Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সত্যালোকের সন্ধানে : ইসলাম গ্রহণ করে শান্তি ও মুক্তি লাভ করুন

প্রকাশের সময় : ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এ, কে, এম, ফজলুর রহমান
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সার্বিকভাবে এই কোরআন সংরক্ষিত আছে এবং থাকবে :
কোন পয়গাম্বরের তা’লীম ও শিক্ষার হেফাজত সার্বিকভাবে তার সহীফায়ে ইলাহীর হেফাজতের ওপর নির্ভরশীল। পূর্ববর্তী কিতাবসমূহ-এর অনুসারীদের জানাভাবে কিংবা অজানাভাবে শাব্দিক পরিবর্তন ও দস্ত-দারাজি থেকে সার্বিকভাবে মুক্ত ও পবিত্র ছিল না। অযুত লক্ষ পয়গাম্বরের মাঝে কতিপয় পয়গাম্বরের কিতাব ও সহীফা ছাড়া অন্যান্যগুলোর অবকাঠামো পৃথিবীতে অবশিষ্ট নেই এবং নামমাত্র যেগুলো বাকি ছিল সেগুলোও ক্রমশ লয়প্রাপ্ত হয়ে নতুন নতুন আঙ্গিকে পরিবর্তিত হয়ে চলেছিল। মূল তৌরিত কিতাব আগুনে পুড়ে ছাই সদৃশ মাটির সাথে মিশে গেছে। পরবর্তী সময়ে এ সকল বিদগ্ধ ও বিচ্ছিন্ন পৃষ্ঠাসমূহ থেকে তৌরিত কিতাবকে সংরক্ষণ করার চেষ্টা চালানো হয়েছে। কিন্তু কোরআনুল কারীমের সাক্ষ্য দ্বারা এ কথা প্রতিপন্ন হয় যে, পূর্ববর্তী কিতাবের অনুবাদ এমনভাবে করা হয়েছে যেখানে মূলানুগ অভিব্যক্তির প্রকাশ মোটেই ঘটেনি। বরং যা কিছু হয়েছে তা সার্বিকভাবে মূল বিবর্জিত ভাষান্তরের একটি খোলস মাত্র। যেখানে এর আসল বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত।
অনুরূপভাবে ইঞ্জিলের পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের কাজও হযরত ঈসার (আ:) আমলেই শুরু হয়েছিল। বিভিন্ন সংরক্ষণকারী ইঞ্জিলের পৃথক পৃথক পা-ুলিপি প্রস্তুত করেছিল। তারপর হযরত ঈসার (আ.) ঊর্ধ্বারোহণের পর সে সকল পা-ুলিপির অনুবাদ করিয়া বিক্ষিপ্ত বস্তুগুলোর অনুবাদে এমন সব ব্যতিক্রমধর্মী বিষয়বস্তুর অবতারণা ঘটিয়েছে যা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। একইভাবে দেখা যায় যে, ‘জরে দস্ত’-এর কিতাব বাদশাহ সিকান্দরের কোপানলে পড়েছিল। ফলে জরে দস্তরে কিতাবে এমন সব বিষয়বস্তুর সংযোজন ও বিয়োজন ঘটেছিল যেখানে সামান্যতম অংশ ব্যতীত মূল কিতাবের স্বরূপ উদঘাটন করা মোটেই সম্ভব ছিল না।
পূর্বতন কিতাবগুলোর এহেন অবস্থা হওয়ার মূয়ে যে কারণ নিহিত ছিল তা খুবই প্রণিধানযোগ্য। বাস্তব জগতে আল্লাহ পাক প্রতিটি বিষয় এবং বস্তুকে পর্যায়ক্রমে পরিপূর্ণতা দান করেন। তাই আল্লাহ পাক পূর্ববর্তী কিতাবসমূহকে চিরস্থায়ী ও সর্বশেষ কিতাবরূপে নাজিল করেননি। যার ফলশ্রুতিতে সে সকল কিতাবের সামগ্রিক হেফাজত ও সংরক্ষণের অঙ্গীকারও প্রদান করা হয়নি। কিন্তু কোরআনুল কারীম সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক এই অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন যে, তা চিরকাল মাহফুজ থাকবে এবং এর অবিনশ্বরতার মাঝে কোনরকম ছেদ বা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হবে না। একই সাথে কোরআনুল কারীমের হেফাজতের জিম্মাদারী স্বয়ং আল্লাহপাক নিজের উপর অর্পণ করেছেন এবং অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেছেন : “অবশ্যই আমি নসীহতপূর্ণ এই কিতাবকে অবতীর্ণ করেছি এবং নিঃসন্দেহে আমিই এর যথার্থ হেফাজতকারী।” (সূরা হিজর : রুকু-১)
