Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পথ নির্দেশ বিতর্কের অবকাশ নেই

প্রকাশের সময় : ২৮ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
(৮) একের অধিক বিবাহ প্রসঙ্গঃ ইসলাম ধর্মে একজন পুরুষের জন্য একের অধিক অর্থাৎ এক থেকে চারজন মহিলাকে বিবাহ করার বিধান রয়েছে। এতে সঠিকভাবে প্রত্যেকের দাম্পত্ত জীবন পরিচালনা করতে পারলে অনেক পুণ্য ও ছাওয়াব রয়েছে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে ঃ নারীদের মাঝ থেকে তোমাদের যাদের ভাল লাগে তাদের দুইজন, তিনজন কিংবা চারজনকে বিয়ে করে নাও, (সুরা নীসা- আয়াত-৩)। তাই ইসলামে একজন পুরুষ এক থেকে চারজন পর্যন্ত নারীকে স্ত্রী হিসাবে রাখার বৈধতা দিয়েছে। এ জন্য কোন ব্যক্তির যদি শারীরিক ও আর্থিক সচ্ছলতা থাকে এবং সে মনে করে সে চারজন স্ত্রীকে একত্রে শরীয়তের বিধান ও ইনসাফভিত্তিক দাম্পত্ত জীবন পরিচালনা করতে পাবে। তাহলে তার জন্য চারজনকে একত্রে বিবাহ করার অধিকার আছে। অন্যথায় তার জন্য চারজনকে বিবাহ করা বৈধ নয়।
(৯) হালাল মাংস খাওয়া নিয়ে অনেকের মনে নানা প্রশ্নের উকি দেয়। গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি ইত্যাদি মাংস কীভাবে হালাল করা যায়? হালাল করে মাংস খাওয়া নিয়ে যত মাথাব্যথা, প্রাণীটি আদৌ হালাল উপায়ে পাওয়া, না অবৈধ চুরির বা ঠকানো ধন, তা নিয়ে তেমন কোনও চিন্তা নেই। পবিত্র কুরআন বলে ‘হে মানুষেরা, পৃথিবীর মধ্যে যা বৈধ পবিত্র, তা থেকে ভক্ষণ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কর না, নিশ্চয়ই সে তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (০২ : ১৬৮)। তাই হালাল করে খাওয়া মানে প্রাণীটি শুধু ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর’ বলে জবেহ করলে হবে না। প্রথমত প্রাণীটির বৈধ মালিক হতে হবে, এরপর আল্লাহর নামে এমনভাবে জবেহ করতে হবে, যাতে করে প্রাণীটির শরীর থেকে বহমান রক্ত বেরিয়ে যায়। মানুষ মরা প্রাণীর মাংস খায় না, কারণ মৃতদেহের মাংসপেশি দূষিত রক্ত শুয়ে নেয়। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনের কয়েকটি বাণী প্রণিধানযোগ্য। যেমন-‘তিনি  কেবল) তোমাদের জন্য মৃত জীব, শোণিত ও শূকর-মাংস এবং যা আল্লাহ ছাড়া (অপরের) উদ্দেশ্যে নিবেদিত, তা ছাড়া অবৈধ করেননি, বস্তুত যে ব্যক্তি নিরুপায়, আদেশ অমান্যকারী নয় এবং সীমা লঙ্ঘনকারী নয়, নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল করুণাময়।’ (০২ : ১৭৩)। ‘ এবং যার উপর আল্লাহর নাম উচ্চারিত না হয়, তা ভক্ষণ কর না এবং নিশ্চয়ই তা দুঙ্কার্য---।’ (০৬ : ১২১)। আমরা কোনও প্রাণী সৃষ্টি করতে পারি না, তাই খাওয়ার উদ্দেশ্যে বৈধ প্রাণী জবেহ করতে আল্লাহর নাম নিয়ে খালিস মনে ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবেহ করতে হয়, যাতে করে প্রাণীটি অযথা কষ্ট না পায়। অথবা পশু-পাখির মাংস খাই। হিং¯্র পশুর মতো রক্তপান করি না। এটা তো হারাম। তাই জবেহের মাধ্যমে প্রাণীর দেহে বহমান রক্ত যাতে সহজে বেরিয়ে যায়, তার ব্যবস্থা করতে হয়।
