দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
এ, কে, এম, ফজলুর রহমান : ইসলাম অর্থাৎ সকল নবী এবং রাসূলদের একক ও সম্মিলিত ধর্মের মূল দুটি কথার উপর নির্ভরশীল। এর একটি হচ্ছে পরিপূর্ণ তাওহীদের বিকাশ এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে সামগ্রিকভাবে রিসালতের বিকাশ। মোটকথা, আল্লাহ তায়ালাকে তাওহীদের সকল গুণাবলীর মাঝে পরিপূর্ণরূপে এবং শরীকহীনরূপে মেনে নেয়া এবং তাঁর সকল পয়গাম্বর ও রাসূলগণকে সমভাবে সত্যবাদী এবং সত্যাশ্রয়ী স্বীকার করা। সুতরাং কোরআনুল করীমে এই বিশেষত্বটি এভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে : “তবে কি তারা আল্লাহর দ্বীন ছাড়া অন্য কোন দ্বীন তালাশ করে? অথচ যা কিছু আকাশসমূহে এবং জমিনে রয়েছে সব কিছুই স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আল্লাহপাকের ফরমাবরদারী করছে। এবং তাঁরই সকাশে সকলকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। (হে পয়গাম্বর!) বলে দিন যে, আমি আল্লাহর উপর এবং তিনি আমার উপর যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন তার উপর এবং যা হযরত ইব্রাহীম ও ইসমাঈল (আ.)-এর উপর এবং হযরত ইসহাক ও হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর উপর এবং তার বংশধরদের উপর নাজিল করা হয়েছে এবং যা কিছু হযরত মূসা (আ.), হযরত ঈসা (আ.) এবং সকল পয়গাম্বরকে তাদের প্রতিপালকের নিকট হতে প্রদান করা হয়েছে, আমরা তাদের সকলকেই সত্য এবং যথার্থ হিসেবে বিশ্বাস করি এবং আমরা তাদের মাঝে কোন পার্থক্য নির্ণয় করি না। আমরা একান্তভাবে আল্লাহপাকের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনকারী। আর যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম তালাশ করে তবে তার নিকট হতে তা কবুল করা হবে না। এবং অবশ্যই সে আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (সূরা আলে ইমরান : রুকু-৯)। এই আয়াতের দ্বারা বুঝা যায় যে, আল্লাহর ওপর এবং সকল রাসূলের ওপর ঈমান আনয়ন করাই হল আল্লাহর দ্বীন এবং এরই নাম হচ্ছে ইসলাম। যে ব্যক্তি নিয়মতান্ত্রিকভাবে কবুল করেনি সে আখেরাতে অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তশীল হবে।
কোরআনুল কারীমের সূরা আলে ইমরানে পরিষ্কারভাবে ইহুদী এবং খ্রিস্টানদের পথভ্রষ্ট হওয়ার তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, তারা ঐশী গ্রন্থসমূহের ভ্রান্ত বিশ্লেষণ করত এবং আয়াতে মুতাশাবিহাতগুলোর অর্থ ও মর্ম উদঘাটনে সীমালঙ্ঘন করত। তাই তারা দ্বীন ইসলাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নানারকম মতবাদের আবর্তে জড়িয়ে পড়ত। এ সম্পর্কে কোরআনুল কারীমে ইরশাদ হচ্ছে : “অবশ্যই আল্লাহর নিকট একমাত্র ধর্ম হচ্ছে ইসলাম এবং কিতাব প্রদান করা হয়েছে তাদের নিকট সত্য জ্ঞান আগমন করার পর পরস্পর জিদের বশবর্তী হয়ে এর মাঝে বিভিন্ন ইখতিলাফ উত্থাপন করেছে। সুতরাং যে আল্লাহপাকের নিদর্শনাবলীকে অস্বীকার করবে তাহলে অবশ্যই আল্লাহপাক দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী। এরপরও যদি তারা তোমার সাথে বিবাদে লিপ্ত হয় তাহলে বলে দাও, আমি এবং আমার অনুসারীগণ নিজেদের সত্তাকে আল্লাহপাকের সন্নিধানে সমর্পণ করেছি।” (সূরা আলে ইমরান : রুকু-২)।
এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে যে, তিনি যেন ইহুদী এবং খ্রিস্টানকে এ প্রশ্ন করেন যে, তারা কি ইসলাম কবুল করবে কি করবে না? কোরআনুল কারীমে ইরশাদ হচ্ছে : “এবং যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে এবং যারা আরবের পথভ্রষ্ট লোক তাদেরকে বলে দিন যে, তোমরা কি ইসলাম গ্রহণ করেছ? যদি তারা ইসলাম গ্রহণ করে থাকে তাহলে তারা সরল পথ লাভ করেছে। আর যদি তারা অস্বীকার করে তাহলে তোমার উপর দায়িত্ব হচ্ছে সত্যিকার সংবাদ তাদের নিকট পৌঁছে দেয়া। অবশ্যই আল্লাহপাক বান্দাহদের সমুদয় অবস্থা প্রত্যক্ষ করছেন।” (সূরা আলে ইমরান : রুকু-২)।
এই আয়াতের দ্বারা বুঝা যায় যে, ইহুদী এবং খ্রিস্টানদেরকে ইসলাম কবুল করার ফলে পরিপূর্ণ হেদায়েত করার খোশ-খবরী প্রদান করা হয়েছে। এর সত্যিকার অর্থ এই যে, পরিপূর্ণ হেদায়েত হল ইসলাম এবং এটাই প্রকৃত দ্বীন যা ইহুদী, নাসারা এবং পূর্ববর্তী পয়গাম্বরদের উম্মতগণ হারিয়ে ফেলেছিল। এবং যাকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মাধ্যমে পুনর্বার পৃথিবীতে পেশ করা হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে এই যে, পূর্ববর্তী আম্বিয়াদের উম্মতগণ যে হেদায়েত লাভ করেছিল তা পরিপূর্ণ ছিল না। বস্তুত : তা ছিল সংক্ষিপ্ত ও অসম্পূর্ণ। এবং ইসলাম যে হেদায়েত নিয়ে আগমন করেছে তাহল কামেল এবং পরিপূর্ণ। তাছাড়া উপরোক্ত আয়াতসমূহে এ কথাও উল্লেখ করা হয়েছে যে, যারা বর্তমানে ঈমান এনেছে এবং ইহুদী, খ্রিস্টান ও সাবেয়ীদের মাঝে যারা আল্লাহর উপর এবং বিচার দিবসের উপর ঈমান এনেছে এবং ইহুদী, খ্রিস্টান ও সাবেয়ীদের মাঝে যারা আল্লাহর উপর এবং বিচার দিবসের উপর ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে তাদের কোন ভয় নেই, তারা চিন্তান্বিতও হবে না। এক্ষেত্রে আল্লাহর উপর ঈমান আনয়ন করার মাকসুদ হল তাওহীদে কামেল অর্থাৎ পরিপূর্ণ তাওহীদকে স্বীকার করা। এবং উপরোক্ত আয়াতের অর্থ এই নয় যে, ইহুদী, নাসারা এবং সাবেয়ীগণ নিজেদের বর্তমান গোমরাহ, আকীদা সত্ত্বেও মুক্তিলাভের অধিকার পেতে পারে। ইহুদী, নাসারা এবং সাবেয়ীদের কথা বাদ দিলেও তাওহীদে কামেল ছাড়া কোন মুসলমানের পক্ষে মুক্তিলাভের অধিকারী হওয়া সম্ভব নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানদের ঈমান এবং নেক আমল সঠিকভাবে তাওহীদের কামেলের শিক্ষা মোতাবেক না হবে এবং তাওহীদে কামেল তাদের রাসূলগণের মাধ্যমে আগমন করেছে, এই নিয়মতান্ত্রিকতা সকলের জন্যই প্রযোজ্য, চাই সে ব্যক্তি মুসলমান কিংবা ইহুদী খ্রিস্টান, সাবেয়ী হোক অথবা যে কোন নবীর অনুসরণের দাবিদার হোক।