আল্লাহ পাকের এই অঙ্গীকার কোরআনুল কারীমের অপর একটি আয়াতে এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে : “অবশ্যই আমার উপরই এই কোরআনের সংরক্ষণ ও পাঠের দায়িত্ব অর্পিত আছে। সুতরাং যখন আমি তা পাঠ করব তোমাদের উচিত তা অনুসরণ করা এবং কোরআনুল কারীমের বিস্তৃত বিবরণ প্রকাশ করা আমারই উপর সমর্পিত আছে।” (সূরা কিয়ামাহ : রুকু-১)
এই আয়াতের দ্বারা বুঝা যায় যে, কোরআনুল কারীমের পাঠের হেফাজতের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত : এর শব্দ, দ্বিতীয়ত : এর এবাদত এবং তৃতীয়ত : এর বিশ্লেষণ বা মর্মোদ্ধার। মহান আল্লাহ পাক এসব কিছুর জিম্মাদারী নিজের উপরই রেখেছেন। কেননা এ সকল ক্ষেত্রে অন্য কারও জিম্মাদারীকে কোনক্রমেই বরদাশত করা হবে না। পরবর্তী আয়াতে মহান আল্লাহ এই বিশেষত্বটি আরও জোরদাররূপে তুলে ধরেছেন যে, এই সত্যসম্ভূত কোরআনুল কারীমের মাঝে বাতিল বা অসত্যের সংস্পর্শ কোনক্রমেই থাকতে পারে না। ইরশাদ হচ্ছে : “এবং নিঃসন্দেহে এই কোরআন এমন এক কিতাব যা সর্বদাই মর্যাদাপূর্ণ। সুতরাং বাতিল বা মিথ্যা এর সম্মুখভাগ অথবা পশ্চাদ্ভাগের কোথাও সংযুক্ত হতে পারে না। এবং এই কিতাব প্রশংসিত বিজ্ঞানময় পরম সত্তার নিকট হতে অবতীর্ণ হয়েছে।” (সূরা-হা-মীম আস-সাজদাহ : রুকু-৫)
এই আয়াতে কোরআনুল কারীমকে মর্যাদাপূর্ণ বা বিজয়ী হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ এই কোরআন সকল অবস্থায় তার প্রতিপক্ষকে দলিল-প্রমাণ দ্বারা পরাভূত করবে। এমনকি কোন বাতিল বা অসত্য এর সস্মুখভাগে এবং পশ্চাদ্ভাগে সংযুক্ত হতে পারবে না। মোটকথা, শাব্দিক দিক থেকে এবং এবারতের দিক থেকে এমনকি অর্থ ও মর্মের দিক থেকে কোনরকম ব্যতিক্রম আরোপ হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব। কারণ এই কিতাব এমন এক বিজ্ঞানময় সত্তার নিকট হতে অবতীর্ণ হয়েছে যিনি তাঁর সা¤্রাজ্যে কারও দখলদারিত্বকে প্রশ্রয় দেন না। এ কারণেই জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মনীষার দিক দিয়ে এই কোরআন সর্বাবস্থায় বিজয়ী থাকবে। যেহেতু এই কোরআন সামগ্রিক সুন্দর ও মঙ্গলের অধিকর্তার নিকট হতে দান করা হয়েছে। সেহেতু এর মাঝে কোনরকম ত্রুটি ও আয়ের থাকা মোটেই সম্ভব নয়।
