বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
কালাম ফয়েজী
পলাশীর প্রহসনমূলক যুদ্ধে (২৩ জুন ১৭৫৭) বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর যখন লর্ড ক্লাইভের নেতৃত্বে ইংরেজ বাহিনী মুর্শিদাবাদ শহরে প্রবেশ করছিল, তখন রাস্তার দু’পাশে অগণিত লোক দাঁড়িয়ে ছিল এবং নীরব দর্শকের মতো ইংরেজদের আগমন চেয়ে চেয়ে দেখেছিল। লর্ড ক্লাইভ পরবর্তীতে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেনÑ ‘রাস্তার দু’পাশে যারা দাঁড়িয়ে ছিলেন তারা যদি একটা করেও ইট নিক্ষেপ করতেন, আমরা ইটের স্তূপের নিচে তলিয়ে যেতাম’।
আসলে সিরাজের বাহিনী বা মুর্শিদাবাদের অধিবাসীদের মতো তখন নবাব সিরাজুদ্দৌলাও ছিলেন হতবিহ্বল এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কী করলে কী হবে, কিছু করা সম্ভব কিনা এত বেইমানকে ঠেলে বা পাল্টা হামলার নেতৃত্বই বা দিবে কে, কাকে তিনি ভারার্পণ করে আত্মগোপন করবেন এমন অগুছালো অবস্থায় জনসমর্থন যতই থাকুক না কেন, সেটা দিয়ে কার্যকরী কোন পদক্ষেপ নেয়া যায় না। নেতৃত্ব দেয়ার জন্য আগে থেকে প্রস্তুত থাকা লাগে। কিন্তু যে নেতৃস্থানীয়দের প্রস্তুত থাকার কথা তারা যদি বিশ্বাসঘাতকতায় লিপ্ত হয়, তাহলে আর কার পক্ষে কীই বা করা সম্ভব!
ঠিক এর আগের ঘটনাও এ রকম। তুর্কিবীর ইখতিয়ার উদ্দিন বিন বখতিয়ার খিলজীর নেতৃত্বে তুর্কিবাহিনী যখন নদীয়া বা নবদ্বীপ আক্রমণ করেন (১২০৪) তখনও নদীয়ার লোকজন ছিল অপ্রস্তুত। লক্ষণ সেন তখন দুপুরের পানাহারে নিয়োজিত ছিলেন। পরিস্থিতি বুঝে ওঠার আগেই মাত্র ১৮ জনের অশ্বারোহী বাহিনী নদীয়া দখল করে ফেলল। আসলে গৌড় ছিল সেন রাজাদের প্রাচীর ঘেরা সুরক্ষিত রাজধানী। আর নবদ্বীপ ছিল গঙ্গার তীরবর্তী একটি পবিত্র শহর। কেবল পূজা পার্বণে সেন রাজারা এখানে অবস্থান নিতেন। পূজা শেষ হয়ে গেলে পুনরায় গৌড়ে ফিরে যেতেন।
যখন নদীয়া আক্রান্ত হয় ততদিনে কর্ণাটক বিহারসহ অন্যান্য অঞ্চল মুসলিম দখলে চলে আসে। নবদ্বীপ আক্রান্ত হলে লক্ষণসেন পাল্টা আক্রমণের ব্যবস্থা না করে নৌকায় চড়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পূর্ববাংলায় পালিয়ে আসেন। তার ধারণা ছিল, পাল্টা আক্রমণ করে তিনি কুলিয়ে উঠতে পারবেন না। আর মুসলিম বাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য আগে থেকে তার প্রস্তুতিও ছিল না। সে যাই হোক, বাংলা যেভাবে ১২০৪ সালে মুসলিম দখলে আসে, প্রায় কাছাকাছি প্রক্রিয়ায় সেটা পুনরায় ইংরেজ দখলে চলে যায়। এ ক্ষেত্রে সে সময়কার নিমকহারাম, বেঈমান, বিশ্বাসঘাতকদের ভূমিকাও কম ছিল না।
রাবণরাজত্ব বেদখলে ধার্মিক বিশ্বসঘাতক ভাই বিভীষণের যেমন ভূমিকা ছিল তেমনি বিএনপির মতো একটি অতীব শক্তিশালী ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পেছনেও বিশ্বাসঘাতক নিমকহারামদের একই তৎপরতা কার্যকর ছিল।
সার্কভুক্ত সাতটি দেশের মধ্যে শ্রীলংকা ও বাংলাদেশ সমুদ্র তীরবর্তী এবং উৎপাদনশীল দেশ হওয়ায় উৎপাদন উন্নয়নে বেশ এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু পার্শ্ববর্তী বড় দেশের সেটা সহ্য হচ্ছিল না। এ জন্য শ্রীলংকার অগ্রগতি ঠেকানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে তামিলদের লেলিয়ে দেয়া হয়। তেমনি বাংলা ও অন্যান্য ছোট দেশের উন্নয়ন উৎপাদন ও সমৃদ্ধিকে ঠেকিয়ে দেয়ার জন্যও কৌশলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল তাবেদার গোষ্ঠীকে ক্ষমতারোহণের সুযোগ করে দেয়া হয়। বাংলাদেশে যদি প্রকৃত ভোটাভুটির মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় যাবার প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে বোধ করি আওয়ামী লীগের পক্ষে এত বড় বৈতরণী পার হওয়া কিছুতেই সম্ভব না।
