বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
মহান রাব্বুল আলামীন কোরআনুল কারীমে ‘ইয়াজুজ মাজুজ’ প্রসঙ্গটি দু’বার উল্লেখ করেছেন। (ক) ইরশাদ হয়েছে : ‘আবার সে পথ ধরল চলতে চলতে সে দুই প্রাচীরের মধ্যভাগে উপনীত হলো। সেখানে সে এমন এক সম্প্রদায়কে পেল, যারা তাঁর কথা বুঝে না। তারা বলল হে যুলকারনাইন, ইয়াজুজ মাজুজরা দেশে ধ্বংসকারী অশান্তি সৃষ্টি করে, এ ব্যাপারে কি আমরা আপনার জন্য খাজনা নির্ধারণ করব? আপনি আমাদের ও তাদের মধ্যে প্রাচীর নির্মাণ করে দেবেন। তিনি বললেন, আল্লাহ আমাকে যে সামর্থ্য দিয়েছেন তাই যথেষ্ট বরং তোমরা কায়িক শ্রম দ্বারা আমাকে সাহায্য করো যাতে আমি তোমাদের ও তাদের মধ্যস্থলে প্রাচীর নির্মাণ করে দেই। তোমরা লৌহখন্ড নিয়ে আস। ফলে মধ্যস্থিত ফাকা পূর্ণ হয়ে পর্বত সমান হলে তিনি বললেন, এবার ফুকতে থাক, তা আগুন সম হলে তিনি পুন:বললেন গলিত তামা নিয়ে আস, এর উপর ঢালাই করে দেই। ফলে ইয়াজুজ মাজুজরা এর উপর আরোহণ করতে এবং তা ভেদ করতে সক্ষম হলো না। তিনি বললেন, এটা আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ, আমার প্রভুর অঙ্গীকার পূর্ণ হলে তিনি তা’ চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেবেন, আমার প্রভুর অঙ্গীকার সত্য।’ (সূরা কাহফ : আয়াত ৯২-৯৮)।
(খ) ইরশাদ হয়েছে : ‘শেষ পর্যন্ত যখন ইয়াজুজ মাজুজ মুক্ত হবে, তারা সকল উচ্চ ভূমি হতে দ্রুত গতিতে আগমন করতে থাকবে।’ (সূরা আল আম্বিয়া : আয়াত ৯৬)।
তবে স্বভাবতই মনের কোনে এই জিজ্ঞাসার উদয় হয় যে, এই ইয়াজুজ মাজুজ কারা? এতদ প্রসঙ্গে বিভিন্ন সহীফা এবং প্রামান্য ঐতিহাসিক গ্রন্থে যা কিছু উল্লেখ করা হয়েছে, তার সারকথা এই: (ক) হযরত নূহ (আ:)-এর সময়কার মহাপ্লাবনের পর তার বংশধর তিন ব্যক্তি হতে বিশ্বময় বিস্তৃত হয়েছে। (১) হাম (২) শাম এবং (৩) ইয়াফিস। আরব আজম ও রোমের পূর্বপুরুষরা ছিলেন শাম-এর বংশধর। ইথিওপিয়া বা হাবশা এবং নাওবা অঞ্চলের পূর্ব পুরুষরা ছিলেন হাম-এর বংশধর। তুর্কি, সাকালিপ এবং ইয়াজুজ-মাজুজের পূর্বপুরুষরা ছিলেন ইয়াফিস-এর বংশধর। (শরহে আকাদায়ে সিফারনিয়্যাহ : ২/১ ১৪)।
এতে বুঝা যায় যে ইয়াজুজ-মাজুজের বিস্তৃতি বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে। (খ) আধুনিক গবেষণালব্ধ সমীক্ষায় বলা হয়েছে যে, ইয়াজুজ-মাজুজ হচ্ছে এশিয়ার উত্তর পূর্ব অঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন ইউরোপের জাতিগোষ্ঠি যারা প্রাচীনকাল থেকে সভ্য দেশগুলোর ওপর ধ্বংসাত্মক বর্বর হামলা চালিয়েছে এবং মাঝে মাঝে প্লাবনের মতো উত্থিত হয়ে এশিয়া এবং ইউরোপ উভয় দিকেই থাবা বিস্তার করেছে। (বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাস : ৯/৪৯১)।
(গ) হযরত হেজকিল (আ:)-এর সহীফা পাঠে জানা যায় যে, (৩৮-৩৯ অধ্যায়) রুশ ও তোবল (বর্তমান তোবলস্ক) এবং মসক (বর্তমান মস্কো ইয়াজুজ মাজুজদের এলাকার অন্তর্ভুক্ত। (সহীফায়ে হেজকিল (আ:) ৩৮-৩৯ অধ্যায়)।
