Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ঐক্য ও সমঝোতা প্রয়োজন

প্রকাশের সময় : ১০ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জামালউদ্দিন বারী
ঈদের মাত্র তিন দিন আগে ঢাকার গুলশানের কূটনৈতিক জোনে হলি আর্টিজান বেকারি ও রেস্টুরেন্টে সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি হওয়া ২০ জন বিদেশি নাগরিকের নির্মম মৃত্যুর শিকার হওয়ার পর পুরো বিশ্বই বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুনভাবে ভাবতে শুরু করেছে। গত বছর গুলশানে ইতালীয় নাগরিক তাভেলা সিজার হত্যার পর যেমন আইএস তার দায় স্বীকার করেছিল, এরপর সন্ত্রাসীদের আরো কয়েকটি টার্গেটেড কিলিংয়ের পরও আইএস দায় স্বীকার করেছিল, একইভাবে গুলশানের সর্বশেষ হামলার পরও আইএস দায় স্বীকার করেছে। প্রতিটি হামলার পর আইএস দায় স্বীকার করলেও বাংলাদেশ সরকার বরাবরই দেশে আইএস নেটওয়ার্ক না থাকার কথা দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রায় প্রতিটি হত্যাকা- ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের পরই সরকারের পক্ষ থেকে বিরোধী দলের ওপর দায় চাপানোর ধারাবাহিক পুনরাবৃত্তি দেখা গেছে। তবে নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডারের ঘটনাটি ছাড়া এখন পর্যন্ত চাঞ্চল্যকর কোনো হত্যাকা- ও নাশকতার ঘটনারই বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত বা কাক্সিক্ষত বিচার নিশ্চিত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আইএস একটি পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের ফ্রাঙ্কেনস্টাইন, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, কোনো রাজনৈতিক দল এবং সরকার এই ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিতে চায় না। অতএব দেশে আইএস আছে এটা স্বীকার করা কৌশলগত কারণে হয়তো সম্ভব নয়। তবে কারা এসব হত্যাকা- ও বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি করছে তা খুঁজে বের না করে প্রতিটি ঘটনাকে রাজনৈতিক ব্লেম গেম ও বিরোধী দল দমনের অজুহাত হিসেবে ব্যবহারের পর ঘটনার ভিন্ন মোটিফ বের হওয়ার ফলে সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। গুলশানের রেস্টুরেন্টে জিম্মিদের উদ্ধারে বাংলাদেশের যৌথ বাহিনী প্রায় ১২ ঘণ্টা সময় নিয়েছিল। শনিবার সকালে আধা ঘণ্টারও কম সময়ের ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ সম্পর্কে সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। অল্প সময়ে অপারেশন শেষ করে জিম্মি নাটকের অবসান ঘটানোর দক্ষতা এবং অন্তত ১৩ জন জিম্মিকে জীবিত উদ্ধারের ঘটনা প্রশংসনীয় হলেও অনেক দেরিতে অপারেশন শুরুর কারণে ২০ জন বিদেশিকে হত্যা করার সুযোগ পাওয়ার অভিযোগও উঠেছে। যদিও সন্ত্রাসীরা রেস্টুরেন্টে ঢোকার পরই বাংলাদেশিদের হত্যা না করার ঘোষণা দিয়ে এসব বিদেশি নাগরিককে গুলি ও জবাই করে হত্যা করেছে বলে পরবর্তীতে জানা গেছে। এর পরও অন্তত দুজন পেশাদার পুলিশ অফিসারসহ পাঁচজন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। বিভিন্ন দেশে আইএস যেভাবে জিম্মি করার পর হত্যা করে থাকে গুলশানে তারই একটি খ-চিত্র যেন দেখা গেল। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, যৌথ বাহিনীর অভিযানে জিম্মি উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের নিহত হওয়ার আগেই আইএসের মিডিয়া আমাক নিউজের বরাত দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইট ইন্টেলিজেন্স  হোস্টেজ প্লটে অংশগ্রহণকারী হিসেবে যাদের ছবি ছাপিয়েছিল যৌথ বাহিনীর অভিযান শেষে প্রকাশিত ছবির সাথে তা হুবহু মিলে গেছে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আইএস নেটওয়ার্কের সক্রিয় তৎপরতার যে দাবি পশ্চিমারা করে আসছিল শেষ পর্যন্ত তা-ই যেন প্রমাণিত হতে চলেছে।
