হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
আবদুল আউয়াল ঠাকুর
সাম্প্রতিক হামলা এবং হামলার সাথে সম্পৃক্ত থাকার সূত্র ধরে দেশের নামিদামি বিশেষ করে ইংরেজি শিক্ষিত তরুণদের নাম প্রকাশিত হওয়ার পর আলোচনা নানা মাত্রিকতায় উন্নীত হয়েছে। অনেক দিন থেকেই এ আলোচনা দেশ ও দেশের বাইরে নিয়ে ছিল। বর্তমানে তা আরো বিস্তৃত হয়েছে। সেই সাথে কারণ অনুসন্ধানের এক ধরনের চেষ্টা বিভিন্ন মহল থেকেও করা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি শুধু বিষয় নিয়েই কথা বলেননি সেই সাথে মৌলিক কিছু প্রশ্নও তুলেছেন। পবিত্র ঈদের দিনের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ...তাদের কিছু বক্তব্য আমরা পেয়েছি। তারা শরিয়া আইন কায়েম করবে, মানুষের তৈরি আইন নাকি চলবে না। আমার প্রশ্ন, যারা এ কথা বলছে তারা তো ইন্টারনেট ব্যবহার করছে অথবা ফেসবুক ব্যবহার করছে অথবা ইউটিউব ব্যবহার করছে অথবা মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে। এগুলো কার তৈরি? মানুষেরই তৈরি। সেই মানুষের তৈরি জিনিসগুলো তারা ব্যবহার করছে। তাহলে মানুষের তৈরি আইন তারা মানবে না, আর মানুষের তৈরি জিনিসগুলো ব্যবহার করবে। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, মানুষের তৈরি করা পোশাক ব্যবহার করবে, মানুষের তৈরি করা অস্ত্র ব্যবহার করে, মানুষের তৈরি করা যানবাহন ব্যবহার করে, সেটা দিয়ে মানুষ হত্যা করে আবার মানুষের তৈরি আইন মানবে না এটা কোন জাতীয় কথা? অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য যুগ জিজ্ঞাসার সাথে সূত্রবদ্ধ। শুধু তিনি নন বিদেশি মিডিয়াও নেমে পড়েছে এর সূত্র-উৎস খুঁজতে। যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের পরিবারের সাথেও কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে। অনেক অভিভাবক কথা বলেছেন। তারা যা বলেছেন তাতে প্রকৃত জিজ্ঞাসার জবাব রয়েছে কিনা তা স্পষ্ট নয়। এ প্রশ্ন খুবই সঙ্গত যে, কেন এবং কী কারণে এসব উচ্চ শিক্ষিত এবং যারা মনে করেন ইংরেজি জানাই শিক্ষিত হওয়ার একমাত্র সনদ তাদের কাছে বিস্ময় লাগার কথা, যে দেশে আমলাদের কর্মোপযোগী করতে ইংরেজির প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে সেই দেশে হামলায় অংশগ্রহণকারীরা অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলতে বলতে প্রাণ দিয়েছে। আধুনিক যুগে যেখানে টিকে থাকার মাধ্যম মনে করা হয় ইংরেজি জানাকে সেখানে বেঁচে থাকার চেষ্টা না করে মরতে গেল কেন? বোধকরি এক কথায় বা এখনো যেভাবে দেখার চেষ্টা করা হচ্ছে সেখানে এর পরিপূর্ণ জবাব নেই। উচ্চ এবং বিভিন্ন মহল থেকে বলা বলা হচ্ছে, এ ধরনের প্রতিভাবানরা এ পথে গেল কেন এবং কীভাবে? অবশ্যই এর সুষ্ঠুও গ্রহণযোগ্য জবাব অবশ্যক।