খতমে নবুওত : খতমে নবুওতের এই দাবি কোরআনুল কারীমের একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। খতমে নবুওতের ধারক ও বাহক হয়ে অনাগতকাল পর্যন্ত বিশ্বের ইতিহাসে সত্য সাক্ষীর ভূমিকা কোরআনুল কারীম চিরস্থায়ীভাবে পালন করতে থাকবে। এই মুখবন্ধের শেষ ফল যদিও এই দাঁড়ায় যে, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর পর কোন নবীর আগমন এবং কোরআনুল কারীমের পর কোন কিতাব অবতীর্ণ হওয়া এমনকি ইসলামের পর কোন ধর্মের প্রয়োজনীয়তা নেই। কিন্তু তবু অহীয়ে মুহাম্মাদী (সা.) যাবতীয় সন্দেহের নিরসন কল্পে সামনে অগ্রসর হয়ে এই বিশ্লেষণ প্রদান করেছে যে, বর্তমানের নবুওত এবং রিসালতের সিলসিলা শেষ হয়ে গেছে। তাই রাসূলুল্লাহর (সা.) পর কোন নবী এবং রাসূলের প্রয়োজন নেই। যেহেতু দ্বীন ইসলাম পরিপূর্ণ হয়ে গেছে এবং আল্লাহর কিতাবের হেফাজত ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা চূড়ান্ত করা হয়েছে এবং আল্লাহ পাকের হেদায়েতের দরওয়াজা বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা চিরতরে বিদূরীত হয়েছে, তাই খতমে নবুওতের এ ব্যবস্থাপনাকে অস্বীকার করা সর্বতোভাবে সীমালঙঘন ছাড়া আর কিছুই নয়।
পৃথিবীর মানবিক ইতিহাস একথার সাক্ষী যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) আগমনের পর দুনিয়ার অবস্থা বদলে গেছে, বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন শ্রেণী ও সমাজগুলো সংঘবন্ধ হয়েছে, পৃথিবীর এক প্রান্ত অপর প্রান্তের সাথে মিশে গেছে এবং কামেল তাওহীদের সমুচ্ছ ধ্বনি আরশ হতে ফরাশ পর্যন্ত বুলন্দ হয়ে গেছে এবং আল্লাহ পাকের সকল রাসূলের সততা ও সত্যবাদিতার অনুপ্রেরণা পর্যায়ক্রমে উন্নতির চরম শিখরে উপনীত হয়েছে। এই মানদ-টি এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, এই বিশ্বের যে সকল জাতি ইসলাম কবুল করেনি তারাও নিয়মতান্ত্রিকভাবে এই উভয়বিধ সত্যতাকে মেনে নিয়েছে।
দীন ইসলাম এবং বহু ধর্মের একান্নবর্তীতা :
উপরোক্ত বিশ্লেষণের পর একথা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ওয়াহদাতে আদিয়ান বা ধর্মসমূহের একতা ও একান্নবর্তীতার অর্থ ও উদ্দেশ্যে কি? বস্তুত ধর্ম মাত্র একটিই যার উপর সকল আম্বিয়ায়ে কেরাম অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং সকল পয়গাম্বর একই ধর্মের প্রচার ও প্রসার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু ধর্মের এই একান্নবর্তীতা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কারণ পূর্ববর্তী আম্বিয়ায়ে কেরামের অনুসারীগণ তাদের কাছে নাজিলকৃত কিতাবসমূহকে পরিবর্তন ও বিয়োজন সাধন করতে থাকে এবং এমনভাবে দস্ত-দারাজির পাঁয়তারা করতে থাকে যার ফলে আম্বিয়ায়ে কেরামের মূল ধর্ম আর অবশিষ্ট থাকেনি। বিভিন্ন সময় ও কালে তাদের সংযোজিত এই পরিবর্তনের মাত্রা ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। ফলে এমন এক অবস্থার অবতারণা ঘটে যে, আসল ধর্মের পরিচয় আর কারও কাছে অবশিষ্ট থাকেনি। সুতরাং পূর্ববর্তী সম্প্রদায় কর্তৃক সংযোজন ও বিয়োজন মুক্ত চিরন্তন ধর্মকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (আ.) আগমন