Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সত্যালোকের সন্ধানে ইসলামে আত্মিক ইবাদতের গুরুত্ব

প্রকাশের সময় : ৪ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এ. কে. এম. ফজলুর রহমান মুনশী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ইবাদত ঃ
কুরআনুল কারীমে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন : “হে মানবম-লী! তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত কর।”
(সূরা বাকারাহ ঃ রুকু-৩)
ইবাদতের অর্থে সাধারণভাবে যে সকল নির্দিষ্ট কর্মকা-কে বুঝানো হয়, যেগুলো মানুষ আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্বপূর্ণ বারাগাহে পালন করে থাকে। কিন্তু এ হচ্ছে ইবাদতের সবচেয়ে সংকীর্ণ ও সংক্ষিপ্ত অর্থ। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মাধ্যমে মানুষের মাঝে সে হাকীকত প্রকাশ করেছেন এর মূল মর্যাদা এই নয় যে, অতীত মাযহাবগুলোর ইবাদতের তরীকা ভিন্ন ইসলামে ইবাদতের পৃথক কোন তরীকা নির্দিষ্ট হয়েছে। বরং ইসলামী ইবাদতে একথাই বলা হয়েছে যে, ইবাদতের হাকীকত ও উদ্দেশ্য কি? আর একই সাথে অতীতের ভ্রান্ত ইবাদতের তরীকাসমূহের বিশুদ্ধিকরণ ও পরিপূর্ণতা দান করা এবং সংক্ষিপ্ত বর্ণনাবলীর ব্যাখ্যা এবং বিশ্লেষণ এবং অস্পষ্ট শিক্ষার দিকনির্দেশনাগুলোর সুস্পষ্ট ব্যবস্থাপনা তুলে ধরা হয়েছে।
আরববাসীরা যেমনি ঐশী মাযহাবের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বেখবর ছিল; তেমনি ইবাদতের অর্থ ও মর্ম এবং এর সহীহ তরীকাসমূহ সম্পর্কেও অজ্ঞ ছিল। আরবে যে সকল ইহুদী ও খৃষ্টান ছিল তারাও এ সম্পর্কে নিজেদের আমল এবং শিক্ষার দ্বারা কোনও বৈশিষ্ট্য তাদের সামনে পেশ করতে পারেনি। সে যুগে যে সকল খৃষ্টান সম্প্রদায় আরবে ছিল, বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তাদের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল এই যে, তারা হযরত ঈসা (আঃ)-এর খোদায়িত্বে বিশ্বাস করত। আর ইবাদতের বেলা পৃথিবীর যাবতীয় আয়েশ-আরাম এবং পরিতৃপ্তির বিষয়াবলীকে নিজেদের উপর হারাম করে আরবের দুর্গম মরুতে, পাহাড়-পর্বতে নিজেদের উপাসনালয় ও গীর্জা নির্মাণ করেছিল এবং সেখানে বসে পৃথিবীর যাবতীয় চেষ্টা- তদবীর, সাধ্য-সাধনার ময়দান হতে সরে গিয়ে একাকীত্ব ও বৈরাগ্যসুলভ জিন্দেগী অতিবাহিত করত। এ জন্য আরবে কাব্য চর্চায় খৃষ্টানদের চিত্র একজন সর্বত্যাগী বৈরাগীর প্রতিকৃতিতেই ফুটে উঠত। আরবে সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ইমরাউল কয়েস বলেছে, “পৃথিবী হতে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপনকারী পাদ্রীর নামের চেরাগ”।
