বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
কোরআন ও হাদীসে কবর শব্দটির বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। কবরের মূল ও প্রকৃত অর্থ মাটির ওই গর্ত, যেখানে শবদেহকে প্রথিত করা হয়। তারপরও কবর শুধু মাটির গর্তের অর্থেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং যেখানেই মানুষের মরদেহ বা তার অংশসমূহ থাকবে, সেটাই তার কবর।
চাই তা মাটির গর্তে হোক বা হিংস্র প্রাণীর উদরে হোক। সকল অবস্থায় ওই জায়গাটুকুকে রূপক অর্থে কবর বলে নামকরণ করা হবে। আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অন্তর্ভূক্ত দ্বীনি বিষয়ে বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, প্রত্যেক মৃত ব্যক্তিরই মুনকার-নাকীর ফিরিশতার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। চাই সে কবরে থাকুক বা বন্য প্রাণীর পেটে থাকুক, পাখীর উদরে থাকুব বা জ্বালিয়ে ভষ্ম করার পর বাতাসে উড়িয়ে দেয়া হোক। (মিরকাত শরহে মিশকাত : খন্ড ১, পৃ. ২০৩; শরহুল মাকাসিদ : খন্ড ৩, পৃ. ৩৬৫-৩৮৬)। বস্তুত: সমুদ্রে জলমগ্ন, বন্য প্রাণীর উদরস্ত, বায়ূপ্রবাহে উড়ন্ত মৃত ব্যক্তিকেও আযাব দেয়া হবে। যদিও আযাবের স্বরূপ সম্পর্কে আমরা অবগত নই।
কবরে প্রত্যেক ব্যক্তিকে ফিরিশতা সওয়াল-জওয়াব করবে। মুমিনগণ সঠিক উত্তর দিবে, কবরে আরাম ও আনন্দের জীবন লাভ করবে। কাফির, মুনাফিক ও মুশরিকগণ সঠিক উত্তর দিতে পারবে না। পরিণামে তারা কঠিন শাস্তিতে নিপতিত হবে।
হযরত আনাস রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন: যখন বান্দাকে মৃত্যুর পর কবরে শায়িত করা হয়, তখন দু’জন ফিরিশতা তার নিকট এসে জিজ্ঞাসা করে- এ ব্যক্তি (হযরত মোহাম্মাদ সা.) সম্পর্কে তোমার ধারণা কি ছিল? লোকটি বলবে: আমি সাক্ষ্য দেই যে, তিনি আল্লাহর বান্দা ও তার রাসূল। তখন তাকে বলা হবে, তোমার সঠিক উত্তরের কারণে আল্লাহপাক জান্নাতে তোমার আসন পরিবর্তন করে দিয়েছেন।
আর কাফির মুনাফিককে জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি দুনিয়াতে (হযরত মোহাম্মাদ সা.) সম্পর্কে কি বলতে? সে উত্তর দিবে, লোকেরা যা বলত, আমি তাই বলতাম। ফিরিশতাগণ তার দুই কানের মাঝখানে লোহার হাতুড়ি দ্বারা আঘাত করবে। ফলে সে এমন বিকটভাবে চিৎকার করেবে যে, মানব ও জ্বিন ছাড়া অন্য সকল সৃষ্টি তা শ্রবণ করবে। (মুসনাদে আহমাদ : খন্ড ৩, পৃ. ১৫৫)।
কবরের জগতকে কোরআন ও হাদীসে ‘বারযাখ’ বলেও অভিহিত করা হয়েছে। আরবী ‘বারযাখ শব্দের অর্থ পর্দা, আবরণ, ঢাকনা, বেড়া। আলমে বারযাখ বা বারযাখের জগত বলতে ওই জগতকে বোঝায়, যেখানে মানুষ মৃত্যুর পর হতে কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত অবস্থান করবে। যেহেতু সে জগতটি দুনিয়ার এ জগত হতে অন্তরালে বা আড়ালে আছে, কাজেই তাকে বারযাখের জগত বলা হয়। অতএব, বারযাখ কোনো বিশেষ স্থানের নাম নয়। বরং মৃত্যুর পর মানবদেহ বা দেহের অংশসমূহ একত্রিতভাবে বা বিচ্ছিন্নভাবে যেখানে থাকবে ওই স্থানই তার জন্য কবর বা বারযাখ।
বারযাখ জগতের সকল অবস্থা মানুষ ও জ্বিন জাতি হতে মহান আল্লাহপাক পর্দার অন্তরালে রেখেছেন, যাতে করে ঈমান বিল গায়েব যথার্থ থাকে। তাছাড়া বারযাখের জগতকে অন্তরালে ও আবরণে আচ্ছাদিত রাখার আরেকটি কারণ হলো, বারযাখের জগত ও পৃথিবীর জগত সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন।
সেই জগতের যাবতীয় অবস্থা পৃথিবীতে অস্থানকারী মানুষের জন্য দেখা বা অনুভব করা সম্ভব নয়। অন্য জগতের কোনো কিছু দৃষ্টিগোচর না হওয়া বা বোধগম্য না হওয়ার ব্যাপারে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। এ বিষয়টি অত্যন্ত সত্য। এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এর মাধ্যমেই অদৃশ্যে বিশ্বাসীগণ হাশরের মাঠে অবিশ্বাসীদের থেকে পৃথক হয়ে যাবে। (শরহে আকীদায়ে সিফারানিয়্যাহ : পৃ. ৪০০)।
যদি আল্লাহপাক বারযাখ জগতের এ সমস্ত বিষয়ের উপর বান্দাহগণকে অবহিত করতেন, তাহলে বান্দাহকে খলীফা বা দায়িত্ব প্রদানের রহস্য এবং গায়েবের প্রতি ঈমান আনয়নের বিষয়টি বিনষ্ট হয়ে যেত ও মানুষ মৃতদেহকে দাফন করা হতে বিরত থাকত। রাসূলুল্লাহ সা. স্পষ্টত:ই ইরশাদ করেছেন, যদি মৃত ব্যক্তিকে দাফন করা থেকে বিরত থাকার আশংকা না থাকত, তাহলে অবশ্যই আমি আল্লাহর দরবারে দোয়া করতাম, যেন তিনি তোমাদেরকে কবরের বা বারযাখ জগতের আযাব শুনিয়ে দেন, যেমন আমি শুনতে পাই। যেহেতু চতুস্পদ প্রাণীর মধ্যে এ কারণ ও হিম্মতটি অনুপস্থিত, তাই তারা তা শুনতে পায়। (শরহে আকীদায়ে তাহাবিয়্যাহ : পৃ. ৪০১)।
মোটকথা, কবরের জগত ও বারযাখের জগত একই বস্তুর দু’রকম নামকরণ মাত্র। আল্লাহপাক এই জগত সম্পর্কে অধিক চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ মুমিন বান্দাহগণকে দান করুন, এটাই আজকের একান্ত প্রত্যাশা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।