Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিয়ন্ত্রণহীন বাস চালকরা

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ১৩ মার্চ, ২০২০, ১২:০০ এএম

বেপরোয়া বাস চালকদের রেষারেষিতে সড়কে প্রাণ হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। নিয়ন্ত্রণহীন বাস চালানোর ফলে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নস্থানে প্রতিনিয়ত ঘটছে মারাত্মক দুর্ঘটনা। এতে কেউ হাত কিংবা পা হারিয়ে সারাজীবনের মতো পঙ্গুত্ব বরণ করছেন। আবার কারো বেঘোরে প্রাণ যাচ্ছে। সস্প্রতি দেশ জুড়ে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়লেও চালকদের সতর্ক হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং সড়কে চালকরা দিনদিন আরো বেপরোয়া ও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে উঠেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের তিব্বত এলাকায় দুই বাসের মাঝে চাপা পড়ে আজিজুল হক (৫২) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। দুর্ঘটনার পর বাস দুটিকে আটক করে থানায় আনা হয়েছে। অন্যদিকে গত বুধবার রাতে ফার্মগেট বিজ্ঞান কলেজের সামনে কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় কামরুল হাসান (৩৫) নামে এক পাঠাও চালক নিহত হয়েছেন।

গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন, প্রেসক্লাব, মৎস্যভবন, শাহবাগ, কারওয়ান বাজার, পান্থপথ, ফার্মগেট, মৌচাক, মালিবাগ, মগবাজার, সায়েদাবাদ, মানিকনগর, কমলাপুর, মুগদা, বাসাবো, মালিবাগ, রামপুরা ও বাড্ডা এলাকার সড়ক ঘুরে বেপরোয়া বাস চলাচলের দৃশ্য দেখা যায়। যাত্রীদের ভাষ্য, কোনো চালকই আইন মানছে না। আগের স্টাইলেই চলছে রাজধানীর গণপরিবহনগুলো।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মফিজ উদ্দিন আহমেদ দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, রাজধানীতে কোনভাবেই বাস চালকদের নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। যত্রতত্র যাত্রী উঠানামা বা যেখানে সেখানে বাস থামিয়ে দেয়া যেন বাস চালকদের স্বভাবে পরিণত হয়েছে। তবে সড়ক দুঘর্টনা নিয়ন্ত্রণে সাধারণ পথচারীদেরও সর্তক হতে হবে। পথচারীরা সর্তক হয়ে নির্দিষ্ট জায়গা দিয়ে রাস্তা পারাপার হলে সড়কে মৃত্যুর হার কমবে বলে অতিরিক্ত কমিশনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ মন্তব্য করেন।

গাড়িচালকরা বলছেন, নিয়োগপত্র ও বিধি অনুসারে বেতন-ভাতা না দিয়ে গাড়ির মালিকরা তাদের বেশি ট্রিপ দিতে বাধ্য করছেন। ফলে গতিসীমাসহ সড়কের আইন পুরোপুরি মানা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। চালকদের দাবি, চাকরি রক্ষার জন্যই তারা মালিকদের নির্দেশ মেনে আসছেন। ফলে সড়ক ও মহাসড়কে শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়েছে, দুর্ঘটনাও বাড়েছে।

নিরাপদ সড়ক চাই কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, বাসচালকরা কাউকেই মানছে না। এক প্রকার ফ্রি স্টাইলে গাড়ি চালাচ্ছেন। চাকায় পিষ্ট হয়ে কিংবা ধাক্কায় কেউ আহত হলে বা মরলেও তা দেখার সময় তাদের নেই। আইন থাকলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনার কারণ গতিসীমা না মেনে গাড়ি চালানো। এ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের নিয়োগপত্র থাকছে না। নিয়োগপত্র না থাকায় সড়কে বিশৃঙ্খলা আরো বাড়ছে। শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের কয়েক দিন রাজধানীতে নিয়ম মেনে গণপরিবহন চললেও এখন সেই আগের অবস্থা। আবারও গণপরিবহন চালকরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ট্রাফিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তারা স্বভাবগত ভয়ংকর প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, বাসচালক থেকে শুরু করে রিকশাচালকরা বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালাচ্ছেন। কার আগে কে যাবে, কে আগে যাত্রী তুলবে সেই প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। সড়কের বিভিন্ন মোড়ে পুলিশ তৎপর হলেও চালকদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না। দুপুর ১২টার দিকে কাকরাইল চৌরাস্তায় আগের চিত্র ফুটে উঠে। সিগন্যাল না দিতেই চালকরা বাস চালাতে তড়িঘড়ি শুরু করে দেন। সিগন্যাল ছাড়ামাত্র মিনিট খানেকের মধ্যেই কে আগে গিয়ে বেশি যাত্রী উঠাবেন সেই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন তারা। তাড়াহুড়ো করে বাস চালাতে গিয়ে বাসের সঙ্গে বাসের ধাক্কাধাক্কির ঘটনাও ঘটে। এরই মধ্যে আবার জীবনের ঝুকি নিয়ে বাসে উঠছিলেন যাত্রীরা।

