হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মোহম্মদ আবদুল গফুর : এখন ফেব্রুয়ারি মাস চলছে। আর আমাদের দেশে ফেব্রুয়ারি মানেই ভাষার মাস। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য সংগ্রামের মাস। ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসের অতি গুরুত্বের দাবিদার একটি অধ্যায়। কারণ ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। তাই ভাষা আন্দোলনের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস জানা আমাদের জন্য অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ।
ভাষা আন্দোলন কীভাবে কোন পটভূমিতে শুরু হয়েছিল? অনেকেরই ধারণা, ভাষা আন্দোলন ছিল উনিশশো বায়ান্নর একটি ঘটনা। কারও কারও আবার ধারণা, ভাষা আন্দোলন শুরু হয় উনিশশো আটচল্লিশে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম গভর্নর জেনারেল মুহম্মদ আলী জিন্নাহর উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণার প্রতিবাদে। এর কোনোটাই সত্য নয়। জিন্নাহ সাহেব ঢাকা আসেন ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ। রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বক্তব্য দেন আরও পরে। অথচ ভাষা আন্দোলনের প্রথম সফল অভ্যুদয় সংঘটিত হয় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। এই অভ্যুদয়ের জের চলতে থাকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে জনতার আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠায় পূর্ব পাকিস্তানের তদানীন্তন চিফ মিনিস্টার খাজা নাজিমুদ্দিন অত্যন্ত ভীত শংকিত হয়ে ওঠেন এ কারণে যে, কায়েদে আজম জিন্নাহ যদি এসে ঢাকার এই টালমাটাল পরিস্থিতি দেখতে পান তাহলে তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ চরমভাবে রাহুগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে। এ আশঙ্কায় তিনি পরিস্থিতি শান্ত করার উদ্দেশ্যে ১৫ মার্চ ভাষা সৈনিকদের সব দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে চুক্তিস্বাক্ষর করেন। ফলে আপাতত পরিস্থিতি শান্ত হয়।
প্রশ্ন আসে, ভাষা আন্দোলন যদি বায়ান্ন বা আটচল্লিশে শুরু না হয়ে থাকে, তবে কবে কীভাবে কোন্ পটভূমিতে এ আন্দোলন শুরু হয়? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেতে আমাদের আরও পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। আমরা সবাই জানি প্রায় পৌনে দু’শ বছর বিদেশি শাসনের অবসানে ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। আজকের বাংলাদেশ তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ তখন একটি প্রদেশ হিসেবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রভাষা যে হিন্দি হবে, সে সিদ্ধান্ত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে আগেই ঘোষণা করা হয়। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে আলোচনা চলাকালে এ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা সংস্থা নিখিল ভারত মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়ে যায়।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ এক বিবৃতিতে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেন। সঙ্গে সঙ্গে বহু ভাষাবিদ প-িত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলেন। এখানে উল্লেখ্য যে, তদানীন্তন পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগই ছিল পূর্ববঙ্গের অধিবাসী এবং তাদের মাতৃভাষা বাংলা। অন্যপক্ষে অবিভক্ত উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে হিন্দুদের হিন্দি-প্রীতির বিপরীতে মুসলমানদের উর্দুর প্রতি একটা সহজাত দুর্বলতা ছিল। তা ছাড়া উপমহাদেশীয় মুসলমানদের প্রাচীনপন্থি ও আধুনিকপন্থি উভয় ধরনের শীর্ষ শিক্ষাকেন্দ্র যথাক্রমে দেওবন্দ ও আলীগড় উর্দু অধ্যুষিত এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় উর্দুর প্রতি আমাদের প্রাচীন ও আধুনিক উভয়পন্থী উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে উর্দুর প্রতি একটা সমীহ বোধ ছিল।
শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের বহু অভিজাত ও শিক্ষিত মুসলমান পরিবারে উর্দুতে কথাবার্তা বলা একটা আভিজাত্যের পরিচায়ক বলে মনে করা হতো। অন্যদিকে ঢাকা মহানগরীর আদি অধিবাসীদের মধ্যে উর্দু-বাংলা মিশ্রিত এক ভাষা বহুল প্রচলিত থাকায় তারাও প্রথম দিকে অনেক দিন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনকে খুব সুনজরে দেখেননি। এসব কারণে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনের পথ মোটেই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। এই পটভূমিতে যারা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য আন্দোলনের সূচনা করেন, তাদের যেমন প্রচুর বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়, তেমনি এসব মোকাবেলা করে তাদের এগোতে হয় সাহসিকতার সঙ্গে।
আগেই বলা হয়েছে, ভাষা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা পরে হলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগ থেকেই এ নিয়ে আলোচনা, বাদ-প্রতিবাদ, লেখালেখি শুরু হয়। এসব বাদ-প্রতিবাদ ও লেখালেখিতে অংশগ্রহণ করে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রাবন্ধিক আবদুল হক, কবি ফররুখ আহমদ প্রমুখ। বাঙালি মুসলমান হয়েও যারা উর্দুকে আভিজাত্যের ভাষা বলে মনে করতেন এসব হীনমন্যতাগ্রস্তদের উদ্দেশ্য করে এ সময় কবি ফররুখ আহমদ রচনা করেন “উর্দু বনাম বাংলা” শীর্ষক বিখ্যাত স্যাটায়ার। নিচে সেটি উদ্ধৃত করা হলো :
দুই শো পঁচিশ মুদ্রা যে অবধি হয়েছে বেতন
বাংলাকে তালাক দিয়া উর্দুকেই করিয়াছি নিকা,
বাপান্ত শ্রমের ফলে উড়েছে আশার চামচিকা
উর্দু নীল আভিজাত্য (জানে তা নিকট বন্ধুগণ)।
আতরাফ রক্তের গন্ধে দেখি আজ কে করে বসন?
