Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সিলেটে বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদরাসার শতবর্ষ উদযাপন ২০ ফেব্রুয়ারি

ফয়সাল আমীন | প্রকাশের সময় : ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ৬:৫৬ পিএম

দিন-মাস-বছর-যুগ-অর্ধ শতাব্ধির সীমানা গড়িয়ে শতবর্ষে পদার্পণ করছে বাংলাদেশের উত্তর পূর্ব সীমান্তে, সুরমা-কুশিয়ারার বাহুডোরে আবদ্ধ জকিগঞ্জ উপজেলার ঐতিহ্যবাহ দ্বীনি প্রতিষ্টান ‘বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল (এম.এ) মাদরাসা’। দ্বীনি এ প্রতিষ্টানের শেকড় যাত্রা শুরু হয়েছিল হযরত শাহজালাল (র.) বুযুর্গ হযরত আলা বখশ (র.) ধারাবাহিক উত্তরসূরী হযরত মাওলানা ফাতির আলী (র.) উদ্যোগে। শ্যামল সবুজ নির্ভৃত পল্লীতে ইসলামী শিক্ষার প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে ১৯২০ সালে প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল এই দ্বীনী মশাল। এই মশালের আলোকে আজঅবধি তৈরী হচ্ছেন দ্বীনের পথের অগুনতি দাঈ। তাদের প্রজ্জ্বলিত দ্বীনি শিক্ষায় সিক্ত হচ্ছেন সাধারন ধর্মপ্রাণ মানুষ। ঐতিহ্যের দ্বীনি স্মারক এ প্রতিষ্টানের শর্তবর্ষ উদ্যাপন নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা বইছে সাবেক ও বর্তমান ছাত্র সহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। তারা ইতিহাসের পাতায় মাদরাসার রূপ-রস রাংগিয়ে রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন অফুরন্ত। এ মাদরাসার শিক্ষা জীবন পার করে দেশ ও দেশের বাইরে দ্বীনি খেদমতে নিয়োজিত রয়েছেন অসংখ্যজন। তাদের মিলনমেলায় বাড়তি আকর্ষণ ছড়াবে শতবর্ষী অনুষ্টানটি। এদিকে, সমৃদ্ধ একটি স্মারক প্রকাশনা সম্পন্ন করা হয়েছে। স্মারকে বানী প্রদান করেছেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্র, একাধিক মন্ত্রী সহ দেশের গণ্যমান্য
শিক্ষাবিদ ও শিক্ষানুরাগীরা। শর্তবর্ষী অনুষ্টানে অতিথির তালিকায় রয়েছেন, পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান, বন ও পরিবেশ মন্ত্রী সাহাব উদ্দিন, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এমপি, সিলেট বিভাগের একাধিক এমপি সহ বিশিষ্টজন। এছড়া উপস্থিত থাকবেন মিশরের ইসলামিক ব্যক্তিত্ব ড. মোহাম্মদ ইয়াহইয়া আল কিত্তানী আল আজহার, ভারতের উজানডীহির পীর সাহেব সৈয়দ মুস্তাক আল মাদানী ও জুনায়েদ আল মাদানী।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শুরুতে মসজিদ কেন্দ্রিক শিক্ষাদান কর্মসূচির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন হযরত মাওলানা ফাতির আলী (র.)। পরবর্তীতে মসজিদ থেকে আলাদা করে বর্তমান স্থানে মাদরাসার গৃহ নির্মাণ করা হয় এলাকাবাসীর সহযোগিতায়। এসময় মাদরাসার জন্য ভূমি দান করেন মনসুরপুর নিবাসী জনাব আছদ্দর আলী চৌধুরী, আজব আলী চৌধুরী, আকদ্দছ আলী চৌধুরী, ছখাওত আলী চৌধুরী, গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী এবং একই গ্রামের খুরশিদ আলী চৌধুরী। এক পর্যায়ে মাদরাসা ক্যাম্পাস বর্ধিত করণে জমি দানের হাত প্রসারিত করেন যুগ শ্রেষ্ট আলেমেদ্বীন হযরত আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)। শুধু দানের মধ্যেই তার অবদান সমাপ্তি নয়, মাদরাসার ইতিহাসে অন্যতম এক আলোকিত অলংকার তিনি। কারন এই মাদরাসার কৃতি ছাত্র, আদর্শ শিক্ষক, দীপ্তমান এক অনুকরনীয় অভিভাবকও তিনি। এ মাদরাসার প্রথমদিকের ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীতে আলিম ও কারী হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে দ্বীনের পথে নিজদের উৎসর্গ করে এ প্রতিষ্টানের সুনাম ছড়িয়ে দিয়েছেন। একদিকে ছাত্রদের মেধার বিচ্ছূরণ অপরদিকে ফুলতলী এ মাদরাসা ক্রম উন্নতি ঈর্ষণীয় সাফল্যের মুখ দেখে। কিন্ত যাত্রার এ শুভ পথ স্থায়ী হতে না হতেই বন্ধ হয়ে যায় মাদরসার দরজা। দেশ বিভাগের পর ১৯৫০ সালে হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ বদরপুর (আসাম) থেকে গ্রামের বাড়ি ফুলতলীতে ফিরে আসেন। পুনরায় তাঁর উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় মাদরাসা