নবুওতে মুহাম্মদী (সা.)-এর এই দাবি নয় যে, এটাই হচ্ছে একমাত্র হেদায়েত এবং এছাড়া অন্যান্য সব কিছু গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতা। বরং নবুওতে মুহাম্মদী (সা.)-এর দাবি হচ্ছে এই যে, তাহল পরিপূর্ণ হেদায়েত। তাছাড়া অন্যান্য ধর্মমতগুলো বর্তমান অবস্থায় নাকেছ বা অসম্পূর্ণ। অর্থাৎ সেই পরিপূর্ণ চিরস্থায়ী হেদায়েত যা নিজ নিজ সময়ে বিভিন্ন আম্বিয়ায়ে কেরাম সাথে নিয়ে আগমন করেছেন সেই পরিপূর্ণ হেদায়েতকে তাদের অনুসারীগণ বিভিন্ন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, দস্ত-দারাজি ও মতবিরোধের দ্বারা বরবাদ করে দিয়েছিল। এই জন্য মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) সেই পরিপূর্ণ হেদায়েত নিয়ে শেষ পর্যায়ে ধরাধামে আগমন করেছেন। সুতরাং এই হেদায়েত সর্বদা পরিপূর্ণই থাকবে এবং এর মাঝে অসম্পূর্ণতার কোন ছাপ কোনকালেই পরিদৃষ্ট হবে না। কেননা, এই হেদায়েতের উৎস হচ্ছে কোরআনুল কারীম। যা পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও ইখতিলাফ হতে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। এ কারণেই ইহুদী এবং খ্রিস্টানদেরকে যখনই এবং যেখানেই নবুওতে মুহাম্মদী (সা.)-এর দাওয়াত দেয়া হয়েছে সেখানে হেদায়েতের বেশারতও শোনানো হয়েছে। সুতরাং কোরআনুল কারীমের এই আয়াত স্পষ্টতঃই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, “হে পয়গাম্বর! যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে এবং আরবের জাহেলদেরকে বলে দিন, তারা যেন ইসলাম গ্রহণ করে। যদি তারা ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে সঠিক পথ লাভ করবে।” (সূরা আলে ইমরান : রুকু-২)। তাছাড়া সূরায়ে বাকারাহ হতে ঘোষণা করা হয়েছে যে, “হে মুসলমানগণ! বলে দাও যে, আমরা আল্লাহর উপর যে কিতাব আমাদের উপর অবতীর্ণ হয়েছে এবং যা হযরত ইব্রাহীম (আ.), ইসমাঈল (আ.) এবং ইসহাক (আ.), ইয়াকুব (আ.) এবং তার সন্তান-সন্ততির উপর অবতীর্ণ হয়েছে এবং যা হযরত মূসা (আ.)-কে এবং হযরত ঈসা (আ.)-কে এবং সমস্ত পয়গাম তাদের প্রতিপালকের নিকট হতে প্রদান করা হয়েছে, আমরা এ সকলের উপর ঈমান আনয়ন করেছি এবং আমরা এ সকল আম্বিয়াদের মাঝে কোনই পার্থক্য নির্ণয় করি না এবং আমরা একমাত্র আল্লাহপাকের ফরমাবদার। সুতরাং তারা যদি তোমাদের মত বিশ্বাস স্থাপন করে তাহলে তারা সোজা রাস্তা লাভ করবে আর যদি তা গ্রহণ করা হতে বিরত থাকে তাহলে তারা বিরুদ্ধবাদিতায় পরিলিপ্ত।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-১৬)। ইহুদী, খ্রিস্টান এবং আহলে কিতাবকে তা’লীমে মুহাম্মদী (সা.)-এর দিকে দাওয়াত দেয়া হয়েছে এই পরিপূর্ণ হেদায়েতকে লাভ করার জন্য যা ইসলাম নামে সুপরিচিত। অর্থাৎ সকল আম্বিয়ায়ে কেরামের অবিনশ্বর ধর্ম এই ইসলামের মাঝেই নিহিত। যার পরিপূর্ণতা নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) দুনিয়াতে তাশরীফ এনেছিলেন। এজন্য মুক্তি ও নিষ্কৃৃতি কেবলমাত্র তাঁকে মনে-প্রাণে অনুসরণ করার মাঝেই নিহিত রয়েছে। এ প্রসঙ্গে কোরআনুল কারীমে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে : “যারা আপনার প্রতি অবতীর্ণ কিতাবের উপর ঈমান এনেছে এবং আপনার পূর্বে নাজিলকৃত কিতাবের উপর ঈমান এনেছে এবং তারা আখেরাতের উপরও বিশ্বাস স্থাপন করেছে তারাই তাদের প্রতিপালকের হেদায়েতের উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এবং তারাই সফলকামের অন্তর্ভুক্ত।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-১)।