খাঁটি শরাফতি নিতে ধরিয়াছি যে অজানা বুলি
তার ভাপে চমকাবে একসাথে বেয়ারা ও কুলি
সঠিক পশ্চিমী ধাঁচে যে মুহূর্তে করিব অর্জন।
পূর্ণ মোগলই ভাব, তার সাথে দু পুরুষ পরে
কাবরের বংশ দাবীÑ (জানি তা অবশ্য সুকঠিন
কিন্তু কোন লাভ বলো হাল ছেড়ে দিলে এ প্রহরে)
আমার আবাদী গন্ধ নাকে পায় আজো অর্বাচীন
পূর্বোক্ত তালাক সূত্রে শরাফতি করিব অর্জন।
নবাবী রক্তের ঝাঁজ আশা করি পাবে পুত্রগণ।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রশ্নে এ ধরনের লেখালেখি এবং বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্য প্রভৃতির পালা চলতে থাকে। আজাদী লীগ, পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ প্রভৃতি দু-একটা স্বল্পায়ু প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হলেও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো সুপরিকল্পিত উদ্যোগ সর্বপ্রথম গ্রহণ করে ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রতিষ্ঠিত তমদ্দুন মজলিস নামের একটি সাংস্কৃতিক সংস্থা। এই সংস্থার উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয় ভাষা আন্দোলনের মেনিফেস্টোরূপী ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ নামের একটি পুস্তিকা। এই পুস্তিকায় স্থান পায় বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, বিশিষ্ট সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবদুল মনসুর আহমদ এবং তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের তরুণ লেকচারার অধ্যাপক আবুল কাসেমের তিনটি নিবন্ধ।
তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে প্রকাশিত ওই পুস্তিকার প্রথম নিবন্ধই ছিল অধ্যাপক আবুল কাসেমের। তাঁর (মজলিসের পক্ষ হতে লিখিত) “আমাদের প্রস্তাব” শীর্ষক নিবন্ধে ভাষা আন্দোলনের মূল দাবি উত্থাপিত হয় এভাবেÑ
“১। বাংলা ভাষাই হবে
(ক) পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন
(খ) পূর্ব পাকিস্তানে আদালতের ভাষা
(গ) পূর্ব পাকিস্তানের অফিসাদির ভাষা।
২। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রভাষা হবে দুটি :
উর্দু ও বাংলা।”
সমগ্র রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এই মূল দাবিতেই পরিচালিত হয়। অধ্যাপক আবুল কাসেম তার নিবন্ধে এক পর্যায়ে বলেন, গণপরিষদের প্রত্যেক সদস্যের কাছে ডেপুটেশন নিয়ে তারা যেন বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে মত দিয়ে বাঙালির আত্মহত্যার পথ সুগম না করেন, তা স্পষ্ট বুঝাতে হবে।
আমরা আগেই বলেছি, ভারতের রাষ্ট্রভাষা যে হিন্দি হবে সে সম্পর্কে পূর্ব থেকেই কংগ্রেস সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে সে সম্বন্ধে মুসলিম লীগ কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করায় বিষয়টি অমীমাংসিতই থেকে যায়। এ পরিস্থিতির সুযোগ নেন নতুন রাষ্ট্রের প্রশাসনের উচ্চ স্তরের কর্মকর্তারা।
এদের মধ্যে উর্দু ভাষীদের বিরাট সংখ্যাধিক্য থাকায় রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে মুসলিম লীগ কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা না নেয়া সত্ত্বেও গোপনে গোপনে তারা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রচেষ্টা শুরু করে দেন। তার প্রমাণ পাওয়া যায়, নতুন রাষ্ট্রের পোস্টকার্ড এনভেলপ, মানি অর্ডার ফরম প্রভৃতিতে ইংরেজির পাশাপাশি শুধু উর্দুর ব্যবহার থেকে।
এই প্রেক্ষাপটে নবগঠিত সাংস্কৃতিক সংস্থা তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে দেয়া হয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশ করেই মজলিস বসে থাকেনি। এ দাবিকে শিক্ষিত জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে ব্যক্তিগত যোগাযোগের পাশাপাশি আলোচনা সভা অনুষ্ঠান এবং অন্যান্য কার্যক্রম শুরু করে দেন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল কাসেম। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের কার্যক্রম জোরদার করার লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিজ্ঞান বিভাগের লেকচারার অধ্যাপক নূরুল হক ভুইয়াকে কনভেনর করে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। জনাব হাবিবুল্লাহ বাহারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ আলোচনা সভায় আলোচনায় অংশ নেন অধ্যাপক আবুল কাসেম, কবি জসীমউদ্্দীন, কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ। ১৯৪৭ সালের ১৭ নভেম্বর রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মওলানা আকরম খাঁসহ কয়েকশ চিন্তাবিদ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, রাজনীতিক ও ছাত্রনেতাদের স্বাক্ষরসহ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি পেশ করা হয়।
