হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
জামালউদ্দিন বারী
তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থানের নেপথ্যে মার্কিনিদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে স্বয়ং তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের পক্ষ থেকেই। অন্যদিকে আমেরিকায় তুরস্কের নির্বাসিত বিরোধী নেতা ফেতুল্লাহ গুলেন এই অভ্যুত্থান প্রয়াসকে এরদোগানের সাজানো নাটক বলেছেন। গুলেনের এ ধরনের মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়ার সরাসরি কারণ হচ্ছে, তুরস্কের সরকারি প্রশাসনে ও রাজনীতিতে অবস্থানরত গুলেন সমর্থক বা গুলেনিস্টদের গোপন আঁতাতের মাধ্যমেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তুরস্কে এমন একটি রক্তক্ষয়ী সামরিক অভ্যুত্থানের প্লট তৈরি করেছিল বলে তুর্কি সরকারের অভিযোগ। এসব অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের লড়াইয়ে ইতোমধ্যে তুরস্ক আইএসবিরোধী যৌথ লড়াইয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তার পথ থেকে সরে এসেছে। তুরস্কে অবস্থিত একটি মার্কিন বিমান ঘাঁটি ইতোমধ্যে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে ফ্রান্সসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমা মিত্ররা তুরস্কের এরদোগান সরকারের বিরুদ্ধে নানা ধরনের হুমকি দিতে শুরু করেছে। জনগণের প্রতিরোধের মুখে সামরিক অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা সরকারগুলো এই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার নিন্দা জানিয়ে এরদোগানের প্রতি তাদের জোরালো সমর্থন ব্যক্ত করলেও অভ্যুত্থান সফল হলে এসব সরকারের বিবৃতি কী হতো তা সহজেই অনুমেয়। সে ক্ষেত্রে হয়তো এরদোগানবিরোধী হাজার হাজার মানুষকে রাস্তায় নামিয়ে উল্লাস প্রকাশ করিয়ে ‘সেনাবাহিনী ও জনগণ স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছে’ বলে বিবৃতি দেয়া হতো। অভ্যুত্থান ব্যর্থ না হলে জেনারেল আকিন ওজতুর্ক হয়তো আরেক হোসনি মোবারক, বেনআলী বা জেনারেল সিসির মতো পশ্চিমা অনুগ্রহপ্রাপ্ত দীর্ঘস্থায়ী তুর্কি শাসকে পরিণত হতেন। সাম্প্রতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, যে কোনো মুসলমান জনসংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে অগণতান্ত্রিক সেনাশাসকদের ক্ষমতা গ্রহণের পর পশ্চিমারা দ্রুতই তাদের প্রতি সমর্থন দিয়েছে। আর নেপথ্য বিষয় হচ্ছে প্রায় সব সফল সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ভূমিকা খুঁজে পাওয়া যায়।
মিসরের হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি গণভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত মোহাম্মদ মুরসির সরকারকে হটিয়ে জেনারেল সিসি আল ফাত্তাহ ক্ষমতা গ্রহণের পর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার উৎখাতের দায়ে পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। বরং জেনারেল সিসির প্রতি সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইচ্ছা, আশা-আকাক্সক্ষাকে পদদলিত করে মিসরে এখন এক অদ্ভুত স্বৈরতান্ত্রিক গণতন্ত্র চালু রেখেছেন জেনারেল সিসি। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে দাবিয়ে রাখার সমরতান্ত্রিক ক্ষমতায়ন সব সময়ই বিপরীত ফল দেয়। ১৯৫৩ সালে ইরানে প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মোহাম্মদ মোসাদ্দেক সরকারকে হটিয়ে পশ্চিমাদের অনুগত রাজতান্ত্রিক পাহলভি শাসনকে আবারো পাকাপোক্ত করতে ব্রিটিশ ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সেখানে একটি সামরিক-রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের প্লট তৈরি করেছিল। সেনাবাহিনীর একশ্রেণীর উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তার পাশাপাশি জনগণের ভেতরে থাকা সরকারবিরোধী অংশকে প্রোপাগান্ডাসহ নানাভাবে মিসগাইড করে অবৈধ সামরিক অভ্যুত্থানে বৈধতার রাজনৈতিক প্রলেপ দেয়া হয়েছিল। তবে ইরানের গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে পশ্চিমা ষড়যন্ত্র ইরানের সাধারণ মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পর তারা বুঝেছিল, পশ্চিমা ধারার গণতান্ত্রিক ফর্মুলায় সেখানে জনগণের শাসন কায়েম করা সম্ভব নয়। জনগণের এই উপলব্ধি ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতাদের প্রতি জনসমর্থন বহুগুণ বেড়ে যাওয়ার কারণেই মোসাদ্দেকের পতনের পর ২৫ বছরের মাথায় ১৯৭৯ সালে ফ্রান্সে নির্বাসিত নেতা ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে ইরানে ইসলামী বিপ্লব সম্ভব হয়েছিল। ইরানের তেল সম্পদকে জাতীয় উন্নয়ন ও জনগণের কল্যাণে সর্বোচ্চ কাজে লাগানোর লক্ষ্যে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত এংলো-ইরানিয়ান তেল কোম্পানিকে জাতীয়করণের মূল্য দিতে হয়েছিল মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে। ইরানে গণতন্ত্রকে আঁতুরঘরে হত্যা করে সেখানে আবারো পাহলভি রাজবংশের একচেটিয়া রাজতান্ত্রিক ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল। রেজা শাহ পাহলভি ইরানের হাজার বছরের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক কৃষ্টি-কালচার ধ্বংস করে ইরানকে পশ্চিমা সংস্কৃতির জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়ে পশ্চিমাদের আস্থা অর্জন করেছিলেন। পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের কারণে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ব্যর্থ হওয়ায় ইসলামী বিপ্লব ছাড়া পশ্চিমাদের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যের সেই গড্ডালিকা প্রবাহ থেকে ইরানকে বের করে আনা হয়তো সম্ভব হতো না। মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে আজ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি।
এশিয়া-আফ্রিকা ও ইউরোপে বিস্তৃত উসমানীয় (অটোমান) সা¤্রাজ্য ৭০০ বছর ধরে প্রায় অর্ধেক দুনিয়া শাসন করেছে। আজকের তুরস্ক সেই অটোমান সা¤্রাজ্যেরই অবশিষ্ট ভগ্ন অংশ। তুরস্ক এখনো এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধ হিসেবে বিবেচিত। সেই ক্রুসেডের পর থেকেই উসমানীয় খিলাফত পশ্চিমাদের প্রধান রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক টার্গেট ছিল। গত শতাব্দীতে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী দেশগুলোর পারস্পরিক অনাস্থা, দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতার ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সংঘটিত হলেও এই দুই মহাযুদ্ধের চূড়ান্ত পরিণতিতে উসমানীয় খিলাফতের পতনের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ, ফরাসি ও মার্কিনিরা মূলত অটোমান সা¤্রাজ্যের ভাগাভাগি ও পুনর্বিন্যাসে লিপ্ত হয়। ইসলামের সত্যিকারের স্পিরিট থেকে মুসলমান শাসকদের বিচ্যুতি এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অনাস্থার সম্পর্ককে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে পশ্চিমা গোয়েন্দারা অন্তর্ঘাত ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে প্রথম মহাযুদ্ধেই উসমানীয় সা¤্রাজ্যের পতন নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়। ১৮৩০ সালে ফরাসি বাহিনীর আলজেরিয়া দখলের মধ্য দিয়ে উসমানীয় সা¤্রাজ্যের পতনের সূচনা হয়েছিল, যা ১৯২৩ সালে সুইজারল্যান্ডের লুসানে সম্পাদিত ব্রিটিশ, ফরাসি, ইতালি, জাপান, রোমানিয়া, গ্রিস ও তুরস্কের মধ্যে সম্পাদিত ট্রিটি অব লুসানর মধ্য দিয়ে বিলুপ্ত হয়। উসমানীয় খিলাফতের পতন হলেও ইসলামের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের জায়নবাদী ষড়যন্ত্র একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। মুসলিম দেশগুলোর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও সম্ভাবনা নস্যাৎ করতে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রেসক্রিপশনে তাদের সম্মিলিত সামরিক শক্তি সদা তৎপর রয়েছে। জাতিগত বিভেদ হানাহানি, গৃহযুদ্ধ, আঞ্চলিক যুদ্ধ ও প্রক্সি ওয়ার অথবা মিথ্যা অজুহাতে ব্যাপক যুদ্ধের মাধ্যমে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েই পশ্চিমারা মুসলিম বিশ্বে নিজেদের পছন্দনীয় শাসদের ক্ষমতায় বসাচ্ছে। এই রিজিম চেঞ্জের পুরনো সা¤্রাজ্যবাদী নীলনকশা অনুসারে ইঙ্গ-মার্কিন যৌথ আয়োজনে ফিলিস্তিনি আরবদের জমি দখল করে ইসরাইল রাষ্ট্র গড়ে তোলার পর থেকেই ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ মধ্যপ্রাচ্যসহ প্রতিটি মুসলিম দেশে সামাজিক-রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে চলেছে। গত এক দশকে মধ্যপ্রাচ্যে আইএস জঙ্গি গ্রুপ সৃষ্টি থেকে শুরু করে তুরস্কে সর্বশেষ সেনা অভ্যুত্থান চেষ্টা পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ব্যর্থ অভ্যুত্থানের নায়ক আকিন ওজতুর্ক ইসরাইলে তুরস্কের সামরিক অ্যাটাচে হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন বলে জানা যায়। এই পুরনো যোগসূত্র কাজে লাগিয়ে তিনি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত, তুরস্কের ইতিহাসে সর্বাধিক জনপ্রিয় এরদোগান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে তুরস্ককে মিসর বা লিবিয়ার মতো অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন?
১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফরাসি জনগণের ঐক্যবদ্ধ রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় সামন্তবাদী দুঃশাসনের প্রতীক বাস্তিল দুর্গের পতনের মধ্য দিয়ে ইউরোপে নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল। সেই থেকে ১৪ জুলাই বাস্তিল দিবসকে ফ্রান্সের জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করা হয়। গত বৃহস্পতিবার ২২৬তম বাস্তিল দিবসের জাতীয় উৎসবে মেতে থাকা ফ্রান্সের নিস শহরের একটি বিনোদন কেন্দ্রের জনবহুল স্থানে ট্রাক চালিয়ে অন্তত ৮৪ জন মানুষকে হত্যা এবং শতাধিক মানুষকে আহত করেছে এক উন্মত্ত নরপিশাচ। পশ্চিমা মিডিয়া ইতোমধ্যেই তাকে একজন মুসলমান হিসেবে শনাক্ত করেছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গি সংগঠন আইএস এর দায় স্বীকার করেছে বলে জানা গেছে। গত বছর জানুয়ারিতে শার্লি এবদো, নভেম্বরে বাতাক্লঁ কনসার্ট হলে সন্ত্রাসী হামলায় দুই শতাধিক মানুষ নিহত হওয়ার পর গত দেড় বছরের মধ্যে এটি ফ্রান্সে তৃতীয় সন্ত্রাসী হামলা, এর প্রতিটি ঘটনায় আইএস দায় স্বীকার করেছে। এসব ঘৃণ্য বর্বরোচিত হত্যাকা-ে আইএস দায় স্বীকার করার সাথে সাথেই পশ্চিমা মিডিয়াগুলো তাদের ইসলামোফোবিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে একযোগে