মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় দেউলিয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২য় বৃহত্তম ব্যাংক
চলতি সপ্তাহের বুধবারও আর দশটি সাধারণ ব্যাংকের মতো বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিপি), যা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক
হাজার হাজার যুবকের মতো আমিও এই মহামারী চলাকালে আমার বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে চিন্তিত। আমি বিশেষত আমার বাবার বিষয়ে উদ্বিগ্ন, যিনি ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম কারাগার কমপ্লেক্স তিহার জেলের একটি ছোট কক্ষে বন্দি রয়েছেন।
আমার বাবা আলতাফ আহমেদ শাহ, বা আব্বু’র (যেভাবে আমি তাকে ডাকি) তার বয়স ৬৩ বছর এবং তার ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। সুতরাং, তিনি ‘উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ’ শ্রেণিতে আছেন যার জীবন সম্ভাব্য হুমকির সম্মুখীন, আল্লাহ না করুন তিনি করোনভাইরাসের সংস্পর্শে আসেন।
আব্বু ২০১৭ সালের জুলাইয়ে গ্রেফতার হন। কোনও অপরাধমূলক কার্যকলাপের কারণে তিনি কারাগারে নন। তার কারাগারের কারণ হল তার রাজনৈতিক তৎপরতা এবং ভারতীয় শাসিত কাশ্মীরের স্বাধীকারের পক্ষে তার অবস্থান। আমার অসুস্থ আব্বুর রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা দেখে ভয় পেয়ে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র তাকে কারাবন্দী করে, রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে ‘দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর’ অভিযোগ আনে।
আব্বু এই প্রথমবার কারারুদ্ধ হননি। তিনি কাশ্মীরের প্রতিরোধ আন্দোলনকে সমর্থন করার জন্য এবং আমার দাদা সৈয়দ আলী শাহ গিলানির নেতৃত্বে প্রতিরোধপন্থী রাজনৈতিক দল হুরিয়াত কনফারেন্সের সদস্য হওয়ার জন্য বেশ কয়েক বছর বিভিন্ন জেলে কাটিয়েছেন।
তিহার কারাগার কমপ্লেক্সে প্রায় ১৬টি কারাগারে ১৭ হাজারেরও বেশি বন্দি রয়েছে। আব্বু এবং আরও অনেক কাশ্মীরি রাজনৈতিক বন্দিকে কথিত ‘উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ সুরক্ষা ওয়ার্ড’-এ রাখা হয়েছে।
হাই সিকিউরিটি ওয়ার্ডগুলোর কয়েদীদের জন্য পারিবারিক পরিদর্শন পদ্ধতি সাধারণ ওয়ার্ডগুলোর তুলনায় পৃথক, এগুলো সংক্ষিপ্ত হয় এবং অন্যসব দর্শনের পর দিনের শেষে।
২০১৭-২০১৮-এ তিহার জেলে আব্বুর সাথে আমার বৈঠকের সময় আমি তার সাথে আরও দৃঢ় এবং আরও স্নেহময় বন্ধন গড়ে তুলেছিলাম। তিহার সফর করা আমার কাছে প্রতিটি অর্থে চ্যালেঞ্জের চেয়ে বেশি ছিল। প্রতি শুক্রবার আমি সেই জায়গাটিতে ভ্রমণের জন্য নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতাম যা আমাকে ভীত করে তোলে, তবে একই সাথে এটি আমাদের উভয়ের জন্য আধ ঘণ্টার সুখানুভূতি দিত। এ দর্শনগুলো সর্বদা মানসিক আঘাত, ক্লান্তি, ভয়, উদ্বেগ এবং ভয়ে পরিপূর্ণ ছিল।
