দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে অটোফেজি শব্দটি বহুল প্রচলিত। অটো এবং ফেজি দুই গ্রীক শব্দের সমন্বয়ে গঠিত অটোফেজি শব্দটির বাংলায় শাব্দিক অর্থ স্ব-ভক্ষন। সাধারণভাবে অটোফেজি হল ক্ষুধার্ত অবস্থায় অর্থাৎ বাহ্যিক খাবারের অনুপস্থিতিতে একটি স্বয়ং-ক্রিয় শারীরিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে শরীর নিজ থেকেই বিভিন্ন ধরনের রোগ তৈরির সহায়ক উপাদান যেমন- মৃত ও নষ্ট অন্তঃ কোষীয় উপাদান, বিষাক্ত রস এবং ত্রুটিপূর্ণ-আমিষ উপাদানগুলোকে নির্মূল করে । সাথে সাথে অন্তঃ কোষীয় উপাদানের পুনঃ চক্রের মাধ্যমে শরীরের কোষকে সুস্থ করে তোলে। দীর্ঘ সময় অনাহারে থাকার দরুন আগ্নাশয়ের গুলুকাগন হরমোনের প্রভাবে অটোফেজি প্রক্রিয়া চালু হয়। যার ফলশ্রুতিতে কোষের চতুর্দিকে আবরণ সৃষ্টির মাধ্যমে অটোফেগজম গঠন হয় যা কোষের মধ্যকার ক্ষতিকারক উপাদানকে ভক্ষণ করে। জাপানের প্রফেসর ইউশিনরি ওশুমি ইস্ট অণুজীবের উপর পরীক্ষা চালিয়ে অটোফেজির কৌশল আবিস্কার করায় ২০১৬ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। এরপর থেকেই পৃথিবীর নামকরা গবেষণাগার গুলোতে অটোফেজি নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সুস্বাস্থ্য রক্ষায় অটোফেজির চমকপ্রদ ফলাফলের জন্য বছরে বেশ কিছুদিন কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা না খেয়ে থাকা জরুরি। ক্ষেত্র বিশেষে ১২ ঘণ্টার বেশিও না খেয়ে থাকতে হয়।
বিজ্ঞানের ভাষায় নির্দিষ্ট কিছু সময় না খেয়ে থাকাকে অটোফেজি নামকরণ করা হলেও এটি মুলত ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত যাকে ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় সাওম বা রোজা বলা হয়। মহান রব্বুল আলামিন মুসলমানদের জন্য প্রতি বছর একমাস ব্যাপী রোজা রাখাকে ফরজ করেছেন। যদিও আমাদের সাধারণ ধারণা এই যে, রোজা রাখলে আমাদের শরীর দিনব্যাপি খাদ্য পানির অভাবে দুর্বল এবং অসুস্থ হয়ে যাবে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দির আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে একজন মানুষের শারিরিক এবং মানসিক সুস্থতার জন্য প্রতি বছর কিছু সময় রোজা থাকা আবশ্যক।
সুস্বাস্থ্য রক্ষায় বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত রোজা বা অটোফেজির গুরুত্বপূর্ণ কিছু অবদান নিম্নরুপঃ
১. শরীরের ত্রুটিপূর্ণ কোষ মানব দেহে ক্যান্সার সৃষ্টির অন্যতম মাধ্যম। মানব দেহের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত ত্রুটিপূর্ণ ও অকেজো কোষকে চিহ্নিতকরণ এবং নষ্ট করার মাধ্যমে রোজা ক্যান্সার সৃষ্টির প্রবণতাকে কমিয়ে দেয়। টিউমার দমন কারক হিসেবে রোজা কার্যকরী ভুমিকা পালন করে।
২. শরীরের বয়সকে ধরে রাখা রোজার অন্যতম একটি উপকার। এর মাধ্যমে নতুন কোষ তৈরি এবং পুরাতন ও অকেজো কোষ দূরীকরণের মাধ্যমে মানব দেহ দীর্ঘ জীবনীশক্তি লাভ করে।
৩. মাইটোকন্ড্রিয়াকে একটি কোষের শক্তিকেন্দ্র বা পাওয়ার হাউজ বলা হয়ে থাকে। রোজা থাকার কারনে বাহ্যিক খাবারের অভাবে মাইটোকন্ড্রিয়া চর্বিকে ভেঙ্গে শক্তি উৎপাদন করে কোষকে শক্তির যোগান দেয়। মাইটোকন্ড্রিয়ার ক্রিয়াকালে কিছু বিষাক্ত পদার্থ তৈরি হলেও রোজা কোষের সার্বিক কাজকে নিয়ন্ত্রন করার মাধ্যমে এসব বিষাক্ত পদার্থের ক্ষতি থেকে শারিরিক সুরক্ষা বজায় রাখে।