একটু পেছন ফিরে তাকানো প্রয়োজন। ধরুন মনীষী সক্রেটিসের কথা। তিনি তার সময়ের বিরুদ্ধে গিয়ে মৃত্যুকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন কেন? তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগই আনা হোক না কেন ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় তিনি সত্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তিনি সে সময়ের যুবকদের সত্যনিষ্ঠ করতে চেয়েছিলেন। আর তাকে হত্যা করা হয়েছিল সে সময়ের বিচারবিভাগের রায়ে যুবকদের পথভ্রষ্ট করার অভিযোগে। বহু বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও যখন আমরা মনীষী সক্রেটিসকে স্মরণ করি তখন তার প্রতি যতটা শ্রদ্ধাশীল হই তারচেয়ে বেশি ঘৃণা করি ওই সমাজপতিদের যারা তার মৃত্যুদ- কার্যকরণে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। সমাজবাদের তাত্ত্বিকগুরু মার্কসের কথাই বলুন। তিনি সেই সমাজের বুর্জোয়া শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। সমাজ পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং অনেকখানি সফলও হয়েছিলেন। মার্কিন সমাজে বিশ্বের সবচেয়ে অমানবিক দাস প্রথার বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন ড. মার্টিন লুথার কিং। তিনি অমর হয়ে আছেন বারাক ওবামার প্রেসিডেন্ট হওয়ার মধ্যদিয়ে। এই আন্দোলন করতে গিয়ে কী ধরনের বৈরী ও মারাত্মক বিরুদ্ধবাদিতার মুখোমুখি তাকে হতে হয়েছিল সে ইতিহাস কম-বেশি সবারই জানা। বিশ্ব প্রেক্ষাপটের বাইরে বাংলাদেশের কথা বলি। অন্তত দুজন প্রতিভাবানের নাম এখানে তুলে ধরা প্রয়োজন। একজন কমরেড আবদুল হক। যিনি সে সময়ে অর্থনীতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রেকর্ড নম্বর পেয়েছিলেন। অন্যজন কমরেড সিরাজ সিকদার। তিনিও তার সময়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে রেকর্ড নম্বর পেয়েছিলেন এখনো তা কেউ ভেঙেছে বলে শুনিনি। তাদের সমসাময়িক অনেকের মুখে তাদের প্রতিভার প্রশংসা শুনেছি। তারা যদি সমাজ পরিবর্তনের জন্য সশস্ত্র লাইন গ্রহণ না করে তাদের অন্য বন্ধুদের মতো প্রচলিত পন্থা গ্রহণ করতেন তাহলে তাদের সামাজিক অবস্থা এখনকার অনেকের চেয়েই হয়তো উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন হতে পারত। কেন তারা সমাজ পরিবর্তনের জন্য এ ধরনের বিপজ্জনক পন্থা গ্রহণ করেছিলেন, কারা তাদের এই পথে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন সে আলোচনা আজকের প্রেক্ষাপটে নিরর্থক। তারা কেউ এখন আর বেঁচে নেই। তারা নির্যাতিত মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের যে পথ ও পন্থা গ্রহণ করেছিলেন সেটিও এখন আর সক্রিয় নেই। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, তারা যখন এপথ গ্রহণ করেছিলন তখন সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন তথা শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে এটাকেই সবচেয়ে সঠিক পন্থা বলে বিবেচনা করা হোত। আজকের মূল্যায়নে নানামুখিতা থাকতে পারে, সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। সোজা কথায় বলা যায় প্রতিভা আকৃষ্ট হয় বিষয়বস্তুর গভীরতায়। প্রাণীকুলের মধ্যে মানুষই যেহেতু চিন্তা করে সে কারণে চিন্তার জগতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে বলতে হবে চিন্তার খোরাক