হযরত মূসা (আ.)-এর কাহিনী বর্ণনা করার পর কোরআনুল কারীমে বলা হয়েছে যে, রহমতে ইলাহী যদিও আম এবং সাধারণভাবে সকলের জন্য অবারিত, কিন্তু এই নির্দিষ্ট নিয়ামত খালেসভাবে তারাই লাভ করবে যারা ত’ালীমে মুহাম্মাদী (সা.)-কে কবুল করেছে এবং তারাই পরিপূর্ণভাবে মুক্তি ও নিষ্কৃতি লাভের হকদার। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে : “এবং আমার রহমত প্রতিটি বস্তুর মাঝে পরিব্যাপ্ত সুতরাং এই রহমতকে আমি সুনির্দিষ্টভাবে তাদের জন্যই লিখে দিব যারা পরহেজগার এবং যাকাত আদায়কারী এবং নির্দেশাবলী মান্যকারী এবং যারা নবীগণের মূল উৎস আমার এই রাসূলের অনুসরণ করে যারা তার বর্ণনা তাদের নিকটস্থ তাওরাত এবং ইনিঞ্জল কিতাবে লিখিতকারে পেয়েছে। যে রাসূল তাদেরকে নেক কাজের নির্দেশ প্রদান করে, বদ কাজ হতে বিরত রাখে। উত্তম বস্তুগুলোকে তাদের জন্য হালাল করে এবং অপবিত্র বস্তুগুলোকে হারাম সাব্যস্ত করে এবং মাথার উপরে আপতিত জিঞ্জিরের বাঁধনকে ছিন্ন করে দেয়। সুতরাং যারা এই পয়গম্বরকে মান্য করেছে এবং তাকে সাহায্য করেছে, শক্তি যুগিয়েছে এবং ঐ সমুজ্জ্বল কিতাবের অনুসরণ করেছে যা তার উপর অবতীর্ণ করা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে তারাই হবে সফলকাম। হে পয়গম্বর! এ কথাও মানুষকে বলে দাও যে, আমি তোমাদের সকলের প্রতি রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছি ঐ আল্লাহর পক্ষ হতে যিনি নভোম-ল এবং ভূম-লের বাদশাহীর মালিক। তিনি ছাড়া অন্য কোনই উপাস্য নেই। তিনিই জীবন দান করেন এবং মৃত্যুমুখে পতিত করেন। সুতরাং আল্লাহ এবং তার রাসূলের উপর ঈমান আন যিনি নবীগণের উৎস। সুতরাং যারা আল্লাহর উপর এবং তার বাণীসমূহের উপর ঈমান আনবে এবং সে মোতাবেক আনুগত্য প্রদর্শন করবে, তারাই হেদায়েত প্রাপ্তদের অন্তর্ভূক্ত হবে।” (সূরা আ’রাফ : রুকু -২০)
এই আয়াতসমূহের মাঝে সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে, অতীত ধর্মমতগুলোর অনুসারীদেরকে মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)- এর উপর ঈমান আনয়ন করা এজন্য জরুরি যে, ঐ পবিত্র ধর্ম যা পূর্বতন মানুষের দস্ত-দারাজির এবং সংযোজনের ফলে বিকৃত হয়ে পড়েছিল ঐ সকল কিতাবের ভবিষ্যদ্বাণী মোতাবেক রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দ্বারা তাকে নতুভাবে পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে এবং পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে যে সকল সংযোজন এবং খুঁটি-নাটি মাসআলার যে সকল কঠোরতাকে তারা অন্তর্ভূক্ত করেছিল সে সকল আবিলতাকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-দূর করে দিয়েছেন এবং তাঁকে বিশ্বনবীরূপে প্রেরণ করা হয়েছে। এ সকল কারণে অন্যান্য সকল নবীদের সাধারণ হেদায়েতনামা ও পরিপূর্ণ মুক্তি ও সাধারণ নিষ্কৃতি এখন শুধুমাত্র অহীয়ে মুহাম্মদী (সা.)- এর মাঝে। তাছাড়া হেদায়েত লাভের কোনই উপায় উপকরণ নেই।