আরবের ইহুদীরা তাদের অসচ্ছরিত্রতা ও ধর্মীয় অপকর্মের দরুন সবচেয়ে বেশী বদনামী কামাই করেছিল। তাদের মাঝে রুহানী একাগ্রতা, বিশুদ্ধতা এবং আত্মত্যাগ, এমনকি আল্লাহর উপাসনার নামগন্ধও অবশিষ্ট ছিল না। তারা কেবল শনিবার দিন তৌরাতের-নির্দেশ মোতাবেক ছুটি ভোগ করত এবং সেদিন কোন কাজকর্ম না করাকে সবচেয়ে বড় ইবাদত মনে করত। কুরআনুল কারীম এই উভয় দলের অবস্থার চিত্র তুলে ধরেছে এবং ইহুদীদের উপর অবিচার, নাফরমানী, হারামখোরী ও শয়তানের উপাসনা করার অভিযোগ আরোপ করেছে। আর খৃষ্টানদের উপর ধর্মীয় ব্যাপারে গোঁড়ামীর অভিযোগও তুলে ধরেছে। (দেখুন, সূরা মায়িদাহ, রুকু-৯ এবং সূরা হাদীদ রুকু-৪)
ইহুদীরা যাদু, টোটকা এবং কার্যাবলীর ভ্রান্ত ধারণায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছিল। আর যখন সুযোগ মিলত, তখন ভিন্ন ধর্মীবলম্বীদের মূর্তির সামনেও মস্তক অবনত করত। খৃষ্টানরা হযরত মরিয়ম (আঃ) ও হযরত ঈসা (আঃ)কে এবং মসীহি আউলিয়া ও শহীদগণের মূর্তিসমূহকে, চিত্রসমূহকে এবং স্মৃতিচিহ্ন ও কবরসমূহকে পূজা-অর্চনা করত। তারা সংসারত্যাগী ইবাদতের নতুন নতুন পদ্ধতির অনুসরণ করত এবং দেহকে কঠিন বেদনা ও শাস্তিদায়ক ইবাদতের পন্থা ও পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল। আর এগুলোকে তারা দ্বীনদারী বলে অভিহিত করত। সূরা হাদীদে কুরআনুল কারীমে ইহুদী ও নাসারা উভয় সম্প্রদায়কে ফাসেক বলা হয়েছে। কিন্তু উভয় সম্প্রদায়ের ফাসেকীর মাঝে খুবই সূক্ষ্ম ও গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে। ইহুদীদের ফাসেকী হচ্ছে ধর্মে কম ও বেশী করা। এবং নাসাবাদের ফাসেকী হচ্ছে ধর্মীয় ব্যাপারে সীমা লঙ্ঘন করা ও গোঁড়ামী। বস্তুত আল্লাহ প্রদত্ত ধর্মীয় জীবনে কম এবং বেশী উভয়টিই দোষণীয় অপরাধ। এ জন্যই আল-কুরআনুল কারীমে উভয় শ্রেণীকেই সরাসরি ফাসেক বলে সাব্যস্ত করেছে। ইরশাদ হচ্ছে, “আমি নূর এবং ইব্রাহীম (আঃ)-কে রাসূলরূপে প্রেরণ করেছিলাম এবং তাদের বংশধরদের জন্য নবুওত ও কিতাব স্থির করেছিলাম, কিন্তু তাদের অল্পসংখ্যকই সৎপথ অলম্বন করেছিল এবং অধিকাংশই ছিল সত্যত্যাগী। তারপর আমি তাদের অনুগামী করেছিলাম আমার রাসূলগণকে এবং অনুগামী করেছিলাম মরিয়ম তনয় ঈসা (আঃ)-কে এবং তাঁকে ইঞ্জিল প্রদান করেছিলাম এবং তাঁর অনুসারীদের অন্তরে দিয়েছিলাম করুণা ও দয়া; কিন্তু সুন্ন্যাসবাদকে তারা নিজেরাই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রবর্তন করেছিল, অথচ আমি তাদেরকে এর বিধান দেইনি, কিন্তু এটাও তারা যথাযথভাবে পালন করেনি, এদের মাঝে যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে আমি পুরস্কার দিয়েছিলাম এবং তাদের অধিকাংশই সত্যত্যাগী।” (সূরা হাদীদ ঃ রুকু-৪)