করেছেন। এবং এই ধর্মের নাম রাখা হয়েছে ইসলাম; যা তদীয় ঐশী গ্রন্থের চিরস্থায়ী হেফাজত এবং ধর্মের পরিপূর্ণতা ও নবুওয়াতের পরিসমাপ্তির কারণে চিরকাল সমুন্নত থাকবে। যদি পৃথিবীর পূর্ববর্তী ধর্মের অনুসারীগণ নিজ নিজ আসল ধর্মে প্রত্যাবর্তন করে, যার শিক্ষা পয়গাম্বরগণ তাদেরকে দিয়েছিলেন তাহলে এটাই হবে চিরন্তন ও অবিনশ্বর ধর্ম যার নাম ইসলাম। এতে করে হযরত নূহ (আ.), হযরত ইব্রাহীম (আ.), হযরত মূসা (আ.), হযরত ঈসা (আ.) এবং সর্বশেষ পয়গাম্বর মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রচারিত ধর্মমতের মাঝে কোনই পার্থক্য পরিদৃষ্ট হবে না। তবে যা কিছু পার্থক্য এতে লক্ষ্য করা যাবে তাহলো সংক্ষিপ্তাকারে প্রকাশ করা এবং বিস্তৃত আকারে প্রকাশ করার তারতম্য। এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমে ঘোষণা করা হয়েছে : “ওহে লোক সকল! যাদেরকে কিতাব প্রদান করা হয়েছে তোমরা ঐ বস্তুর উপর ঈমান আনয়ন করো যা আমি নাজিল করেছি যা তোমাদের সম্মুখস্থ কিতাবের সত্যতার সাক্ষী স্বরূপ; ঐ দিন আসার পূর্বে যেদিন তাদের চেহারাসমূহ আমি অন্ধকারাচ্ছন্ন করে পিছনের দিকে প্রত্যাবর্তিত করে দেব কিংবা তাদের উপর অভিসম্পাত বর্ষণ করব যেমনটি আমি শনিবার দিন সীমা লঙ্ঘনকারীদের প্রতি অভিসম্পাত আরোপ করেছিলাম।” (সূরা আন-নিসা : রুকু-৭)
আরবের অংশীবাদী শ্রেণীর লোকদের চেয়ে কিতাবধারী ইহুদী ও খ্রিস্টানদের এই হাকীকতটি বুঝবার ও উপলব্ধি করার বেশি প্রয়োজন ছিল। কারণ তাদের সামনে যে কিতাব রয়েছে এতে পরবর্তী কিতাবের উপর ঈমান আনয়নের সুস্পষ্ট নির্দেশ বিদ্যমান ছিল। এবং ইসলামের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা তাদের পক্ষে মোটেই সমীচীন ছিল না। এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমে ঘোষণা করা হয়েছে : “তোমরা ঈমান আনয়ন করো ঐ কিতাবের উপর যা আমি নাজিল করেছি এবং যা তোমাদের সাথে যে কিতাব আছে এর সত্যতার সাক্ষ্যদাতা এবং তোমরা সর্বপ্রথম অস্বীকারকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।”
কিন্তু এত কিছুর পরও তাদের অবস্থার কোনই পরিবর্তন সাধিত হয়নি। এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমে ঘোষণা করা হয়েছে : “এবং তাদেরকে যখন বলা হয়েছে যে, তোমরা ঈমান আনয়ন কর যা কিছু আল্লাহপাক অবতীর্ণ করেছেন। তখন তারা এ উত্তর প্রদান করল যে, আমরা ঐ কিতাবের উপর ঈমান আনয়ন করব যা আমাদের উপর অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং এ ছাড়া অন্যান্য কিতাবগুলোর প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করব। অথচ এই কুরআন তাদের সাথে যা আছে তার সত্যতাও শনাক্ত করে থাকে।