পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
কোরবানি মুসলিম উম্মাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। যাদের ওপর জাকাত ওয়াজিব, তাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য স্বার্থত্যাগ, আত্মত্যাগ ও সম্পদ ত্যাগই হলো কোরবানি। কোরবানি শুধু আনন্দ উৎসব নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা ও দর্শন। যে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণ মূর্ত হয় মানুষের জীবনে, তার জন্য চরম ত্যাগ স্বীকারের এক প্রতীকী আচার এই কোরবানি। কোরবানির চামড়া গরিবের হক। কিন্তু সেই গরিবের হক মেরে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চামড়া ব্যবসায়ীরা দুই বছর ধরে মুনাফাখুরির মহড়া দিচ্ছে। গতবারের মতো এবারও কোরবানির চামড়া নিয়ে সিন্ডিকেট করে দাম ফেলে দেয়া হয়েছে। সারাদেশের ‘ইনকিলাব’ প্রতিনিধিরা জানান, সর্বত্রই চামড়ার দাম নি¤œমুখি। অনেকেই বিক্রি করতে না পারায় চামড়া ফেলে দিচ্ছেন। মূলত চামড়া নিয়ে সিন্ডিকেট তৈরি করায় পুঁতে ফেলা হচ্ছে হাজার হাজার চামড়া। এতে ক্ষতি হচ্ছে দেশের অথর্নীতির। দেশের অর্থনীতিবাদ, আলেম ওলামা ও ইসলামী চিন্তাবিদরা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন।
চামড়ার দাম নির্ধারণ নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণানলয়ের দোঁড়ঝাপ ছিল চোখে পড়ার মতো। সরকার চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয় অনেক কম। পাশাপাশি নানা ধরণের কমিটি গঠন করে। কাঁচা চামড়া বিদেশে রফতানির কথাও বলা হয়। কিন্তু কোনো কিছুই চামড়া ব্যবসার সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেনি। ওই সিন্ডিকেটের ফাঁদে পড়েই পশুর চামড়ার দাম পড়ে গেছে। এতে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন দোষ দিচ্ছেন সরকার ও ব্যাংকগুলোকে, আর চামড়া ব্যবসায়ী সমিতি দোষ দিচ্ছে তাদের ট্যানাস মালিকদের। সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের একে অপরকে দোষারোপে চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কোরবানিদাতা ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। চামড়ার ন্যায্য মূল্য না পেয়ে অকেকেই চামড়া পুঁতে ফেলেছেন। গত দু’দিন রাজধানীর পোস্তা, আমিন বাজার ও সাভারে দেখা গেছে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ট্রাকে চামড়া নিয়ে এসে বিক্রি করতে না পেরে কাঁন্নায় ভেঙে পড়েন মৌসুমী ব্যবসায়ীরা।
জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ড. খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ কোরবানির চামড়ার বাজার ধস নিয়ে বলেছেন, চামড়া ব্যবসায়ীরা অতি বেপরোয়া। তাদের মধ্য থেকেই ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ষড়যন্ত্র না হলে এভাবে দাম কমতে পারে না। সরকার দাম বেঁধে দিচ্ছে। অথচ সে দামেও কিনছে না। তার মানে এ শিল্পের ব্যবস্থাপনায় সরকার ব্যর্থ। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, চামড়া তো কাঁচামাল, জরুরি এই কাঁচামালটি নিয়ে সমস্যার পেছনে রয়েছে এর চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থা। দেশে নির্ধারিত মূল্যে কাঁচা চামড়া কেনা হয় না, যেখানে চামড়া ফেলে দেয়া হচ্ছে, সংগ্রহের ন্যূনতম নিয়ম মানা হচ্ছে না এমন সাপ্লাই-চেইনে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড-বায়াররা ব্যবসা করতে চাইবে না। সাপ্লাই চেইনের এই ঘাটতিগুলো দূর না হলে, নিয়ম মানা না হলে, কপ্লায়েন্সের ঘাটতি দূর না হলে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা দেশের চামড়ার বাজারে প্রবেশ করবে না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও দেশের চামড়া খাতের সিন্ডিকেট ভাঙতে রানা প্লাজার মতো একটি ঝাঁকুনি দরকার।
