বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব
রুহুল কবির রিজভী বলেছেন,
শেখ হাসিনা তার নিজের পিতার নামে ঘোষিত
মুজিববর্ষ উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। যেকোন মূল্যে তাকে ঢাকায় আনার জন্য নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। কয়েকদিন আগে দিল্লিতেও গণহত্যার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী কি এখন বাংলাদেশের মানুষের সেন্টিমেন্ট উপলব্ধি করতে পারছেন ? দিল্লিতে সুপরিকল্পিতভাবে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। এটি কেবল বাংলাদেশের মানুষের বক্তব্য নয়, গতকাল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও সমাবেশে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি বরং সুপরিকল্পিতভাবে গণহত্যা চালানো হয়েছে।
তিনি বলেন, নিজ দেশেই যে রক্ত ঝরছে সেটিকে বন্ধ না করে মিঃ মোদী যে বাংলাদেশে আসছেন সেটি কি এদেশের মানুষকে উপহাস করা নয় ? এটি তাঁর বিবেচনায় থাকা উচিৎ। রক্তগঙ্গা বয়ে যাওয়া ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সরকার কেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশে আনার জন্য এতো উদগ্রীব ? এই প্রশ্ন এখন মানুষের মুখে মুখে।
বুধবার (৪ মার্চ) দুপুরে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
রুহুল কবির রিজভী বলেন, দেশের জনগণের মর্যাদাকে সমুন্নত রাখার জন্য এই সরকারের উচিত ছিল ভারতে গণহত্যার প্রতিবাদ করা। মুসলিম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক ও বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদ করা। অথচ সেটি না করে নিশিরাতের সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন, দিল্লির গণহত্যা আর নাগরিকত্ব আইন নাকি তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এই আইনটি করার সময় স্পষ্টভাবেই বাংলাদেশসহ আরো কয়েকটি দেশের নামোল্লেখ করা হয়েছে। তাহলে এটি কিভাবে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হতে পারে ? এই বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে ভারতের ক্ষুব্ধ জনগণ সেদেশের সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছেন। ওই মামলায় ‘পক্ষ’ হওয়ার জন্য জাতিসংঘ পর্যন্ত ভারতের সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন জানিয়েছে। এর অর্থ, এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। যে আইনের কু-প্রভাব অন্যদেশে পড়তে পারে সেটিকে অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে উড়িয়ে দেয়ার বিষয় নয়। এই যেমন ‘করোনা ভাইরাস’, চীন থেকে উৎপত্তি তাই বলে এটা কি চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয় ?
বিএনপির এই নেতা বলেন, জনরোষ টের পেয়ে নিশিরাতের সরকারের মন্ত্রীরা আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের দোহাই দিচ্ছেন। আমরা স্পষ্ট করেই বলতে চাই, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ আমাদেরকে কারো কাছে মাথা বিকিয়ে দিতে নয়, আত্মমর্যাদাশীল হতে শিখিয়েছে। মাথা উঁচু করে চলতে শিখিয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নিহিত আছে যাবতীয় আত্মশক্তি ও প্রাণপ্রাচুর্য। নি:সঙ্কোচে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গের প্রেরণা। রক্তস্নাত পথে পাওয়া স্বাধীনতাকে নিশ্চয়ই কারো কাছে বিকিয়ে দেয়ার জন্য নয়। কিন্তু সেই মুক্তিযুদ্ধের দোহাই দিয়ে আওয়ামী লীগ এখন বাংলাদেশকে নতজানু করে রাখতে চায় বিদেশীদের কাছে।