জোগায় যেসব বিষয় চিন্তাশীল প্রতিভাবানরা সেখানেই আকৃষ্ট হয়। সঙ্গত বিবেচনা থেকেই বলা যায়, চলমান ঘটনার প্রকৃতি যাই হোক এটা স্বীকার করতেই হবে ইসলাম কোনো ধরনের সন্ত্রাস বৈষম্য শোষণ সমর্থন করে না। আলোচ্য ঘটনাবলির সাথে ইসলামের নামও জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। সে কারণেই এটা বলা এবং সংশ্লিষ্টদের ভাবনায় রাখা জরুরি যে, কেন ইসলামকে ব্যবহার করা হচ্ছে। সোজা ভাষায় বলা যায় সমাজ ও বিশ্বের চলমান যে বৈষম্য বা নিপীড়ন তা থেকে মুক্তির পথ হিসেবেই হয়তো ইসলামকে ভাবা হচ্ছে। সে কারণেই হয়তো প্রতিভাবানদের আন্দোলিত করছে। আরো একটি বিষয় এখানে বলা প্রয়োজন। আমাদের দেশের একশ্রেণীর নাগরিক দেশে ধর্মীয় শিক্ষা মাদ্রাসার নাম শুনলেই চিৎকার করতে থাকেন। তারা কি অনুভব করছেন দেশে ব্যভিচার সামাজিক অবক্ষয়ের জন্য দায়ী বলে বিবেচিত পর্নোগ্রাফি এবং ভারতীয় চ্যানেলসমূহ নিষিদ্ধ না করে নিষিদ্ধ করা হলো পিস টিভি। এর আগে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ইসলামিক টিভি। বর্তমান সময়ে সভ্যতার সংকট হিসেবে যারা শোষণ নিপীড়ন বর্ণ বৈষম্যবাদকে দেখছেন তারা এটা নিশ্চিত হয়ে গেছেন যে প্রচলিত কাঠামোতে এর নিরসন সম্ভব নয়। চলমান মতবাদের ব্যর্থতাই মূলত তরুণদের আকৃষ্ট করে থাকতে পারে। বিষয়টি সরকারের যারা বিশ্লেষক তারাও ভেবে দেখতে পারেন। বলা হয়ে থাকে গণতন্ত্রেই সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার সংরক্ষিত রয়েছে। অথচ পর্যালোচনা করলে বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা গণতন্ত্র রপ্তানি করতে গিয়ে বিশ্বকে এক নতুন মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে, যে আলোচনা এখন সেসব দেশেই হচ্ছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে যে প্রসঙ্গ উঠেছে বিশেষ করে ওই নির্বাচনে ভারতীয় সমর্থনকে কেন্দ্র করে প্রচলিত ফর্মেটে তার সমাধানের কোনো পথ খোলা আছে এমন ধারণা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা পোষণ করেন না। সঙ্গতভাবেই আধুনিক ও শিক্ষিত ও প্রতিভাবানদের আন্দোলিত করে। কারণ তারা নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট। দেশের বাস্তবতার সাথে প্রতিটি নাগরিকের রুটি-রুজি, চাকরি-বাকরির সম্পর্ক রয়েছে। দেশ যেভাবে দলীয়করণ করা হয়েছে তাতে বিশেষ মতের ছাড়া অন্য কারো নাগরিক অধিকার লাভের সুযোগ নেই বললেই চলে। যেখানে গোয়েন্দা রিপোর্টের অজুহাতে ৩৫তম বিসিএস ব্যাচের নিয়োগ হয়েছে সম্প্রতি সেখানে যাদের বয়স অতিক্রান্ত হয়ে যচ্ছে তারা কী করে তাদের সম্ভাবনা দেখবে? সামাজিক অস্থিরতা বিশৃঙ্খলা নৈরাজ্য হতাশা স্বাভাবিকভাবেই এনার্কিইজমের জন্ম দেয়। এ কারণে কিছু যুবকের বিভ্রান্তির আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। এক ধরনের হিরোইজমে কাউকে কাউকে পেয়ে বসতেই পারে। সেদিক থেকেও বিষয়টিকে দেখতে হবে। বিশ্ব বাস্তবতা পর্যালোচনা করলে এটাই সত্যি যে, বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রতি আকর্ষণ বেড়েছে এবং বাড়ছে। বিষয়টি আমাদের দেশে হঠাৎ করে কারো কারো চোখে ভিন্নরকম লাগলেও বাস্তবতা ভিন্ন।