উপরোক্ত আয়াতসমূহের মর্ম হতে বুঝা যায় যে, খৃষ্টানদের ধর্মে বাড়তি ও কমতির অবতারণা ঘটেছিল। এ জন্য আল-কুরআন তাদেরকে লক্ষ্য করে বার বার ঘোষণা করছে, “ধর্মের মাঝে গোঁড়ামী করো না।” (সূরা নিসা : রুকু-২৩; সূরা মায়িদাহ : রুকু-১০)
তাদের সবচেয়ে বড় গোঁড়ামী ছিল এই যে, হযরত ঈসা (আঃ)-কে শুধু আল্লাহর রাসূল হওয়ার হুকুম দেয়া হয়েছিল। তারা তাকে আল্লাহর ছেলে বলে মানতে লাগল। আর ইহুদীদের অবস্থা ছিল এই যে, তারা আল্লাহর রাসূলদেরকে রাসূল বলে মেনে নিতে চাইতো না। বরং তাদেরকে হত্যা করে ফেলতো। (সূরা বাকারাহ; সূরা আলে ইমরান) একই সাথে তারা মহান সত্য আল্লাহকে বাদ দিয়ে প্রতিবেশী মূর্তিপূজারীদের সাথে পূজায় লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। সুতরাং তৌরাতে ইহুদীদের মূর্তিপূজা এবং ভ্রান্ত উপাস্যের সামনে মস্তক অবনত করার উল্লেখ বারবার এসেছে। তাদের সম্পর্কে আল-কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “যারা মূর্তিপূজা করেছে।” (সূরা মায়িদাহ : রুকু-৯)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) খৃষ্টানদেরকে তাবলীগ করেছিলেন, “মরিয়ম তনয় মসীহ তো কেবল একজন রাসূল। তাঁর পূর্বে বহু রাসূল গত হয়েছে, এবং তাঁর মাতা ছিল সত্যনিষ্ঠ। তারা উভয়ে পানাহার করত; দেখ, তাদের জন্য আয়াত কিরূপ বিশদভাবে বর্ণনা করি, আরোও দেখ, তারা কিভাবে সত্যবিমুখ হয়। বল, তোমরা কি আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুর ইবাদত কর, যে তোমাদের ক্ষতি বা উপকার করার কোন ক্ষমতা নেই, আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ, বল হে কিতাবিগণ! তোমরা তোমাদের দ্বীন সম্বন্ধে অন্যায় বাড়াবাড়ি করো না, এবং যে সম্প্রদায় ইতিপূর্বে পথভ্রষ্ট হয়েছে ও অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে এবং সরল পথবিচ্যুত হয়েছে তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করো না।” (সূরা মায়িদাহ : রুকু-১০)
অথচ তাদের অবস্থা ছিল এই, “তারা আল্লাহ ছাড়া তাদের প-িতগণকে ও সংসার বিরাগীগণকে হুকুমের মালিক বলে গ্রহণ করেছে।” (তাওবাহ : রুকু-৫)
সে যুগে খৃষ্টানদের যে সকল গীর্জা ও ইবাদতের স্থান আরবে বিশেষ করে আবিসিনিয়াতে ছিল, সেগুলোতে হযরত ঈসা (আঃ), হযরত মরিয়াম (আঃ) হাওয়ারী, অলী এবং শহীদগণের মূর্তি ও চিত্র খোদিত ছিল। ইবাদতকারীগণ এগুলোর সামনে ধ্যান, চিন্তা ও অবনত মস্তকে অবস্থান করতো। সাহাবায়ে কেরামদের মাঝে যারা আবিসিনিয়া হিজরতের প্রাক্কালে সে সব গীর্জা দেখেছিলাম তাদের বিবিগণের মাঝে কাহারো কাছে সেই বুযুর্গদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন ভালো মনে হয়েছ্ িসুতরাং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মৃত্যুশয্যার সময় কোন কোন আযওয়াজুম মুতাহহারাত তাঁর কাছে সেই ঘটনার কথা উল্লেখ করেছিলেন এবং সেই