বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
আল্লাহ তাআলার অশেষ শুকরিয়া। তিনি মুসলমানকে ইসলামের মতো পূর্ণাঙ্গ দ্বীন দান করেছেন। নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত আদায় করার পথ ও পন্থা যেমন বলে দিয়েছেন তেমনি লেনদেন, আচার-আচরণ, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন কেমন হবে তাও জানিয়ে দিয়েছেন। বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে দাম্পত্য জীবন ও পারিবারিক জীবনের সূচনা হয়। ইসলামী শরীয়তে এই সম্পর্ক কায়েম করতে হলে যেমন সুনির্ধারিত কিছু বিধান রয়েছে তেমনি প্রয়োজনে এই সম্পর্ক ছিন্ন করতে হলেও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে।
কোরআন-হাদীসে সেগুলো অনুসরণ করারও জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। যদি সেই বিধানগুলো মান্য না করা হয় তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করা হবে, যা একটি মারাত্মক গুনাহ। সাথে সাথে এই অমান্য করার কারণে জীবনের পদে পদে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে এবং অসংখ্য বালা-মুসীবতে নিপতিত হতে হবে, যার বাস্তব নমুনা আমাদের সমাজ জীবনে প্রতিদিন সৃষ্টি হচ্ছে এবং পেপার-পত্রিকায় সেগুলো শিরোনাম হচ্ছে। বিশেষত শরীয়ত পরিপন্থী পদ্ধতিতে তালাক প্রদান করে দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটালে যে পেরেশানি ও জটিলতা সৃষ্টি হয় তা বর্ণনাতীত।
বিবাহ করার উদ্দেশ্য তালাক দেয়া নয় : বিবাহের মাধ্যমে যে দাম্পত্য সম্পর্কের সূচনা হয় তা অটুট থাকা এবং আজীবন স্থায়ীত্ব লাভ করা ইসলামে কাম্য। সুতরাং স্বামী কখনও বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করার চেষ্টা করবে না এবং বিবাহ-বিচ্ছেদের পরিস্থিতিও সৃষ্টি করবে না। কেননা বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন হলে এর কুপ্রভাব শুধু স্বামী-স্ত্রীর ওপর সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং গোটা পরিবারটিই তছনছ হয়ে যায়, সন্তান-সন্ততির জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
কোনো কোনো সময় এই ঘটনার জের পরিবারের গন্ডি অতিক্রম করে বংশীয় কোন্দলে পরিণত হয় এবং সামাজিক জীবনে এর অত্যন্ত খারাপ প্রভাব পড়ে। এজন্য যে সকল কারণে দাম্পত্য সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার উপক্রম হয় সেগুলো দূর করার জন্য ইসলামী শরীয়ত বিভিন্ন বিধান দিয়েছে এবং এ বিষয়ে কোরআন-হাদীসে অনেক নির্দেশনা রয়েছে। প্রথমে বুঝিয়ে-শুনিয়ে সমাধান করতে বলা হয়েছে। এরপর স্ত্রীর সাথে শয্যা ত্যাগ, সতর্ক করা, শাসন করার পথ অবলম্বন করার আদেশ করা হয়েছে।
এতটুকুতে মীমাংসা না হলে উভয় পক্ষে দু’জন শালিস নিযুক্ত করে একটি চূড়ান্ত ফয়সালায় উপনীত হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে। এগুলো হলো দাম্পত্য জীবনে ইসলামী হেদায়েতের অনন্য বৈশিষ্ট্য। আফসোস! আমাদের যদি বোধোদয় হতো এবং ইসলামী নির্দেশনাকে আদর্শ বানাতে পারতাম! সুতরাং আবেগের বশিভ‚ত হয়ে নয়; বরং বুঝে-শুনে, চিন্তা-ফিকির করে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।
