকে গায়েব করে সমাজের বিভিন্ন অপরাধ দমন করার প্রবনতার, নেতিঅবাচক দিক সমূহ সাম্প্রতিক সময়ে প্রায়শই প্রকাশ পাচ্ছে। সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সরকারের বিভিন্ন প্রয়াশ বিনষ্ট করতে আমাদের সমাজে অবৈধভাবে আস্কারা পেয়ে পড়ে উঠা সুবিধাবাদী গোষ্ঠি এই ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘হারিয়ে যাওয়ার’ হুমকি ব্যবহার করে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করছে।
লিখিতে বক্তব্যে স্বাক্ষীদের দীর্ঘ মেয়াদী সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, স্বাক্ষীদের পরিচিত বা আত্মীয় স্বজনের মাধ্যমেও যেন স্বাক্ষীদের উপর কোন চাপ সৃষ্টি না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। সময় কালক্ষেপন না করে দ্রুত তদন্ত সম্পন্ন করে অভিযোগপত্র দাখিল করতে হবে। এই মামলাটি দ্রুত বিচার আদালতের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। এছাড়াও কোনোভাবেই এই ঘটনার সাথে যেন কোনো রাজনৈতিক দূরভিসদ্ধি বাস্তবায়িত না হয় সেদিকে সকলের সদয় দৃষ্টি কামনা করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ৩১ জুলাই রাত ৯টার দিকে টেকনাফের বাহারছড়ায় কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের গুলিতে মারা যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা রাশেদ খান। এ ঘটনা তদন্ত করতে প্রথমে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহা. শাজাহান আলিকে আহ্বায়ক করে গত ১ আগস্ট তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পরে একই দিন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে সদস্য রেখে যুগ্মসচিব পদমর্যাদার চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে আহ্বায়ক করে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এ ঘটনায় বুধবার (৫ আগস্ট) সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) নেতৃত্বে সেনা ও পুলিশ সদর দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কক্সবাজার পরিদর্শন করেছেন। তারা সেখানকার সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। পরে সেনাপ্রধান ও আইজিপি এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন। এ সময় তারা বলেন, পুলিশের গুলিতে মেজর সিনহার মৃত্যুর ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন বলে মনে করছে দুই বাহিনী। এ ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে জয়েন্ট এনকোয়ারি টিম গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির ওপর সেনাবাহিনী ও পুলিশের পূর্ণ আস্থা রয়েছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।