Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সত্যালোকের সন্ধানে ইসলামে আত্মিক ইবাদতের গুরুত্ব

প্রকাশের সময় : ২৮ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এ. কে. এম. ফজলুর রহমান মুনশী
আমলে সালেহ :
আমলে সালেহ বা নেক আমল বলতে শুধুমাত্র দৈহিক ইবাদত ও সম্পদভিত্তিক ইবাদতই বুঝায় না। বরং এর সাথে আত্মিক ইবাদতও অন্তর্ভুক্ত আছে। মহান আল্লাহপাক এ প্রসঙ্গে ইরশাদ করেছেন।
যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমলসমূহ করেছে। (সূরা তীন : রুকু-১)
মূলত রাসূলুল্লাহ (সা.) যে তালিম ও শিক্ষা নিয়ে আগমন করেছিলেন এর বুনিয়াদি মাসালা হচ্ছে এই যে, মানুষের মুক্তি দুটি জিনিসের ওপর নির্ভরশীল। প্রথমত, ঈমান এবং দ্বিতীয়ত, আমলে সালেহ বা নেক আমল। বক্ষ্যমাণ গবেষণাপত্রে আমলে সালেহের বিশ্লেষণ ও বয়ান স্থানলাভ করেছে। বস্তুত ঈমান হচ্ছে বুনিয়াদি বিধিবিধানের ওপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করার নাম। আর আমলে সালেহ হচ্ছে সেই বিধানসমূহ অনুসারে আমল করা ও বাস্তবায়িত করা। কোনো কথার শুধুমাত্র জ্ঞান ও বিশ্বাস কামিয়াবির জন্য যথেষ্ট হতে পারে না। যতক্ষণ পর্যন্ত সে জ্ঞান ও বিশ্বাস মোতাবেক আমল করা না হয়।
ইসলাম মানুষের নাজাত ও মুক্তিকে দুটি জিনিসের ওপর নির্ভরশীল সাব্যস্ত করেছে। এ দুটি বস্তু একটি অপরটির সম্পূরক। পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, ঈমান হচ্ছে বুনিয়াদ এবং আমলে সালেহ হচ্ছে এর ওপর প্রতিষ্ঠিত দেয়াল ও স্তম্ভ। যেভাবে একটি ইমারত ভিত্তি ছাড়া প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। তেমনি দেয়াল ও স্তম্ভ ছাড়া তা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না।
ঈমান ও আমলে সালেহের উত্তম উদাহরণ হচ্ছে আর্কিমিডিসের সূত্র ও ছকের মতো। ঈমানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে উদ্ভাবনী নিয়মনীতি এবং পরিজ্ঞাত বিধানাবলীর সাথে সম্পৃক্ততা। যেগুলোর যথার্থতা স্বীকার না করলে আর্কিমিডিসের ছকগুলোর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতে বাধ্য। কিন্তু যদি এসব উদ্ভাবনী নিয়মনীতি এবং পরিজ্ঞাত বিধানবলীকে স্বীকার করে নেয়া হয় এবং সে মোতাবেক ছকগুলোর ব্যবহার না করা হয়, তাহলে নির্মাণ, ভূগোল, দূরত্ব ও পরিধি নির্ণয়ে আর্কিমিডিসের উদ্ভাবিত বিষয়ের কোনো মূল্যই থাকবে না। এমনকি এর দ্বারা মানুষ আসল উদ্দেশ্যও সাধন করতে পারবে না। সাধারণ মানুষের ভুল বোঝাবুঝিকে দূর করার জন্য এ ব্যাপারে কোরআনুল কারীমের শিক্ষাকে বিস্তৃতভাবে তুলে ধরা দরকার।
