Inqilab Logo

রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের বৈপরিত্য এবং কর্পোরেট লুটপাটের অর্থনীতি

প্রকাশের সময় : ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জামালউদ্দিন বারী : অনৈতিক পুঁজিতান্ত্রিক সা¤্রাজ্যবাদি বিশ্বব্যবস্থায় কোন তন্ত্রই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। চলমান বিশ্ববাস্তবতায় যে অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা এবং অবিমৃষ্যকারিতা লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে তা’ একচেটিয়া পুঁজিবাদি বিশ্বব্যবস্থারই কুফল। রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে শুরু করে মানুষের জীবনাচার, রাজনীতি, অর্থনীতি, চিন্তার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মীয়-সংস্কৃতির লালন, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের চর্চাসহ সবই পুঁজিবাদী একচেটিয়া কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণের অধীনে চলে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, লাটিন আমেরিকা, এশিয়া, ইউরেশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকান সাব-সাহারাসহ বিশ্বের ধনী-দরিদ্র সব দেশের উপর এই কর্পোরেট সা¤্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রণ ক্রমে জোরদার হয়ে উঠছে। পূর্ব ও পশ্চিমের শহুরে মধ্যবিত্তশ্রেণীর চাহিদা অনুপাতে ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া এবং শ্রমঘন শিল্পে দক্ষ শ্রমিকের সহজলভ্যতার বৈষম্যের কারণে অপেক্ষাকৃত জনবহুল উন্নয়নশীল অঞ্চলের শিল্পোদ্যোক্তাদের সুবিধাজনক অবস্থানে এনে দিয়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পশ্চিমের মধ্যবিত্ত, নি¤œমধ্যবিত্ত ভোক্তারা সস্তায় পণ্যসামগ্রী পাওয়ার সেই সুযোগ গ্রহণ করায় চীন, ভারত কোরিয়া, ব্রাজিলের মতো দেশের নব্য উদ্যোক্তাদের কাছে পশ্চিমা মেনুফ্যাকচারিং খাত মার খাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই বৈদেশিক বাণিজ্য ও ঋণের পাল্লা দ্রুত উন্নয়নশীল নন-ওয়েস্টার্ন দেশগুলোর দিকে ভারী হতে চলেছে। পশ্চিমের কর্পোরেট কোম্পানিগুলো নিজেদের মুনাফার প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে প্রতিবছর হাজার হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করায় সেখানে বেকার জনসংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তায় বাড়তি চাপ সৃষ্টি হলেও ফেডারেল বাজেটে ঘাটতির কারণে অর্থনৈতিক সামাজিক নিরাপত্তার পরিসর ক্রমে সঙ্কচিত হয়ে পড়ছে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর নাগরিকরা কর্পোরেট নিয়ন্ত্রকদের কাছে নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে শুরু করেছে। এই দশকের শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক মন্দার সময় পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রতীক ওয়ালস্ট্রিটের দখল নিতে ‘অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট’ শ্লোগান তুলে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল। প্রায় একই সময়ে আমাদের দেশে লাখ লাখ মানুষ শেয়ার বাজারে পুঁজি হারানোর মতো মার্কিন যুক্তরাষ্টে ব্যাংকঋণে দেউলিয়া, চাকরি হারানো এসব মানুষ নিজেদেরকে সে দেশের ৯৯ ভাগ মানুষের প্রতিনিধি বলে দাবি করেছিল। অর্থনৈতিক মন্দা থেকে উত্তরণের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো হাজার হাজার কোটি ডলারের বেইল আউট বাজেট ঘোষণা করে শুধুমাত্র কর্পোরেট কোম্পানিগুলোকে লে-অফ হওয়া থেকে রক্ষা করলেও কোটি মানুষের অর্থনৈতিক-সামাজিক নিরাপত্তা ও বৈষম্য নিরসনে কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। উপরন্তু অর্থনৈতিক সা¤্রাজ্যবাদের মুখোসটিকে রক্ষা করতে কৌশলে পুরো বিশ্বকে একটি নতুন যুদ্ধসজ্জা