(১০) শবেবরাতে আমাদের সমাজে কোনও কোনও জায়গায় মোমবাতি ইত্যাদি দিয়ে আলো জ্বালানো হয়। কারণ, এটা ভাগ্যরাত্রি। অনেকে ভাবেন, আলো জ্বালালে পরবর্তী সারা বছর ভাগ্য ভাল যাবে। অনেকে এ উপলক্ষে ভাল খাবারের ব্যবস্থা করেন। কারণ, এদিন ভাল খেলে নাকি পরবর্তী শবেবরাত পর্যন্ত ভাল খাওয়া যাবে। এ ধরনের অন্ধবিশ্বাস আজও একাংশ মানুষের দ্বারা লালিত, যদিও বর্তমানে শিক্ষার অনেক প্রসার লাভ হয়েছে।
(১১) সেদিন জনৈক বন্ধু বলেছেন যে, তার একজন অমুসলিম অধ্যাপক বন্ধু নাকি তাকে জিজ্ঞোস করেছেন, আপনারা কোন মুসলমান মৃত্যুসংবাদ শুনলে পড়েন ‘ইন্না লিল্লাহি ও ইন্না ইলায়হি রাজিয়ূন’ কিন্তু অমুসলিমদের মৃত্যুসংবাদ শুনলে পড়েন ‘ফি নারি জাহান্নামা খালিদিনা ফিহা’-যে কথাটির অর্থ নাকি ‘তার চিরকাল নরকবাস হোক।’ এভাবে কয়েক মাস আগে আমার জনৈক অমুসলিম বন্ধুর ফোন এলো।  ‘আচ্ছা, অমুসলিম কারও মৃত্যু সংবাদ শুনলে নাকি মুসলিমদের ‘ফি নারি জাহান্নামা খালিদিন ফিহা’ পড়তে হয়। অর্থাৎ সে জাহান্নমের আগুনে যাক। আমি বললাম, ‘তবে মুসলিমের মৃত্যু সংবাদে মুসলিমদের কী পড়তে হয়? অপরপ্রান্ত থেকে জবাব এলো-‘ইন্না লিল্লাহি ও ইন্না ইলায়হি রাজিয়ুন।’ আমি জিজ্ঞাস করলাম, এটা আপনাকে কে বলেছে। উত্তর এলো, ‘আমার গাড়ির মুসলিম ড্রাইভার।’ আমার বড় মনঃপীড়া হলো এই ভেবে যে, ইসলামের সুমহান শিক্ষা অজ্ঞদের হাতে পড়ে কীভাবে বিকৃত হয়ে মানবসমাজে ভুল বার্তা দিয়ে চলেছে। আমি অমুসলিম বন্ধুটিকে বললাম, ইসলাম শিখিয়েছে কোনও বিপদ ঘটলে বা কারও মৃত্যু সংবাদ শুনলে ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজিউন’ পাঠ করতে হয়। এটা পবিত্র কুরআনের শিক্ষা (০২ : ১৫৬)। আর এ মহাবাণীর অর্থ হলো-‘নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর কাছে ফিরে যাব।’ এতে মৃত ব্যক্তিটির বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। এটা পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করা হয়। আর এটাই ইসলামের মূল শিক্ষা। মানুষ কাজেকর্মে, চিন্তাভাবনায় আল্লাহর কাছে আত্মসর্মপণ করে তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলবে। এবারে কথা হলো, অমুসলিমদের মৃত্যু সংবাদ শুনলে পৃথক কিছু পাঠ করার কি কোনও বিধান আছে? এ অর্বাচীনের তো এমন কিছু জানা নেই। আর -----‘ফি নারি জাহান্নামা খালিদিনা ফিহা’ তো পবিত্র কুরআনের একটি বাণী।’ (৯৮ : ০৬)। এটার সঙ্গে কারও মৃত্যু বা মৃত্যু সংবাদে পাঠ করার কোনও সম্পর্ক নেই। হাদিসের গ্রন্থসমূহ থেকে জানা যায়, মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) যে কোনও ব্যক্তির মৃতদেহ নিয়ে যেতে দেখলে দাঁড়িয়ে যেতেন। একবার জনৈক ইহুদি ব্যক্তির মৃতদেহ নিয়ে যেতে দেখে তিনি দাঁড়িয়ে গেলে সাহাবিরা এটা এক ইহুদির মৃতদেহ বলে তাঁকে মনে করিয়ে দিলে তিনি বলেছিলেন, ‘এটা কি এক আত্মা ছিল না?’