কোরআনুল কারীমের মূল শিক্ষার প্রতি গভীরভাবে তাকালে এ কথা অবশ্যই মেনে নিতে হবে যে, মানুষের মুক্তি ও কামিয়াবী অর্জনের অসংখ্য নির্দেশ আল- কোরআনে রয়েছে। কিন্তু এই নির্দেশাবলীর সকল স্থানেই ঈমান এবং নেক আমলকে পরস্পর নির্ভরশীল বলে সাব্যস্ত হয়েছে। মানুষের মুক্তি ও সফলতার জন্য আল- কোরআনের সর্বত্রই প্রথম ঈমানকে এবং তারপরে নেক আমলকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “কালের শপথ। প্রকৃতই মানুষ ক্ষতিগ্রস্ততার মাঝে নিমগ্ন; কিন্তু তাদের ছাড়া, যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে।” (সূরা আসর : রুকু-১)।
কালের খাতায় ইতিহাসের পাতায় এমন বহু ঘটনার কথা সমুজ্জ্বল হয়ে রয়েছে যে, আল্লাহর ওপর বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য উন্নতি, অগ্রগতি এবং কামিয়াবির দুয়ার সর্বদাই খোলা ছিল। এই বিশ্বাসের পরিপূর্ণতার জন্য নেক আমলেরও প্রয়োজন আছে। অপর এক আয়াতে আল্লাহপাক ঘোষণা করেছে, “অবশ্যই আমি মানুষকে সুন্দরতম আকৃতিতে পয়দা করেছি। তারপর তাকে নি¤œতম পর্যায়ে নিক্ষেপ করেছি। কিন্তু ঈমানদার ও নেক আমলকারীদেরকে নয়। সুতরাং তাদের জন্য রয়েছে অফুরন্ত পুরস্কার।” (সূরা তীন : রুকু-১)
এই আয়াতের দ্বারা সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, মানুষ স্বীয় কাজকর্মের দ্বারা নি¤œ হতে নি¤œতর পর্যায়ে অবনমিত হয়ে যায়। কিন্তু এই নিকৃষ্টতম পর্যায়ের কোনোই শেষ সীমা নেই। অপকর্মের কুফল শুধু কেবল বর্তমান সময়ের জন্যই নয় বরং অনাগত ভবিষ্যৎকেও অন্ধকারময় করে তোলে। বস্তুত এখান হতেই ঈমানের সমুন্নত অবস্থা এবং নেক আমলের বিশেষ মর্যাদার কথা অনুধাবন করা যায়।
এ পর্যায়ে আল-কোরআনে ইহুদি সম্প্রদায়ের স্বভাবকে তুলে ধরে ঘোষণা করা হয়েছে, তারা দাবি করত জান্নাত কেবলমাত্র ইহুদিদের জন্যই নির্ধারিত। কিন্তু তাদের সেই দাবি যে ভিত্তিহীন এবং ভুয়া তার স্বরূপ উদ্ঘাটন করে আল-কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “কিন্তু যারা ঈমানদার এবং নেক আমলকারী, জান্নাত তাদেরই জন্য নির্ধারিত।” মোটকথা, জান্নাত লাভের ব্যাপারটি বংশ এবং সম্প্রদায় বিশেষের জন্যই নির্ধারিত নয়। বরং জান্নাত লাভের জন্য যা একান্ত প্রয়োজন, তা হলো ঈমান এবং নেক আমল। যে ব্যক্তি ঈমান আনয়নের পর নেক আমল করবে, সদানুষ্ঠানে নিজের জীবনকে অতিবাহিত করবে, তারাই হবে জান্নাতের হকদার। আল-কোরআনে স্পষ্টতই বলে দেয়া হয়েছে যে, “নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে এবং ইহুদি, সাবেঈন ও নাসারাদের মাঝে যারা আল্লাহ ও আখেরাতের ওপর ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে, তাদের কোনোই ভয় নেই এবং তারা চিন্তান্বিত ও হবে না।” (সূরা মায়িদাহ : রুকু-১০)