মোটকথা, দ্বীনে মুহাম্মাদী (সা.)-কে কবুল করা সকল মানুষের জন্য এ কারণে জরুরি যে, এটাই হচ্ছে অবিনশ্বর ধর্ম। যা অন্যান্য সকল ঐশী ধর্মের মূল নির্যাস এবং পূর্ববর্তী আম্বিয়াদের অনুসারীগণ কর্তৃক পরিবর্তন ও দস্ত-দারাজির কারণে আসল ধর্মমত বরবাদ হয়ে গিয়েছিল। সহীফায়ে মুহাম্মাদী (সা.) সেই আসল ধর্মকে নিয়েই আগমন করেছেন। সুতরাং তা চিরকাল মাহফুজ থাকবে। কেননা, এই দ্বীনের নবী হচ্ছেন খাতেমুন্নাবিয়্যীন। তাঁর ধর্মই হচ্ছে পরিপূর্ণ ধর্ম এবং তার কিতাবই হচ্ছে সকল ঐশীগ্রন্থের তত্ত্বাবধায়ক ও হেফাযতকারী এবং কিয়ামত পর্যন্ত এই কিতাবের পরিপূর্ণ হেফাজত ও স্থায়ীত্বের অঙ্গীকার প্রদান করা হয়েছে। অতএব এই চারটি দাবি অর্থাৎ পরিপূর্ণ ধর্ম, কুরআনের হেফাযতকারী হওয়া, কিয়ামত পর্যন্ত তা মাহফুজ ও অবিকৃত থাকা এবং খতমে নবুওত নি¤œলিখিত প্রমাণসমূহ দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন হওয়া।
পরিপূর্ণ ধর্ম
একমাত্র কুরআনুল কারীম ছাড়া অন্যান্য ঐশী গ্রন্থগুলোর কোন একটিও এই দাবি উত্থাপন করেনি যে, তা মোকাম্মাল ও পরিপূর্ণ এবং এর দ্বারা আল্লাহর ধর্ম স্বীয় যাবতীয় আইন-কানুন ও শাখা-প্রশাখার ভিত্তিতে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। (মানাছিক, মানাহিজ এবং শারায়েব) বরং পূর্বতন ধর্মগুলোর প্রত্যেকটি নিজের আমলে এ কথা বলেছে যে, এরপর আরো একটি নবুওয়াত আগমন করবে যা তার কাজকে পরিপূর্ণতা প্রদান করবে। মহান আল্লাহপাক হযরত মূসা (আ.)-কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, “আমি তাদের জন তাদের ভ্রাতেৃবৃন্দের মধ্য হতেই তেমার মত একজন নবীর আবির্ভাব ঘটাব এবং স্বীয় মুখ নিঃসৃত বাণী তাঁর প্রতি প্রেরণ করব। এবং যা কিছু আমি তাঁর নিকট প্রকাশ করব তিনি তা সকলের সামনে তুলে ধরবেন।” (ইসতিসনা : ১৮-১৯)।
এর দ্বারা বুঝা যায় যে, হযরত মূসা (আ.)- এরপর তার মত একজন নবীর আবির্ভাব অবশ্যম্ভাবী ছিল। যার মুখে স্বয়ং আল্লাহপাক নিজের কালাম অর্পণ করবেন। এর দ্বারা এ কথাও পতিপন্ন হল যে, হযরত মূসার মত অপর একজন শরীয়তধারী নবী আল্লাহপাকের বাণীসহ আগমন করবেন। অনুরূপভাবে হযরত ঈসা (আ.)-ও বলেছিলেন, “কিন্তু সেই ফকিলিত (আহমেদ) পবিত্রতার প্রাণশক্তি যাকে মহাপ্রভু আমার পরে প্রেরণ করবেন। তিনিই তোমাদেরকে সব বিষয় শিক্ষা দিবেন। এবং যে সকল বাণী আমি তোমদের সামনে উপস্থাপন করেছিলাম সেগুলো তোমাদের স্মরণ করিয়ে দেবেন।” (যোহন : ১৪-১৬)। “এবং সেই ফকিলিত (আহমেদ) আগমন করে দুনিয়াকে সত্যতা ও ইনসাফ বর্জনের গুনাহ ও অপরাধের কারণে দোষী সাব্যস্ত করবেন। গুনাহ এজন্য যে, তারা আমার উপর ঈমান আনয়ন করেনি ... আমার এছাড়াও তোমদের কাছে অনেক কিছু বলার আছে যেগুলো তোমরা বর্তমানে মোটেই বরদাশত করতে পারবে না। কিন্তু তিনি অর্থাৎ সে সত্যসম্ভূত প্রাণসত্তা তোমাদের সামনে যাবতীয় সত্য পথ উন্মুক্ত করবেন, তা এজন্য যে, তিনি নিজ থেকে কোন কথাই বলবেন না। বরং যা কিছু ঐশী বাণী শ্রবণ করবেন তাই প্রচারে প্রবৃত্ত হবেন এবং তিনি আমার মর্যাদাও তুলে ধরবেন।” (যোহন : ১৬-১৮)। হযরত ঈসা (আ.)