আমাদের দেশে কথিত আইএস থাক বা না থাক, এর পক্ষে-বিপক্ষে যতই বিতর্ক হোক, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এখানেও আইএস ও মোসাদ মডেলের টার্গেটেড কিলিং, জিম্মিদের নির্মম হত্যার ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। এসব ঘটনায় নিরপরাধ মানুষ, বন্ধু দেশের নিরপরাধ নাগরিক যারা আমাদের উন্নয়নমূলক কর্মকা-ে বিশেষজ্ঞ, পরামর্শক অথবা কূটনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্মকা-ে অংশ নিতে এ দেশে এসেছিল তাদের হত্যা করে ওরা বাংলাদেশকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে চায়, বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা, বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে স্তব্ধ করে দিতে চায়। কয়েক বছর ধরেই একের পর এক সংঘটিত এসব ঘটনার পেছনে দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বিরোধী দলের প্রতি সরকারের অসহিষ্ণুতা এবং নিবর্তনমূলক মনোভাবকে দায়ী করছেন দেশি-বিদেশি রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সারা বিশ্বই এখন সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদী হামলার চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। সাধারণত রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও ইমেজ ক্ষুণœকারী বড় ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয়। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সব রাজনৈতিক শক্তি একটি ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগে শামিল হয়। কিন্তু বাংলাদেশে বরাবরই এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ চোয়াল শক্ত করে বিরোধী দলের ওপর দায় চাপিয়ে তাদের দমনের নীলনকশা নিয়েই যেন ব্যস্ত থাকছেন। কোনো বিবেকবান মানুষই সন্ত্রাসী তৎপরতায় মানুষ হত্যার নির্মমতাকে সমর্থন করতে পারে না। তবে কোনো দেশের সরকার জনগণের আস্থা হারালে অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সংক্ষোভের শিকার হলে মতলববাজ সন্ত্রাসী অথবা ভিনদেশি এজেন্টরা তার সুযোগ গ্রহণ করে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করে থাকে। এ জন্যই রাজনৈতিক কারণে সৃষ্ট সন্ত্রাসী তৎপরতা অস্ত্র দিয়ে নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না। গত বছর প্যারিসের শার্লি এবদোতে সন্ত্রাসী হামলার পর মার্কিন ফরেন সার্ভিস ডিপার্টমেন্টের একজন সাবেক কর্মকর্তা ও লেখক পিটার ভ্যান বুরেন নিজের উপলব্ধিসঞ্জাত লেখাটিকে অপ্রিয় সত্য হিসেবে বর্ণনা করে গত ১৫ নভেম্বর আইসিএইচ ব্লগে প্রকাশিত এক নিবন্ধের শিরোনাম দিয়েছিলেন, ‘প্যারিস : ইউ ডোন্ট ওয়ান্ট টু রিড দিস’। শুরুতেই তিনি বলেন, তিনি নিজেও এ সময় এ ধরনের নিবন্ধ লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন না, ‘বাট আই বিলিভ ইট নিডস টু বি সেইড’, আমার বিশ্বাস এটা বলা প্রয়োজন। এভাবেই লেখাটি শুরু করেছেন পিটার বুরেন। এরপর প্যারিস থেকে শুরু করে পেছনের নাইন-ইলেভেন, অস্ট্রেলিয়া, বালি ও লন্ডনে সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা ও শোক জানিয়ে পাশ্চাত্যের সা¤্রাজ্যবাদী যুদ্ধের ফিরিস্তি ও অসংখ্য মানুষের হত্যাকা-ের আংশিক ক্রনলজিক্যাল তালিকা প্রকাশের আগেই যে উপসংহার টেনেছেন তার বাংলা অনুবাদ অনেকটা এ রকম, ‘তোমরা মধ্যপ্রাচ্যকে একা থাকতে দাও। আরো ব্যর্থ রাষ্ট্র সৃষ্টি করা বন্ধ কর। মিথ্যার ওপর ভর করে নিজ দেশে আমাদের নাগরিক স্বাধীনতাকে নির্বাসনে পাঠিয়ো না। যেসব মুসলমান আমাদের সাথে বসবাস করছে, তাদের অধিকার বঞ্চিত করার চেষ্টা বন্ধ কর। যুদ্ধের ধরন ও গতি-প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা কর। একটি ধর্মীয় বিশ্বাস এবং কিছু বদ্ধমূল ধারণা যা পাশ্চাত্যবিরোধী, সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী, তাকে তুমি বোমা দিয়ে নির্মূল করতে পারবে না। তিনি আরো বলেন, সন্ত্রাসীদের পরাভূত করতে আমরা আমেরিকায় আমাদের অনেক স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়েছি। এটা কোনো কাজে আসেনি। সন্ত্রাসীদের পরাভূত করতে আমরা ইরাকে ৪ হাজারের বেশি মার্কিনি নর-নারী জীবন দিয়েছি এবং আরো কয়েক হাজার জীবন দিয়েছি আফগানিস্তানে, আমরা তাদের প্রশ্ন করারও কোনো সুযোগ দেইনি যে, কেন তারা প্রাণ দিচ্ছে। আমরা বিভিন্ন দেশে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছি। আমরা এখন  সিরিয়ায়, তার আগে লিবিয়ায় এবং ইরাকে যুদ্ধ করে শুধু কিছু ব্যর্থ রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছি। এসব যুদ্ধনীতি কোনো কাজে লাগেনি। বরং একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টির সাথে সাথে সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করেছে। আমরা আমাদের মুসলমান নাগরিকদের ওপর নির্যাতন ও বিড়ম্বনা চাপিয়ে দিয়ে তাদের চরমপন্থার দিকে ধাবিত হতে বাধ্য করছি। আর সব অপকর্মের জন্য চোয়াল শক্ত করে আইএসকে দোষারোপ করছি।’ পিটার ভ্যান বুরেন ছাড়াও আরো অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষক টেররিজমের নেপথ্য কারণসমূহের বিশ্লেষণ করে একই রকম মতামত দিয়েছেন।
মুসলমানদের সিয়াম সাধনার মাস পবিত্র রমজান শুরুর মাত্র একদিন আগে গত ৫ জুন চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু আক্তার সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হওয়ার পর রমজানের শুরুতেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী  সারা দেশে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে। সাত দিনের সেই অভিযানে সন্দেহভাজন জঙ্গি হিসেবে অন্তত ১৬ হাজার মানুষকে আটকের খবর পাওয়া যায়। এদের মধ্যে পুলিশের তালিকাভুক্ত শতাধিক  জঙ্গি সন্ত্রাসী রয়েছে বলে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়। ছয় দফায় অনুষ্ঠিত সদ্য সমাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সারা দেশে উঠতি সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া তৎপরতা ও অস্ত্রের ঝনঝনানি দেখা গেছে। হাজার হাজার মানুষ হতাহত হওয়া, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও কেন্দ্র দখলের মাধ্যমে সরকারি দলের একক আধিপত্যের এই নির্বাচনকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নিকৃষ্ট নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা। মিতু হত্যায় জড়িত টার্গেটেড কিলার দমনের লক্ষ্যে নির্বাচনের পর পর পরিচালিত যৌথ বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে এসব উঠতি অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের কতজনকে ধরা হয়েছিল তা দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট নয়। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষকে আটকের খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের কোনো তথ্য তেমন গোচরে আসেনি। তবে গত ১৮ জুন ঢাকার দিয়াবাড়ি খাল থেকে এক সাথে শতাধিক বিদেশি পিস্তল ২৬৩টি এসএমজি ম্যাগাজিন এবং হাজার রাউন্ড বুলেট উদ্ধার করে পুলিশ। এসব অব্যবহৃত ও আমদানি করা ইনট্যাক অস্ত্রের উৎস সম্পর্কে এখনো পুলিশ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেনি। এসব অস্ত্রের উৎস সম্পর্কেও কাউকে কাউকে দোষারোপের রাজনীতিতে লিপ্ত হতে দেখা গেছে। ঘৃণ্য সন্ত্রাসীদের ধরে বিচারের সম্মুখীন করা এবং তাদের শিকড় খুঁজে বের করার  বদলে কথিত সন্দেহভাজনদের ধরে ক্রসফায়ারে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিকে আরো ঘোলাটে ও আতঙ্কজনক করে তোলা হচ্ছে বলে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন। প্রতিটি ঘটনার পরই সন্ত্রাসী-গুপ্তঘাতকদের উৎস খুঁজে বের করার কথা বললেও দু-একজন সন্দেহভাজনকে ধরার পর অস্ত্র উদ্ধার বা সহযোগীদের ধরার নাম করে ক্রসফায়ারে হত্যার মধ্য দিয়ে অপরাধের চাক্ষুষ সাক্ষীসহ ক্লু ধামাচাপা দেয়ার ঘটনার পুনরাবৃত্তি চলছে। মাদারীপুর সরকারি নাজিমউদ্দিন কলেজের শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীকে হত্যা প্রচেষ্টার সাথে জড়িত বলে কথিত ফাহিম সাধারণ মানুষের হাতে ধরা পড়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে তাকে শিবির-জামায়াতের লোক বলে দাবি করা হয়। তবে তাকে ক্রসফায়ারে হত্যা করার পর বিরোধী দলের পক্ষ থেকে কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, সরকার প্রকৃত দোষীদের আড়াল করতেই হয়তো ফাহিমকে ক্রসফায়ারে হত্যা করেছে। একজন তরুণ নানা কারণে নানাভাবে সন্ত্রাসী কর্মকা-ে সম্পৃক্ত হতে পারে। এতদিন আমাদের দেশের একশ্রেণীর সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি একটি মতলবি প্রচারণার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একযোগে হইচই চালাচ্ছিল যে, বাংলাদেশে কওমি মাদরাসাগুলো জঙ্গিবাদে মদদ দিচ্ছে। যদিও এ পর্যন্ত কোনো সন্ত্রাসী ঘটনায় কোনো মাদরাসার প্রাতিষ্ঠানিক সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে গুলশানের রেস্টুরেন্টে হত্যাকা-ের সাথে জড়িতদের সবাই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়া ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান বলে জানা যায়। এদের আর্থিক প্রলোভন দিয়ে কেউ এ কাজে সম্পৃক্ত করেছে এমন অনুমান যেমন বিশ্বাসযোগ্য নয়, আবার স্কলাসটিকা, টার্কিশ হোপ স্কুল, নর্থসাউথ-ব্রাক ইউনিভার্সিটি তাদের শিক্ষার্থীদের এসব সন্ত্রাসী তৎপরতার জন্য দায়ী এমনটা দাবি করাও বালখিল্যতা। গুলশান রেস্টুরেন্টে যৌথ অভিযানে নিহত ৬ সন্ত্রাসীর একজন রোহান ইমতিয়াজ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা, বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের উপমহাসচিব এস এম ইমতিয়াজ খানের পুত্র। রোহানের পিতা একজন আওয়ামী লীগ নেতা হওয়ার কারণে কেউ যদি দাবি করে সন্ত্রাসী তৎপরতার সাথে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে জড়িত তাহলে তা কি বিশ্বাসযোগ্য হবে? আমাদের দেশে এ ধরনের দাবি তোলা ও ব্লেম গেমে লিপ্ত হওয়ার ঘটনা কোনো নতুন বিষয় নয়। তবে বিশেষত সরকারি মহল এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে অপরাধের সরলিকরণ ও রাজনীতিকরণের ফলেই বাংলাদেশে জননিরাপত্তা ও সামগ্রিক পরিস্থিতি ঘোলাটে ও জটিল রূপ ধারণ করেছে।
গুলশানে জঙ্গিবাদী হামলায় নিহতদের মধ্যে ৯ জন ইতালীয় নাগরিক এবং ৭ জন জাপানি নাগরিক রয়েছেন। ইতিপূর্বেও ইতালীয় নাগরিক তাভেলা সিজার এবং জাপানি নাগরিক হোসি কোনিও টার্গেটেড কিলিংয়ের শিকার হওয়ার পর আইএস দায় স্বীকার করেছিল। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, জাপান আমাদের সবচেয়ে পরীক্ষিত বন্ধুরাষ্ট্র এবং অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার, অন্যদিকে ইতালি আমাদের গার্মেন্ট পণ্যের অন্যতম ক্রেতা। শুক্রবারের সন্ত্রাসী হামলায় নিহত জাপানি নাগরিকরা বাংলাদেশের প্রস্তাবিত মেট্টোরেল প্রকল্পের সাথে যুক্ত ছিলেন, আর নিহত ইতালীয় নাগরিকদের বেশিরভাগ আমাদের তৈরি পোশাক রফতানির সাথে জড়িত বলে জানা যায়। অর্থাৎ এই হত্যাকা-ের সাথে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দেয়ার ইঙ্গিত রয়েছে। ঈদের আগে গুলশানে জঙ্গি হামলার পর সেখানকার শপিংমল ও বিপণিবিতানগুলো ফাঁকা হয়ে যায়। এসব ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বছরের প্রধান ব্যবসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এরই মধ্যে আইএস ঢাকায় আবারো জঙ্গি হামলার টার্গেট হিসেবে ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত শপিংমল ও বিনোদন ও বিজনেস হাব যমুনা ফিউচার পার্কে হামলা চালানোর আগাম ঘোষণা দিয়েছে। এই ঘোষণার পর নিশ্চিতভাবেই যমুনা ফিউচার পার্কের ব্যবসায়-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশ সন্ত্রাসীদের টার্গেট হওয়ার নেপথ্য কারণ যাই থাক, এসব হামলায় প্রথমত দেশের অর্থনীতি সরাসরি আক্রান্ত হচ্ছে, দ্বিতীয়ত বিদেশি বিনিয়োগ ও বৈদেশিক যোগাযোগ, বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নিরাপত্তাজনিত কারণে ইতিমধ্যে বৃটেন, অস্ট্রেলিয়া জার্মানি বাংলাদেশে তাদের কার্গো বিমান ওঠানামায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ফ্রান্স, ইতালি, কানাডাও  বাংলাদেশে কার্গো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশিত হয়েছে। কার্গো নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি যাত্রীবাহী বিমান চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপের কথাও বলা হচ্ছে। এসব আশঙ্কা যদি সত্য হয়, বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক ভাবমর্যাদা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা আমাদের জন্য উদ্বেগের বিষয়। গুলশান রেস্টুরেন্টে সন্ত্রাসী হামলা এবং ২০ জন বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনা বিশ্ব গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার হয়েছে। বাংলাদেশে সন্ত্রাস ও জননিরাপত্তার সংকটের পেছনে দেশের রাজনৈতিক সংকটকেই দায়ী করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