১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর করাচিতে একটি শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের সাধারণ ভাষা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। এর প্রতিবাদে ৬ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আবুল কাসেম। এ সময় পাকিস্তান সেন্ট্রাল পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক ১৫ ডিসেম্বর এক সার্কুলারে বাংলাকে বাদ দিয়ে ইংরেজি, উর্দু, হিন্দি, এমনকি মৃত ভাষা সংস্কৃত ও ল্যাটিনকে পরীক্ষার বিষয়ভুক্ত করায় তার বিরুদ্ধে অধ্যাপক আবুল কাসেম এক বিবৃতি দেন। তখন ঢাকায় কোনো দৈনিক ছিল না। ৩১ ডিসেম্বর কলকাতার দৈনিক ইত্তেহাদে ঐ বিবৃতি এবং এ বিষয়ে “অবিশ্বাস্য” শীর্ষক এক কড়া সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। ওই পত্রিকায় কপি ঢাকায় এলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
আগেই বলা হয়েছে, ঢাকার আদি অধিবাসীরা পূর্ব থেকেই উর্দু-বাংলা মিশ্রিত ভাষা ব্যবহার করতেন। বাংলা ভাষা আন্দোলনকে তারা প্রথম দিকে অনেক দিন সুনজরে দেখতেন না। এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে জনাব এস এম তৈফুরকে সভাপতি এবং নবকুমার ইনস্টিটিউশনের হেডমাস্টার জনাব আবদুল মান্নানকে কনভেনর করে ঢাকা মজলিস নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়।
১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাতে বক্তৃতাদানের দাবি তোলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। সে দাবি প্রত্যাখ্যাত হওয়ার প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক কাসেমের সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি সাবেক বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগের সোহরাওয়ার্দী-হাশিম সমর্থক অংশ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে একটি স্বতন্ত্র সংস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এ সংস্থা ভাষা আন্দোলনের সমর্থক হওয়ায় পুনর্গঠিত সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর নির্বাচিত হন যুগপৎ মজলিস ও ছাত্রলীগের সদস্য তমদ্দুন মজলিসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য জনাব শামসুল আলম।
এই সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে বাংলার ন্যায্য দাবি স্বীকারের বিরুদ্ধে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল ও মিটিং-মিছিলের মাধ্যমে ১১ মার্চ প্রতিবাদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়।
১১ মার্চের এ প্রতিবাদ দিবস ব্যাপক সাফল্যম-িত হয়। রেলওয়ে কর্মচারী লীগ এ ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন দেয়ায় ঐ দিন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে খুব কম ট্রেনই রওনা হতে পেরেছে। ঢাকার অবস্থা ছিল আরও নাজুক। সচিবালয়ের চারদিকে কড়া পিকেটিং চলায় খুব কম অফিসার ভেতরে প্রবেশের সুযোগ পান। সে সময় সচিবালয়ের চারদিকে দেয়াল ছিল না, ছিল কাঁটাতারের বেড়া। এ বেড়া ডিঙিয়ে অনেক পিকেটার ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং উপস্থিত সচিব ও অফিসারের কাছ থেকে বাংলা রাষ্ট্র ভাষা না হলে পদত্যাগের ওয়াদা আদায় করে।
পুলিশ কিছু পিকেটারকে গ্রেফতার ও অন্যদের ওপর লাঠিচার্জ করায় বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা আরও বেড়ে যায় এবং সমগ্র এলাকা বিক্ষুব্ধ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। সচিবালয়ের চারদিকের এ অরাজক অবস্থা চলে কয়েক দিন ধরে। প্রাদেশিক চিফ মিনিস্টার খাজা নাজিমুদ্দিন ভড়কে গিয়ে ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সব দাবি মেনে নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ফলে পরিস্থিতি আপাতত শান্ত হয়।
যে খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সব দাবি মেনে নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেন, তিনিই কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরবর্তীকালে ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেয়ায় জনগণের কাছে তিনি বিশ্বাসঘাতক প্রতিভাত হন। তাঁর এ ঘোষণার প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সারা পূর্ব পাকিস্তানে এ ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় নবগঠিত সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে। একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার দাবিতে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশি গুলিবর্ষণে শহীদ হন রফিক, বরকত, সালাম, জব্বার প্রমুখ। তাদের রক্তদানের মধ্যদিয়ে ভাষা আন্দোলন এক অনন্য অপ্রতিরোধ রূপ ধারণ করে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।