সত্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়েই বিশ্বের সচেতন মানুষেরা ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিচ্ছে। এরকমই একজন ডা. মরিস বুকাইলি। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরাঁ প্রেসিডেন্ট পদে থাকেন ১৯৮১-১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। তিনি তার পদে থাকাকালীন আশির দশকের শেষের দিকে ফেরাউনের মমিকে আতিথেয়তার জন্য মিসরের কাছে অনুরোধ জানালেন। ফ্রান্স তাতে কিছু প্রতœতাত্ত্বিক গবেষণা করতে চাইল। মিসরের সরকার তাতে রাজি হলো। প্লেনের সিঁড়ি থেকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট, তার মন্ত্রীবর্গ ও ফ্রান্সের সিনিয়র অফিসারগণ লাইন দিয়ে দাঁড়ালেন এবং মাথা নিচু করে ফেরাউনকে স্বাগত জানালেন। ফেরাউনকে জাঁকালো প্যারেডের মাধ্যমে যখন রাজকীয়ভাবে বরণ করে, তার মমিকে ফ্রান্সের প্রতœতাত্ত্বিক কেন্দ্রের একটা বিশেষ ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হলো, যেখানে ফ্রান্সের সবচেয়ে বড় সার্জনরা আছেন এবং তারা ফেরাউনের মমিকে ময়নাতদন্ত করে সেটা স্টাডি করবে ও এর গোপনীয়তা উদঘাটন করবে। মমির ওপর গবেষণার জন্য প্রধান সার্জন ছিলেন প্রফেসর মরিস বুকাইলি। থেরাপিস্ট যারা ছিলেন তারা মমিটাকে পুনর্গঠন করতে চাচ্ছিলেন, আর ডা. মরিস বুকাইলি দৃষ্টি দিচ্ছিলেন যে, কীভাবে এই ফেরাউন মারা গেল সেদিকে। পরিশেষে, রাতের শেষের দিকে ফাইনাল রেজাল্ট এলো! ‘তার শরীরে লবণ অবশিষ্ট ছিল।’ এটাই সবচেয়ে বড় প্রমাণ যে ফেরাউন ডুবে মারা গিয়েছিল এবং তার শরীর ডুবার পরপরই সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র থেকে তুলে আনা হয়েছিল। তারপর লাশ সংরক্ষণ করার জন্য দ্রুত মমি করা হলো। এখানে একটা ঘটনা প্রফেসর মরিসকে হতবুদ্ধি করে দিল যে, কীভাবে এই মমি অন্য মমিদের তুলনায় বিলকুল অরক্ষিত অবস্থায় থাকল, যদিওবা এটা সমুদ্র থেকে তোলা হয়েছে কারণ কোনো বস্তু যদি আর্দ্র অবস্থায় থাকে, ব্যাকটেরিয়া ওই বস্তুকে দ্রুত ধ্বংস করে দিতে পারে, আর্দ্র পরিবেশে ব্যাকটেরিয়া দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে পারে। ডা. মরিস ফাইনাল রিপোর্ট তৈরি করলেন; যাতে তিনি বললেনÑ এটা একটা নতুন আবিষ্কার। সেই সময় একজন তার কানে ফিসফিসিয়ে বলল : মুসলিমদের এই ডুবে যাওয়া মমি সম্পর্কে ঝট করে আবার বলতে যেও না। কিন্তু তিনি দৃঢ়ভাবে এর সমালোচনা করলেন এবং এটা আজব ভাবলেন যে, এরকম একটা বিশাল আবিষ্কার যেটা আধুনিক বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য সহায়তা করবে সেটা জানানো যাবে না। কেউ একজন তাকে বলল, কোরআনে বলা আছে যে ফেরাউনের ডুবা ও তার লাশ সংরক্ষণের ব্যাপারে। এই ঘটনা শুনে ডা. মরিস বুকাইলি বিস্মিত হয়ে গেলেন এবং প্রশ্ন করতে লাগলেন, এটা কীভাবে সম্ভব? এই মমি পাওয়া গেল ১৮৮১ সালে, আর কোরআন নাজিল হয়েছে আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে। আরবরা প্রাচীন মিসরীয়দের মমি করার