ও অস্ত্রপ্রতিযোগিতার মধ্যে ঠেলে দেয়ার যে পরিকল্পনা তারা ইতিমধ্যেই গ্রহণ করেছিল, সেটি আরো বেগবান হয়ে উঠে। অর্থাৎ এমআইসি বা মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের ওপর ভর করে এককেন্দ্রিক অর্থনৈতিক সা¤্রাজ্যবাদ টিকিয়ে রাখার শেষ চেষ্টা এখন চলছে। ওয়ার অন টেররিজমের নামে সারাবিশ্বে এক ভয়ঙ্কর ভীতি ছড়িয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্বের সম্পদ লুণ্ঠনের এক কুৎসিৎ প্রতিযোগিতা চলছে। মধ্যপ্রাচ্য, মধ্যএশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে লুণ্ঠন ও ভাগাভাগির এই প্রতিযোগিতায় সাবেক দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তির পাশাপাশি চীন ও ভারতের মতো অগ্রসরমান পরাশক্তিগুলোর মধ্যেও একপ্রকার বোঝাপড়া এবং ঠা-া লড়াইয়ের চিত্র লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে।
গণতন্ত্র ও সম্পদের ওপর জনগণের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণই হচ্ছে আন্তর্জাতিক সা¤্রাজ্যবাদ এবং আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের পথে প্রধান বাঁধা বা চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ ও দ্বন্দের অভিজ্ঞতা আমাদের কাছে নতুন বিষয় নয়। একচেটিয়া বাণিজ্যকে পাকাপোক্ত করার এক পর্যায়ে ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘল-ভারতের শাসন ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে কী-না করেছিল? প্রায় দুশ বছরের প্রত্যক্ষ উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পরও আমরা প্রত্যাশিত গণতন্ত্র এবং জনগণের সম্পদের নিয়ন্ত্রণ পাইনি। সাবেক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণের স্থলে আমাদের ওপর আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক আধিপত্যবাদের বহুবিধ কুশীলবের নিয়ন্ত্রণ আরো বেশি ভোগান্তির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকট পশ্চিমা কর্পোরেট মিডিয়ার অন্যতম আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হতে দেখা গেছে। গত ডিসেম্বরে জেনেভায় অনুষ্ঠিত টেড কনফারেন্স ভিডিওটি কয়েকদিন আগে আইসিএইচ ব্লগে প্রকাশিত হয়, টেড কনফারেন্স হচ্ছে বিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সমস্যা সম্পর্কিত জনমত গঠনে একটি পশ্চিমা বেসরকারি উদ্যোগ। জেনেভায় অনুষ্ঠিত টেড কনফারেন্সে গ্রিসের সাবেক অর্থমন্ত্রী এবং অর্থনীতিবিদ ইয়ানিস ভারোফাকিশ-এর ১৮ মিনিটের বক্তৃতার শিরোনাম, ‘ক্যাপিটালিজম উইল ইট ডেমোক্রেসি-আনলেস উই স্পিক আপ’। আমরা (জনগণ) যদি প্রতিবাদি না হই পুঁজিবাদ গণতন্ত্রকে খেয়ে ফেলবে। তিনি সম্ভবত এখানে গ্রিস, ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলতে চেয়েছেন। ইয়ানিস ভ্যারোফাকিশ নিজের অভিজ্ঞতার আলোকেই বলেন, আজকের দিনে সরকারগুলো দেশের প্রকৃত সমস্যাগুলো সমাধান করতে ব্যর্থ হচ্ছে, এর কারণ হচ্ছে- আপনি হয়তো রাজনীতিতে আছেন, কিন্তু ক্ষমতার মূল নিয়ন্ত্রণটি রয়েছে অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রকদের হাতে। ধনিক শ্রেণী ও কর্পোরেট শক্তিগুলো রাজনীতিকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করছে বলে তিনি মনে করেন, এই রাজনীতিক-অর্থনীতিবিদ এমন দিনের স্বপ্ন দেখছেন, যখন পুঁজির সাথে শ্রমিকের কোন দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকবেনা, আশাবাদি মানুষ হিসেবে আমরা নিজেদের দেশ ও সমাজব্যবস্থা নিয়ে স্বপ্ন দেখতেই পারি। তবে বিশ্বব্যবস্থার নিয়ন্ত্রকরা আমাদের জনগণের ইচ্ছার উপর আমাদের শাসনব্যবস্থা তথা গণতন্ত্র ও অর্থনীতিকে পরিচালিত হতে দিতে প্রস্তুত নয়। মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়া-আফ্রিকার দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গণতন্ত্র