আমি যখন আব্বুর সাথে দেখা করতে যাই, আমাকে অপেক্ষা করার জায়গায় তিন ঘণ্টার বেশি অপেক্ষা করতে হত, একটি ভাঙা বেঞ্চের কোণে বসে ভীতবিহ্বল থাকতাম। আব্বুকে দেখার একটু সাহস ও হতাশা ব্যতীত অপেক্ষার স্থানে প্রবেশের আগে আমার আর কিছু বহন করার অনুমতি ছিল না।
আমি এবং অন্যরা যখন অপেক্ষায় থাকতাম, ইঁদুর, পোকামাকড় এবং বিপথগামী কুকুর ঘরে লুকিয়ে থাকত। কারাগারের অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতি দেখে আমি অনেকবার অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। ভিতরে তাপ এবং আর্দ্রতা সত্ত্বেও দর্শনার্থীরা এমনকি এক গ্লাস পরিষ্কার পানি পান করতে পেতেন না।
আমি যখনই আব্বুকে জেলের অবস্থা বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতাম, তিনি প্রশ্ন এড়িয়ে যেতেন, তবে তার শারীরিক অবস্থাই বলে দিত। প্রত্যেকবার দেখা করতে গিয়ে তাকে ক্রমেই দুর্বল দেখতে পেতাম এবং তাকে অনেক বেশি বয়সী দেখা যেত, তার চুল এবং দাড়ি সাদা হয়ে গেছে।
রাগের বশে আমি একবার তাকে জিজ্ঞাসা করলাম কেন তিনি এমন একটি জীবন বেছে নিয়েছিলেন যা তাকে এবং আমাদের পরিবারকে এত বড় যন্ত্রণায় ফেলেছে? তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি সৌভাগ্যবান যে, তুমি আমাকে দেখার ও আমার সাথে দেখা করার সুযোগ পাচ্ছ। আমি একই কারাগারে আছি যেখানে আফজাল গুরু এবং মোহাম্মদ মকবুল ভাটকে ফাঁসি দিয়ে কবর দেয়া হয়েছে। তাদের পরিবার তাদের লাশও দেখতে পায়নি। তাদের মৃত্যুর পরেও তারা কারাগারে রয়েছেন’। ভাট ও গুরু ছিলেন কাশ্মীরি যাদের গ্রেফতার এবং ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর’ অভিযোগও করা হয়েছিল; তাদের যথাক্রমে ১৯৮৪ এবং ২০১৩-এ ফাঁসি দেয়া হয়।
আব্বু সর্বদা আমার মনোবল চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করতেন, আমাকে তার মুক্তির দিনটির জন্য আশা এবং প্রার্থনা করতে বলেছিলেন। আমি এ বছর ২১ ফেব্রুয়ারি সর্বশেষ তাকে দেখেছি। এটি সবচেয়ে আবেগময় সফরগুলোর একটি ছিল, কারণ আমি তাকে এক বছরেরও বেশি সময় দেখিনি। ‘আহ! বায়েদ চাহাম গামাইখ্! (আহ! তুমি বড় হয়ে গেছ), তিনি প্রথম যখন হাল্কা আলোয় পরিপূর্ণ ঘরের জানালা দিয়ে আমাকে দেখে বলেছিলেন, তাকে আমার কাছে বয়স্ক মনে হচ্ছিল, তবে আমি তা বলিনি।
এক মাস পর করোনাভাইরাসের কারণে ভারত দেশব্যাপী লকডাউনে গেছে। এসময় কারাগার পরিদর্শন নিষিদ্ধ ছিল। আমার বাবার সম্পর্কে আমার উদ্বেগ আরও বেড়েছে এ কারণে যে, ভারতে বন্দিরা পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা পায় না। ইতোমধ্যে কাশ্মীরি বন্দিদের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি ঘটনায় দেখা গেছে যেখানে মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা অবহেলা করা হয়েছে।