গুলশান হত্যাকা-ে জড়িতদের ছবি ও নাম-ঠিকানা পরিচয় ইতিমধ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। আমাক নিউজ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক টেররিজম মনিটরিং সংস্থা সাইট ইন্টেলিজেন্স এদেরকে আইএস জঙ্গি বলে দাবি করলেও বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে এদের নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সদস্য বলে দাবি করা হয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামিলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম গুলশান হামলায় শিবির জড়িত বলে দাবি করেছেন। আবার বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া এবং সংবিধানপ্রণেতা ও বর্ষীয়ান রাজনীতিক ও আইনজ্ঞ ড. কামাল হোসেন দুঃশাসন ও আইনের শাসনের অভাবে সন্ত্রাসবাদের উত্থান ঘটছে বলে মন্তব্য করেছেন। ইতিপূর্বে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকেও বাংলাদেশে রাজনৈতিক কারণে সন্ত্রাসবাদের উত্থানের আভাস দেয়া হয়েছিল। সন্ত্রাসবাদ রুখে দিতে আবারো বিএনপি নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় ঐক্যের আহ্বান নাকচ করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী অপরাধীদের শেকড় খুঁজে বের করার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন। আলকায়েদা, তালেবান, বোকো হারাম ও আইএসের শেকড় কোথায় পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীরা তা জানে কি জানে না সেটা যতটা না বিবেচ্য বিষয়, তার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সফল হওয়া। প্রচলিত পন্থায় সামরিক লড়াইয়ে তাদের বিরুদ্ধে সারাবিশ্ব ব্যর্থ হয়েছে। এখানে পিটার ভ্যান বুরেনের সেই উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য, যেখানে তিনি বলেছেনÑ ‘ যুদ্ধের ধরণ ও গতি-প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা কর। একটি ধর্মীয় বিশ্বাস এবং কিছু বদ্ধমূল ধারণা যা পাশ্চাত্যবিরোধী, সা¤্রাজ্যবাদবিরোীধ, তাকে তুমি বোমা দিয়ে নির্মূল করতে পারবে না।’ কোনো সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা যে সমাধান নয়, তা জেএমবির তৎপরতা থেকেই বোঝা যায়।  মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে ১০ বছর করা সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা  এমারিলিস ফক্সের আলজাজিরাকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকার অবলম্বনে গত ৩ জুলাই আইসিএইচ ব্লগে পোস্ট করা একটি নিবন্ধের শিরোনাম ছিল, তোমার শত্রুর কথা শোন, ‘লিসেন টু ইউর এনিমি’। তালেবান, আল-কায়েদাসহ তাদের আদর্শিক শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হাজার হাজার কোটি ডলার ব্যয় করার পরও নির্মূল করতে ব্যর্থ হয়ে তাদের সাথে কথা বলতে ও কথা শুনতে শুরু করেছে। ইরান এবং সিরিয়ার শাসকদের সাথেও সমঝোতা হয়েছে। বাংলাদেশের সরকার ও বিরোধী দল তথা গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সহযোগী ও সহযোদ্ধা রাজনৈতিক নেতারা কি দেশের স্বার্থে একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় উপনীত হতে পারেন না? দেশকে চরম সংকটের মুখে ঠেলে দেয়ার আগে দেশের ১৬ কোটি মানুষের মনে অনেক উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার সাথে এই প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। প্রতিপক্ষ নির্মূল বা ফেলে দেয়ার গতানুগতিক চিন্তা ও একগুঁয়েমি পরিহার করে সংশ্লিষ্টরা ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রুদ্ধ হয়ে পড়তে পারে বলে আশংকা করছেন পর্যবেক্ষকরা।  
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ঐক্য ও সমঝোতা প্রয়োজন
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