থাকলে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদিদের দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের গণতন্ত্র দেশের অভ্যন্তরে এবং পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। আমাদের জনগণ গণতন্ত্র চায়, কিন্তু পশ্চিমারাও কি সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশে গণতন্ত্র চায়? বিগত সংসদ নির্বাচন, আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থা এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণে বর্তমানে তারা যে অবস্থান গ্রহণ করেছে তার পেছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের পরিবর্তিত অবস্থান। রাজনৈতিক সরকার তার ক্ষমতা ধরে রাখতে গোপন বোঝাপড়ায় তাদের সাথে সহাবস্থানে পৌঁছতে পারলে স্বৈরতন্ত্র, রাজতন্ত্র বা গণতন্ত্র তাদের কাছে মুখ্য বিষয় নয়। যুদ্ধবাজ অর্থনৈতিক সা¤্রাজ্যবাদ এবং কপোর্রেট অর্থনীতির কুশীলবদের কাছে কখনো কখনো দেশ-কালের চেতনা গৌণ হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে রোড আইল্যান্ডে বসবাসকারি মার্কিন লেখক, জো ক্লিফোর্ড সম্প্রতি লেখা এক নিবন্ধে প্রশ্ন রেখেছেন, মার্কিন জনগণকে ক্যানসার থেকে রক্ষায় ৪ বিলিয়ন ডলারের একটি গবেষণা প্রকল্প বন্ধ রেখে ১৩ বিলিয়ন ডলারের একটি বিমানবাহী রণতরী নির্মাণের প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি প্রশ্ন রাখেন, প্রতিদিন কতজন মার্কিনী তথাকথিত সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হচ্ছেন, আর কতজন মার্কিন নাগরিক ক্যান্সারে মারা যাচ্ছেন। ক্যান্সারে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি হলেও তাদের অর্থ খরচের আগ্রহ কিন্তু সন্ত্রাস বিরোধি সামরিক বাজেটের উপরই নিবদ্ধ। কারণ এর পেছনে রয়েছে কর্পোরেট পুঁজিবাদ, বিশেষত: এমআইসি’র প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ ও দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের বিষয়। অবশ্য ক্যান্সার নিয়েও কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর বিশাল অর্থনৈতিক এজেন্ডা রয়েছে।
অষ্টাদশ শতকে (১৭৭৬ সালে) টমাস জেফারসন, জন এডামস এবং বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন যৌথভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার যে ঘোষণা প্রকাশ করেছিলেন তাতে বলা হয়েছিল, ‘আমরা এই সত্যকে মেনে চলার অঙ্গিকার করছি যে, সৃষ্টিকর্তা সব মানুষকে কিছু অবিচ্ছেদ্য অধিকার দিয়ে সমানভাবে সৃষ্টি করেছেন, এসব অধিকার হচ্ছে-জীবন, স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের নিশ্চয়তা।’ উই হোল্ড দিজ ট্রুথস টু বি সেল্ফ এভিডেন্ট, দ্যাট অল মেন আর ক্রিয়েটেড ইকোয়াল, দ্যাট দে আর এনডাউড বাই দেয়ার ক্রিয়েটর উইথ সারটেইন আনএলিনেবল রাইটস, দ্যাট অ্যামং দিজ আর লাইফ, লিবার্টি অ্যান্ড দ্য পারসুইট অব হ্যাপিনেস’। গত আড়াইশ বছর ধরে এই বাক্যবন্ধ ইংরেজি ভাষার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ বাক্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। পশ্চিমা গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং বৈষম্যমুক্ত সমাজব্যবস্থা নির্মাণের মূল গ্যারান্টি ছিল মার্কিন স্বাধীনতার এই ঘোষণা। কপোর্রেট পুঁজিবাদের রাক্ষুসে ক্ষুধা মার্কিন গণতন্ত্রের এই আপ্তবাক্যের অঙ্গিকারকে পদানত করে এখন শ্রেফ সংবিধানের কাগুজে বিষয়ে পরিণত করেছে। ধর্ম, বর্ণের পার্থক্য, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ-বৈরিতা, ভীতি ও নিপীড়নের মধ্য দিয়ে তারা মার্কিন গণতান্ত্রিক সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে যুদ্ধবাদি অর্থনীতির নিয়ামক পদ্ধতিতে পরিনত করেছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাবেক অ্যাসোসিয়েট এডিটর এবং মার্কিন ট্রেজারির ইকোনমিক পলিসি বিষয়ক সাবেক এসিসটেন্ট সেক্রেটারি ড. পল ক্রেইগ রবার্টস তার সাম্প্রতিক এক নিবন্ধের শিরোনাম দিয়েছেন, ‘দ্য ওয়েস্ট ইজ রিডিউজড লুটিং ইটসেল্ফ’। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করে পশ্চিমা কর্পোরেট কোম্পানিগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অর্থনৈতিক লুণ্ঠন জোরদার করছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখিয়ে সম্পদ লুণ্ঠনের পন্থা অবলম্বন করছে। একদিকে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের দোহাই দিয়ে জনগণের উপর বাড়তি ট্যাক্সের বোঝা চাপিয়ে সরকারের প্রভাবশালী ও অসৎ অংশীদাররা এবং কর্পোরেট কোম্পানিগুলো যৌথভাবে জনগণের সম্পদ লুণ্ঠনের প্রক্রিয়া বজায় রাখছে। অন্যদিকে সন্ত্রাসী গ্রুপ, জাতিগত ও আঞ্চলিক শত্রুর জুজু দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র ও নিরাপত্তা সরঞ্জামের ব্যবসায় করে কর্পোরেট মুনাফাবাজি এবং শাসকশ্রেণীর কমিশন বাণিজ্যের সুযোগ অবারিত করা হচ্ছে। এভাবেই তথাকথিত উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়ে দেশগুলোকে বৈদেশিক ঋণ এবং কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণের আওতায় নিয়ে আসা সহজ হচ্ছে। পল ক্রেইগ রবার্টস এ প্রসঙ্গে ইউরোপের গ্রীস এবং পর্তুগালের কথা উল্লেখ করেছেন, সর্বশেষ ইতালি এবং স্পেনের অর্থনীতির নাজুক অবস্থাও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এসব দেশের গণতন্ত্র ও সরকার ব্যবস্থার বাস্তবতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘দ্য পিপলস আর পাওয়ারলেস বিকজ দেয়ার গভর্নমেন্টস ডু নট রিপ্রেজেন্ট দেম’। প্রোপাগান্ডা, ঘুষ-দুর্নীতি ও কালোটাকার শক্তির সম্মিলিত তৎপরতা এবং শাসকশ্রেণীর মূর্খতার কাছে ইউরোপীয় জনগণের অসহায়ত্ব চরমভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বলে মনে করা হচ্ছে। ইউরোপের এই বাস্তবতার সাথে বাংলাদেশ ও উপমহাদেশের বাস্তবতার কিছু পার্থক্য থাকলেও জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন ও অর্থ পাচারের সার্বিক অবস্থায় এক প্রকার সাযুজ্য বিদ্যমান রয়েছে।
বাংলাদেশের নাগরিকরা এখন এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন যার জবাব দেয়ার সুযোগও তাদের হাতে নেই। ঊনিশশ’ একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে পুরো ষাটের দশকে জেনারেল আইয়ুব খানের সরকার এ দেশের মানুষকে গণতন্ত্রের বদলে উন্নয়নের কথা বলেছিল। সত্তুরের নির্বাচন এবং রক্তাক্ত স্বাধীনতা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে লাখো প্রাণের বিনিময়ে বিজয় ছিনিয়ে আনার মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষ প্রমান করেছে, তারা তথাকথিত উন্নয়নের চেয়ে গণতন্ত্র ও স্বাধীকারের দাবিকেই বেশি মূল্য দিয়ে অর্জন করতে চায়। এ দেশের জনগণ নয় মাসে স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হলেও রাজনৈতিক বিভেদের কারণে সামরিক স্বৈরাচার হঠাতে ৯ বছর সময় লেগেছিল। বাংলাদেশের মানুষকে উন্নয়নের যে সব স্বপ্ন ও পরিসংখ্যানের বাণী শোনানো হচ্ছে তার সাথে বাস্তবতার কোন মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বছরের পর বছর ধরে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে স্থবিরতা বিরাজ করছে। ক্রমবর্ধমান বেকার জনশক্তির চাপ বহনে আমাদের সমাজ এবং অর্থনীতি অক্ষম হয়ে পড়েছে। দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকায় হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। লাখ লাখ মানুষ অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। স্থল ও সমুদ্রপথে ইউরোপের বর্ডারগুলোতে যখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে হাজার হাজার রিফিউজি ভিড় জমাচ্ছে, সেখানে অনাকাঙ্খিতভাবে বাংলাদেশিদের উপস্থিতিও বিশ্ববাসীর নজর কাড়ছে। তাদের কেউ কেউ গুলি খেয়ে মরতে রাজি, কিন্তু বাংলাদেশে ফিরে আসতে রাজি নয়, ইত্যাদি শ্লোগান সম্বলিত প্লাকার্ড বহন করে মিডিয়ার সামনে হাজির হতে দেখা গেছে। দেশে আইনের শাসন নেই, গণতন্ত্র নেই, মানবাধিকার নেই, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান না থাকলেও উন্নয়ন আছে ! এ এক অবিশ্বাস্য বাস্তবতার মুখোমুখি আমরা। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ না হওয়া, কর্মসংস্থানের সুযোগ সঙ্কুচিত হওয়া এবং ব্যাংকগুলোতে অলস টাকা জমা হওয়া এবং বিদেশে পুঁজি পাঁচার হওয়ার পেছনে দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং অদৃশ্য অস্থিরতাকেই দায়ী করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। এসব সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের বদলে দেশকে আরো বেশী অস্থির, অস্থিতিশীল এবং অনিরাপদ করে তোলার জন্য সরকার যেন সব রকমের আয়োজন জোরদার করে যাচ্ছে। শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিরোধিদলীয় নেতার একটি রাজনৈতিক বক্তব্যকে কেন্দ্র করে দেশদ্রোহ মামলা, যুদ্ধাপরাধিদের বিচারের পাশাপাশি নানা আয়োজন থেকে মনে হতে পারে, সরকার বিরোধি রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় আনার ন্যূনতম চেষ্টার বদলে তাদেরকে একটি সবার্ত্মক দ্বন্দ্ব ও বৈরিতার পথেই ঠেলে দিতে চাচ্ছে। ন্যূনতম বোধ সম্পন্ন একজন সাধারণ মানুষও বোঝেন, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হওয়া ছাড়া দেশে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এ জন্য প্রথমেই প্রয়োজন একটি ক্রেডিবল ইলেকশন এবং সত্যিকার অর্থে জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার। ইতিহাসের অনিবার্য বাস্তবতায় বাংলাদেশে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের আলখেল্লার নিচে একটি দ্বি-দলীয় শাসকচক্র গড়ে উঠেছে। একটি সময়োপযোগী বিকল্প রাজনৈতিক প্লাটফর্ম সৃষ্টি হওয়ার আগ পর্যন্ত এ দেশের দ্বিধাবিভক্ত মানুষ হয়তো আরো কয়েকবার পালাক্রমে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ অথবা তাদের নেতৃত্বাধীন জোটকে ক্ষমতায় আনতে চাইবে। একটি রাজনৈতিক পক্ষ আরেকটি পক্ষকে স্বচ্ছ ও নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় মোকাবিলা করার বদলে, গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথ রুদ্ধ রেখে রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে অথবা সন্ত্রাসী কায়দায় সমূলে ধ্বংস করে দেয়ার চেষ্টা করলে তা’ দেশের গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের সম্ভাবনাকে নস্যাতের পদক্ষেপ হিসেবেই গণ্য হবে। অতীতে হঠকারি রাজনীতির কারণে আমরা বার বার পিছিয়ে পড়া সত্ত্বেও, সম্ভাবনার তুলনায় অর্জন অনেক কম হওয়া সত্ত্বেও এ দেশের সংগ্রামী সাহসী জনগণ বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং গার্মেন্টস শিল্পের মতো শিল্পদ্যোগকে সামনে এগিয়ে নিয়ে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছে। দেশের সরকার এবং সব রাজনৈতিক শক্তি এই অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার অংশীদার। কোন প্রতিশোধ-প্রতিহিংসা নয়, এ দেশের অসহায় মানুষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের সুমতি এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান প্রত্যাশা করেন। কোন সা¤্রাজ্যবাদি বা কর্পোরেট রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এজেন্ডা নয়, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সৃষ্টিকর্তা এবং জনগণের কাছে দায়বদ্ধ সরকার কায়েম করতে চায়।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের বৈপরিত্য এবং কর্পোরেট লুটপাটের অর্থনীতি
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