এই আয়াতের মমকর্থাও একই যে, জান্নাত লাভের ব্যাপারটি বংশ এবং গোত্রের ওপর নির্ভরশীল নয়। বরং আহকামে ইলাহীর ওপর বিশ্বাস করা এবং সে মোতাবেক আমল করাই হচ্ছে জান্নাত লাভের একমাত্র উপায়। ঈমানহীনতা ও পাপ কাজের চূড়ান্ত ফল হচ্ছে আখেরাত বরবাদ হয়ে যাওয়া। পক্ষান্তরে ঈমান ও নেক আমলের ফল হচ্ছে দ্বীন ও দুনিয়ার মঙ্গল লাভ করা। মহান আল্লাহপাকের এটাই হচ্ছে স্বাভাবিক কানুন। এই নিয়মনীতির মাঝে চুল পরিমাণ ব্যতিক্রমও হয় না। সুতরাং জুল-কারনাইনের জবানীতে আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন। “তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি গোনাহের কাজ করেছে, অচিরেই আমি তাকে আজাবে নিপতিত করব, তারপর তাকে তার প্রতিপালকের দরবারে প্রেরণ করা হবে, সুতরাং তাকে নিকৃষ্টতম আজাব দেয়া হবে, পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে, তার জন্য রয়েছে সম্মানজনক প্রতিফল।” (সূরা কাহাফ : রুকু-১২)
অপর এক আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছেÑ “যে ব্যক্তি নেক আমল করে এবং সে মুমিন, তবে তার পরিশ্রম বৃথা যাবে না; এবং অবশ্যই আমি তার নেক আমলকে লিপিবদ্ধ করে রাখি।” (সূরা আম্বিয়া : রুকু-৭) অন্যত্র আল্লাহপাক আরো ঘোষণা করেছেন, “সুতরাং তাদের পরে তাদের এমন সব উত্তরাধিকারী হয়েছে যারা সালাতকে বরবাদ করেছে, নফসের খাহেশ অনুযায়ী পথ চলেছে, তবে তারা পথভ্রষ্টতার সাথেই মিলিত হবে। কিন্তু যারা তওবাহ করেছে, ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে সুতরাং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের ওপর বিন্দুমাত্রও জুলুম করা হবে না।” (সূরা মারইয়াম : রুকু-৪)
এই আয়াত এবং সমপর্যায়ের অন্যান্য আয়াত দ্বারা একথা সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, জান্নাতের হকদার কেবল তারাই, যারা ঈমানদার এবং ঈমানের চাহিদা মোতাবেক নেক আমলের দ্বারা জীবনকে সুন্দরতম করে গড়ে তুলেছে। একই সাথে যাদের মাঝে এই যোগ্যতা নেই তারা আল্লাহপাকের রহমত ও বরকত হতেও বঞ্চিত থাকবে। আল-কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “এবং যারা ঈমান এনেছে ও নেক আমল করেছে, তারা জান্নাতের বাগানসমূহে অবস্থান করবে এবং তারা আল্লাহর কাছে যা চাইবে, তা-ই লাভ করবে এবং এটাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ মেহেরবাণী। আল্লাহর পক্ষ হতে এই খোশ-খবরী ঐ সকল বান্দাদের জন্য যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে।” (সূরা শু’রা : রুকু-২) আল-কোরআনের অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে, “অবশ্যই যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে, তাদের জন্যই জান্নাতুল ফেরদাউসের আতিথ্য।” (সূরা কাহাফ : রুকু-১২)
এরপর আল্লাহপাক আরও ইরশাদ করেছেন, “যে ব্যক্তি স্বীয় পরওয়ারদিগারের সাথে মিলনের আশা রাখে তবে সে যেন নেক আমল করে এবং আল্লাহর ইবাদতে কাউকেও যেন শরীক না করে।” (সূরা কাহাফ : রুকু-১১)