কোরবানিদাতারা পশুর চামড়া বিক্রির টাকা এলাকার এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিংসহ গরিব-দুঃখী মানুষের মধ্যে বিতরণ করে থাকেন। কেউ কেউ মসজিদ-মাদরাসা ও কবরস্থানের জন্যও দান করেন। গতবারের মতো এবারও চামড়া নামমাত্র দামে বিক্রি হওয়ায় দুস্থ-অসহায়রা চরমভাবে বঞ্চিত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছে, কয়েক বছর ধরেই পরিকল্পিতভাবে কোরবানির পশুর চামড়ার দর আগের বছরের তুলনায় কমিয়ে নির্ধারণ করছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। এটাও বলা হয়ে থাকে যে ট্যানারি ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম কমিয়ে দিয়েছে।
সূত্র জানায়, ৩১ বছরের মধ্যে এবারই সবচেয়ে কম দামে বিক্রি হয়েছে পশুর চামড়া। দাম এতটাই কমেছে যে কাঁচা চামড়ার দাম না পাওয়ায় কোরবানিদাতাদের অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে চামড়া মাটিতেও পুঁতে দিয়েছেন। মৌসুমি ব্যবসায়ী অনেকে দাম না পেয়ে কাঁচা চামড়া রাস্তায়ও ফেলে দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে চামড়ার দাম কমে যাওয়ার বিষয়ে ‘চামড়া সিন্ডিকেট’কে দায়ী করে অনেকেই স্ট্যাটাস দিয়েছেন।
মাদরাসার ছাত্র, ও গরিবদের হক চামড়ার দাম কেড়ে নিতে পরিকল্পিতভাবে চামড়াশিল্পকে সিন্ডিকেটের কবলে ফেলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, এবার কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহে সাধারণ ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সরকারকে জিম্মি করে ফেলা হয়। আর এটা করা হয়েছে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারিপল্লী স্থানান্তর করতে মালিকদের বাধ্য করার প্রতিশোধ হিসেবে! কোরবানির চামড়া আমাদের দেশের সম্পদ। সম্ভাবনাময় চামড়াশিল্পের দ্রæত বিকাশের স্বার্থে কোরবানির চামড়া নিয়ে অসাধু বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। কোরবানির পশুর চামড়া গরিবের হক। এর অর্থ মেরে খেয়ে বিত্তবিলাস করা শুধু নৈতিক অপরাধই নয়, সমাজ ও ইসলামের দৃষ্টিতে গর্হিত অপরাধ করছেন।
চামড়া শিল্পে সিন্ডিকেট নৈরাজ্য দুস্থ ও নিরন্ন মানুষে পেটে মারাত্মকভাবে আঘাত হেনেছে। অসাধু সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দেশের সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্পকে ধ্বংসের দারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দেশের হাজার হাজার কওমি মাদরাসা কোরবানির পশুর চামড়ার বিক্রয়লব্ধ আয়ের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। এবার কোরবানির চামড়ার ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় মাদরাসাগুলো আর্থিকভাবে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। কোনো কোনো মাদরাসায় সংগ্রহকৃত কোরবানির পশুর চামড়া মাত্র তিনশ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ঈদের দিন এবং গভীর রাত পর্যন্ত মাদরাসার ছাত্ররা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করে রিকসা ও ভ্যান ভাড়া দিয়ে মাদরাসায় জমা করেছে। অনেক মাদরাসায় জমাকৃত এসব চামড়া ন্যায্য মূল্যে না পেয়ে পানির দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। একাধিক মাদরাসার শিক্ষকরা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
চামড়া খাতকে রক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক ট্যানারির মালিকদের কোরবানি ঈদের আগেই প্রায় চারশ’ কোটি টাকার ঋণ বরাদ্দ দিয়েছে। তার পরেও ট্যানারির মালিকরা একশ্রেণির দালাল ফড়িয়াদের মাধ্যমে কম দামে চামড়া কিনছে।
কোরবানির পশুর চমড়া নিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি হওয়ায় বিভিন্ন ইসলামি দলের নেতৃবৃন্দ আজ রোববার পৃথক পৃথক বিবৃতিতে এসব অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তারা চমড়া শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষা এবং মাদরাসার গরিব এতিম অসহায় ছাত্রদের হক্ব আদায়ে সরকারি উদ্যোগ ন্যায্য মূল্যে জরুরিভিত্তিতে চামড়া ক্রয়ের জোর দাবি জানান।
বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির আমীর আল্লামা সারওয়ার কামাল আজিজী ও মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইযহার আজ রোববার এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, অসাধু সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দেশের সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্পকে ধ্বংসের দারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর আমীর মুফতী সৈয়দ মোহাম্মদ রেজাউল করীম পীর সাহেব চরমোনাই বলেছেন, কয়েক বছর ধরে একটি চক্র চামড়া খাতে নৈরাজ্য করে যাচ্ছে। ফলে চামড়াশিল্প ও বহু দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেইসাথে দেশের এতিম ও গরিব জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি প্রিন্সিপাল মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ আজ সকালে ওলামায়ে কেরামের সাথে এক মতবিনিময় সভায় বলেন, সারা বছর যে পরিমাণ পশুর চামড়া সংগৃহিত হয় তার অর্ধেকের যোগান হয় ঈদুল আজহার সময়। অথচ এ সময়টাতে সরকারের ছত্রছায়ায় সিন্ডিকেটগুলো এমনভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে যেন তাদের চামড়ার কোনো প্রয়োজনই নেই। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের ঢাকা মহানগরীর সভাপতি মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী ও সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মতিউর রহমান গাজিপুরী এক বিবৃতিতে বলেছেন, দেশের কওমি মাদরাসাগুলোতে যাকাত ও কোরবানির চামড়া খাতের আয় থেকেই গরিব ছাত্রদের পড়া লেখার ব্যয় নির্বাহ করা হয়ে থাকে। চামড়ার দরপতন ঘটিয়ে এই জায়গাটাতেও কুঠারাঘাত করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানান : মৌসুমি ব্যবসায়ীর কাছে থাকা এবং বিভিন্ন মাদরাসা ও এতিম খানায় দেয়া চামড়াও যথাসময়ে বিক্রি করতে না পারায় নষ্ট হয়ে গেছে। এতে বঞ্চিত হয়েছেন অসহায়, হতদরিদ্র এতিম, মিসকিনরা।
ঈদের পরদিন নগরীর মুরাদপুর ও আতুরার ডিপো এলাকায় বিভিন্ন আড়তের সামনে থেকে কয়েক হাজার চামড়া তুলে নিয়ে ডাম্পিং করার কথা জানান স্থানীয় কাউন্সিলর মোবারক আলী। বিবির হাট এলাকা থেকে প্রায় দশ হাজার গরুর চামড়া ডাম্পিং করা হয়। বিক্রি করতে না পেরে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা এসব চামড়া রাস্তায় ফেলে যান।
স্টাফ রিপোর্টার, চাঁদপুর থেকে জানান : ঈদের দিন শহরের পাড়া মহল্লায় দেখা যায়, কোরবানি শেষে চামড়া রাস্তার পাশে যত্রতত্র ফেলে রাখা হয়েছে। দেখা যায়নি চামড়া ক্রয় করতে আসা কোনো মৌসুমী ব্যবসায়ীদের।
আদমদীঘি (বগুড়া) উপজেলা সংবাদদাতা জানান : এবার লোকসানের ভয়ে অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী চামড়া কেনা থেকে বিরত থাকায় আদমদীঘি ও সান্তাহারের স্থানীয় চামড়া ব্যাবসায়ীরা ইচ্ছেমতো দামে চামড়া কেনার কারনে কোরবানির পশুর চামড়ার বাজারে ধস নামে।
নওগাঁ জেলা সংবাদদাতা জানান : নওগাঁয় গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর কোরবানির পশুর চামড়ার দাম একেবারে নেই বললেই চলে। গ্রামাঞ্চল থেকে সরকারের বেঁধে দেয়া দামে চামড়া কিনে বিক্রি করতে এসে লোকশান গুনতে হচ্ছে মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ীদের।
সৈয়দপুর (নীলফামারী) উপজেলা সংবাদদাতা জানান : এবারে কোরবানির চামড়ার দর পতনে চরম বিপাকে পড়েছেন নীলফামারী সৈয়দপুর উপজেলার এতিমখানা ও কওমি মাদরাসা কর্তৃক পরিচালিত লিল্লাহ বোর্ডিংগুলো কর্তৃপক্ষ। তারা এখন এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংগুলো কিভাবে পরিচালনা করবেন তা নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।