Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পথ নির্দেশ বিতর্কের অবকাশ নেই

প্রকাশের সময় : ২১ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী
ইসলাম শুধু আচারসর্বস্ব ধর্ম নয়, বরং এক পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। তাই সঙ্গত কারণে মনুষ্য জীবনের এমন কোনও ক্ষেত্র নেই যেখানে ইসলাম অনুপস্থিত। কিন্তু আমাদের সমাজে প্রচলিত অনেক নিয়মাবলী সম্পর্কে সাধারণ মানুষ প্রায়শ ভুল ধারণা পোষণ করেন। সমাজে শিক্ষার প্রসার হলেও বংশানুক্রমে মেনে চলা অনেক নিয়ম সম্পর্কে কিছু মানুষের অজ্ঞতা আমাদের অনেক সময় মনঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ইসলামের অনিন্দ্যসুন্দর জীবন বিধানসমূহ একাংশ নামসর্বস্ব মুসলমানের হাতে ক্রীড়নক স্বরূপ ব্যবহৃত হয়।
(১) মুসলিম সমাজে প্রচলিত পর্দাপ্রথা নিয়ে ভিন্ন ধর্মের এমনকি নিজ ধর্মের অনেকে বিরক্তি প্রকাশ করেন এবং এটাকে মুসলিম মেয়েদের হীনম্মন্যতার কারণ হিসাবে ভেবে থাকেন। কিন্তু পর্দা মেনে চলা বলতে আসলে আব্রু রক্ষা করা বোঝায়। ইসলামি পরিভাষায় যাকে হিজাব বলে। হিজাব মানে চারদেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থেকে নারীর কারাবাস নয়। পর্দা মানেই শুধু কালো বোরকা নয়। বরং হিজাব মানে মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল নির্দেশিত উপায়ে নিজের পার্থিব দেহের রক্ষণাবেক্ষণ, মান-সম্মান, ইজ্জত-আব্রুর হেফাজত করা। সুষ্ঠুভাবে নিজের দেহকে পরপুরুষের কুদৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে রাখা নারীর জন্য শুধু কর্তব্য নয়, বরং গৌরবের বিষয়। কারণ, উপযুক্ত পোশাক পরিধান মানুষ হিসাবে নারীর মর্যাদা বৃদ্ধি করে, নারীকে সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে সহায়তা করে।
(২) ইসলামে বিবাহ নারী-পুরুষের জন্য একটি স্বাধীন পবিত্র চুক্তি, যার মাধ্যমে সুষ্ঠু সমাজ তথা সফল মানবজীবন গঠিত হয়। এখানে বিয়ে করা আর বিয়ে দেওয়া দু’টি আলাদা বিষয় নয়। উপযুক্ত সাক্ষীর মাধ্যমে ইজাব অর্থাৎ প্রস্তাব ও কবুল অর্থাৎ অনুমোদন দ্বারা নারী-পুরুষের মধ্যে বিবাহ সম্পন্ন হয়। পুরুষের মতো নারীও মানুষ, কোনও বস্তু নয়। তাই ইসলামে কন্যাদানের কোনও সুযোগ নেই। বিবাহের বিষয়ে নারী সম্পূর্ণ স্বাধীন। মাতা-পিতা ও অন্যান্য অভিভাবকদের ভূমিকা শুধু পথপ্রদর্শক, ব্যবস্থাপক ও কল্যাণকামী ছাড়া আর কিছু নয়। কোনও নারী যদি রাজি হয়ে মোহরের পরিমাণ স্বীকার করে ইজাব দেয় অর্থাৎ কোনও পুরুষকে বিবাহ করার প্রস্তাব দেয়, কেবল তখনই সে পুরুষটি সে বিশেষ নারীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পেতে পারে। তাই ইসলামী বিবাহে নারীর অধিকার আগে সুরক্ষিত। অথচ আমাদের সমাজ বলে, পুরুষ বিয়ে করে আর নারীর বিয়ে হয়। এটা যে সমাজে গড়ে ওঠা একটা ভ্রান্ত ধারণা, এতে সন্দেহ নেই। তবুও আমাদের সমাজে অনেক সময় মেয়েদের জোর করে বিয়ে দেওয়ার ঘটনা গোচরে আসে। অনেক জায়গায় মেয়েদের কাছ থেকে ইজাবের সাক্ষী নিতে ভয় দেখানো, এমনকি কনেকে মারপিট পর্যন্ত করা হয় বলেও জানা যায়। যাকে বলপ্রয়োগ করে বিয়ে দেওয়া বলা যায় যা ইসলামি শিক্ষা ও অনুশাসনে নিষিদ্ধ।
(৩) কন্যার বিয়ের সময় জেহেজ বা যৌতুক দান বর্তমানে অনেকটা পণ প্রথার রূপ ধারণ করেছে। যেসব সমাজে কন্যাদান করা হয় এবং বিয়ের পর বাবার সম্পত্তিতে কন্যার কোনও দাবি থাকে না, সেখানে কন্যার পিত্রালয় থেকে বরপক্ষ পুণ্য দাবি করে। যদিও বর্তমানে আমাদের দেশের আইনে এটা নিষিদ্ধ। দুঃখের ব্যাপার, আমাদের বর্তমান শিক্ষিত মুসলিম সমাজে একাংশ মানুষ অনেক সময় কন্যার অভিভাবকের কাছে জেহেজ দানের আড়ালে অনেক দামি বস্তু এমনকি দু’চাকার, কেউ কেউ চারচাকার গাড়িও চেয়ে বসেন। এটা বর্তমানে অনেকটা সংক্রামক রোগের আকার ধারণ করতে চলেছে। এ বিষয়ে সচেতন মুসলিম সমাজের আশু প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন।
(৪) আমাদের সমাজে একাংশ লোক আছেন, যারা ভাবেন যে, ঘরে নতুন বউ আসে পরিবারের সবার সেবা করার জন্য। এ যেন এক ক্রীতদাসীস্বরূপা। অনেক জায়গায় বউয়ের উপর এমন শাসন চালানো হয়, যেমন পান থেকে চুন খসলে রক্ষা নেই যদিও বর্তমানে শিক্ষার বিস্তারের ফলে পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। অথচ ইসলামী অনুশাসনে পরিবারের কাজকর্ম করতে স্ত্রী আইনত বাধ্য নয়। স্বেচ্ছায় পরিবারের লোকদের সেবা করা সেটা স্বতন্ত্র কথা এবং এটা পুণ্যকর্মস্বরূপ।
(৫) রমজান মাসে মেয়ের শ্বশুরালয়ে ইফতারি দেওয়ার প্রথা আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত। রমজানে রোজা রাখা প্রত্যেক বালেগ মুসলমানের জন্য বাধ্যতামূলক কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। রোজাদারকে ইফতার করানো একটা পুণ্যকর্ম। তাই বলে গাড়ি বোঝাই করে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকদের খাওয়ানোর মধ্যে কি যৌক্তিকতা রয়েছে? এটা একটা বোকামি ছাড়া আর কী? তবে অনেকে ইজ্জত বাঁচাতে ঋণ-ধার করে কার্টুন কার্টুন ইফতারি পাঠান এবং এটা যে একটা ইসরাফ খরচ অর্থাৎ অপব্যয়, তা বলাই বাহুল্য। পবিত্র কুরআন বলে, ‘হে আদম সন্তানগণ, প্রত্যেকবার মসজিদে উপস্থিত হওয়ার সময়ে তোমরা সুসজ্জিত হও এবং ভোজন ও পান কর এবং অপব্যয় কর না, নিশ্চয় তিনি (আল্লাহ) অপব্যয়কারীদের ভালবাসেন না।’ (০৭:৩১)। আত্মীয়-স্বজনদের ইফতারি আমরা পাঠাব এবং তা হতে হবে পরিমিত পরিমাণ। টাকার অহঙ্কারে বাহাদুরি দেখাতে প্রতিযোগিতায় নেমে নয়। পবিত্র কুরআন বলে, ‘আল্লাহ উদ্ধত অহঙ্কারীকে ভালবাসেন না।’ (৫৭:২৩)। আর পবিত্র হাদিস বলে, ‘যার অন্তরে বিন্দু পরিমাণ অহঙ্কার আসে সে বেহেশতে যাবে না’-(মুসলিম)।