ঈমান আনয়ন করার পর নেক আমল হতে মাহরুম থাকার কথা কল্পনাই করা যায় না। আসল কথা হচ্ছে এই যে, যেক্ষেত্রে আমলের স্বল্পতা দেখা দিবে সে ক্ষেত্রে পরিমাণ অনুপাতে ঈমানের দুর্বলতাও প্রকট হয়ে দেখা দেয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। পক্ষান্তরে কোন জিনিসের ওপর পূর্ণ বিশ্বাস গ্রহণের পর এর বিপরীত কাজ করা প্রকৃতিবিরুদ্ধ। আগুন তৃণখ-কে জ্বালিয়ে দেয়। একথা বিশ্বাস করার পর কেউ কি আগুনে নিজের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে? কিন্তু অবুঝ শিশু যে আগুনের দাহিকা শক্তি সম্পর্কে অজ্ঞ, সে হয়ত আগুনে হাত বাড়িয়ে দিতে আগ্রহী হতে পারে। সুতরাং আমলের ক্ষেত্রে দুর্বলতাকেই প্রতিভাত করে।
এ কারণেই শুধু ঈমান অথবা শুধু আমলকে নয়, বরং সকল স্থানেই ঈমান এবং আমল উভয়কে মিলিয়েই নাজাতের পথ সুগম হতে বাধ্য। পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে, তারা নেয়ামতপূর্ণ জান্নাতে অবস্থান করবে।” (সূরা হজ্জ : রুকু-৭)
অনুরূপভাবে পবিত্র কোরআনে সামান্য শাব্দিক পরিবর্তনসহ প্রায় ৪৫টি স্থানে এই নির্দেশ রয়েছে- যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে.......। এ সকল নির্দেশাবলী দ্বারা সার্বিকভাবে একথা প্রতিপন্ন হয় যে, ইসলামের দৃষ্টিতে ঈমান এবং আমল পরস্পর সম্পূরক ও অপরিহার্য মিলিত রূপ। এ দুটোর একটিকে অপরটি হতে কোনক্রমেই পৃথক করা যায় না। পরকালে নাজাত, নিষ্কৃতি, উন্নতি ও কামিয়াবীর মূল মানদ- এ দু’টির উপর সমভাবে নির্ভরশীল। সামান্যতম পার্থক্য যা লক্ষ্য করা যায়, তাহলো মর্যাদার ব্যাপার। মর্যাদার ক্ষেত্রে ঈমানকে আমলের উপর স্থান দেয়া হয়েছে মাত্র।
যে সকল বিশ্বাসী বান্দাহদের জন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুনিয়াবী হুকুমত ও সালতানাতের ওয়াদা ও অঙ্গীকার করেছেন, তারাও ঐ শ্রেণিভুক্ত যারা ঈমানের সাথে নেক আমলেরও পাবন্দ। আল-কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “তোমাদের মাঝে যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে, আল্লাহপাক ওয়াদা করেছেন যে, তাদেরকে যমীনের বুকে প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন।” (সূরা নূর : রুকু-৭) আখেরাতের মাগফেরাত ও শুভ জীবিকার অঙ্গীকারও তাদের স্বপক্ষেই করা হয়েছে। আল-কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “আল্লাহপাক তাদের মাঝে যারা ঈমান এনেছে, নেক আমল করেছে, তাদের প্রতি ওয়াদা করেছেন যে, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মাগফেরাত এবং বৃহত্তর বিনিময়।” (সূরা ফতহ : রুকু-৪)
কোন কোন আয়াতে ঈমানের পরিবর্তে ইসলাম অর্থাৎ আনুগত্যকে এবং আমলে সালেহের স্থলে ইহসান অর্থাৎ পুণ্যকর্মকে স্থানদান করা হয়েছে। উদাহরণ- একটি আয়াতে ইহুদী ও নাসারাদের এ দাবি যে, “জান্নাতে শুধু কেবল তারাই প্রবেশ করবে” বাতিল করে দেয়া হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, “হ্যাঁ, যে কেউ আল্লাহর নিকট সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করে এবং সৎকর্মপরায়ণ হয়, তার ফল তার প্রতিপালকের নিকট রয়েছে এবং তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।” (সূরা বাকারা : রুকু-১৬)
