বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
মহাবিশ্বের তুলনায় মানুষ এক নগণ্য প্রাণী। নগণ্য বললেও অনেক বেশি বলা হয়ে যায়। বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধান অনুযায়ী, যেখানে পৃথিবীটাই খুঁজে পাওয়া যায় না, সেখানে মানুষ কোন ছাড়।
বিবেচক ও বুদ্ধিমান এ প্রাণীটি কত যে দুর্বল ও ক্ষুদ্র তা পবিত্র কোরআন তুলে ধরেছে। বলা হয়েছে, ‘মানুষের জীবনে কি এমন একটি সময় ছিল না? যখন সে উল্লেখ করার মতো কোনো বস্তু হিসেবে পরিগণিত হতো না’ (আল কোরআন ৭৬ : আয়াত ২)। অনত্র আল্লাহ বলেন, ‘আর মানুষ সৃষ্টিগত ভাবেই দুর্বল’ (আল কোরআন ৪ : আয়াত ২৮)।
মানুষের মৃত্যুর চেয়ে তার বেঁচে থাকাটাই বরং বেশি বিস্ময়কর। মানুষের হায়াত যেমন সীমিত, তার কর্মশক্তি যেমন সীমিত ঠিক তেমনি সীমিত তার শ্রবণ, দৃষ্টি ও অনুভূতিশক্তি। বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, মানুষ তার চর্মচোখে যা কিছু দেখে তা তার চারপাশের প্রকৃতি ও জগতের তিন ভাগ। ৯৭ ভাগই সে খালি চোখে দেখে না। নানা যন্ত্র ও আলোকসম্পাতে আরো এক-আধ ভাগ সে দেখতে পারে বটে, তবে ৯৫ ভাগ সৃষ্টি দুর্বল মানুষেরা কোনোদিনই দেখে না।
মানুষের বোধ ও কল্পনা শক্তিও উপরোল্লিখিত শক্তিগুলোর চেয়ে কিছু বেশি হলেও মহাসৃষ্টির বিশালত্বের তুলনায় খুবই নগণ্য। যে জন্য আল্লাহর রাস‚ল সা. সৃষ্টিজগতের সর্বাপেক্ষা জ্ঞানী বা প্রজ্ঞাবান হওয়া সত্তে¡ও বলেছেন, ‘অতি সামান্য জ্ঞানই আমাকে দেয়া হয়েছে’। অর্থাৎ সর্বজ্ঞ ও পরম জ্ঞানী মহান আল্লাহর সামনে সৃষ্টিজগতের সকলের সব জ্ঞান মহাসিন্ধুর তুলনায় সূচাগ্র বারি বিন্দুও নয়।
পবিত্র কোরআনে এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘বিচারের মাধ্যমে অপরাধীকে হত্যা, খুনের বদলা খুন, আঘাতের সমপরিমাণ প্রত্যাঘাত ও সন্ত্রাসের সম প্রতি বিধান (কিসাস), এর ভেতর রয়েছে তোমাদের জন্য বাঁচার বার্তা।’ অর্থাৎ কিছু মৃত্যু এমন আছে যার মাঝে লুক্কায়িত আছে বহুপ্রাণ। চিন্তাশীলরা এ আয়াত থেকে শিক্ষাগ্রহণ করো।
অন্য জায়গায় বলেন, জুলুমের প্রতিকার সশস্ত্র লড়াই। এতে ঈমানদাররা যেমন জীবন দেবে, জালিমদের জীবন নেবে। এ কাজটি মানবতার স্বার্থেই আল্লাহর বিধানের অন্তর্ভুক্ত। যার কোরআনী পরিভাষা হচ্ছে ‘কিতাল ও জিহাদ’। অবশ্য জিহাদের অর্থ আরো ব্যাপক। আল্লাহ তায়ালা এই কষ্টকর জিহাদের বা সশস্ত্র যুদ্ধের হুকুম দেয়ার পর বলেন, ‘এমন হতে পারে যে, একটি জিনিস তোমরা অপছন্দ করো অথচ সেটি তোমাদের জন্য কল্যাণকর, আর এমনো হতে পারে যে, তোমরা একটি জিনিস পছন্দ করো, অথচ এটি তোমাদের জন্য মন্দ। (আর এর কারণ এই যে) আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না’ (আল কোরআন ২ : আয়াত ২১৬)।