নতুন করে যাত্রা শুরু করে। মাদরাসার সভাপতি বা মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। ১৯৫৯ সালে মাদরাসাটি দাখিল স্তরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক স্বীকৃতি পায়। ১৯৭৫ সালে এক প্রলয়ংকরী কাল বৈশাখী ঝড়ে মাদরাসা গৃহ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়। ফলে মাদরাসার স্বাভাবিক পাঠদান ব্যাহত হয়। এমনি দুরবস্থায় মাদরাসাটি পুনপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আবারো হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) তাঁর দানের হাত প্রসারিত করেন। তাঁর বদান্যতা ও প্রবাসী মুরীদীন-মুহিব্বীনের সহযোগিতায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিলুপ্ত মাদরাসাটি অল্পদিনের মধ্যে পুনপ্রতিষ্ঠা লাভ করে। মাদরাসার পূর্ব ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরী ছাহেবজাদা মাওলানা মো. নজমুদ্দীন চৌধুরীকে মাদরাসার দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়। তাঁর একনিষ্ট প্রচেষ্ঠায় ১৯৭৭ সালে মাদরাসাটি আলিম স্তরে বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন মাননীয় ধর্ম, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট ও বাংলাদেশ জমিয়তুল মোদার্রেছীনের সভাপতি মরহুম আলহাজ¦ মাওলানা এম.এ মান্নান ফুলতলীতে এক সমাবেশে আমন্ত্রিত হয়ে যোগদান করেন। এখানে অবস্থানকালে মাদরাসা পরিদর্শন করে এর ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং মাদরাসাটি কামিল পর্যন্ত উন্নীত করার জন্য আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহকে সুপরামর্শ দেন তিনি। পরবর্তীতে তাঁর সহযোগিতায় মাদরাসাটি ১৯৮৯ সালে ফাযিল, ১৯৯৪ সালে কামিল (হাদীস) ও ২০০১ সালে কামিল (তাফসীর) স্তরে স্বীকৃতি লাভ করে। মাদরাসার দাখিল ও আলিম যথাক্রমে এসএসসি ও এইচএসসি’র সমমান হলেও ২০০৬ এর আগে ফাযিল ও কামিল ডিগ্রি ও মাস্টার্সের সমমানের ছিল না। ২০০৫ সাল থেকে সারাদেশে মাদরাসার ফাযিল ও কামিলকে যথাক্রমে ডিগ্রি ও মাস্টার্সের মান প্রদানের দাবি জোরদার হয়। এ লক্ষে স্বতন্ত্র আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনও সক্রিয় হয়ে উঠে। আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে ২০০৬ সালে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) সিলেট থেকে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচি পালন করেন। বৃহত্তর আন্দোলনের মুখে তৎকালীন সরকার সে বছরই মাদরাসার ফাযিল ও কামিল স্তরকে যথাক্রমে বি.এ ও এম.এ সমমানে উন্নীত করে ইসলামি বিশ^বিদ্যালয়, কুষ্টিয়া এর অধীনে ন্যস্ত করে। ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সারা দেশে ৩১টি মাদরাসায় ৪ বছর মেয়াদি ফাযিল অনার্স কোর্স চালু করা হয়। এ সময় ফুলতলী মাদরাসায়ও ফাযিল শ্রেণিতে অনার্স কোর্স চালু হয়। ২০১৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে ‘ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় বিল’ পাশ হয়। বর্তমানে বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল এম.এ মাদরাসা ‘ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়’ এর অধিভুক্ত ইসলামী শিক্ষাধারার সর্বোচ্চ স্তরের একটি মাদরাসা। এ প্রতিষ্ঠানে দাখিল থেকে কামিল স্তরের পাশাপাশি আল হাদীস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে ফাযিল বি.এ (অনার্স) ও কামিল (মাস্টার্স) কোর্স চালু রয়েছে। বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল (এম.এ) মাদরাসা ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইতিমধ্যে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছে দেশব্যাপী। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানে প্রায় দেড় হাজার শিক্ষার্থী দ্বীনী শিক্ষা অর্জন করছে। তাদের নিরলস জ্ঞান অর্জনের মধ্যে দিয়েই ইসলামের -আদর্শ ও শিক্ষা বিস্তারে এ নিরলস খিদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে এ প্রতিষ্ঠান।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