Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইত্যাদি : সব আনন্দের সমষ্টি

প্রকাশের সময় : ১৪ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ৯:৫৫ পিএম, ১৩ জুলাই, ২০১৬

ডিলান হাসান : ঈদ উপলক্ষে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর আনন্দ আয়োজন শেষ হয়েছে। সুদীর্ঘকাল ধরে ঈদে এই আনন্দ আয়োজন হয়ে আসছে। চ্যানেল কর্তৃপক্ষ তার সমস্ত মেধা দিয়ে ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সাজিয়ে থাকেন। নাটক, টেলিফিল্ম, পুরনো সিনেমা, তারকাভিত্তিক টক শো, নৃত্যানুষ্ঠান, সঙ্গীতানুষ্ঠান, গেম শো, ছোটদের অনুষ্ঠান, খেলাধুলাবিষয়ক অনুষ্ঠান দিয়ে সাধারণত ঈদ আয়োজন করে থাকেন। অনেক চ্যানেলের এসব অনুষ্ঠান একজন দর্শকের পক্ষে কি দেখা সম্ভব? এ প্রশ্নের উত্তরে এমন একজন দর্শক খুঁজে পাওয়া যাবে না যে বলবে, সম্ভব। এখন পৃথিবীতে যদি ‘অসম্ভব’ বলে কিছু থাকে, তবে তা হচ্ছে এই একটি কাজ। আবার কেউ যদি বলে সম্ভব, তাহলে তার কথাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। মানুষ অনেক অসম্ভবকেই সম্ভব করেছে। এই মানুষের মধ্যে যদি হানিফ সংকেতের নামটি এসে যায়, বিশেষ করে টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখার মধ্যে, তবে সবাই একমত হবেন, হ্যাঁ তাঁর পক্ষে সম্ভব। একসাথে সব চ্যানেলের অনুষ্ঠান একজন দর্শককে তিনি দেখিয়ে দিতে পারেন। প্রশ্ন আসতে পারে, তিনি কি ম্যাজিসিয়ান? উত্তর হবে, হ্যাঁ। তিনি ‘ম্যাজিস্টিক ম্যাজিসিয়ান’। ইত্যাদি নামক জাদুর কাঠি দিয়ে তিনি টেলিভিশনের সব অনুষ্ঠান দেখিয়ে দিতে সক্ষম। এক ইত্যাদিতেই তিনি দর্শকের বিনোদনের সব চাহিদা পূরণ করে দিচ্ছেন। তাও আবার তথ্য ও শিক্ষার সমন্বয়ে। যা সাধারণত চ্যানেলগুলোর গতানুগতিক ও সাধারণ চিন্তাভাবনার অনুষ্ঠানে দেখা যায় না। সংক্ষেপে যদি বলা হয়, ইত্যাদির মাধ্যমে দর্শক নাটক, টেলিফিল্ম, সিনেমা, সঙ্গীত, নৃত্যসহ ভাবনার অতীত বিনোদনের সর্বোচ্চ চাহিদা পূরণ করতে পারছেন। চতুরঙ্গ বিনোদন বলে যে কথা আছে, নিজস্ব ও দেশীয় সংস্কৃতির ধারক-বাহক হয়ে থাকা ইত্যাদি ছাড়া আর কোথায় পাবেন দর্শক? বলার অপেক্ষা রাখে না, চ্যানেলগুলো ঈদের সময়ই কেবল বড় পরিসরে বিশেষ আনন্দ আয়োজন করে থাকে। অন্যদিকে প্রতি তিন মাস অন্তর ইত্যাদি সারা বছরই ঈদ আনন্দ হয়ে থাকে। ফলে ইত্যাদির প্রতিটি পর্বই বিশেষ পর্ব। এখানে আলাদা করে ঈদের বিশেষ পর্ব বা অন্য কোনো উৎসবের নামে ইত্যাদি বিশেষ পর্ব নির্মাণের প্রয়োজন পড়ে না।
এবারের ঈদে যে ইত্যাদি পরিবেশিত হলো, তাকে টেলিভিশনের সব ঈদ আনন্দের সমষ্টি বলা যায়। এক ইত্যাদি দিয়েই হানিফ সংকেত দর্শকদের ঈদের সব অনুষ্ঠান দেখিয়ে দিয়েছেন। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, আড়াই দশকেরও বেশি সময় ধরে ইত্যাদি দর্শকের সারা বছরের আনন্দের সমাহার হয়ে রয়েছে। পৃথিবীর আর কোনো টিভি অনুষ্ঠান দর্শককে এভাবে ধারাবাহিক আনন্দ দিতে পারেনি। মানের যে উঁচু-নিচু বা হেরফের বলে একটা কথা আছে, ইত্যাদির ক্ষেত্রে তা কখনো ঘটেনি। বরং সময়ের সাথে সাথে ইত্যাদিতে মেধা, মনন, মানবিকতা আরো ধারালো হয়ে উঠছে। বলাবাহুল্য, ইত্যাদি হানিফ সংকেতের ব্রেইন চাইল্ড। যাই হোক, ঈদের ইত্যাদিতে এবার জাতীয় কবির ঈদের গান ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’ কীভাবে উপস্থাপন করা হয়, তা নিয়ে দর্শকের মধ্যে বেশ কৌতূহল ছিল। অনেকেরই মাথায় আসছিল না, গানটি আর কীভাবে উপস্থাপন করা যেতে পারে! যে ব্যাপক ও অকল্পনীয়ভাবে এতদিন গানটি পরিবেশন করা হয়েছে, এবার কেমন হবে, এ নিয়ে অনেকটা ধোঁয়াশার মধ্যে ছিলেন দর্শক। ক্লু পাওয়া গিয়েছিল, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের দিয়ে গানটি করানো হবে। শুনতে খুব সাধারণ মনে হয়েছে। দেখার পর মনে হয়েছে, আহ্! কী অসাধারণ। এই অসাধারণ শুধু আনন্দের নয় বরং মানবিকতার। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শতাধিক শিল্পীকে গাইতে দেখে আনন্দের পাশাপাশি মায়া-মমতায় চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছে। দর্শকের এই ঘোর কাটতে না দিয়েই হানিফ সংকেত একের পর এক ঘোরের মধ্যে নিয়ে যেতে থাকেন। এ্যান্ড্রু কিশোরের গানে নিয়ে যান। এখানে দেখা গেল এটি শুধু বিনোদনের গান নয়, নারী নির্যাতন, তরুণদের মূল্যবোধ ও শিশু অধিকারের কথা বলা হয়েছে সুরে সুরে। দেশাত্মবোধক গান মানে যে শুধু দেশের মাটি ও রূপ বৈচিত্র্য বর্ণনা নয়, এর সাথে মানুষের মানবিকতাও জড়িয়ে আছে, তাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন হানিফ সংকেত। ভিনগ্রহের তিন মানবের পৃথিবী নামক গ্রহে আগমন ও ভিন্ন অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে যাওয়া নিয়ে যে নাটিকাটি দেখিয়েছেন, তা শুধু চমকপ্রদই নয়, এর মাধ্যমে কিছু মানুষের যে অমানুষিক চিন্তা-ভাবনা যা আমাদের জীবনে ক্ষত হয়ে রয়েছে, তা সুনিপুণভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সাধারণ বিষয় নিয়ে অসাধারণ চিন্তার কী অসামান্য উপস্থাপনা! নাটিকাটির শেষে যখন দেশের গানটি বেজে উঠে তখন হৃদয় বিগলিত না হয়ে পারেনি। পর্বটিতে অভিনেতা শহীদুজ্জামান সেলিম, মীর সাব্বির, চিত্রনায়ক ইমন এবং বিশিষ্ট অভিনেতা আলমগীর অংশগ্রহণ করেন। তাদের অংশগ্রহণে পর্বটি মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠে। ইত্যাদিতে নাচ-গানের জন্য কোনো তারকার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ ইত্যাদি নিজেই তারকা সৃষ্টির একটি কারখানা। তারপরও ইত্যাদিতে প্রতিষ্ঠিত তারকাদের দেখা যায়। এর কারণ তারকারাই গৌরব বোধ করে ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করে। তারা জানে ইত্যাদি শুধু আনন্দই দেয় না, এটি মানুষ ও মানবিকতার কথা বলে। দেশ ও জনগণের কথা বলে। নিজের সংস্কৃতিকে সবার ঊর্ধেŸ তুলে ধরে। কাজেই এমন একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রে আরোহন করা গৌরব এবং দায়িত্ববোধেরও ব্যাপার। এই গৌরব থেকেই তারকারা ইত্যাদিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। এবারের ইত্যাদিতে তারকাদের নামের পর্বে দেখা গেল চিত্রনায়ক ফেরদৌস, চিত্রনায়িকা পূর্ণিমা, আইকন মডেল নোবেল ও গুণী অভিনেত্রী অপি করিমকে। আমাদের জাতীয় জীবন এখন ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। জটিলতার আবর্তে পড়ে মানুষের স্বাভাবিক আচরণেও পরিবর্তন ঘটছে। ইত্যাদি বিষয়টি বেশ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে এবং তা তুলে এনেছে। অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী পারফরমেন্সের মাধ্যমে মিউজিক্যাল ড্রমা রিমোট কন্ট্রোল শিরোনামের মাধ্যমে বিভিন্ন অপ্রীতিকর ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ কথাবার্তার লাগাম টেনে ধরা উচিত, তা অত্যন্ত সুচারুরূপে তুলে ধরা হয়। অন্যদিকে অভিনেতা সাইদ বাবুকে নিয়ে আরেকটি মিউজিক্যাল ড্রামায় মানুষের মনোজগতে ক্রিয়াশীল বিভিন্ন বিষয় তুলে আনা হয়। ইত্যাদি বরাবরই মানুষের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতি ও প্রবণতার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখে। তার প্রমাণ এই গানের মাধ্যমে আবার পাওয়া গেল। ইত্যাদির কমন পর্ব মামা-ভাগ্নে ও নানী-নাতি এবং অন্যান্য স্কিটের মাধ্যমে ক্রমাগত এই বিষয়গুলো তুলে ধরা হচ্ছে। বিদেশি অপসংস্কৃতির প্রতি আমাদের যেন ঝোঁক একটু বেশি। বিদেশি অপসংস্কৃতির আগ্রাসনের কথা আমরা অহরহ বলি। তবে ইত্যাদি বলে অন্যভাবে। বিদেশিদের দিয়েই আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি তুলে ধরার এক কার্যকর পন্থা উদ্ভাবন করে। আমাদের গ্রাম-বাংলার মাটি ঘেঁষা মানুষের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য বিদেশিদের দিয়ে অভিনয় করিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন, বিদেশি অপসংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ দেখানোর প্রয়োজন নেই, বিদেশিরাই আগ্রহ নিয়ে আমাদের সংস্কৃতিতে অংশগ্রহণ করছে। মোবাইল, ইন্টারনেটের যুগে প্রিয়জনদের কাছে আমাদের চিরায়ত চিঠি লেখার যে সংস্কৃতি, তা অনেকটা বিলুপ্তির পথে। এ বিষয়টি হানিফ সংকেত তার তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তিতে তুলে এনেছেন দর্শক পর্বে। এ পর্বে প্রিয়জনদের কাছে চিঠি লেখা এবং যাকে লেখা হচ্ছে তার প্রতিক্রিয়া চারজন ভিন্ন ভিন্ন মানসিকতার মানুষের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। এর মাধ্যমে আমরা যেমন চিঠি লেখার সংস্কৃতিকে ফিরে পাই, তেমনি মানুষের মানসিকতারও পরিচয় পাই। আবার কোনো মানসিকতা ঠিক নয়, তারও সমাধান দেয়া হয়েছে। বিনোদন এবং শিক্ষার এক অপূর্ব সমন্বয় আমরা এ পর্বে দেখতে পেলাম। সঙ্গীতশিল্পী মমতাজকে তার গানের বাইরে নিয়ে অভিনয়ের মাধ্যমে যথার্থভাবেই বিষয়টি ইত্যাদি তুলে ধরেছে। আবারো বলতে হচ্ছে, তথ্য, শিক্ষা ও বিনোদনের এমন অপূর্ব মেলবন্ধন কেবল ইত্যাদিতেই পাওয়া যায়। ফলে ইত্যাদির মাধ্যমে এক ঘণ্টাতেই দর্শক তার আনন্দের সব তৃপ্তি পেয়ে যান। আসলে ইত্যাদিকে প্রশংসা করার বিশেষণের জন্য নতুন শব্দের প্রয়োজন। যা সবসময়ই প্রশংসিত হয়ে আছে, তার প্রশংসা করার মতো প্রচলিত শব্দ যথেষ্ট নয়। ফলে ইত্যাদিকে বলতে হয় ইত্যাদি তুমি ‘ইত্যাদি’।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইত্যাদি : সব আনন্দের সমষ্টি
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