Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উল্টো রথে মানবিকতা

ইউরোপ সীমান্তে শরণার্থীদের প্রতি সহিংসতা

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২০ মার্চ, ২০২০, ১২:০৩ এএম


সীমান্তে সহিংতা এখন ইউরোপীয় অভিবাসন নীতির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাড়িয়েছে। উদ্বাস্তুদের দুর্দশা কোন কাকতালীয় ঘটনা নয়। যে কেউ গ্রিসে পৌছালে সে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। গ্রীক দ্বীপপুঞ্জ লেসবোসে ২০ হাজার মানুষ এই সংখ্যার মাত্র ৭ ভাগের জন্য তৈরি একটি শিবিরে আটকে আছে। গ্রীক সরকার নতুন শিবির তৈরি করছে। তবে তার সাথে আশ্রয়প্রার্থীদের আসা-যাওয়ার বিষয়ে কঠোর নিয়ম-নীতি যোগ হবে। কেউ গ্রীস থেকে বের হয়ে গেলে ক্রোয়েশিয়ান সীমান্ত পুলিশ, যাদের বিরুদ্ধে প্রতিবেশী বসনিয়ায় ফেরত পাঠানোর আগে অভিবাসীদের মারধর ও ছিনতাইয়ের অভিযোগ আছে, তাদের হাতে নির্যাতিত হওয়ার দায়ভার তার নিজেকেই নিতে হবে।’

২০১৫ সালে হাজার হাজার অবৈধ অভিবাসী এবং আশ্রয়প্রার্থী জার্মানি যাওয়ার পথে হাঙ্গেরিতে প্রবেশ করে। তাদের থামানোর জন্য হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান দেশটির দক্ষিণ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া তৈরি করেছিলেন। তৎকালীন ইউরোপীয় কমিশন-ইউ অরবানের জোর সমালোচনা করে বলেছিল, ‘আমরা মাত্রই ইউরোপের দেয়াল ভেঙেছি; আমাদের সেসব বানানো উচিত নয়।’ অথচ ৫ বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে যে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সীমানায় আবারও কুৎসিত দৃশ্যের অবতারণা ঘটেছে। ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টা করা অভিবাসীদের একটি ডিঙ্গি নৌকায় গ্রীক জাহাজের ক্রুরা লাঠি দিয়ে আঘাত করে এবং অনুপ্রবেশ বন্ধে তাদের উপর সতর্কীকরণ গুলি চালায়। কিন্তু এবার কমিশনের প্রতিকিয়াটি ছিল ভিন্ন। ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি উরসুলা ভন ডের লেয়েন বলেন, ‘এই সময়ে গ্রীসকে আমাদের ইউরোপের ঢাল হওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাই।’ তাহলে কেন পরিবর্তন ঘটল?

২০১৫ এবং ২০১৬ সালের অভিবাসন সঙ্কটের সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের দৃষ্টিভঙ্গি দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল যখন ২০ লাখেরও বেশি মানুষ অঞ্চলটিতে পালিয়ে আসে। একদিকে, মানবিকতার কান্ডারীরা, যারা ইইউকে আদর্শস্থাপনকারী, পাহাড় চ‚ড়ায় জ্বলে থাকা উজ্বল আলোর দিশারী হিসাবে দেখতেন, তাদের জন্য নৈতিকতার প্রশ্নে ইইউ’র সহজ প্রতিক্রিয়া ছিল ‘উইলকোমেন্সকুলটুর’ বা স্বাগতম সংস্কৃতি।

অন্যদিকে ছিল কট্টরপন্থীরা। বাস্তবতা (একটি রাষ্ট্র কেবল একবারের জন্য অনেক শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে পারে এবং খাওয়াতে পারে) এবং রাজনীতির (খুব বড় এবং আকস্মিক উদ্বাস্ত সমাগমকে একপেশে অনুমতি দেয়, এমন যে কাউকে ভোটাররা ক্ষমতাচ্যুত করে দেবে) উপর ভিত্তি করে তারা সীমান্তে কঠোর, নৃশংস ব্যবস্থার পক্ষে যুক্তি দিয়েছিল। ৫ বছর লড়াইয়ের পর মানবতাবাদীরা হার মেনেছে। কট্টরপন্থীরা এখন শাসন ব্যবস্থার শিখরে অবস্থান করছে। ম‚ল নীতিকে পাশ কাটিয়ে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইনকে বাধ সেধে (গ্রিস ১ মাসের জন্য আশ্রয়ের আবেদন স্থগিত করেছে এই যুক্তিতে যে, উদ্বাস্তদের সাম্প্রতিক আগমন তুর্কি সরকারের সাজানো, যারা এই সুযোগে ইইউ’র কাছ থেকে বেশি অর্থ আদায় করতে চায়।)