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-১১) পক্ষান্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.) যে ধর্মকে উপস্থাপন করেছেন এর বুনিয়াদ পূর্ববর্তী রাসূল ও কিতাবসমূহকে সত্যতার সাথে স্বীকার করার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ কারণে ইসলাম মুসলমান হইবার জন্য শুধু এর আবশ্যকতাকেই সুনির্দিষ্ট করেনি যে, তারা শুনামাত্র রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উপর ঈমান এনেছে; বরং এ কথাকেও সুনির্দিষ্ট করেছে যে, তারা পূর্বতন সকল নবুওত ও কিতাবের উপর ঈমান এনেছে। সুতরাং খোদ কুরআন এ সাক্ষ্য প্রদান করেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) শুধু কেবল এ যাতনা এবং নিগ্রহ ভোগ করেননি যে তাঁর স্বদেশবাসীগণ তাঁর কিতাবকে মানতে রাজী হয়নি বরং সত্যিকার বেদনা ছিল এই যে, এই অবিশ্বাসকারীরা পূর্ববর্তী কিতাবসমূহকে মোটেই মান্য করত না। এ প্রসঙ্গে সূরা সাবাহ- এর মাঝে মহান আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন : “এবং অবিশ্বাসকারীরা এ কথাও বলেছে যে, আমরা কখনও এই কুরআনের উপর ঈমান আনয়ন করব না। এমনকি এর পূর্ববর্তী কিতাবের উপরও ঈমান আনব না (অর্থাৎ তৌরিত)।” (সূরা সাবা : রুকু-৪)
এ কারণে রাসূলুল্লাহ (সা.) পরিষ্কারভাবে এ ঘোষণা প্রদান করেছেন, “যে ব্যক্তি আমার আবদিয়তকে এবং আমার রিসালাতকে স্বীকার করার সাথে সাথে ঈসা ইবনে মরিয়মকে (আ.) ও আল্লাহর বান্দা এবং তার রাসূল ও কালেমা এবং আল্লাহর নিকট হতে আগত রূহ হিসেবে বিশ্বাস করবে সে অবশ্যই জান্নাতে গমন করবে।” (সহীহ বুখারী : কিতাবুল আম্বিয়া; ঈসা (আ.) প্রসঙ্গ)
মোটকথা, সেই চিরস্থায়ী অবিনশ্বর ধর্ম শুধুমাত্র একটিই ছিল এবং দুনিয়ার সকল আম্বিরায়ে কেরাম সেই একই মাত্র দ্বীনের পয়গাম নিয়েই দুনিয়াতে আগমন করেছিলেন।
এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় স্মরণে রাখা খুবই দরকার। আমরা জানি যে কোন বস্তু তার আত্মবিকাশের লগ্নে একটি সূক্ষ্ম কেন্দ্রবিন্দু হতে যাত্রা শুরু করে। পরবর্তীকালে প্রয়োজনের তাকিদে সে বস্তু বা বিষয়টি পর্যায়ক্রমে যতই বিস্তৃত ও পরিবর্ধিত হতে থাকে ততই এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির মাঝে কিছুটা পরিবর্তন ও পার্থক্য স্বভাবতঃই পরিদৃষ্ট হয়। যেমন একটি বৃক্ষ তার বৃদ্ধির পরিপূর্ণ প্রান্ত উপনীত হওয়ার পূর্বে এর শাখা-প্রশাখা, পত্র-পল্লব এবং রং ও রূপের মাঝে বিভিন্ন অবস্থার সমাবেশ ঘটে থাকে। কিন্তু পরিপূর্ণতা সাধনের পর এর মাঝে বৈপরীত্য বা পরিবর্তনের আর কোন অবকাশ থাকে না। যদিও একটি মাত্র বৃক্ষই শুরু থেকে পরিপূর্ণতা দ্বার প্রান্তে উপনীত হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে, কিন্তু তাই বলে মূল বৃক্ষের আসল বৈশিষ্ট্যগুলো সময় ভেদে নিষ্প্রভ হয়েছে সত্য কিন্তু চির অবলুপ্ত হয়নি। তেমনি ইসলাম ধর্ম সৃষ্টির শুভলগ্ন থেকেই যাত্রা শুরু করেছে এবং এর ব্যবহারিক কর্মকা- সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার সাহায্যে হযরত আদম (আ.)-এর মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে প্রবর্তিত হয়েছে। তারপর এর অগ্রগতি ও উন্নতি হযরত নূহ (আ.) পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে চলে এসেছে। হযরত আদম (আ.) হতে হযরত নূহ (আ.) পর্যন্ত এই পর্যায়ক্রমিক উন্নতির মাঝে তাওহীদ ও রিসলাতের শিক্ষার মাঝে কোন পরিবর্তন সাধিত হয়নি।