মূর্তি ও চিত্রগুলোর সৌন্দর্যের কথাও বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, আল্লাহ পাক ইহুদী ও নাসারাদের উপর অভিসম্পাত বর্ষণ করুন। তারা নিজেদের পয়গাম্বরদের কবরগুলোকে ইবাদতগাহ বানিয়ে নিয়েছে। তোমরা কখনো এরূপ করো না। যখনই তাদের কোন ভালো লোক মারা যেত তখন তারা তার কবরকে ইবাদতগাহ বানিয়ে নিত এবং এগুলোর মাঝে মূর্তি নির্মাণ করতো। (সহীহ মুসলিম : কিতাবুল মাসাজিদ)
এডওয়ার্ড গীবন রোমের উত্থান-পতন নামক ইতিহাস গ্রন্থের খ-ে খৃষ্ট ধর্মের ইবাদতের অবস্থা তুলে ধরেছেন। এগুলোর সবই উপরোল্লিখিত হাদীসের সত্যতারই প্রতিফলন। বিশেষ করে তৃতীয় ও পঞ্চম খ-ে হযরত ঈসা (আঃ) হযরত মারয়াম (আঃ), পৌল এবং বিভিন্ন অলী ও শহীদগণের পূজার যে বিবৃতি বিধৃত আছে, তার সবই উপরোক্ত হাদীসের যথার্থতার উদাহরণ। আর আজো রোমান ক্যাথলিক এবং প্রাচীন গীর্জাগুলোর দেয়ালে যে অবস্থা বিরাজ করছে, তা কুরআনুল কারীমের সত্য আওয়াজের বাস্তবতাকে আরো সুস্পষ্ট করে তুলছে। আর আজো খৃষ্টানরা দিনে বা রাতে মোমবাতির আলোক সজ্জার ভিতর দিয়ে সেই মূর্তিগুলোর সামনেই ধ্যান ও মোরাকাবায় নিরত থাকতে দেখা যায়। রোম এবং ইাতালীর ঐতিহাসিক গীর্জাগুলো দর্শনকালে সে হুবুহু চিত্র আমি স্বচক্ষেই অবলোকন করেছি। সেসময় উপরোক্ত হাদীসের বিশ্লেষণ আমার চোখের সামনে উপস্থিত ছিল।
ইহুদী এবং খৃষ্টানদের বাদ দিয়ে খাস আরবের লোকেরা ‘আল্লা’ নামের সাথে অবশ্য পরিচিত ছিল। যদিও আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীর তাৎপর্য সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ বেখবর ছিল। তারা লাত, ওজ্জা, হুবল এবং নিজ নিজ কবিলায় যে সকল দেবতাকে নিজেদের আশা-পূরণকারী ও পূজা-অর্চনার উপযুক্ত বিবেচনা করত। এমনকি পাথরের স্তূপের সামনে অংশীবাদিত্বের বহু রুসুম ও রেওয়াজ পালন করত। খানায়ে ক’বা অর্থাৎ ইব্রাহীম খলিল (আঃ)-এর মত মূর্তি সংহারকারীর ইবাদতখানায় তিনশ ষাটটি মূর্তি সংস্থাপিত করেছিল। আর তাদের নামায ছিল এই যে, কা’বাগৃহের অঙ্গনে একত্রিত হয়ে বাঁশী বাজানো এবং মূর্তিগুলোকে খুশী করার জন্য তালি বাজানো। কুরাইশদের মাঝে একেশ্বরবাদী যায়েদ বিন আমর যিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নবুওতের পূর্বে মূর্তিপূজা হতে তওবা করেছিলেন এবং প্রায়ই বলতেন, “হে আল্লাহ! আমি জানি না, কেমন করে তোমার উপাসনা করব, যদি জানতাম, তাহলে সেভাবেই আমি ইবাদত করতাম।” (সীরাত ইবনে হিশাম, যায়েদ বিন আমার প্রসঙ্গ)
একজন কবি সাহাবী আমের বিন আকওয়া খায়বর ভ্রমণকালে এই কবিতাটি গাইতেছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তা স্মরণ করেছিলেন। আল্লাহর শপথ! যদি আপনি না হতেন, তাহলে আমরা সত্যিকার পথ খুঁজে পেতাম না। এমনকি দান-খয়রাত করতাম না এবং নামাযও পড়তাম না।