স্বামী-স্ত্রীর প্রতি কোরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা : সাধারণত বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ার পিছনে মৌলিক যে কারণগুলো থাকে সেগুলো হলো, স্বামী-স্ত্রী একে অপরের হক যথাযথ আদায় না করা। একজন অন্যজনকে গুরুত্ব না দেয়া। কথায়-কাজে অযথা দ্বিমত পোষণ করা। একে অন্যের প্রতি আস্থা না রাখা, বিশ্বাস না করা। এ সকল কারণে একসময় তাদের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ চরমে পৌঁছে এবং দাম্পত্য জীবন ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়।
সুতরাং উভয়ের কর্তব্য হলো, পরস্পরের হকগুলো যথাযথভাবে জানা এবং তা আদায় করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা। কোনো ক্ষেত্রে দোষ-ত্রুটি হয়ে গেলে তা অকপটে স্বীকার করে নেয়া এবং অতি দ্রুত সেটাকে শুধরে নেয়া। এভাবে সবকিছুকে সহজভাবে মেনে নেয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। তাহলে সম্পর্ক দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হবে। এরকম শুধরে নেয়া ও মেনে নেয়ার অভ্যাস গড়ে না তুললে সামান্য মনোমালিন্যেও অন্তরে প্রচন্ড কষ্ট অনুভব করবে। এখানে স্বামী-স্ত্রীর কিছু শরয়ী হক তুলে ধরা হলো।
স্বামীর ওপর স্ত্রীর হকসমূহ : ১. স্ত্রীর সাথে সর্বদা ভালো আচরণ করা। ২. স্ত্রীর কোনো কথায় বা কাজে কষ্ট পেলে ধৈর্য ধারণ করা। ৩. উচ্ছৃঙ্খল, বেপর্দা চলাফেরা করতে থাকলে নম্র ভাষায় তাকে বোঝানো। ৪. সামান্য বিষয় নিয়ে স্ত্রীর সাথে ঝগড়া-বিবাদ না করা। কথায় কথায় ধমক না দেয়া। রাগ না করা। ৫. স্ত্রীর আত্মমর্যাদায় আঘাত করে এমন বিষয়ে সংযত থাকা। শুধু শুধু স্ত্রীর প্রতি কুধারণা না করা। স্ত্রীর সম্পর্কে উদাসীন না থাকা।
৬. সামর্থানুযায়ী স্ত্রীর খোরপোষ দেয়া। অপচয় না করা। ৭. নামাজ পড়া এবং দ্বীনের আহকাম মেনে চলার জন্য উৎসাহ দিতে থাকা। শরীয়ত পরিপন্থী কাজ থেকে বিরত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করা। ৮. একান্ত নিরুপায় না হলে তালাক না দেয়া এবং প্রয়োজনের ক্ষেত্রে শরীয়ত-গৃহীত অবলম্বন করা। ৯. প্রয়োজন মাফিক থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা। ১০. মাঝে মাঝে স্ত্রীর নিকটাত্মীয়দের সাথে দেখা-সাক্ষাত করার সুযোগ করে দেয়া। ১১. প্রয়োজনে স্ত্রীকে শাসন করা। সতর্ক করা।
স্ত্রীর ওপর স্বামীর হকসমূহ : ১. সর্বদা স্বামীর মন জয় করার চেষ্টা করা। ২. স্বামীর সাথে অসংযত আচরণ না করা। স্বামীকে কষ্ট না দেয়া। ৩. শরীয়তসম্মত প্রত্যেক কাজে স্বামীর আনুগত্য করা। গুনাহ এবং শরীয়তবিরোধী কাজে অপারগতা তুলে ধরা এবং স্বামীকে নরম ভাষায় বোঝানো। ৪. প্রয়োজনাতিরিক্ত ভরণ-পোষণ দাবি না করা। ৫. পরপুরুষের সাথে কোনো ধরনের সম্পর্ক না রাখা।
৬. স্বামীর অনুমতি ছাড়া কাউকে ঘরে ঢোকার অনুমতি না দেয়া। ৭. অনুমতি ছাড়া ঘর থেকে বের না হওয়া। ৮. স্বামীর সম্পদ হেফাযত করা। অনুমতি ছাড়া সেখান থেকে কাউকে কোনো কিছু না দেয়া। ৯. স্বামীকে অসন্তুষ্ট করে অতিরিক্ত নফল নামাজে মশগুল না থাকা। অতিরিক্ত নফল রোজা না রাখা। ১০. স্বামীর আমানত হিসেবে নিজের ইজ্জত-আব্রু হেফাযত করা। কোনো ধরনের খেয়ানত না করা। ১১. স্বামী দরিদ্র কিংবা অসুন্দর হওয়ার কারণে তাকে তুচ্ছ না করা। ১২. শ্বশুর-শাশুড়িকে সম্মানের পাত্র মনে করা। তাদেরকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করা। ঝগড়া-বিবাদ কিংবা অন্য কোনো উপায়ে তাদের মনে কষ্ট না দেয়া। ১৭. সন্তানদের লালন-পালনে অবহেলা না করা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।