। অভিবাসনের বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দিকনির্দেশনা দেশটির কর্মকর্তাদের কাছে এখন পওর ডেকারেজার লেস অত্রেস অর্থাৎ ‘অন্যকে নিরুৎসাহিত করণ’ দর্শনে পরিণত হয়েছে। এবং তারা তা অনুসরণ করতেই আগহী।
যে কৌশলগুলি একসময় জাতীয়তাবাদীদের দাবি ছিল, মূলধারার সরকার সেসব গ্রহণ করেছে। ভূমধ্যসাগরের এনজিও জাহাজগুলিকে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে এবং ক্রুদের হয়রানি করা হয়েছে। যারা শরণার্থীদের রুটে খাদ্য ও জলের ব্যবস্থা করে ইউরোপ ভ্রমণে সহায়তা করতো, তাদের বিরুদ্ধে মানবপাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে।
মানুষকে উৎসাহিত করতে উদ্ধার কাজে নিয়ামক হিসাবে ভূমধ্যসাগরীয় টহল জোরদার করা হয়েছে যাতে উপক‚লরক্ষী বাহিনীর মাধ্যমে উদ্ধারের প্রত্যাশায় মানুষ সাহসের সাথে হিমশীতল জলের মেকাবেলা করে। এই সমস্ত কিছুর পেছনে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য যুক্তি হ’ল, কঠোর সীমান্ত ব্যবস্থাপনা নমনীয় পদক্ষেপের জন্য রাজনৈতিক বিবেচনার মঞ্জুরি দিতে পারে। যেমন, সমস্যাস্থল থেকে শরণার্থীদের সরাসরি পুনর্বাসন। দুর্ভাগ্যক্রমে, এটি সেভাবে কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে না। ২০১৫ সাল থেকে এপর্যন্ত মাত্র ৬ লাখ ৫৫ হাজার শরণার্থী ইইউতে পুনর্বাসিত হয়েছে।

আরেকটি সম্ভাব্য বাহানা হ›ল, দ্বিতীয়বারের মতো শরণার্থী সঙ্কট সম্ভবত ডানপন্থী দলগুলিকে নির্বাচনে জিততে সহায়তা করবে, যেমন প্রথমটি ব্রেক্সিটের স‚ত্রপাত ঘটাতে এবং ইতালির মাত্তেও সালভিনির উত্থানে সহায়তা করেছে। ফলস্বরূপ, বিরোধী দলগুলিকে ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য সরকার আশ্রয়প্রার্থীদের উপসাগরে রাখতে প্রায় যে কোনও কিছু করতে প্রস্তত বলে মনে হচ্ছে, এমনকি তা যদি আশ্রয়প্রার্থীদের ওপর নির্যাতনও হয়।
২০১৫ সালে তৎকালীন ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি জ্যঁ ক্লদ জুঙ্কার ইউরোপকে রুটিওয়ালা হিসেবে ঘোষণা করে বলেছিলেন, ‘ ইউরোপ (গ্রীক দ্বীপ কোস) সেই রুটিওয়ালা যে ক্ষুধার্ত ও শ্রান্ত প্রাণীদের তার রুটি তুলে দেয়।’ অথচ চলতি বছরে ইউরোপ সেই গ্রীক জাহাজের প্রতিচ্ছবি যে শরণার্থী ভর্তি একটি ডিঙ্গি নৌকাকে গুলি করে ডুবিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। এটি একটি জঘণ্য পরিস্থিতি, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতিগত নেতৃত্বের বিষয়ে প্রচারনাগুলিকে ভন্ডামিতে পরিণত করেছে। তবে আরো শরণার্থী সংকট এড়াতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা এমন নির্দয় ম‚ল্য দিতে ইচ্ছুক বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। সূত্র : দ্য ইকোনোমিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