এই কবিতার মূল হাকীকত ছিল মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর শিক্ষার বিকাশ। যা আরববাসীদের ইবাদত- বন্দেগীর সহীহ তরীকার সাথে সুপরিচিত করেছিল। আরবের বাইরে এক আল্লাহর ইবাদত কোথাও ছিল না। গ্রীক মূর্তিপূজারীরা নিজেদের বাদশাহ এবং বীরদের প্রতিমূর্তি এবং গ্রহ-তারকার প্রতিচ্ছবির ইবাদত-বন্দেগী করত। রোম, এশিয়া মাইনর, ইউরোপ, আফ্রিকা, মিসর, বারবার হাবশা প্রভৃতি খৃষ্টান রাষ্ট্রগুলোতে হযরত ঈসা (আঃ), হযরত মরিয়াম এবং হাজারো দেব-দেবী ও নিহতদের মূর্তি, হাড় এবং তাদের কল্পিত স্মরণীয় স্থানের পূজা-অর্চনা জারি ছিল। জুরদস্তের রাজত্বে ছিল অগ্নিপূজার হিড়িক। হিন্দুস্থান হতে শুরু করে কাবুল, তুর্কি স্থান, চীন ও ভারতীয় দীপপুঞ্জে গৌতম বুদ্ধের মূর্তি নির্মাণ করে, সমাধি তৈরি করে, এমনকি তার জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া হাড়গোরের পূজা করা সর্বত্র বিরাজমান।
চীনের কনফুসাস বাপ-দাদার মূর্তির সামনে ছিল অবনত মস্তক। হিন্দুস্থানের সূর্য দেবতা, গঙ্গা মা এবং অবতারদের পূজা ছিল প্রবহমান। ইরাকের সায়েরী সম্প্রদায় সপ্তর্ষিম-লের পূজা করত। বাকি সব দুনিয়া গাছ, বৃক্ষ-তরুলতা, পাথর, জানোয়ার, ভূত-প্রেত এবং দেবতাদের পূজা-অর্চনা করতে ছিল। মোটকথা, সেই সময় যখন তামাম দুনিয়ায় এক আল্লাহকে ছেড়ে দিয়ে আকাশ হতে যমীন পর্যন্ত সকল মাখলুকাতের বন্দেগী করতো, তখনই একটি বিশুদ্ধ মরু এলাকার প্রান্ত হতে আওয়াজ উঠলো, হে লোক সকল! স্বীয় ঐ পরওয়ারদিগারের ইবাদত কর, যিনি তোমাদের এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদের পয়দা করেছেন। (সূরা বাকারাহ) পূর্বতন আসমানী কিতাবের অনুসারীদেরকে জানানো হলো, “হে আহলে কিতাব! এসো তোমরা এবং আমরা কর্মক্ষেত্রে একাত্ম হয়ে যাই, যে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আমরা একক সত্যিকার আল্লাহ ছাড়া আর কাহারো এবাদত করব না। (সূরা আলে ইমরান)
কিন্তু এই আওয়াজ মরু আরবের কতিপয় সত্যান্বেষী ব্যক্তি শুনতে পেল এবং প্রত্যুত্তরে বলে উঠল, হে আমাদের পরওয়ারদেগার! আমরা একজন ঈমামের প্রতি আহ্বানকারীর ঘোষণা শুনতে পেরেছি। যিনি ঘোষণা করেছেন তোমরা স্বীয় প্রতিপালকের উপর ঈমান আনয়ন কর, এতে করে আমরা ঈমান এনেছি। হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি আমাদের অপরাধ ক্ষমা করে দিন। (সূরা আলে ইমরান)
সুতরাং এ সকল ঘটনাবলী সামনে রেখে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ঐ দোয়ার সত্যতার কথা স্মরণ করুন। যা তিনি বদর যুদ্ধের চরম সন্ধিক্ষণে পাক জবানে একান্ত আনুগত্যের ভিত্তিতে বারগাহে ইলাহীতে করেছিলেন। হে আল্লাহ! আপনার ইবাদতকারীদের এই ক্ষুদ্র দল আপনার জন্য সমরক্ষেত্রে সমুপস্থিত। হে আল্লাহ! আজ যদি তারা মিটে যায়, পরাজিত হয় তাহলে এ নিখিল বিশ্বে আপনার ইবাদতকারী কেউ থাকবে না। (সহীহ মুসলিম ও জামে তিরমিজী, বদর প্রসঙ্গ)