স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত জনগণতান্ত্রিক দল ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। পরে অবশ্য মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয়। ১৯৪৯ সালের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই যুগপথভাবে গণতন্ত্রের জন্যই আন্দোলন করে আসছিল এ দলটি। তাদের দাবি ছিল জমিদার বুর্জোয়া ধনিক শ্রেণি নয়, নির্বাচিত সাধারণ শ্রেণিই হবে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রকৃত হকদার। সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এক সময় স্বাধিকার আদায়ের যুদ্ধে নেমে পড়ে এ দল ও দেশের মানুষ। কিন্তু দুর্ভাগ্য স্বাধীনতা লাভের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলেও সরকারের অভ্যন্তরীণ চরিত্রে কোনো পরিবর্তন এলো না। শেখ মুজিব নিজে জনমানুষের নেতা হয়েও ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য মুসলিম লীগ নেতাদের মতই পদক্ষেপ নিলেন। প্রথমে হলেন প্রধানমন্ত্রী, তারপর প্রেসিডেন্ট। তাতেও সন্তুষ্ট থাকলেন না তিনি। স্বাধীনতার মূলমন্ত্র গণতন্ত্রকে হত্যা করে সকল রাজনৈতিক দল বাজেয়াপ্ত করে একমাত্র দল হিসেবে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করলেন এবং সমালোচনার পথ রুদ্ধ করার জন্য চারটি নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা রেখে সকল পত্র-পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দিলেন। দেশের মানুষের জাতীয়তাবোধ ও স্বদেশপ্রেম ধাক্কা খেলো এবং আবেগপ্রবণ জাতি অতি আবেগের জন্য শক্তভাবে নাজেহাল হলো।
শেখ মুজিব নিজে দীর্ঘদিন ধরে গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলে একটা জনমত ও জনস্রোত তৈরি করলেন, আন্দোলন সংগ্রাম করে প্রবাহকে আরও বেগবান করলেন, কিন্তু নিজে ক্ষমতার পাদপীঠে এসে যখন নিজ স্বার্থে খরস্রোতা নদীর উপর বাঁধ দিয়ে বসলেন, তখন স্বাভাবিকভাবে পানির চাপ বাড়তে থাকলো, যার অনিবার্য পরিণতিতে বাঁধ ভেঙে গেল এবং বাঁধ নির্মাণকারীসহ সকলে পানির তোড়ে ভেসে গেল।
বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক দলগুলো স্বাধীনতা লাভের আগে জন্ম নেয় এবং যে দলগুলো পরে জন্ম নেয় এই দুই ধরনের দলের চরিত্রে আকাশ-পাতাল ফারাক। যেমন কমিউনিস্ট পার্টি, জামায়াত, আওয়ামী লীগÑএই দলগুলোর চরিত্রে আগ্রসী মনোভাব বেশি। স্বাধিকার আদায়ের জন্য কট্টর ধারায় আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে তাদের হাতে ও গায়ে রক্তের দাগ লেগে যায়। পরবর্তী সময়ে একই রূপ পরিগ্রহ করে স্বাধীনতার পর গঠিত জাসদের চরিত্রেও। জাসদের নেতাকর্মীরাও শেখ মুজিবের একদেশদর্শী নীতির বিরোধিতা করতে গিয়ে ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের মোকাবেলায় তারাও আগ্রাসী হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে বিএনপি বা জাতীয় পার্টি অনেক কলুষ মুক্ত। এর কারণ, তাদের নির্যাতন নিষ্পেষণ বিরোধী আন্দোলন খুব একটা করার প্রয়োজন হয়নি। কারণ দল দু’টির জন্ম হয়েছে রাজবাড়িতে, কার্যক্রমও পরিচালিত হয়েছে রাজপ্রাসাদ থেকে। প্রতিটি ক্ষেত্রে সৌন্দর্য রক্ষা করে...।