ইসলামবিরোধী কোরাস গাইতে শুরু করে। তবে এখন তাদের গতানুগতিক প্রচারণা বিশ্বব্যাপী মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা বা গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলতে শুরু করায় জঙ্গিবাদ বিশ্লেষণে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটতে শুরু করেছে। সন্ত্রাসী ঘটনার সাথে জড়িত হামলাকারী একজন হোক বা একাধিক হোক, সশস্ত্র হোক বা নিরস্ত্র হোক, নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যার পর হামলাকারীকেও নিহত দেখানো হচ্ছে। তবে নিহত হামলাকারীরা যে মুসলমান ছিল তার কিছু তথ্যপ্রমাণ অকুস্থলে রেখে যাচ্ছে! দেড় দশক আগে নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে বিমান হামলা থেকে শুরু করে শার্লি এবদো, বাতাক্ল কনসার্ট হল, গত মাসে অরল্যান্ডো নাইটক্লাব অ্যাটাক এবং সর্বশেষ বাস্তিল দিবসের ট্রাক হামলা পর্যন্ত এর কোনো ব্যত্যয় দেখা যায়নি। প্রতিটি ঘটনার পরই ইউরোপ-আমেরিকায় মুসলমান অভিবাসী ও অভিবাসন প্রত্যাশীদের ওপর নতুন নতুন খড়গ নেমে এসেছে। ইসলাম-বিদ্বেষ ও জাতিগত বৈষম্যমূলক আইনকানুন ও রাজনীতির পালে হাওয়া লেগেছে।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশও এই হেজিমনির রাজনৈতিক টার্গেটের বাইরে নয়। ঢাকার গুলশানে আর্টিজান রেস্টুরেন্ট ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদ জামাতের পাশে সন্ত্রাসী হামলার সাথে আইএস জড়িত থাকার বিষয়টি অথেনটিকেট করছে সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ। ১ জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় অজ্ঞাত সন্ত্রাসীদের জিম্মি নাটক চলার সময় আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন ভেতরের অবস্থা সম্পর্কে তেমন কিছু তথ্য দিতে পারছিল না, তখন সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ আইএস জঙ্গিদের বার্তা সংস্থা আমাক নিউজের বরাত দিয়ে প্রায় ২০ জন বিদেশিসহ অন্তত ২৫ জনকে হত্যার সাথে জড়িত ৬ জন জঙ্গির ছবি প্রকাশ করে। ২ জুলাই সকালে সেনাবাহিনীর কমান্ডো ইউনিটের ১৫ মিনিটের ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ শেষ হওয়ার পর সাইট ইন্টেলিজেন্সের প্রচারিত সংবাদ ও চিত্রের সত্যতার প্রমাণ বেরিয়ে আসে। ইতিপূর্বের আরো কয়েকটি টার্গেটেড কিলিংয়ের ঘটনায় আইএসের দায় স্বীকারকে আমাদের সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃপক্ষ প্রত্যাখ্যান করে দেশীয় জঙ্গি ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর দায় চাপানোর কোশেশ করলেও এবারের ঘটনায় ওভাবে অস্বীকার করা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বাংলাদেশে আইএস জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক থাকার বিষয়টিকে সামনে এনে যারা জঙ্গি দমনে বহুজাতিক উদ্যোগে বাংলাদেশকে সরাসরি সম্পৃক্ত করতে দীর্ঘদিন ধরে সচেষ্ট ছিল, হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলার পর তারা অনেকটা সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। দেশে রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠার সর্বজনীন আহ্বানে সরকার সাড়া না দিয়ে বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন বাড়িয়ে ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে চাইলে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ষড়যন্ত্রকারীদের নীলনকশার বাস্তবায়নই সহজ হতে পারে। গুলশান ও শোলাকিয়ায় তথাকথিত আইএস জঙ্গি হামলার পর বাংলাদেশে পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সেই সাথে শুক্রবারের জুমার খুতবায় সরকারি নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব আনা হয়েছে। যদিও ইসলামে সন্ত্রাস জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা নেতারাও আইএসের সাথে প্রকৃত ইসলাম তথা কোরআন-হাদিসের শিক্ষা এবং প্রকৃত মুসলমানদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করছেন। তথাপি ডি-র্যাডিকেলাইজেশনের নামে ইসলামী শিক্ষা, ও মূল্যবোধের চর্চাকে সঙ্কুচিত করে তুলতে এসব জঙ্গি হামলাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বাধা দিয়ে বা বাধ্য করে ইসলামী শিক্ষা ও কোরআন-হাদিসের অনুশাসন থেকে নিবৃত্ত রাখার ফলাফল কখনো কোথাও সফল হয়নি। এ ধরনের প্রয়াস সব সময়ই শাসকদের জন্য বুমেরাং বা বিপরীত ফল দিয়েছে। সন্ত্রাসবাদের মিথ্যা অভিযোগ তুলে পশ্চিমা দুনিয়ায় মুসলমানদের ওপর যত বেশি নিয়ন্ত্রণ ও বৈষম্যমূলক নীতি আরোপ করা হয়েছে পশ্চিমা অনুসন্ধিৎসু তরুণরা তত বেশি ইসলামের প্রতি কৌতূহলী হয়ে কোরআনের শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন।
ফ্রান্সে বার বার সন্ত্রাসী হামলার পেছনে কোনো কোনো বিশ্লেষক মধ্যপ্রাচ্যে ফ্রান্সের অব্যাহত ও ঐতিহাসিক হস্তক্ষেপকে দায়ী করছেন। বাস্তিল দিবসে ফ্রান্সের নিস শহরে ট্রাক হামলায় অন্তত ৮৪ জন নিহত হওয়ার পর ডিসিডেন্ট ভয়েস জার্নালের সাবেক সহ-সম্পাদক কিম পেটটারসনের লেখা ডিসিডেন্ট জার্নালে প্রকাশিত একটি নিবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘স্টপ ইউজিং মিলেনারি রিলিজিয়নস এজ অ্যা স্কেপগোট ফর দ্য ক্রাইমস অব মডার্ন ইম্পেরিয়ালিজম’। অর্থাৎ এই শিরোনামে কিম পেটারসন হাজার বছরের পুরনো ধর্মগুলোকে নব্য সা¤্রাজ্যবাদের অপরাধমূলক তৎপরতার বলির পাঁঠায় পরিণত করা বন্ধ করার কথা বলেছেন। নিবন্ধটি মূলত একটি সাক্ষাৎকারভিত্তিক রচনা। পেটারসনের এই সাক্ষাৎকারটি ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মুখোশ উন্মোচনকারী রুগ স্টেট গ্রন্থের লেখক, ইউলিয়াম ব্লামের সাথে অনলাইনভিত্তিক। ইউলিয়াম ব্লাম বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস ও সামরিক আগ্রাসনের জন্য মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের ভূমিকা তুলে ধরলেও ইসলাম ধর্ম ও কোরআন-হাদিস সম্পর্কে তার অজ্ঞতা ও সীমাবদ্ধ জ্ঞান নিয়ে কিম পেটারসন প্রশ্ন তুলেছেন। সেখানে তিনি নিবন্ধটির শুরুতেই পবিত্র কোরআনের সূরা আনফালের ৬১ নম্বর আয়াত এবং জিহাদ সম্পর্কে এবং জ্ঞান আহরণ সম্পর্কে একটি সহি হাদিস উদ্ধৃত করেছেন। সূরা আনফালের ৬১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর তারা যদি সন্ধি বা শান্তির দিকে ঝুঁকে, আপনিও সেদিকে ঝুঁকবেন এবং নির্ভর করবেন আল্লাহর ওপর। বস্তুত তিনি (আল্লাহ) সব জানেন এবং শোনেন।’ জিহাদ সম্পর্কিত হাদিসটিতে আল্লাহর রাসূল বলেছেন, ‘সর্বোত্তম জিহাদ হচ্ছে নিজের প্রবৃত্তিকে জয় করা’, বিদ্যানের কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও পবিত্র’। কিম পিটারসন কোরান হাদিসসহ ইসলামী জ্ঞান চর্চা করেছেন এবং কয়েক বছর মুসলিম দেশে বসবাস করে সেখানকার জীবনচিত্র সম্পর্কে অবগত হয়েও নিজেকে ইসলামী জ্ঞানে যথেষ্ট সমৃদ্ধ, এমন দাবি করতে রাজি নন। তবে উইলিয়াম ব্লামের সাথে যুক্তিতর্কে পেটারসন অনেকগুলো উদাহরণ ও গ্রন্থের উদ্ধৃতি তুলে ধরেছেন, যেখানে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের পর পশ্চিমা গবেষকদের অনেকে ইসলামের শান্তিবাদী অবস্থানকে তুলে ধরেছেন। ইসলাম এবং