-ও স্বীয় জবানেই নিজের অপূর্ণতার কথা ব্যক্ত করেছেন এবং তিনি পরবর্তীকালে একজন আগমনকারীর পরিচয়ও প্রদান করেছেন যিনি সত্যধর্মকে পরিপূর্ণতা দান করবেন। পরিশেষে সকল উম্মতের প্রতিশ্রুত সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা রাসূলুল্লাহ (সা.) আগমন করলেন এবং এই দাবি করলেন যে, আমি হযরত মুসা (আ.)-এর মত বনী ইসরাঈলদের ভ্রাতৃবৃন্দ অর্থাৎ বনী ইসমাঈলের মাঝে আগমন করেছি এবং আমার মুখম-লে আল্লাহপাক স্বীয় বাণী অর্পণ করেছেন এবং তিনি এই দাবিও করেছেন যে, আমিই হলাম সত্যতার সেই প্রাণশক্তি যা হযরত ঈসা মসীহের মূল শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করা, সত্যপথ নির্দেশ করা এবং ঈসা মসীহের কসমপূর্ণ বাণীকে পরিপূর্ণতা দানের জন্য আগমন করেছি। আমি নিজের থেকে কোন কথা বলি না, তবে ঐ সকল বাণী আামি সবার সামনে প্রচার করি যা আমি উপর হতে পেয়ে থাকি। এবং শেষ জমানায় অহীয়ে ইলাহীর পরিসমাপ্তি কুরআনুল কারীমে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে : “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং আমার নিয়ামত তোমাদের প্রতি পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের জন্য ইসলাম ধর্মকে পছন্দ করলাম।” (সূরা মায়িদাহ : রুকু-১)
এই পরিপূর্ণতার প্রভাব ছিল এই যে, তিনি ইহুদীদের কোন কোন কঠিন আইন-কানুনকে যা তাদের প্রতি আরোপ করা হয়েছিল প্রকৃত পক্ষে সেগুলো দ্বীনে ইব্রাহীমের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না সেগুলোকে সংস্কার সাধন করেন; কিংবা মানুষ নিজেদের থেকে যে সকল কিতাবে যে সংযোজন ও দস্ত-দারাজি করেছিল এসব আবিলতা দূরীভূত করে এমন এক উপযোগী ও সহজ আহকাম প্রদান করেন যা সকল যুগের জন্য উপযোগী হতে পারে। এ কারণেই তিনি নিজের পরে আর কোন নতুন শরীয়ত অথবা নতুন পয়গাম্বর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করেননি। এমনকি নতুন কোন পয়গাম্বরের খবরও দেননি। এমনিভাবে নতুন কোন শরীয়তের প্রয়োজনীয়তার এন্তেজার করার আবশ্যকতাও অবশিষ্ট থাকেনি। কেননা দ্বীন পরিপূর্ণতা সাধনের পর কোন নতুন শরীয়ত অথবা নতুন কালাম আগমনের অবকাশ আর কোথায়? এবং এ নিরিখে কুরআনুল কারীমের প্রতিটি স্থানে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পূর্ববর্তী নবী ও রাসূলগণের প্রতি এবং কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান আনয়নের তাকিদ বার বার করা হয়েছে। কিন্তু কুরআনুল কারীমের কোথাও একথা বলা হয়নি যে, আপনার পরে নাজিলকৃত কিতাবসমূহ ও রাসূলগণের প্রতি ঈমান আনয়ন করতে হবে। কারণ ইসলাম পরিপূর্ণতা লাভ করার পর পরবর্তীতে কোন নবী এবং রাসূলের আগমণ কিংবা কোন নতুন কিতাব নাজিল হওয়ার পর চিরতরে রুদ্ধ হয়ে গেছে।
কুরআন সকল কিতাবের নির্যাস