সুতরাং এ সকল আয়াতসমূহের দ্বারা এই নিয়মতান্ত্রিকতা প্রতিষ্ঠিত হয় যে, মুক্তির উপায় শুধু কেবল ঈমানের উপরই নির্ভরশীল নয়, বরং ঈমানের সাথে আমলে সালেহও থাকতে হবে। আর এটা অত্যন্ত স্পষ্ট কথা যে, ইসলামপূর্ব মাজহাবগুলোতে কম-বেশির মাত্রা ছিল প্রকট। পৌলের পত্রাবলী অনুসারে জানা যায় যে, খ্রিস্টানদের মতে মুক্তি লাভের উপায় শুধুমাত্র ঈমানের উপরই নির্ভরশীল। বৌদ্ধ ধর্ম অনুসারে বলা হয়, কেবলমাত্র পুণ্যকর্মের দ্বারাই নির্বাণ লাভ করা যায়। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে ধ্যান-ধারণাকে মুক্তিলাভের পথ বলে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু ইসলামের পয়গাম্বর (সা.)-এর পয়গাম মানুষের নাজাতের উপায় হিসেবে আত্মিক ঈমান এবং দৈহিক নেক আমল উভয়ের সম্মিলিতরূপকে সাব্যস্ত করা হয়েছে।
অর্থাৎ প্রথম জিনিস হচ্ছে এই যে, আমাদের নিয়ম-নীতিসমূহ বিশুদ্ধ হওয়ার একীন ও বিশ্বাস হবে। তাকে ঈমানি বলা হয়। আর দ্বিতীয় জিনিস হচ্ছে সেই নিয়ম-নীতি মোতাবেক আমাদের আমল ও কাজ সহীহ ও বিশুদ্ধ হবে। এটাই আমলে সালেহ। সকল প্রকার কামিয়াবীর ভিত্তি এ দু’টি জিনিসের উপর নির্ভরশীল। কোন রুগ্ন ব্যক্তি শুধু কেবল ডাক্তারি নিয়ম-নীতিকে সহীহ বলে মানলে রোগ-বালাই থেকে মুক্তিলাভ করতে পারে না। যতক্ষণ না সে সেই নিয়ম-নীতি মোতাবেক আমল না করে। অনুরূপভাবে শুধু ঈমানের নিয়ম-নীতিকে স্বীকার করে নেয়া মানবিক মুক্তি ও কামিয়াবীর জন্য যথেষ্ট হতে পারে না। যতক্ষণ না সেই নিয়ম-নীতি মোতাবেক পরিপূর্ণ আমল করা হয়। আল-কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “অবশ্যই ঐ সকল মু’মিন সফলকাম হয়েছে, যারা স্বীয় নামাজে একান্তই প্রণত, যারা বেহুদা কাজ-কর্মের প্রতি পৃষ্ঠ প্রদর্শনকারী এবং যারা যাকাত আদায়ে তৎপর এবং যারা নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে ....... এবং যারা স্বীয় আমানত এবং অঙ্গীকারের প্রতি সযতœ সচেতনতা অবলম্বন করে এবং যারা স্বীয় নামাজের হেফাজত করে, আর এই সকল লোকই (জান্নাতের) ওয়ারিস।” (সূরা মু’মিনুন : রুকু-১)
এই পৃথিবীতে মহান আল্লাহপাক প্রতিটি বস্তুকে আমাদের উপাদানভিত্তিক কার্যকারণের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। এখানকার উন্নতি, অগ্রগতি, কামিয়াবী, মুক্তি ও সৌভাগ্য শুধু কেবল আত্মিক বিশ্বাস এবং ঈমানের দ্বারাই হাসিল করা যায় না, যতক্ষণ না এই আকীদাহ ও বিশ্বাস মোতাবেক আমল করা না হয়।