অনুরূপভাবে হযরত নূহ (আ.) হতে হযরত ইব্রাহীম (আ.) পর্যন্ত মূল ইসলমের এক স্বর্ণযুগের অবতারণ ঘটে। এ সময়ে ইসলাম অপ্রতিরোধ্য ও অজেয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তারপর হযরত ইব্রাহীম (আ.) হতে শুরু করে নূরনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) পর্যন্ত সময়কাল ইসলমের বিজয়-বৈজয়ন্তীকে শ্রেষ্ঠত্বের চূড়ান্ত শীর্ষে উপনীত করেছে। এই পর্যায়ক্রমে অগ্রসরতার মাঝে সত্য বিরূপ ও বিদ্বেষী সম্প্রদায়ের লোকেরা পবিত্র ইসলামের মাঝে স্বকপোলকল্পিত নানা প্রকার ধর্মবিগর্হিত কর্মকা- ও চেতনার সমাবেশ ঘটাতে প্রয়াস পেয়েছে। কিন্তু মহান রাব্বুল আলামীন ক্লেদাক্ত এই পথপরিক্রমাকে কুরআনুল কারীমের ভাষায় সামগ্রিকভাবে পরিত্যাজ্য বলে ঘোষণা করেছেন এবং সর্বতোভাবে ওয়াহদাতে দ্বীনের হাকীকতকে কুরআনুল কারীমের ভাষায় এভাবে ব্যক্ত করেছেন, “হে পয়গাম্বারগণ! তোমরা পবিত্র বস্তুসমূহ ভক্ষণ কর এবং সৎকর্মপরাণ হও। অবশ্যই আমি তোমাদের যাবতীয় কর্মকা- সম্পর্কে সম্যকে অবহিত। এবং অবশ্যই তোমরা সকলেই একই উম্মতের অন্তর্ভুক্ত এবং আমিই তোমাদের সকলের প্রতিপালক। সুতরাং তোমরা আমাকে ভয় কর। কিন্তু রাসূলগণের অনুসারীরা পরস্পর পরস্পরের মুলোৎপাটনের লক্ষ্যে নিজেদের মাঝে বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতার রূপ ফুটিয়ে তুলেছে। শেষ পর্যন্ত তারা এমন হয়ে গেছে যে, এদের প্রত্যেকটি দল নিজ নিজ মতাদর্শে আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেছে।” (সূরা মুমিনুন : রুকু-৪)
এই বিশেষত্বটি অধিক বিস্তৃতাকারে রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজের ভাষায় এভাবে ব্যক্ত করেছেন, “সকল আম্বিয়ায়ে কেরাম এমন এক ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ যাদের পিতা এক এবং মাতা হচ্ছেন ভিন্ন ভিন্ন এবং তাদের ধর্মও হচ্ছে এক।” (সহীহ বুখারী : কিতাবুল আম্বিয়া-ঈসা প্রসঙ্গ)
বাস্তবে এই যদি হয় অবস্থা তাহলে বিশ্বের সকল মানুষের কাছে আমাদের একান্ত আহ্বান রইল এই যে, আপনারা ইসলাম গ্রহণ করে দুনিয়ার শান্তি এবং আখেরাতের মুক্তি ও নিষ্কৃতির পথকে সুগম করে তুলুন। এতেই রয়েছে সফলতা। অন্যথায় দুনিয়া এবং আখেরাত উভয় জিন্দেগীতেই পস্তাতে হবে। এর কোন ব্যতিক্রম হবে না। ওয়ামা আলাইনা ইল্লাল বালাগ।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সত্যালোকের সন্ধানে : ইসলাম গ্রহণ করে শান্তি ও মুক্তি লাভ করুন
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