পদ্ধতি তো জানতই না, মাত্র কয়েক দশক আগে আমরা জানলাম। ডা. মরিস বুকাইলি সেই রাতে ফিরাউনের লাশের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে রইলেন, আরো গভীরভাবে ভাবছিলেন যেটা তার কলিগ তার কানে ফিসফিসিয়ে বলে গেল যে মুসলিমদের কোরআনে ফেরাউনের লাশের সংরক্ষণের কথা। বাইবেলে ফেরাউন কর্তৃক মুসা (আ.) পিছু নেয়ার কথা বলা আছে, কিন্তু ফিরাউনের লাশের কি হলো, সেটা সম্পর্কে কিছুই বলা নেই। তিনি নিজেকেই প্রশ্ন করছিলেন যে, এটা কি সম্ভব যে এই মমি যার সেই ফেরাউন কি মুসার (আ.) পিছু নিয়েছিল? এটা কি ধারণা করা যায় যে, মুহাম্মদ (সা.) ১৪০০ বছর আগেই এটা সম্পর্কে জানতেন? ডা. মরিস বুকাইলি সেই রাতে ঘুমাতে পারলেন না। তিনি তাওরাত আনালেন এবং সেটা পড়লেন। তাওরাতে বলা আছেÑ পানি এলো এবং ফেরাউনের সৈন্য এবং তাদের যানবাহনগুলোকে ঢেকে দিল, যারা সমুদ্রে ঢুকল তাদের কেউই বাঁচতে পারল না। ডা. মরিস বুকাইলি হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন যে বাইবেলে লাশের সংরক্ষণের ব্যাপারে কিছুই বলা নেই। তিনি তার লাগেজ বাঁধলেন এবং সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি মুসলিম দেশে যাবেন এবং সেখানে প্রখ্যাত মুসলিম ডাক্তারদের সাক্ষাৎকার নেবেন, যারা এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ। তার সেখানে পৌঁছানোর পর ফেরাউনের লাশ ডুবার পর সংরক্ষণের যে আবিষ্কার তিনি যেটা পেয়েছেন সেটা নিয়ে বললেন। একজন বিশেষজ্ঞ (মুসলিম) পবিত্র কোরআন খুললেন এবং আয়াতটা ডা. মরিসকে পড়ে শুনালেন, যেখানে সর্বশক্তিমান আল্লাহ সুবহানাহুতায়ালা বলেছেনÑ “অতএব আজকের দিনে বাঁচিয়ে দিচ্ছি আমি তোমার দেহকে, যাতে তা তোমার পশ্চাদবর্তীদের জন্য নিদর্শন হতে পারে। আর নিঃসন্দেহে বহু লোক আমার মহাশক্তির প্রতি লক্ষ্য করে না।”-[আল-কোরআন; সুরা : ইউনূস, আয়াত : ৯২] তিনি এই আয়াতের দ্বারা খুবই প্রভাবিত হয়ে পড়লেন এবং তিনি তার জোর গলায় চিৎকার দিয়ে বললেনÑ আমি ইসলামে প্রবেশ করেছি এবং আমি এই কোরআনে বিশ্বাসী।
ডা. মরিস বুকাইলি ফ্রান্স ফিরে গেলেন এক ভিন্ন অবস্থায়। ফ্রান্সে ১০ বছর তিনি আর কোন ডাক্তারি প্র্যাকটিস করেননি বরং এই সময়েই (টানা ১০ বছর ধরে) তিনি আরবি ভাষা শিখেছেন। তিনি পবিত্র কোরআনে কোনো বৈজ্ঞানিক দ্বিমত আছে কিনা সেটা খুঁজেছেন, তারপর তিনি পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতের অর্থ বুঝলেন যেটাতে বলা আছে : “এতে মিথ্যার প্রভাব নেই, সামনের দিক থেকেও নেই এবং পেছন দিক থেকেও নেই। এটা প্রজ্ঞাময়, প্রশংসিত আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ।” [সুরা : হা-মীম সাজদাহ, আয়াত : ৪২] (ডা. মরিস বুকাইলি অংশটি বিশিষ্ট সাংবাদিক সৈয়দ আবদাল আহমদের লেখা থেকে উদ্ধৃত) ১৯৮৬ সালে ডা. মরিস বুকাইলি একটা বই লেখেন যেটা পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের টনক নডিয়ে দেয়। যেটা বেস্ট সেলার হয়। বইটি প্রায় ৫০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বইটির নাম : “বাইবেল, কোরআন এবং বিজ্ঞান। বইটি