রিজভী বলেন, মুজিব জন্ম শতবার্ষিকী পালন নিয়ে চলছে তুঘলকী কান্ড। রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিতে সংকীর্ণতাবাদ ও একদেশদর্শীতা এবং দেশজুড়ে অবিশ্বাস অসহিষ্ণুতা ও বিদ্বেষের আবহে তারা মুজিব জন্ম শতবার্ষিকী পালন করছে। এটিকে তারা যেন নিশিরাতের নির্বাচনের সাফল্যের উৎসব হিসেবে মনে করছে। মুজিব জন্ম শতবার্ষিকী নিয়ে সারাদেশে চলছে চাঁদাবাজীর মহোৎসব। ব্যবসায়ীদের দিন কাটছে চাঁদাবাজদের আতংকে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের যতই বলুন না কেন ‘মুজিববর্ষের নামে চাঁদাবাজির দোকান দেয়া যাবে না’-কিন্তু এটি তাঁর মুখের কথা, বাস্তবে এর কোন প্রতিফলন নেই। নেতারা বড় বড় ব্যবসায়ীদের ডেকে ডেকে চাঁদার ফর্দ ধরিয়ে দিচ্ছেন। এখানেই থেমে নেই, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন মুজিববর্ষ উপলক্ষে রাজধানীর প্রতিটি বাড়ির দেয়াল রং ও সংস্কার করতে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। সাধারণ মানুষকে বাধ্য করা হচ্ছে এই বর্ষ পালনে। সদ্য সরকারী হওয়া ৩০৪টি কলেজকে শেখ মজিবের ভাস্কর্য তৈরি করতে গত ১৪ জানুয়ারি নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রী তাঁর পিতার জন্ম শতবর্ষ উদযাপনে কত হাজার কোটি টাকা খরচ করবেন তার কোন হিসাব দিচ্ছেন না জনগণের কাছে। কেবল যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আয়োজন করতে যাচ্ছে ৯৭টি ইভেন্ট। যার সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭৬ কোটি ছয় লাখ টাকা। এভাবে প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও সরকারী-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যে পরিমান টাকা খরচের উদ্যোগ নিয়েছে তাতে সবাই হতবাক। যেখানে দেশের তরুণ সমাজ বেকারত্বে ধুকছে, মানুষ অর্ধাহার-অনাহারে দিনযাপন করছে সেখানে এভাবে অর্থ খরচের উৎসব নিয়ে জনগণ প্রশ্ন করছে। একদিকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট, বিদেশে বেহিসেবি অর্থ পাচার, ব্যাংকগুলো দেউলিয়া করে দেয়া হয়েছে অন্যদিকে ঋণের টাকায় চলছে সরকার। সেই সময়ে এই অর্থনাশ যজ্ঞ দেখে জনগণ শংকিত ও হতাশ। আসলে হুকুমবাদ আর জোর জবরদস্তি করে কাউকে ‘আইকন’ হিসেবে তোলা যায় না। আওয়ামী সরকারের বর্বরোচিত নীতির কারণেই মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘ইনক্লুসিভ’ না করে তারা বরং তাঁকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তুলছে।
এখন উল্টোপথে চলছে দেশ মন্তব্য করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব বলেন, ক্ষমতাসীনরা নিজেদেরকে মনে করছেন আইন আদালতের উর্ধে। ফ্যাসিবাদ জাঁকিয়ে বসেছে হিংস্র রুপ নিয়ে। নিজেদের ইচ্ছেমতো রায় বের করার জন্য দেশের আদালতকে ব্যবহার করা হচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার আপনারা দেখেছেন, পিরোজপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে কি ভয়াবহ নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে। ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রতারণা, জালিয়াতি, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে পিরোজপুর-১ আসনের সাবেক এমপি এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম এ আউয়াল এবং তার স্ত্রী পিরোজপুর জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি লায়লা পারভীনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা তিন দুর্নীতি মামলায় জামিন আবেদন বাতিল করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন জেলা ও দায়রা জজ আব্দুল মান্নান। আদালতের এই আদেশের বিরুদ্ধে দুর্নীতিবাজ আওয়ামী লীগ নেতার সমর্থকরা আদালতের বাইরে তান্ডবলীলা শুরু করে। পিরোজপুরের রাস্তা-ঘাট অবরুদ্ধ করে গাড়ি ভাংচুর, হামলা, আগুন জালিয়ে বিক্ষোভ, যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়ে