একজন ৫৪ বছরের কাশ্মীরি প্রতিরোধ নেতা পীর সাইফুল্লাহ। ২০১৭ সালে গ্রেফতার হওয়ার আগে তাকে মস্তিষ্কে টিউমারের অপারেশন হয়েছিল। বেঁচে থাকার জন্য তার জীবন রক্ষাকারী ওষুধের প্রয়োজন হয় এবং প্রায়শই কারাগারে অজ্ঞান হয়ে পড়ছিলেন। তবে তিনি আমাকে বলেছিলেন, এখন পর্যন্ত তাকে একবারই চিকিৎসা সহায়তা দেয়া হয়েছে। তার এক হতাশ বার্তায় সাইফুল্লাহ আমাকে লিখেছিলেন: ‘আমি এই কারাগারে মারা যাচ্ছি। আমার দেহ এখন হাল ছাড়ছে, আমি মনে হয় আর বাঁচতে পারব না’।
গত বছরের ডিসেম্বরে ৬৫ বছর বয়সী কাশ্মীরি গোলাম মুহাম্মদ ভাট উত্তর প্রদেশের কারাগারে মারা যান। তাকে কাশ্মীরের জননিরাপত্তা আইনের আওতায় আটক করা হয়েছিল। এটি এমন এক আইন যা ভারতীয় পুলিশকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনও অপরাধ করতে পারে এমন সন্দেহ হলে যে কাউকে আটক করার অধিকার দেয়।
কাশ্মীরের বাইরে কয়েক শ’ কাশ্মীরি বন্দী রয়েছেন এবং তাদের বেশিরভাগই বিচারাধীন বন্দি। তাদের সুস্থতার খবর এবং তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত বার্তা কদাচ কারাগারের বাইরে এসে পৌঁছাতে পারে।
ভারতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কাশ্মীরি রাজনৈতিক বন্দিদের শত শত পরিবারের মধ্যে আরও উদ্বেগ ছড়িয়েছে। আমরা সবাই ভয় করি আমরা হয়তো আমাদের প্রিয়জনদের আর দেখতে পাব না। ভারতে বর্তমানে এ পর্যন্ত সাড়ে ৫ লাখেরও বেশি নিবন্ধিত করোনাভাইরাস সংত্রমণের ঘটনা ঘটেছে এবং কমপক্ষে ১৬ হাজার ৫শ’রও বেশি মানুষ মারা গেছে। মে মাসের শেষদিকে তিহার জেলে প্রথম করোনা সংক্রমণ দেখা গেছে এবং সেখানে ছড়িয়ে পড়ার গুজব রয়েছে।
মার্চ মাসে বন্দিরা এ রোগের পরীক্ষায় পজেটিভ হতে শুরু করার পরে, সুপ্রিম কোর্ট খুব শিগগরিই জনগণের ভিড় হ্রাস করার জন্য মুক্তির আদেশ দেয়। এপ্রিলে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতিকে কারাগার থেকে গৃহবন্দি করা হয়েছিল; জম্মু ও কাশ্মীরের ৬৫ বন্দিকেও মুক্তি দেয়া হয়। তবে এখনও পর্যন্ত আমার বাবা এবং তার সহযোগীদের মুক্তি দেয়া হয়নি, যদিও তাদের বিরুদ্ধে যে কোনও অভিযোগই ভারতের কোনও আদালতে প্রমাণিত হয়নি।
আমার মা, যিনি আব্বুকে গ্রেফতারের পর থেকে খুব অসুস্থ ছিলেন, আমাকে প্রতিদিন কোনও খবর আছে কিনা তা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে আনেন। গত মাসে আমাদের জামিনের আবেদন খারিজ করা হয়, তবে আমার বাবাকে হাসপাতালে পরীক্ষা করানোর জন্য আমাদের আবেদন গৃহীত হয়েছিল। আব্বুকে চিকিৎসা দেয়ার জন্য ১ জুন আদালতের আদেশ জারি করা সত্ত্বেও কারা কর্তৃপক্ষ এখনও তা কার্যকর করেনি।
করোনাভাইরাসে মৃত্যু ও সংক্রমণ আরো বাড়ায় ন্যায়বিচার এবং আমাদের প্রিয়জনকে মুক্ত, জীবিত এবং ভালভাবে দেখতে পাবার আশা ক্রমেই কমে যাচ্ছে।
(লেখক : রুয়া শাহ তুরস্কে সিনেমা ও টিভি বিষয়ে অধ্যয়নরত ভারতের সাবেক সাংবাদিক এবং হুররিয়াত কনফারেন্স নেতা সৈয়দ আলী শাহ গিলানির নাতনী)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।