৪. শরীরে সংক্রমণশীল ব্যাকটেরিয়া যেমন মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস ও বিভিন্ন সংক্রামক ভাইরাস কে ধ্বংস করার মাধ্যমে এবং প্রদাহের কারনে সৃষ্ট বিষাক্ত উপাদান দূরীকরণের মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলে।
৫. ব্রেইনে সৃষ্ট অকেজো এবং ক্ষতিগ্রস্থ আমিষ ব্রেনের কার্যক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়। স্নায়ুর অবক্ষয়জনিত রোগ যেমন পারকিন্সন রোগের জন্য আলফা সাইনুক্লেইন ও আলজহেইমার রোগের জন্য আমাইলয়েড জাতীয় আমিষ দায়ী। এই জাতীয় ক্ষতিকারক আমিষকে দূর করার মাধ্যমে রোজা স্নায়ুর বিভিন্ন রোগ থেকে মস্তিস্ককে রক্ষা করে।
৬. রোজা কিটোসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্রেইন এবং শরীরের প্রদাহ কমিয়ে দেয় এবং ব্রেইন এর জন্য নতুন ষ্টেম কোষ তৈরি করে। এর ফলে স্নায়ুতন্ত্রের মধ্যকার সংযোগ চাঙ্গা হওয়ার দরুন ব্রেইন এর কার্যক্ষমতা অনেকাংশে বেড়ে যায়।
৭. পরিপাক তন্ত্রের কোষগুলো প্রতিনিয়ত কর্মময় থাকতে চায়। রোজার মাধ্যমে কোষগুলো বিশ্রামের সুযোগ পায় এবং এই সময়ে অকেজো কোষগুলো পুনঃচক্রের মাধ্যমে দূরীভূত হয়ে নতুন কোষের পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে পাকস্থলির ক্রিয়া তথা সার্বিকভাবে পরিপাক তন্ত্রের কার্য প্রণালী উন্নত হয়।
৮. রোজা মানবদেহে প্রদাহ সৃষ্টিকারী ত্রুটিপূর্ণ কোষকে দূর করার মাধ্যমে শরীররে বিভিন্ন সুস্থ কলা এবং অঙ্গকে আরও বেশি সুরক্ষিত করে তোলে। গ্রোথ হরমোনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে উজ্জীবিত করে তোলে।
৯. হৃৎপিন্ডের জন্য ক্ষতিকারক কোলেস্টেরলকে (স্বল্প ঘনমাত্রার লিপো-প্রোটিন) ভেঙ্গে রক্তনালির জমাটবদ্ধতা নিবারন করে এবং হৃৎপিন্ডের কোষের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে হৃৎপিন্ডের রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক রাখে। ফলে হার্ট বা হৃৎপিন্ডের গুরুতর রোগের হাত থেকে রোজা মানুষকে রক্ষা করে।
১০. রোজা রাখার দরুন রক্তে গ্লুকোজ এর পরিমান কমে যায় এবং ইনসুলিন এর ক্রিয়া সক্রিয় হয়। এর ফলে ডায়াবেটিস রোগ থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায়। উপরন্তু রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরল এর পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখার মাধ্যমে রক্তের গুনগত মান বজায় রাখে।
মহান রব্বুল আলামিনের দেওয়া প্রতিটি বিধিনিষেধ যে মানব জাতির জন্য অতিশয় কল্যাণকর, পবিত্র মাহে রমাদানের রোজা (বিজ্ঞানের ভাষায় অটোফেজি) তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। রমাদানের এই পবিত্র মাসে এখলাসের সাথে রোজা পালনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হল মহান রবের সন্তুষ্টি আর জাগতিক এই চমকপ্রদ ফায়দা মুমিনের জন্য বোনাস।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।