ভয়ানক তান্ডব চালাতে থাকে। এই জেলা শহরটিকে মূহুর্তের মধ্যে এক আতংকের জনপদে পরিণত করে। এখানেই শেষ নয়, তারপরে যা ঘটেছে তা আরো ভয়াবহ। রায় ঘোষনার ঘণ্টাখানেক পর বিচারক আবদুল মান্নানকে ওপরের বিশেষ নির্দেশে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়। বিচারক কেন জামিন দিলো না সে অপরাধে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করার ঘোষনাও দেয়া হয়। এরপর মাত্র চার ঘন্টার মধ্যে আদালতে নতুন বিচারক বসিয়ে তার কাছ থেকে ইচ্ছেমতো রায় আদায় করে নেন। সাবেক এমপি এ কে এম এ আউয়াল কারাগারে না গিয়ে বীরদর্পে বাড়িতে চলে যান। এই হচ্ছে আওয়ামী লীগের নিশিরাতের সরকারের বিচার। সেই স্বাধীন বিবেকের বিচারকের পরিণতি এখন কি হবে তা নিয়ে দেশবাসী শংকিত। তার পরিণতি কি এস কে সিনহার মতো হবে, না মোতাহার হোসাইন এর মতো হবে তা নিয়ে দেশবাসীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই গভীর শঙ্কা নিয়ে অপেক্ষা করছে। এরপরও যখন নিশিরাতের সরকারের মন্ত্রীরা চিৎকার করে বলেন, সরকার আদালতের রায়ে হস্তক্ষেপ করেনা তখন আওয়ামী লীগ লজ্জা না পেলেও বিবেকবান দেশবাসীর লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায়। এতসব ভনিতার কি দরকার ? পরিষ্কার করে বলে দিলেই তো হয়-‘কিসের আবার আইন’ ! ‘শেখ হাসিনার কথাই তো চূড়ান্ত আইন’ ! কথায় বলে, হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়েনা। অথচ নিশিরাতের সরকারের আমলে জনগণ কি দেখছে ? হাকিমও নড়ে, হুকুমও নড়ে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হুকুম নড়ে না। এটাকেই বলে, আইন আদালত মাকড়সার জালের মতো। মন্ত্রী-এমপি, ক্ষমতাসীনরা এই জালে আটকাবে না, এই জালে আটকাবে সাধারণ জনগণ আর বিরোধীদলের নেতা-কর্মীরা। এরই নাম আওয়ামী লীগ।দেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্বকীয়তা ও পৃথকীকরণের পরিবর্তে নিশিরাতের সরকার বিচার বিভাগকে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের একটি শাখা হিসেবে পরিণত করেছে মন্তব্য করে রিজভী বলেন, বিচারকের কাজ এখন ন্যায়বিচারের মাধ্যমে রায় দেয়া নয়, ক্ষমতাসীন মহলের কাছ থেকে পাঠানো রায় পড়া। আওয়ামী লীগ আইন আদালতকে তাদের পকেট আর ভ্যানিটি ব্যাগে ভরেছে। বাংলাদেশের বিচার বিভাগ স্বাধীন একথা এখন নিছক কৌতুক। আবার দুই বছরের বেশী সময় যাবৎ সম্পূর্ণ বিনা অপরাধে কারারুদ্ধ গুরুতর অসুস্থ দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জামিনের প্রসঙ্গ আসলেই এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রী-নেতারা বলেন, আদালতের ওপর নাকি তাদের হাত নেই। কি হাস্যকর কথা! তাহলে পিরোজপুরের আদালতে দিনে দুপুরে এটা কোন হাতের কালো থাবা ? বাস্তবে আইন এখন নিজস্ব গতিতে চলেনা, চলে সরকারের গতিতে। যদি আইনের শাসনের লেশমাত্র থাকতো তাহলে জনগণের প্রাণপ্রিয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আজ জেলে থাকতেন না। দেশনেত্রীকে কারাগারে রেখে বিনা চিকিৎসায় প্রাণনাশ করার জন্য মিডনাইট সরকারের প্রধানমন্ত্রী কেবল জামিনে বাধা দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছেন না, গণভবনে বসে মেডিকেল রিপোর্টও তুলে দিচ্ছেন পিজি হাসপাতালের ডাক্তারদের হাতে। সেই নির্জলা মিথ্যা রিপোর্ট ডাক্তাররা উপস্থাপন করছেন বিচারপতিদের সামনে। বাংলাদেশে এখন চলছে আইয়্যামে জাহেলিয়াতের আদলে আওয়ামী জাহেলিয়াত। বাংলাদেশের চারবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, ৭৫ বছর বয়স্কা মহিয়সী একজন মরনাপন্ন অসুস্থ নারীকে কাগজ-কলমে সুস্থ দেখিয়ে যে অমানবিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন তার পরিণতি এই সরকারকে ভোগ করতেই হবে।