Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিশ্বসন্ত্রাস, রাজনৈতিক ব্লেইম গেম ও বহুমাত্রিক সংকট

প্রকাশের সময় : ১৩ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জামালউদ্দিন বারী
বাংলাদেশের চলমান বাস্তবতা দেশের ১৬ কোটি মানুষকে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও নিরাপত্তাহীনতায় ঠেলে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে চরমপন্থা ও জঙ্গিবাদের উত্থানের আশঙ্কা প্রকাশিত হচ্ছিল। দেশে তখনো কোনো জঙ্গি তৎপরতা দৃশ্যমান না থাকলেও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ বিঘিœত ও সীমিত হয়ে পড়া এবং বৃহত্তর রাজনৈতিক সমঝোতার প্রস্তাব সরকার কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার প্রেক্ষাপটে এই আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছিল। একটু পেছনে তাকিয়ে বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, প্রায় এক দশক আগে এক-এগারোর দুই বছরের ক্রান্তিকাল পেরিয়ে বাংলাদেশ আবারো একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পদার্পণ করেছিল। ২০০৮ সালের ২৯ নভেম্বরের নির্বাচনটি যেমনই হোক, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সেই নির্বাচনকে মেনে নিয়েছিল। কিছুটা বিতর্কিত, ভঙ্গুর তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মহাজোট ক্ষমতায় এলেও জোটের অন্যতম শরিক দল জাতীয় পার্টির নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও এক সময় মহাজোটকে ক্ষমতায় আসতে সেনাসমর্থিত সরকারের অনুঘটকদের পরোক্ষ ভূমিকার কথা মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলেন। মাইনাস টু ফর্মুলা থেকে অসম প্লেয়িং ফিল্ডের নির্বাচনী তৎপরতা এবং নির্বাচনে মহাজোট বিজয়ী হওয়ার পর সেনাসমর্থিত সরকারের সময় দায়ের করা মামলাগুলোর মধ্যে একতরফাভাবে নিজেদের মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নিয়ে বিএনপি নেতাদের আগের মামলাগুলোই শুধু ট্রায়ালের জন্য প্রস্তুত করা হয়নি, সেই সাথে নতুন নতুন শত শত মামলা দিয়ে বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার-পরোয়ানা ও মামলার জালে বন্দী করা হয়েছে। ইতিমধ্যে উচ্চ আদালতের একটি রায়ের দোহাই দিয়ে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের হঠকারি, অকার্যকর উদ্যোগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছে। অধিকাংশ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল যেমন সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি, এরই ধারাবাহিকতায় অধিকাংশ সংসদীয় আসনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় ১৫৪টি আসনে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীরা বিনাভোটে নির্বাচিত হয়েছে। নির্বাচনে কোনো প্রতিপক্ষ না থাকায় সাধারণ ভোটাররাও কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেয়ার গরজ অনুভব করেনি। একইভাবে বিদেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষকরাও ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে আসেনি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সেই নির্বাচনকে স্বীকৃতি দেয়নি, সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য তারা প্রথম থেকেই সরকারকে চাপ দিলেও সরকার এসব চাপ বা দাবিকে বরাবরই অগ্রাহ্য করে এসেছে। এভাবেই বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং ক্ষমতকার পরিবর্তনে নির্বাচনী ব্যবস্থা ও ভারসাম্যপূর্ণ রাজনৈতিক-গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করার মধ্য দিয়ে সামগ্রিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তাবোধকে এক জটিল আবর্তে ঠেলে দেয়া হয়েছে।
৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পর ইতোমধ্যে আড়াই বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, দেশের বিরোধী দল, নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক মহলের প্রত্যাশা অনুসারে এরই মধ্যে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন না হোক, আগামী নির্বাচনে বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য একটি মিটিগেশন তৎপরতা শুরু হওয়াই ছিল সবার কাছে ইতিবাচক প্রত্যাশা। বলাবাহুল্য, দেশের চলমান সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা ও সর্বব্যাপী নিরাপত্তাহীনতা, গুপ্তহত্যা, সন্ত্রাসবাদী নাশকতা এবং জঙ্গিবাদ দমনের নামে যেসব দেশি-বিদেশি ও যৌথ তৎপরতা শুরু হয়য়েছে, সেখানে গণতন্ত্র ও নির্বাচনের ইস্যুগুলো গৌণ হয়ে পড়েছে। এমনকি সন্ত্রাসবাদ দমনে একটি জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়ার পরও সরকার ও বিরোধী দল ব্লেইম গেমে লিপ্ত হয়ে পড়ছে। যে কোনো দেশে এ ধরনের পরিস্থিতিতে বৃহত্তর স্বার্থে সাধারণত সরকারের পক্ষ থেকে ঐক্য ও রাজনৈতিক সমঝোতার ডাক দেয়া হয়। বাংলাদেশে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকে বার বার রাজনৈতিক সমঝোতা ও জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয়া হলেও সরকারের পক্ষ থেকে সরাসরি তা প্রত্যাখ্যানের বিস্ময়কর মনোভাব দেখা যাচ্ছে। এমনকি সরকারের শরিক এবং জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে একটি জাতীয় সংলাপের তাগিদ দিয়েছে। অন্যদিকে সংলাপ-সমঝোতার প্রয়োজনীয়তা অগ্রাহ্য করে সরকার জঙ্গিবাদ জিইয়ে রাখতে চায় বলে অভিযোগ তুলেছে বিএনপি
একটার পর একটা গুপ্তহত্যা ও সন্ত্রাসবাদী ঘটনার পর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ, যোগাযোগ ও ভাব-মর্যাদার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে। নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে তৈরি পোশাক খাতের ক্রেতারা বাংলাদেশে আসা বন্ধ করে দিতে শুরু করেছে। অ্যাপারেল বায়ারদের কিছু সংস্থা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে তাদের নির্ধারিত সফর বাতিল করেছে। ইউরোপের দেশগুলো বাংলাদেশে তাদের কার্গো ফ্রেইট ওঠানামা বন্ধ করে দিচ্ছে। অর্থাৎ একেকটি সন্ত্রাসী ঘটনা প্রথমেই বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য, অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান তথা অর্থনীতির লাইফলাইনের ওপর আঘাত হানছে। ইসলামী জঙ্গিবাদের নামে যে চক্র বাংলাদেশে এসব সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা একই সঙ্গে এ দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের শান্তি ও সহাবস্থানের নীতির ওপর আঘাত করছে। শান্তির ধর্ম ইসলামের বদনামের কলঙ্ক লেপন করার পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করছে। রোজার একদিন আগে চট্টগ্রামে একজন পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীকে রাজপথে ধারালো ছুরিতে ও গুলি করে হত্যার পর সারাদেশে যৌথ বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে ১৬ হাজারের বেশি সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে আটক করার পর ঈদের মাত্র তিন দিন আগে গুলশানের ডিপ্লোম্যাটিক জোনে অবস্থিত একটি রেস্টুরেন্টে সশস্ত্র সন্ত্রাসী হামলায় ২০ জন বিদেশিসহ দুই ডজনের বেশি নিরপরাধ মানুষকে হত্যার রোমহর্ষক ঘটনা, হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলায় অংশগ্রহণকারী সন্ত্রাসীরা সামরিক বাহিনীর কমান্ডো অপারেশনে নিহত হওয়ার পরও ঈদের দিন দেশের বৃহত্তম ঈদ জামাত শোলাকিয়া ময়দানে পরিকল্পিত নাশকতার ছক এবং চেকপোস্টে পুলিশ হত্যার ঘটনা পিলে চমকে দেয়ার মতো। গত বছর ঢাকার ডিপ্লোমেটিক জোনে প্রকাশ্য রাজপথে ইতালীয় নাগরিক হত্যার পর অন্তত অর্ধডজন গুপ্তহত্যা ও নাশকতার ঘটনায় গোয়েন্দা ব্যর্থতার অভিযোগ উঠে এসেছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদী তৎপরতা দমনে খোদ পশ্চিমা দেশগুলোর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও নানাভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের এসব ব্যর্থতার কারণে একযুগের বেশি সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অন্যায় যুদ্ধের বিভীষিকাময় গণহত্যা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। ইরাক ও আফগানিস্তানে এক দশকের ন্যাটো হামলার কারণে এসব দেশের রিজিম চেঞ্জ, লাখ লাখ সাধারণ মানুষের মৃত্যু, ন্যাটো বাহিনীর হাজার হাজার সদস্যের মৃত্যু ও পঙ্গুত্ববরণ, হাজার হাজার কোটি ডলারের সামরিক ব্যয়ের পরও সন্ত্রাস দমনের লক্ষ্য অর্জনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে এখন জঙ্গিদের সাথে সমঝোতা করেও মুখ রক্ষা করে বিদায় নেয়ার পথ খুঁজে পাচ্ছে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইরাক যুদ্ধের আগে সাদ্দাম সরকারের হাতে ডব্লিউএমডি বা ব্যাপক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রসহ কেমিকেল ও বায়োলজিক্যাল ওয়েপন থাকার মিথ্যা তথ্য বা তথ্য বিভ্রান্তির নেপথ্য কারণ কী ছিল? দুই হাজার এক সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর মাইলস্টোন ঘটনা নাইন-ইলেভেনে টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় আলকায়েদা এবং ইসরাইলের জড়িত থাকার বিষয়টি যেমন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত নয়। একইভাবে আল-কায়েদা, আইএস, বোকো হারামের মতো সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর উত্থান ও রাষ্ট্রশক্তিকে পরাস্ত করে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালিয়ে যাওয়া এবং বিশাল এলাকা নিজেদের দখলে রাখার চলমান বাস্তবতা নিয়েও অনেক প্রশ্ন আছে। এসব ঘটনার সাথে একটি কনস্পিরেসি থিউরি এবং প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সা¤্রাজ্যবাদী হিসাব-নিকাশ সক্রিয় রয়েছে।
শাতিল আরবের নৌ-সীমা বিরোধকে কেন্দ্র করে সাদ্দাম হোসেনকে পেছন থেকে উসকে দিয়ে বিতর্কিত ভূ-খ- দখল ও ইরান ইরাকের মধ্যে একটি যুদ্ধ বাধিয়ে তা ৮ বছর প্রলম্বিত করার মধ্য দিয়েই মধ্যপ্রাচ্যে সাম্প্রতিক সা¤্রাজ্যবাদী হেজিমনির বীজ বপণ করা হয়েছিল। আট বছরের যুদ্ধের রেশ কাটতে না কাটতেই ইরাকের কুয়েত দখল ও ১৯৯০ সালে প্রথম গাল্ফ ওয়ারের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের দুই সম্ভাবনাময় সামরিক শক্তিকে একই সাথে দুর্বল করার প্রয়াস ছিল। কুয়েতকে ইরাকি বাহিনীর দখলমুক্ত করার জন্য মার্কিন বাহিনী নজিরবিহীন সামরিক সমাবেশ ও আগ্রাসন চালালেও মূলত তাদের পরোক্ষ ইঙ্গিতেই সাদ্দাম হোসেন কুয়েত দখল করতে চেয়েছিল বলে জানা যায়। আট বছরের যুদ্ধের খরচ জোগাতে গিয়ে ইরাক সরকার পশ্চিমা সহযোগী দেশগুলোর কাছে বিশাল আকারে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ায় ধারদেনার খরচ মেটাতে কুয়েতের তেলক্ষেত্রগুলোর দখল নেয়ার পাশাপাশি পারস্য উপসাগরের সাথে একটি সরাসরি নাভাল অ্যাকসেস পাওয়ার জন্য সাদ্দাম হোসেন কুয়েত দখলের অভিপ্রায় ব্যক্ত করলে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত তাদের অভ্যন্তরীণ বিরোধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে না বলে জানিয়েছিল। বাগদাদে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত এপ্রিল গ্লাসপি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের কাছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের (সিনিয়র) এই বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন। ইসলামী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইরানের রাজনৈতিক উত্থান এবং সাদ্দাম হোসেনের ইরাক মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের লাঠিয়াল ইসরাইলকে ভবিষ্যতের নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কায় ঠেলে দিয়েছিল। সেই আশঙ্কা থেকে ইসরাইলকে মুক্ত রাখতেই প্রথমে ইরান-ইরাক যুদ্ধ, প্রথম গাল্ফ ওয়ার, পারমাণবিক প্রকল্পের অজুহাতে ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ, অতঃপর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও ডব্লিউএমডি থাকার মিথ্যা অভিযোগে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর ইরাক দখলের পাশাপাশি ইরানের বিরুদ্ধে ব্যাপক রণপ্রস্তুতি ও অব্যাহত হুমকির পেছনে লক্ষ্য ছিল অভিন্ন। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের পর পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের জন্য একটি বিকল্প প্রতিপক্ষ দাঁড় করানো মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের ব্যবসায় টিকিয়ে রাখতে অতি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল। হার্বাডের প্রফেসর স্যামুয়েল পি হান্টিংটন উদ্ভাবিত ‘ক্লাস অব সিভিলাইজেশন’ ধারণাকে সামনে এনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মানচিত্র পরিবর্তনের একটি ব্যাপক ছক এঁকেছিলেন। নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসী বিমান হামলার মধ্য দিয়ে সেই নীলনকশা বাস্তবায়নের বাস্তব ও প্রত্যক্ষ সামরিক উদ্যোগ নেয়া হয়। আফগানিস্তানে সামরিক হামলার আগে নাইন-ইলেভেন ঘটনার প্রথম প্রতিক্রিয়ায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট বুশ এই যুদ্ধকে ‘ক্রুসেড’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। সা¤্রাজ্যবাদী যুদ্ধের নীতিনির্ধারকরা শুরুতেই একে একটি এন্ডলেস বা অন্তহীন যুদ্ধ বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে যা-ই দৃশ্যমান হোক না কেন, হান্টিংটনের সূত্র অনুসারে কোল্ড ওয়ার পরবর্তী বিশ্ববাস্তবতায় পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে ইসলাম, হিন্দুইজম, বুদ্ধিজমসহ প্রতিটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আইডেন্টিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়ে পশ্চিমাদের অনুকূল ও নিরবচ্ছিন্ন নয়া বিশ্বব্যবস্থা কায়েম করাই ছিল এই যুদ্ধ শুরুর মূল লক্ষ্য।
ইরাক যুদ্ধের আগের পশ্চিমা গোয়েন্দা তথ্য ও যুক্তরাজ্যের অংশগ্রহণের যথার্থতা নিরূপণের উদ্দেশ্যে গঠিত এক সদস্য তদন্ত কমিটির প্রধান স্যার জন চিলকটের প্রতিবেদনটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন তৈরির দায়িত্ব প্রাপ্তির প্রায় সাত বছর পর প্রকাশিত এই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের অনেক আগেই চিলকটের উত্থাপিত অভিযোগ ও তথ্য-প্রমাণসমূহ অনুসন্ধানী রিপোর্ট ও নানাজনের বিশ্লেষণে উঠে এসেছিল। ছাব্বিশ লাখ শব্দের বিশালায়তন চিলকট রিপোর্টের নানা ফাইন্ডিংস নিয়ে ভবিষ্যতে হয়তো নানামাত্রিক অনেক বিশ্লেষণ বেরিয়ে আসবে। মাত্র কয়েকটি বাক্যে তার রিপোর্টের সারবত্তা সম্পর্কে বলতে গিয়ে চিলকট দেখিয়েছেন, শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের চেষ্টা না করেই বুশ-ব্লেয়ার ইরাক দখলের সামরিক অভিযান শুরু করেছিলেন। সাদ্দামের হাতে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার গোয়েন্দা তথ্য সঠিক ছিল না। যুদ্ধের পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেয়ার হিসাব-নিকাশেও মারাত্মক ভুল ছিল। সর্বোপরি ভুল ও ত্রুটিপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট বুশের সামরিক অভিযান পরিকল্পনার প্রতি বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের শর্তহীন সমর্থন ছিল অযৌক্তিক ও অবিবেচনাপ্রসূত। চিলকট রিপোর্ট প্রকাশের পর তৎকালীন বৃটিশ উপ-প্রধানমন্ত্রী জন প্রেসকট ইরাক যুদ্ধকে অবৈধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করেছেন। সেই সাথে সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর তার অনুগত বাহিনীর সদস্যদের ব্যাপকহারে চাকরিচ্যুত করার মার্কিনি সিদ্ধান্তও একটি মারাত্মক ভুল ছিল বলে মন্তব্য করেছেন প্রেসকট। এই ভুল সিদ্ধান্তের কারণে মূলত এসব চাকরিচ্যুত সেনাসদস্যই পরবর্তীতে আইএসে যোগ দিয়েছিল বলে মনে করেন বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ড। একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও সম্ভাবনাময় দেশ ও অঞ্চলকে বধ্যভূমি ও ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার পর এখন বলা হচ্ছে, তাদের সিদ্ধান্ত, গোয়েন্দা তথ্য ও হিসাব-নিকাশ ভুল ছিল! ইতিমধ্যে লাখ লাখ মানুষ হতাহত হয়েছে। কোটি মানুষ বাস্তুহীন হয়েছে। আইএসের তৎপরতা শুরুর পর সিরিয়া, ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যে উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা ছাড়াই সিরিয়াও একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। আর এই সন্ত্রাসী তৎপরতা এখন মধ্যপ্রাচ্যের গ-ি পেরিয়ে বিশ্বের অন্যতম বহৎ মুসলিম জনপদ বাংলাদেশেও হানা দিতে শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশে ক্ষমতাসীনদের সাথে বিরোধী দল ও জনগণের সুস্পষ্ট মতবিরোধ রয়েছে এবং যেখানে ক্ষমতার পরিবর্তনে জনগণের রাজনৈতিক অধিকারকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে মূলত সেসব দেশেই আইএসসহ জঙ্গিবাদী তৎপরতা বিস্তার লাভ করেছে। একটি বিভক্ত জাতি সব সময়ই ভঙ্গুর ও দুর্বল। এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্বার্থান্বেষী মহলের প্রশ্রয় বা প্ররোচনায় একেকটি দেশকে ডি-স্ট্যাবিলাইজ করে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। যারা ‘অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম’ নাম দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে একটি যুদ্ধ শুরু করে তা সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
যারা নিজেদের দেশের সন্ত্রাসী কর্মকা- রুখতে পারছে না তারা ক্রমাগত বাংলাদেশে আইএস ও জঙ্গিবাদের হুমকির কথা শোনাচ্ছে এবং এসব হুমকি মোকাবেলায় বাংলাদেশের পাশে থেকে সহায়তার আশ্বাস দিচ্ছে। আমাদের সরকারও সম্ভবত সেই ফাঁদে পা দিতে শুরু করেছে। সরকার ও বিরোধী দলের ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করছে একদিকে সন্ত্রাসীরা, অন্যদিকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি। জাতির সামনে এখন সবকিছুই যেন অস্পষ্ট, ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। সর্বত্র উদ্বেগ, হতাশা আতঙ্ক। বাংলাদেশের এই পরিস্থিতি তুলে ধরে গত ৭ জুলাই নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘শক অ্যান্ড ডিনায়াল ইন বাংলাদেশ’। এই নিবন্ধে বাংলাদেশে একটি হতাশা ও চরম নিরাপত্তাহীনতার হুমকির মধ্যেও সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতার অভাব ও প্রত্যাখ্যানের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনেও বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভক্তির সুযোগে সন্ত্রাসবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থা শক্তিশালী হয়ে উঠছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে। বিদেশিরা যা-ই বলুন, বাংলাদেশের বাস্তবতা এ দেশের সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝতে হবে। ‘পলিটিক্স ইজ আর্ট অব কমপ্রোমাইজ’, গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এই বাক্য ধ্রুব সত্যের মতো বাস্তব। ক্ষমতায় টিকে থাকতে অথবা ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী সন্ত্রাসবাদ ও সা¤্রাজ্যবাদী স্বার্থের কাছে মাথানত করলে বা তাদের পাতা ফাঁদে পা দিলে তা দেশের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় পরিচয়ের কারণেই বাংলাদেশ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরাশক্তির টার্গেট হতে পারে। ইরাক ও সিরিয়া তার বাস্তব উদাহরণ। উদারনৈতিক ধর্মীয় সংস্কৃতি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও রাজনীতিসচেতন বাংলাদেশের মানুষ কোনো পরাশক্তি বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কাছে কখনো নতিস্বীকার করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিশ্বসন্ত্রাস
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