শুধু এই বিশ্বাস যে, রুটি আমাদের ক্ষুধার সার্বিক এলাজ, তা আমাদের ক্ষুধা নিবৃত করতে পারে না। কিন্তু এর জন্য আমাদের চেষ্টা পরিশ্রম ও সাধ্য-সাধনা করে রুটি অর্জন করতে হবে এবং এই রুটি চিবিয়ে ঢোক গিলে উদরস্থ করতে হবে। আর এই বিশ্বাস যে আমাদের পা আমাদেরকে একস্থান হতে অন্যস্থানে নিয়ে যেতে পারে এই বিশ্বাস আমাদেরকে একস্থান হতে অন্যস্থানে নিয়ে যেতে পারে না, যতক্ষণ না আমরা এই বিশ্বাসের সাথে দু’পায়ের হরকত বা পদচারণায় উদ্বুদ্ধ হই। একই অবস্থা আমাদের জাগতিক অন্যান্য কাজ-কর্মের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য একারণেই এই পৃথিবীতে আমল ছাড়া শুধু ঈমানী কামিয়াবী অর্জনের ক্ষেত্রে অচল ও বেকার। তবে এতটুকু ঠিক যে, যারা এই নিয়ম-নীতিসমূহকে বিশুদ্ধ বলে বিশ্বাস করে, তারা ঐ সকল লোক হতে উত্তম যারা এগুলোকে মোটেই মানে না। কেননা এদের মাঝে প্রথম শ্রেণিটির কখনো না কখনো সঠিক পথে আগমন করা এবং নেক আমল পালন করার নিশ্চয়তা ও আশা আছে। আর দ্বিতীয় শ্রেণিটির ক্ষেত্রে যেহেতু প্রথম ধাপই অনুপস্থিত এ জন্য আখেরাতেও তারা অস্বীকারকারীদের মোকাবেলায় হয়ত আল্লাহপাকের ফজল ও করম লাভের অধিক উপযোগী হবে। কেননা তারা কমসে-কম সেই ফরমানকে সঠিক বলে ধারণা করেছিল।
নেক আমলের প্রকার ভেদ :
আমলে সালেহ বা নেক আমলের পরিধি খুবই বিস্তৃত। এর মাঝে মানবিক উত্তম কর্মকা-ের যাবতীয় শাখা-প্রশাখা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যার একমাত্র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও খোসনুদী অর্জন করা। এতদসত্ত্বেও নেক আমলের সামগ্রিক তিনটি শ্রেণি রয়েছে। যথা (১) ইবাদত, (২) আখলাক এবং (৩) মোয়ামালাত।
ইসলামী পরিভাষা অনুসারে ‘ইবাদত’ শব্দটি খুবই বিস্তৃত। এর মাঝে ঐ সকল প্রতিটি কাজই জড়িত আছে, যেগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর খোশনুদী অর্জন করা। এ জন্য আখলাক ও মোয়ামালাতও যদি নেক নিয়তের সাথে পালন করা হয়, তাহলে এগুলোকেও ইবাদত বলে গণ্য করা হবে।
কিন্তু ফিকাহবিদগণ তাদের পরিভাষায় এই তিনটি শ্রেণির জন্য পৃথক পৃথক অধ্যায় রচনা করেছেন। যার সম্যক বিবরণ এভাবে পেশ করা যায়। প্রথমত, নেক আমল দু’ভাগে বিভিক্ত। (১) যেগুলোর সম্পর্ক খাসভাবে আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত, এগুলোকে ইবাদাত বলে। (২) যেগুলোর সম্পর্ক বান্দাহদের সাথে সম্পৃক্ত সেগুলো আবার দু’ভাগে বিভক্ত, যথা (ক) যেগুলো মানবিক দায়-দায়িত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং (খ) যেগুলো আইনগত জিম্মাদারী বলে বিবেচিত। এর প্রথমটিকে আখলাক এবং দ্বিতীয়টিকে মোয়ামালাত বলা হয়। নেক আমলের এই তিনটি শ্রেণির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পর্যায়ক্রমে উপস্থাপন করতে আমরা প্রয়াসী হব।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