আল্লাহ পাক স্বীয় নবীর দোয়া কবুল করলেন। কারণ, খাতেমুল আম্বিয়ার পরে আর কোন নবীর আগমন ঘটবে না। যিনি পথভ্রষ্ট দুনিয়াকে আল্লাহর স্মরণে নিমগ্ন করবেন এবং আল্লাহর সত্যিকার ইবাদতের তালীম দেবেন।
এক আল্লাহর ইবাদত:
ধর্মীয় পরিপূর্ণতা ও সংস্কারের ক্ষেত্রে নবুওতে মুহাম্মদী (সাঃ)-এর প্রাথমিক বড় কাজ ছিল দুনিয়ার ইবাদতখানাগুলো হতে বাতেল উপাস্যদের বাইরে নিক্ষেপ করা এবং এ সকল বাতেল উপাস্যের পূজা-অর্চনা চিরতরে মিটিয়ে দেয়া এবং কেবলমাত্র এক আল্লাহর সামনে সকল সৃষ্ট পদার্থের মস্তক অবনত করা। এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ঘোষণা জারী করা হয়েছে, “আকাশ ও যমীনের সকল মাখলুক সেই মেহেরবান আল্লাহর সামনে গোলাম হয়েই আসবে।(সূরা মরিয়াম) আল্লাহ ছাড়া না আসমানে এবং না যমীনে এমন কি না আসমানের উপরে এবং না যমীনের নীচে এমন কোন বস্তু বা পদার্থ আছে, যে মানুষের সেজদা, রুকু ও কেয়ামের হকদার হতে পারে এবং না তার নাম ছাড়া অন্য কাহারো নামে কোন প্রাণীর প্রাণ উৎসর্গ করা যেতে পারে। কিংবা বাতেল উপাস্যের জন্য ইবাদত গৃহ নির্মাণ করা যেতে পারে, না এর জন্য নজর মানা যেতে পারে, না তার কাছে দোয়া প্রার্থনা করা যেতে পারে; স্বয়ং সকল ইবাদত কেবলমাত্র আল্লাহরই জন্য এবং সকল আরাধনা কেবল তারই নিমিত্ত হতে হবে।
এজন্যই আল কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “অবশ্যই আমার সালাত এবং আমার কোরবানী এবং আমার জীবন ও আমার মৃত্যু সবকিছুই এক আল্লাহর জন্যই নিবেদিত, যিনি সমগ্র বিশ্বের প্রতিপালক। (সূরা আনয়াম)
একই সাথে অবিশ্বাসীদেরকে মূর্তি, দেবতা, নক্ষত্রসমূহ ও অন্যান্য সৃষ্ট পদার্থের ইবাদত করা থেকে প্রতিনিবৃত্ত করা হয়েছে এবং তাদেরকে সামগ্রিকভাবে বুঝানো হয়েছে যে, সত্যিকারভাবে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাহারো ইবাদত হতে পারে না। কিন্তু যখন তাদের উপর এ সকল উপদেশ ও বুঝানোর কোন প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব দেখা গেল না তখন ইসলামের নবীর উপর সার্বিক সম্পর্কহীনতার এই ঘোষণা জারি করার নির্দেশ হলো, “বলুন হে কাফের সম্প্রদায় তোমরা যার অর্চনা কর, আমি তার উপাসনা করি না। আর আমি যার ইবাদত করি, তোমরা তার ইবাদত কর না। আর আমিও তার ইবাদত করব না, যার ইবাদত তোমরা কর। আর তোমরাও তাঁর ইবাদত করবে না, যার ইবাদত আমি করি। তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম এবং আমার জন্য আমার ধর্ম। (সূরা কাফিরুন)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