বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
আউস ও খাজরাজ গোত্রদ্বয়কে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করার পাশাপাশি মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভাতৃবন্ধন সুদৃঢ় করার পর মহানবী সা. মদীনাকে একটি রাষ্ট্রসংগঠনের আওতায় আনার দিকে মনোযোগ প্রদান করেন। মদীনার নিরাপত্তা, সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প ছিল না। মদীনায় তৎকালে তিন শ্রেণীর লোক বসবাস করত। ১. আদিম পৌত্তলিক সম্প্রদায় ২. বহিরাগত ইহুদী সম্প্রদায় এবং ৩. নবদিক্ষিত মুসলিম সম্প্রদায়। এই তিন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশ্বাস, চিন্তা ও আদর্শগত কোনো মিল ছিল না। দ্বিতীয়ত: শুরুতে মুসলিমদের ব্যাপারে ওই দুই সম্প্রদায়ের বিদ্বেষ বা হিংসা না থাকলেও অত্যল্পকালের মধ্যেই তারা মুসলিমদের সম্পর্কে বৈরি মনোভাবাপন্ন হয়ে পড়ে।
এমতাবস্থায়, পরস্পরবিরোধী আদর্শের তিন সম্প্রদায়ের মধ্যে সাধারণ ঐক্য ও সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর না হলে মদীনাকে নতুন রাষ্ট্রসংগঠনের আওতায় আনা অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে নবী করিম সা. ত্রিপক্ষীয় আলোচনা সভার আয়োজন করেন এবং সেই সভায় তার লক্ষ্য এবং মদীনার স্বার্থের কথা ব্যক্ত করেন। তিনি সকল পক্ষের সম্মতিক্রমে একটি সমঝোতাপত্র বা সনদ লিপিবদ্ধ করান এবং তাতে তিন পক্ষই স্বাক্ষর করে।
সনদের প্রথমেই আছে মুহাজির, আনসার ও অপরাপর মুসলিমগণের সম্পর্ক, অধিকার, দায়িত্ব, বিচার ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়। এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার মুসলিমদের ওপর দেয়া হয়। এরপর কতিপয় পৌত্তলিক সম্প্রদায়ের নামোল্লেখসহ তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়। অতঃপর সকল সম্প্রদায়ের জন্য কতগুলো নীতি নির্দেশ প্রদান করা হয়। ইবনে হিশামের মতে, এগুলো হলো :
কোনো গোত্র বা সম্প্রদায় শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে সকলে সমবেত শক্তিতে তা প্রতিহত করবে।
কেউ কোরাইশ গোত্রের সঙ্গে গোপন চুক্তিতে আবদ্ধ হবে না, তাদের কাউকেই আশ্রয় দেবে না এবং তাদের দুষ্ট সংকল্পে সহায়তা করবে না।
মদীনা আক্রান্ত হলে সকলে সমবেতভাবে আক্রমনকারীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবে এবং প্রত্যেক সম্প্রদায় যুদ্ধব্যয় নিজে বহণ করবে।
সকল সম্প্রদায় স্বাধীনভাবে নিজেদের ধর্ম পালন করবে। কেউ তাতে হস্তক্ষেপ করবে না।
ব্যক্তির অপরাধের জন্য গোত্র বা সম্প্রদায়ের অধিকার খর্ব হবে না। ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবে তার বিচারের ব্যবস্থা হবে।
মদীনায় নরহত্যা নিষিদ্ধ।
শোণিত পণ পূর্বের মতো বহাল থাকবে।
উৎপীড়িতকে রক্ষা করতে হবে।
প্রত্যেক সম্প্রদায়কে মিত্রপক্ষসমূহের অধিকার রক্ষা করতে হবে।
মুসলিমদের সম্পর্কে বলা হয়, তারা অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি সদয় ব্যবহার করবে, তাদের মঙ্গলের চেষ্টা করবে, অনিষ্টের সংকল্প করবে না। এই সঙ্গে এ সিদ্ধান্তও হয় যে, মুহাম্মাদ সা. এই সমাজ ব্যবস্থার প্রধান হবেন এবং সকল বিরোধ সাধারণভাবে মীমাংসা না হলে মীমাংসার ভার তার ওপর ন্যস্ত হবে। তিনি আল্লাহর বিধান মতে, মীমাংসা করবেন। এই সনদের ভিত্তিতে আল্লাহর রাসূল সা.-এর নেতৃত্বে একটি সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা মদীনায় প্রতিষ্ঠিত হয়, যাকে আদর্শ রাষ্ট্র বা ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইতিহাস। ইসলামে ন্যায়বিচার, উদারতা, সাম্য, পরমতসহিষ্ণুতা, অসাম্প্রদায়িতা কতটা গুরুত্ব লাভ করেছে, এই সনদ তার প্রমাণ।
এই সনদের ওপর ভিত্তি করে কোনো সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে ওঠলে তার শান্তি, সম্প্রীতি, নিরাপত্তা ও বিকাশ অবধারিত। আসলে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সমাজ ও রাষ্ট্রে যে অশান্তি, সন্ত্রাস, অনাচার, জুলুম ও বৈষম্য চলছে, মহানবীর মদীনা রাষ্ট্রের আদর্শে রাষ্ট্র গড়ে উঠলে তা থাকবে না, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।