(৬) আত্মীয়ালয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্যসামগ্রী না পাঠিয়ে আমরা যদি তা গরিবদের সদকা দিতে পারি, তা হলে অনেক ভাল হয়। কারণ, গরিব-দুঃখীদের জন্য সদকা করা একটি পুণ্যকর্ম। পবিত্র কুরআনে সদকার মাহাত্ম্য বর্ণনা করে উল্লেখ করা হয়েছে-‘যারা আল্লাহর পথে স্বীয় ধন-সম্পদ ব্যয় করে, তাদের দৃষ্টান্ত এরূপ-যেমন, একটি শস্য বীজে সাতটি শীষ উৎপন্ন হয়েছে (এবং) এর প্রত্যেক শিষে একশত শস্য আছে এবং আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা বর্ধিত করে থাকেন এবং আল্লাহ সুপ্রশস্ত মহাজ্ঞানী।’ (০২:২৬১)। ‘যারা দিবসে ও রজনীযোগে প্রকাশ্যে ও গোপনে স্বীয় ধন-সম্পদ দান করে, পরে তাদের প্রতিপালকের নিকট তাদের পুরস্কার রয়েছে এবং তাদের পক্ষে আশঙ্কা নেই ও তারা দুঃখিত হবে না।’ (০২: ২৭৪)। অথচ আমরা তেলা মাথায় তেল দিতে খুব ওস্তাদ। গরিব-দুঃখীর জন্য আমাদের মনে ব্যথা হয় না। যদিও পবিত্র কুরআন-হাদিসে দুস্থদের সাহায্য করতে মানুষকে নানাভাবে উপদেশ দেওয়া হয়েছে।
(৭) দাম্পত্য জীবনে অনিবার্য পরিস্থিতিতে তালাক দেওয়া ইসলামের একটি অনিন্দ্যসুন্দর বিধান। কিন্তু তালাক ব্যবস্থা আমাদের সমাজে এক বহুচর্চিত বিষয়। পবিত্র কুরআনে তালাকের বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশাবলী থাকা সত্ত্বেও আমাদের সমাজে এ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির অভাব নেই। শিক্ষিত, অশিক্ষিত নির্বিশেষে কিছু মানুষের কাছে তালাক শব্দটি আতঙ্কস্বরূপ। একবার তালাক পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনাকালে জনৈক অধ্যাপক বন্ধু বললেন, এ শব্দটি উচ্চারণ করা খুব ঝুঁকিপূর্ণ, কেননা হয়তো আপনার অজান্তে আপনার স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে। তখনই সেখানে উপস্থিত আমার এক বন্ধু, যিনি বিবাহিত ও আইনজীবী, তিনি কম করে হলেও সাতবার তালাক শব্দটি উচ্চারণ করে বললেন-কী হলো? বলুন।’ আমি আশ্চর্য হলাম এ ভেবে যে, একজন উচ্চশিক্ষিত অধ্যাপক মানুষের যদি তালাক সম্বন্ধে এত ভুল ধারণা থাকে, তা হলে অশিক্ষিতরা কী করবে? হায়! মূঢ়তার তো একটা সীমা আছে। এভাবে একাংশ সাধারণ শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত মানুষেরও ইসলামের অনেক বিধান সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞানের অভাব রয়েছে। (চলবে)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পথ নির্দেশ বিতর্কের অবকাশ নেই
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