এ আয়াতের সাধারণ ব্যবহার মুফাসসিরগণ করেছেন, জিহাদের ক্ষেত্রে তো এটি আছেই দার্শনিক অর্থে জীবনের প্রতিটি পছন্দ-অপছন্দের ক্ষেত্রেও দুর্বল ও স্বল্পজ্ঞানী মানুষ জানে না কিসে তার মঙ্গল। ভাগ্য তাকে সামান্য কষ্ট দিয়ে বড় যে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে এ কথাটি ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত, (ওয়াল ক্বাদরি খাইরিহি ওয়া শাররিহি মিনাল্লাহি তায়ালা) মানে ঈমানদারের একথা বিশ্বাস করতেই হবে যে, ভাগ্যের কাছ থেকে পাওয়া ভালো ও মন্দ দু’টোই আল্লাহ তায়ালার দেয়া।
পাশাপাশি এ বিশ্বাসও ঈামাদারের জন্য অপরিহার্য যে, আল্লাহ তার ঈমানদার বান্দার কোনো অমঙ্গল কখনোই করেন না। বান্দার দৃষ্টিতে যেটি অমঙ্গল আল্লাহর ফায়সালায় সেটিই মহা কল্যাণের দ্বারোদঘাটন। আল্লাহর তরফ থেকে দেয়া ছোট্ট একটি ‘না পাওয়া’ বিশ্বাসী বান্দার জন্য জীবনের সেরা প্রাপ্তির মহা উদ্বোধন। এ জন্য নিজের মনের বিরুদ্ধে, স্বপ্ন ও কল্পনার বিরুদ্ধে, আশা ও অঙ্কের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া কোনো ‘কেয়ামত’কেও নিরেট মন্দ বলে ধারণা করা মুমিনের কাজ নয়। বিশ্বাসের আলোকে ভাবতে গেলে, এতেই নিহিত রয়েছে অনেক বড় কোনো বৈপ্লবিক বিজয়ের অঙ্কুর।
আল্লাহর প্রতি আস্থাবান ও নিজেকে অক্ষম ও দুর্বল বান্দা হিসেবে যারা ভাবতে পারেন তারা ধ্বংসের মাঝখানে বিধ্বস্ত অস্তিত্ব নিয়েও সাফল্য ও শক্তিমান উত্থানের স্বপ্ন দেখেন। কারণ, তারা মহানবী সা. এ হাদিসের আলোকে চলেন, যেখানে নবী করিম সা. বলেছেন, ‘হতাশা এক ধরনের কুফরি’।
তারা ঈমানের জোরে হতাশা নামক কুফরিকে দূরে সরিয়ে রাখেন। তারা আঘাতে বিচূর্ণ হন, ঘাতকের হাতে নিহত হন, সামগ্রিক লড়াইয়ে ধ্বংস হয়ে যান কিন্তু পরাজিত ও হতাশ হন না। তার বিশ্বাস ভাঙে না। তার সাহসে আঁচ লাগে না। তার লক্ষ্যে বাঁক আসে না। ঈমান ও তাওয়াক্কুল তাকে সটান, সুদৃঢ়, অমর, অক্ষর, অজেয় করে রাখে। ঈমানী হিরোরা ধ্বংস হন কিন্তু পরাজিত হন না। আল্লাহর পথে নিবেদিতরা মরে গেলেও মৃত্যুবরণ করেন না।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ যে কথাটি এভাবে বলেছেন, ‘যারা আল্লাহর পথে জীবন দেয়, তাদের তোমরা অবশ্যই মৃত গণ্য করবে না। তারা জীবিত এবং নিজের রবের নিকট থেকে রিজিক পেতে থাকে’ (আল কোরআন ৩ : আয়াত ১৬৯)। অন্য জায়গায় আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহর রাহে জীবন দেয়, তোমরা তাদের মৃত বলো না, তারা জীবিত কিন্তু তোমরা তা বোঝ না’ (আল কোরআন ২: আয়াত ১৫৪)। সুতরাং একথা বিশ্বাস করতেই হবে যে, বান্দা জানে না কিসে তার মঙ্গল।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।