ক্রিশ্চানিটির একটি সংক্ষিপ্ত ও তুলনামূলক আলোচনার শেষে পেটারসন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের সাথে যেমন খ্রিস্ট ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই, তেমনি তথাকথিত ইসলামী জঙ্গিবাদের সাথেও ইসলাম ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে ইসলামে অন্যায়ের প্রতিরোধের আহ্বান আছে। মুসলমানদের মধ্যে পশ্চিমাদের প্রতি ঘৃণা ও জঙ্গিবাদ শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়নি। মুসলমানদের সম্পদ লুণ্ঠন এবং পশ্চিমা সামরিক আগ্রাসনের ধারাবাহিক ঘটনাবলী মুসলমানদের বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে।
পশ্চিমা নেতারা এখন একযোগেই বলছেন, ইরাক যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভুল নীতির কারণে জঙ্গিবাদী গ্রুপ আইএসের জন্ম হয়েছে। ইসলামোফোবিয়ার এজেন্ডা বাস্তবায়িত করতেই ইসরাইলসহ পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীরা আইএস (দায়েশ)-কে সশস্ত্র করেছে, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যে জাতিগত ও ফিতনা সৃষ্টি করে পশ্চিমা বশংবদ সরকারগুলোকেও সন্ত্রাসবাদী তৎপরতায় অর্থায়নে বাধ্য করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে এসব তথ্য এখন আর গোপন থাকছে না। যদিও পশ্চিমা কর্পোরেট মিডিয়া সব সময়ই প্রকৃত সত্য আড়াল করতে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারেই ব্যস্ত রয়েছে। ফ্রান্সের নিস শহরে বাস্তিল দিবসে ট্রাক হামলার নারকীয় ঘটনা সম্পর্কে লেখা এক নিবন্ধে আইরিশ সাংবাদিক এবং প্যারিসভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক জেরোদ অ কলমেইন নিসের ঘটনাকে ফরাসি গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা অথবা জায়নবাদী এজেন্ডার বাস্তবায়ন কিনা, এই প্রশ্ন তুলেছেন। এখানে জেরোদ কলমেইন মন্তব্য করেছেন, বর্তমান বিশ্বের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কর্মকা-ের ৯০ ভাগ বা তার বেশি পরিচালিত হচ্ছে মিডিয়া ডিজইনফরমেশনের কাজে। এ কারণে কোথায় কী ঘটছে তার প্রকৃত সত্য শুধু মিডিয়ার রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বাস করা যায় না। এমনকি আমাদের মতো দেশেও সরকারি-বেসরকারি গণমাধ্যমের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ এবং রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির কারণে এমনকি সাধারণ মানুষের কাছেও বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। এভাবেই আমাদের দেশেও সরকার, সামাজিক ব্যবস্থা, রাজনীতি, মিডিয়া ও শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীন একটি চরমপন্থি প্রজন্ম গড়ে উঠছে। যারা পশ্চিমা ধাঁচের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও জঙ্গিবাদের প্রলোভনে জড়িয়ে পড়ছে। পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদ এবং তাদের অনুসারী অথবা বশংবদ সরকারগুলো কর্পোরেট ও জায়নবাদী এজেন্ডায় রাষ্ট্র ক্ষমতার অপব্যবহার অব্যাহত রেখে শুধুমাত্র পুলিশ বা সেনাবাহিনী দিয়ে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের সমস্যা দূর করা কখনো সম্ভব নয়। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের আন্তর্জাতিক সা¤্রাজ্যবাদী এজেন্ডা এবং মানব মনস্তত্ত্বের স্বাভাবিক বিবর্তন ও গতি-প্রকৃতিকে অগ্রাহ্য করে ঘৃণার বদলে ঘৃণা এবং সন্ত্রাসের বদলে সন্ত্রাস মোকাবেলার ভ্রান্ত কৌশল কোনো কাজে আসছে না।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।