জিয়াউর রহমান আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফ্রন্ট, জাসদ ও বাসদকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন এবং তাদের জনপ্রিয়তা হারানোর কাহিনীও জানতেন। বুঝে শুনেই তিনি নেতিবাচক নীতি গ্রহণ করেননি। বরং ছাত্রদল, যুবদল, মূলদলসহ সকলকে তিনি ধৈর্য শিক্ষা ও সৌন্দর্যের মোড়কে আবৃত করার চেষ্টা করেছেন। জন্মলগ্নে বিএনপির গায়ে জিয়া যে রূপ ও রং তুলির আঁচড় টেনে দিয়েছিলেন, সেই আদর্শ-রূপ-লাবণ্য এখনো বিএনপি বিস্মৃত হয়নি। ফলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে বিএনপির গায়ে যতই কালিমা লেপনের চেষ্টা করুক না কেন, তাদের অপচেষ্টা-অপপ্রচার কোনভাবেই সফল হয়নি। দেশের মানুষ নকশাল, বাকশাল, লালবাহিনী, নীলবাহিনী, সর্বহারা, ছাত্রলীগ, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্র শিবির বলতে যা বোঝে ছাত্রদল বা বিএনপি, জাতীয় পার্টি বলতে তা কখনো বোঝে না। অবশ্য সুবিধা আদায় ও সুবিধা নেয়ার জন্য বিস্তর নেতিবাচক কর্মকা- যে করেনি তা নয়। তবে সেটা সংগঠনের মূল চরিত্রের অংশ নয়। দল দুটোর আসল টার্গেট ক্ষমতায় যাওয়া এবং দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখা। আর আওয়ামী লীগের চরিত্র হলো যে কোনো কৌশলে ক্ষমতায় যাওয়া, ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং অপ্রয়োজনে ছড়ি ঘুরানো। তাতে জনগণ রুষ্ট হোক বা দেশের বারটা বাজুক, তাতে তাদের কিছুই যায় আসে না। আর আগে থেকে জনসমর্থন হারিয়ে ফেলায় তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বাঁকাচোরা পথ ও পদ্ধতি ছাড়া উপায়ই বা কি!
এবার আসা যাক অন্য প্রসঙ্গে। শক্তির উৎস তারুণ্য, টাকা, জ্ঞান ও সংস্কৃতি। এসবের তাৎপর্য আমাদের চেয়ে পার্শ্ববর্তী বুদ্ধিমান দাদারাই ভালো বোঝেন। আমরা জানিÑ একজন তরুণ যুবকের কর্মজীবনে প্রবেশের শ্রেষ্ঠ সময় আঠারো থেকে পঁচিশ। এ সময়ে তাদের যদি কোনভাবে লাইনচ্যুত করে ফেলে যায়, তাহলে তাদের সারা জীবনের সম্পূর্ণ এনার্জি বিপথে চালিত হতে বাধ্য। এজন্য দাদারা আমাদের যুব সমাজকে বিপদগামী করার জন্য সীমান্তের ওপাড়ে শত শত ফেনসিডিল কারখানা স্থাপন করেছেন। এছাড়া সহজে যাতে গাঁজা, হিরোইন, ইয়াবা প্রবেশ করতে পারে সে ব্যবস্থাও আছে যথাযথ। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা নানা বৈষম্য ও অপ্রাপ্তির জন্য হতাশাগ্রস্ত থাকে। এ অবস্থায় যদি সুলভে তাদের হাতে মাদকদ্রব্য চলে আসে তবে তার পরিণাম কী হয় সেটা বলারই অপেক্ষা রাখে না। যে তরুণের চোখজোড়া স্বপ্ন থাকার কথা, জনসেবা ও দেশপ্রেম দ্বারা উদ্বুদ্ধ হবার কথা সেই তরুণরাই যদি অন্যদিকে চালিত হয় তবে বুঝতে হবে তাদের থেকে দেশ প্রেমমূলক কোন কর্ম আশা করতে পারে না। পরিণাম এই, তাদের ভবিষ্যৎও অন্ধকার, দেশের ভবিষ্যৎও অন্ধকার।
আমাদের দেশের মানুষকে বিপথে চালিত করার জন্য এখানে কয়েকটি সংস্থা সরাসরি অর্থ পেয়ে থাকে। তার মধ্যে কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন ও পত্রিকাও আছে। সংস্থাগুলো সব সময় তৎপর থাকে পার্শ্ববর্তী দেশের পলিসি অনুসারে কর্ম করতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরেই থাকে তাদের সমূহ আয়োজন। কারণ তারা জানেÑ এ প্রতিষ্ঠানই সকল কিছুর পীঠস্থান। এখানে আঘাত করলে মুহূর্তে তা ছড়িয়ে পড়বে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। বলা চলে, এ সংস্থাগুলোই আমাদের তরুণ প্রজন্মের মগজ ধোলাইয়ের অন্যতম কারিগর। তারা তাদের নেতিবাচক কর্মকা- পরিচালনার জন্য কৌশলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধেকে ব্যবহার করে। তারা এ-ও জানে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বললে কারও কিছু বলার থাকবে না। [চলবে]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।