(ঘ) ইসরাঈলী ঐতিহাসিক ইউফিসুস ইয়াজুজ মাজুজ অর্থে সিথিয়ান সম্প্রদায়কে বুঝিয়েছেন। যাদের বসবাস স্থল ছিল কৃষ্ণ সাগরের উত্তর পূর্বে অবস্থিত। কৃষ্ণ সাগর আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। (ঙ) গবেষক জিরুম-এর বিশ্লেষণ অনুসারে জানা যায় যে, ইয়াজুজ মাজুজ ককেশিয়ার উত্তরে কাস্পিয়ান সাগরের নিকট বসবাস করত। এই জাতিগোষ্ঠির লোকেরা হারামখুরীতে খুবই অভ্যস্ত। আল্লাহপাক যা হারাম করেছেন তা তাদের নিকট আজও প্রিয় খাদ্য হিসেবে বরিত হয়ে আসছে।
প্রসঙ্গত : এই ইয়াজুজ মাজুজের দলের আবির্ভাব এবং শেষ পরিণামের কথাও জানা থাকা দরকার। সাইয়্যেদেনা হযরত ইমাম মাহদী (আ:)-এর ইন্তেকালের পর ইসলামী সাম্রাজ্যের সকল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব হযরত ঈসা (আ:)-এর ওপর অর্পিত হবে। তখন অত্যন্ত শান্তি শৃঙ্খলার সাথে সকলের জীবন অতিবাহিত হতে থাকবে। এমন সময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত ঈসা (আ:)-কে অবহিত করবেন। ‘হে ঈসা, আমি এমন এক সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটাব, যাদের মোকাবেলা কেউ করতে পারবে না। তাদের সাথে যুদ্ধ করার ক্ষমতা কারো নেই। তুমি আমার বান্দাহগণকে পাহাড় পর্বতে সমবেত করো।’ (হযরত নাওয়াফ বিন সাময়ান (রা:) কর্তৃক বর্ণিত হাদীস : মোসনাদে আহমাদ)। এই সম্প্রদায়ই হলো ইয়াজুজ-মাজুজ।
লৌহ প্রাচীর ভেঙ্গে পড়ার পর ইয়াজুজ মাজুজকে উচ্চ ভূমি হতে দৌড়াতে দৌড়াতে আসতে দেখা যাবে। তাদের প্রথম দলটি তবরিয়া উপসাগরের পাশর্^ দিয়ে অতিক্রমকালে এর সবটুকু পানি পান করে ফেলবে। অন্যদল সেখান দিয়ে গমনকালে শুষ্ক সমুদ্রের দিকে লক্ষ্য করে বলবে, এখানে কি কখনো পানি ছিল? হযরত ঈসা (আ:) ও তার সঙ্গী-সাথীগণ পাহাড় পর্বতে পরিবেষ্টিত ও অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়বেন। ভীষণ দুরাবস্থায় খাল কাটাবেন। খাদ্যের তীব্র অভাব দেখা দিবে। তখন গরুর একটি মাথা একশত দীনার হতেও উৎকৃষ্ট ও মূল্যবান বলে বিবেচিত হবে। তখন হযরত ঈসা (আ:) ও তার সাথীগণ মহান আল্লাহপাকের দরবারে কায়মনো বাক্যে দোয়া করবেন। আল্লাহপাক ইয়াজুজ মাজুজের উপর ‘নাতাফ’ নামক রোগ প্রেরণ করবেন। এটা এক প্রকারক্ষত রোগ। ফলে, সকল ইয়াজুজ মাজুজ এক সঙ্গে মৃত্যু বরণ করবে।
এরপর হযরত ঈসা (আ:) ও তার সঙ্গী-সাথীগণ সমতল ভূমিতে অবতরণ করবেন। দেখতে পাবেন, সমস্ত ভূখন্ড তাদের মৃতদেহে ভরে গেছে। তখন তারা এ দুর্বিসহ পরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্য অনুনয় বিনয়সহ আল্লাহর কাছে মিনতি জানাবেন। আল্লাহপাক দীর্ঘ গর্দান বিশিষ্ট এক প্রকার পাখী প্রেরণ করবেন। তারা মৃতদেহগুলো আল্লাহর ইচ্ছায় দূর অচেনা কোনো স্থানে নিয়ে নিক্ষেপ করবে। তারপর আল্লাহপাক মূষলধারে বৃষ্টিবর্ষণ করবেন। যার পানিতে সকল কাঁচা-পাকা ঘরবাড়ী, মাঠ-ময়দান বিধৌত হয়ে আয়নার মতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে যাবে। অতঃপর আল্লাহর পক্ষহতে ভূমির প্রতি নির্দেশ হবে ‘তোমার উদ্ভিদ’ বের করো, ফলমূল বৃদ্ধি করো, বরকত ও কল্যাণ ফিরিয়ে দাও। তখন ভূমি উৎপাদিত আনারগুলো এত বড় হবে যে, একটি আনারের অংশ বিশেষ একদল লোক খেতে পারবে এবং তার খোসাতে ছায়া গ্রহণ করতে পারবে। দুগ্ধবতী পশুতে এ পরিমাণ দুধের বরকত হবে সে একটি উটনীর দুধ একটি সাম্প্রদায়ের লোক পান করে পরিতৃপ্ত হতে পারবে। একটি ছাগলের দুগ্ধ একদল মানুষের জন্য যথেষ্ট হবে। (সহীহ মুসলিম ৪০১-৪০২)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।