মহান রাব্বুল আলামীন সর্বশেষ যে কিতাব নাজিল করেছেন তা লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত কুরআনুল কারীম। এই কুরআনই হচ্ছে পরিপূর্ণ দ্বীন বা জীবন বিধানের মূলদ-। কিন্তু এই কিতাব শুধু কেবল নিজের সত্যতার সাক্ষ্যই প্রদান করে না; বরং কিতাবের সত্যতার সাক্ষ্যও প্রদান করে। আল কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সত্যতার সাক্ষ্যদাতা এই কুরআন”। (সূরা মায়িদাহ : রুকু-৭)
কুরআনুল কারীমে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সত্যতা ও শিক্ষা পরিপূর্ণভাবে বিধৃত আছে। পূর্ববর্তী কিতাবসমূহ ছিল বিভিন্ন বিষয়ের আংশিক নিয়মতান্ত্রিকতাপূর্ণ। পরিপূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হওয়ার জন্য যে সকল পূর্ব প্রস্তুতির প্রয়োজন পড়ে পূর্ববর্তীকালের কিতাবগুলোতে সে দিক-নির্দেশনার সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী সংযোজিত ছিল। কিন্তু কুরআনুল কারীমের প্রতি যারা আনুগত্য প্রদর্শন করে এবং বিধি-বিধান মেনে চলে তারা পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের শিক্ষা ও সত্যতাকে নির্দ্বিধায় গ্রহণ করে নেয়। এই বৈশিষ্ট্যটি একমাত্র কুরআনুল কারীম ছাড়া অন্য কোন ঐশীগ্রন্থে পরিদৃষ্ট হয় না। ইরশাদ হচ্ছে : এবং আমি আপনার প্রতি সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেছি যা আপনার পূর্ববর্তী কিতাবসমূহকে সত্য সাক্ষ্য দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত করে এবং এই কুরআন পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সত্যতা ও বিশুদ্ধতার সাক্ষ্য বহন করে।” (সূরা মায়িদাহ : রুকু-৭)। কুরআনুল করীম সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে যে, পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের মুহাইমিন বা পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে এই কুরআন। এই পৃষ্ঠপোষকতা এবং সত্য সাক্ষ্য প্রদানের ভিত্তিতে সর্বশেষ নাজিলকৃত গ্রন্থ পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহের সাক্ষ্য দাতা এবং অভিভাবক। সুতরাং এ প্রসঙ্গে মুহাইমিন শব্দটির সম্যক বিশ্লেষণ একান্ত জরুরি। তাই হযরত ইবনে আব্বিাস (রা.)-এর অভিমত হচ্ছে এই যে, কুরআন হচ্ছে সাক্ষ্য দানকারী এবং আমানতদার। একইভাবে কুরআনের পূর্বেকার প্রত্যেক কিতাবকেই যথার্থ আমানতদার হিসেবে সত্য বলে রায় দিয়েছে। তাছাড়া হযরত কাতাদাহ (রা.) বলেন, কুরআনুল কারীমের পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের আমানতদার এবং বিশ্বস্ত সাক্ষ্য হচ্ছে এই কুরআন। মোটকথা, পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে যে সকল সত্যতা এবং সত্য শিক্ষার আমানত রক্ষিত ছিল সে সকল সত্যতা ও সত্য শিক্ষার আমানতসমূহ কুরআনুল কারীমের মাঝে বিধৃত আছে। বস্তুত পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের অসম্পূর্ণতাকে দূরীভূত করে কুরআনুল কারীম পরিপূর্ণতার সুস্পষ্ট নিদর্শন দুনিয়ার সামনে উপস্থাপিত করেছে। (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।