বাংলায় রূপান্তর করেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক আখতার-উল-আলম। বইটি সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, বাইবেল, কোরআন ও বিজ্ঞান যুক্তিভিত্তিক বিশ্লেষণ এবং সেই সাথে তুলনামূলক বিচার পর্যালোচনা ও গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ পুস্তক। মরিস বুকাইল থিওরি অফ এভুলুশনকে চ্যালেঞ্জ করে চমৎকার একটি বই লেখেন, যার নাম দেন ও হোয়াট দি অরিজিন অব ম্যান।
শরিয়া আইন ও মানুষের তৈরি আইন নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে বোধকরি সে বিষয়টিও ইতিহাসের আলোকে দেখা প্রয়োজন। আইনের মূল উৎস কি- যদি ইন্টারনেটে জানতে চান তাহলে জবাব দেবে মুসা (আ.)-এর কাছে আল্লাহ প্রেরিত ৮টি মৌলিক নীতিমালা। বর্তমান পৃথিবীতে কেউ একে সমর্থন করছে অথবা কেউ এর বিরোধিতা করছে। এই ৮টি মৌলিক নীতমালার বিবরণ এমন, হযরত মুসা (আ.)-এর কওম তার কাছে লিখিত বিধান চাইলে আল্লাহ তাঁকে ৩০ দিন রোজা থাকতে বলেন। হযরত মুসা (আ.) ৩০ দিন রোজা রাখার পর মুখ পরিষ্কার করে আল্লাহর কাছে বিধান চাইলে যেহেতুু রোজাদারের মুখের ঘ্রাণ আল্লাহর কাছে খুব প্রিয় তাই তাকে পুনরায় ১০ দিন রোজা রাখতে বলেন। এরপর আল্লাহ তাকে লিখিত যে বিধান দেন সেটিই মূলত আইনের মূল উৎস। অতীত নবীদের সকল বিধানের সারসংক্ষেপ নিয়ে নাজিল হয় পবিত্র কোরআন। মুসলমানদের জন্য কোরআন ও সুন্নাই আইনের মূল উৎস। এর অনুসরণেই কেবল আইন তৈরি হতে পারে। এর মানে সাংঘর্ষিক কোন আইন মুসলমানদের জন্য মানা বৈধ নয়। এ কথা বাদ দিলেও অর্থনীতিও স্বীকার করে মানুষ কিছু উৎপাদন করতে পারে না। উপযোগিতা বৃদ্ধি করাকেই অর্থনীতিতে উৎপাদন বলা হয়। বাস্তবতও দেখা যায় ভূমি থেকে শুরু করে মানুষ যা ভোগ বা উপভোগ করছে তার সবকিছুই প্রকৃতিনির্ভর। সম্পদের বণ্টন নিয়ে এটাই বর্তমান সময়ে বড় বিবেচ্য বিষয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সময় পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনকে সহজভাবে মেনে নিলে সংকটের সমাধান অনেক সহজ হয়। ছোট্ট উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ব্রেক্সিট থেকে বেরিয়ে গেছে যুক্তরাজ্য। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর পদ নিয়ে কোনো ভোট হয়নি। ক্যামেরন ব্রেক্সিট বিরোধী ছিলেন তাই ব্রেক্সিটকে তিনি তার বিরুদ্ধে ভোট বলে বিবেচনা করে সরে গিয়েছেন পদ থেকে। নিজের মত পালনে ব্রিটেনবাসীকে বাধ্যকরণের কোনো ব্যবস্থা নেননি। প্রতিটি ইস্যুকেই এভাবে দেখতে হবে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোই শাসকদের প্রধান কাজ। বিশ্বজুড়ে যে তোলপাড় চলছে তার কতটা বাংলাদেশে কীভাবে প্রয়োগ হচ্ছে তা নিয়ে হয়তো নানা পর্যালোচনা হতে পারে। তবে সবকিছুর ঊর্ধেŸ এটা বলতে হবে যে, শোষণ, বঞ্চনা নৈরাজ্যের অবসান না করে বিশ্বকে মানুষের বসতযোগ্য করার কোনো বাস্তবতা বিরাজ করছে না। সেদিকে নজর দিলে বোধকরি কথিত সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ আপনাতেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।