রামপুরা রুটের তুরাগ বাসের এক চালক জানান, সব কিছু আগের মতো চলছে। প্রতিদিন নির্ধারিত টাকা দিতে হচ্ছে বাস মালিককে। ঝড়-বৃষ্টি কিংবা যে কোনো প্রতিকুলতার মধ্যেও মালিককে নির্ধারিত টাকা বুঝিয়ে দিতে হয়। এ কারণে প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে তাদের গাড়ি চালাতে হচ্ছে। তিনি বলেন, যত ট্রিপ তত টাকা। আগে যেতে পারলেই বেশি যাত্রী পাওয়া যায়। কারণ বেশি যাত্রী বেশি টাকা।

রামপুরা বিশ্বেেরাডের সবুজবাগ এলাকায় রহমত উল্লাহ নামে এক যাত্রী জানান, কোনো কিছুই পরিবর্তন হয়নি। চালকরা যেভাবে গাড়ি দাঁড় করান তাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই বাসে উঠতে হয়। স্কুল পোশাক পরা বেশ কয়েক জন শিক্ষার্থী জানায়, আগেও ঝুঁকি নিয়ে গণপরিবহনে উঠতে হতো আর এখনও তাই রয়েছে। কোন পরিবর্তন নেই, বেহাল অবস্থা বলে তারা মন্তব্য করেন। এ সময় জহির নামে এক ছাত্র বলেন, আসলে এ সব দুঘর্টনা বা অব্যবস্থাপনা নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যাথা নেই। সবাই নিজের আখেড় নিয়েই ব্যস্ত বলে ওই ছাত্র মন্তব্য করেন।
গতকাল দুপুরে সার্ক ফোয়ারায় দায়িত্বরত এক ট্রাফিক সার্জেন্ট নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দেখুন চালকরা কি করে গাড়ি চালাচ্ছেন। আইন দিয়ে তাদের কিছু করা যাবে না। নিদিষ্ট জায়গায় বাস দাঁড়ানোর নির্দেশনা থাকলেও বেপরোয়া চালকরা চৌরাস্তায় বাস থামিয়ে যাত্রী তুলছেন। অপর একজন সার্জেন্ট জানান, শত চেষ্টা করেও এমন অনিয়ম রোধ করতে পারছি না।

রামপুরায় হাবিবুর রহমান নামে এক বাস চালক জানান, রেসিংয়ের মধ্য দিয়েই রাজধানীতে বাস চালাতে হচ্ছে। সিরিয়ালের গাড়ি হলেও অন্য গাড়িকে পেছনে ফেলতে না পারলে অতিরিক্ত টাকা রোজগার করা যায় না। ফলে একটি বাস আরেকটির সঙ্গে গা ঘেঁষে চলছে। কোনোটি খানিক চাপ দিলেই ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। যাত্রী উঠা-নামার সময় একটি গাড়ি আরেকটি গাড়িকে সাইড না দেয়ার ঘটনা তো হরহামেশাই ঘটছে। ওই সময় কেউ কেউ গুরুতর আহত হন। আবার কারও কারও প্রাণও যায় বলে তিনি মন্তব্য করেন।

দুই বাসের চাপায় প্রাণ হারালেন একজন
রাজধানীর তেজগাঁও তিব্বত এলাকায় দুই বাসের মাঝে চাপা পড়ে আজিজুল হক এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার সকালে এ দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার পর বাস দুটিকে আটক করে থানায় আনা হয়েছে। নিহতের লাশ ময়না তদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়েছে। নিহতের বাড়ি জামালপুর জেলায় এবং তিনি কেরানীগঞ্জে থাকতেন বলে জানা গেছে।

তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার এসআই শ্রীধাম জানান, গতকাল সকাল সোয়া ছয়টার দিকে তিব্বত শহীদ মিনারের সামনে দুটি বাসের চাপায় ওই ব্যক্তি গুরুতর আহত হয়। পরে আহত ব্যক্তিতে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক সকাল সাড়ে সাতটার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। বাস চালকরা পলাতক রয়েছে। এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে।

ফার্মগেটে কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় পাঠাওচালক নিহত
রাজধানীর ফার্মগেট বিজ্ঞান কলেজের সামনে কামরুল হাসান (৩৫) নামে পাঠাওচালক নিহত হয়েছেন। বুধবার রাতে এ দুর্ঘটনা ঘটে। পরে তাকে গুরুতর আহতাবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। প্রত্যক্ষদর্শী পথচারী আবুল কাশেম জানান, ফার্মগেট বিজ্ঞান কলেজের সামনে একটি মোটরসাইকেলকে কাভার্ড ভ্যান ধাক্কায় দিলে চালক কামরুল গুরুতর আহত হন। পরে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে এলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তিনি আরও জানান, মৃত ব্যক্তির আইডি কার্ড থেকে নামপরিচয় জানা গেছে। গাজীপুর জেলার টঙ্গী উপজেলার মরকৌন গ্রামের মৃত আবুল হোসেনের ছেলে।

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সড়ক


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