(১২) মুসলমানি দেওয়া বলে আমাদের এতদঞ্চলে একটা কথা বহুল প্রচলিত। লালন ফকিরের সেই গানটি প্রায় সবার জানা-‘সুন্নত দিলে হয় মুসলমান, নারীর তরে হয় কি বিধান? বামুন চিনি পৈতে প্রমাণ, বামনি চিনি কিসে রে? সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে? আসলে ছেলেদের খতনা দেওয়া ইসলামে একটি পালনীয় বিধান। এটা একটা বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে একজন পুরুষ মানুষ বিভিন্ন ধরনের সম্ভাব্য রোগ থেকে বেঁচে থাকে। এটার মধ্যে কুসংস্কারের কোনও সুযোগ নেই। এটা শুধু মুসলমান নয়, যে কোনও পুরুষের জন্যই উপকারী। এ নিয়ে কারও মনে সন্দেহ থাকলে চিকিৎসাবিদদের কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন। তবে হ্যাঁ, বাড়ির ছেলেদের খতনা দেওয়া উপলক্ষে অনেকে দাওয়াতের আয়োজন করেন, এটা অবশ্য সুন্নতসম্মত ও প্রতিদানযোগ্য।
(১৩) সারা বিশ্বে মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতানৈক্যের দরুন নানা দল-উপদল রয়েছে। এমনকি আমাদের এতদঞ্চলের মুসলিম সমাজও দলাদলি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত নয়। অনেকে পবিত্র হাদিসের সূত্র উল্লেখ করে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, মহানবী বলে গেছেন যে, মুসলমানদের মধ্যে ৭৩ দল হবে এবং এর মধ্যে কেবল একটি দলই জান্নাতে যাবে, যারা আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহ মেনে চলবে। এতদঞ্জলে সব মুসলমানই কুরআন-হাদিসের অনুসারী। তাই আমরা যে জান্নাতে যাওয়া দলের অন্তভুক্ত, এতে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। কারণ, আমরা সবাই আল্লাহর রস্বিকে ধারণ করে আছি। পবিত্র কুরআন বলে-(১) ‘ তোমরা একযোগে আল্লাহর রস্বিকে সুদৃঢ়রূপে ধারণ কর এবং তোমরা (দলে দলে) বিভক্ত হয়ো না---।’ (০৩ : ১০৩)। (২) হে বিশ্বাস স্থাপনকারীগণ, তোমরা আল্লাহর অনুগত হও ও রাসূলের অনুগত হও এবং তোমাদের মধ্যস্থ আদেশ দাতাগণের; অতঃপর যদি তোমাদের মধ্যে কোনও বিষয়ে মতবিরোধ হয়, তবে আল্লাহ ও রসুলের দিকে প্রত্যাবর্তিত হও-যদি তোমরা আল্লাহ ওপরকালের প্রতি বিশ্বাস করে থাক, এটাই কর‌্যাণকর ও শ্রেষ্ঠতম পরিসমাপ্তি।’ (০৪ : ৫৯)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পথ নির্দেশ বিতর্কের অবকাশ নেই
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