বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ও উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ভারতের ইংরেজ শাসক ও তার অনুচর শিখ ও অন্যদের মুসলিম বিদ্বেষীরূপ চরম আকার ধারণ করে। এহেন সঙ্কটময়কালে মুসলিম ভারতের সংগ্রামী ধর্মীয় নেতা, অযোধ্যার অন্তর্গত রায়বেরিলী জেলায় সাইয়্যেদ আহমাদ শহীদ বেরেলবী রহ. ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হযরত আলী রা. এর পুত্র হযরত হাসান রা. এর বংশ সম্ভূত ছিলেন এবং আলে মোহাম্মাদ সা.-এর রক্তধারা তার মাঝে প্রবহমান ছিল। তার পিতার নাম ছিল সাইয়্যেদ মোহাম্মাদ ইরফান রহ.। তিনিও আলে মোহাম্মাদ সা.-এর অন্তর্ভূক্ত ছিলেন বলে ইসলামের পুরুত্থানের জন্য কায়মনে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করতেন।
রায়বেরেলীতে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করার পর কিশোর সাইয়্যেদ আহমাদ লখনৌ গমন করেন। বাল্যকাল থেকেই সৈনিকসুলভ কুচকাওয়াজ এবং শারীরিক কসরত সুলভ কর্মকান্ডের প্রতি তার সবিশেষ অনুরাগ ছিল। তারপর তিনি ধর্মীয় বিদ্যা অর্জনের জন্য দিল্লি এসে উপস্থিত হন।
সেখানে শাহ ওয়ালীউল্লাহ মোহাদ্দেসে দেহলভী রহ. এর পুত্র তদানীন্তন শ্রেষ্ঠ আলেম শাহ আব্দুল আজিজ রহ. এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। অল্পকালের মধ্যেই তিনি ধর্মীয় জ্ঞান এবং অধ্যাত্মিক জ্ঞানে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। এরই মধ্যে জিহাদের প্রেরণা তার শিরা উপশিরায় টগবগ করে ফুটতে ছিল। তাই শিক্ষা সমাপনান্তে তিনি জিহাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন।
২৪ বছর বয়সে (১৮১০ খ্রিস্টাব্দে) তিনি রাজপুতনায় গমন করেন এবং আমীর খানের সৈন্যবাহিনীতে দীর্ঘ সাত বছর কাজ করেন। তারপর ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি ধর্মীয় শিক্ষক ও সংস্কারকরূপে প্রচারমূলক দেশ ভ্রমণে বের হন। তদানীন্তন ভারতীয় মুসলমানদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অধঃপতনে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত ছিলেন। এ জন্য তিনি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমণ করে মুসলমানদর যাবতীয় কুসংস্কার বর্জন, চরিত্র সংশোধন ও শুদ্ধ সরল ধর্ম পদ্ধতি অবলম্বনের আন্দোলন চালাতে লাগলেন।
এ সময়ে আরব দেশে ওহাবী আন্দোলন চরম আকার ধারণ করলেও তার মতাদর্শের সাথে ওহাবী মতবাদের সর্বাংশে মিল ছিল না বিধায় তিনি ওহাবী ছিলেন না। অতি শীঘ্রই তার মতবাদ ও সুমান চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। তদানীন্তন ভারতের অগণিত মুসলমান তার অনুসারী হয়। তার বিশ্বস্ত সহচরদের মধ্যে শাহ মোহাম্মাদ ইসমাঈল শহীদ, মৌলভী আব্দুল হাই এবং মৌলভী মোহাম্মাদ ইউসুফ ছিলেন উল্লেখযোগ্য।
১৮২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতায় আগমন করেন এবং তথা হতে হজযাত্রা করেন। প্রায় তিন বছর সেখানে অবস্থান করে ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং খিলাফত প্রতিষ্ঠার মানসে জিহাদের সক্রীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ধর্মীয় শিক্ষার সাথে সাথে তিনি তার অনুসারীগণকে অস্ত্র চালনা শিক্ষায় ও পারদর্শী করে তোলেন।
তার বিভিন্ন পত্রাবলী পাঠে জানা যায়, ইংরেজ শক্তিকে বিতাড়িত করে ভারতে মুসলিম শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠাই ছিল তার জিহাদের প্রধান উদ্দেশ্য। শিখগণ মুসলমানদের ঘোর বিরোধিতা ও ইংরেজদের সহায়তা করত বলে সামরিক কারণে তার প্রথম লক্ষ্য ছিল পাঞ্জাব হতে শিখ বিতারণ করা। কাবুল ও কান্দাহারের মুসলিম শাসকগণ তাকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন।
১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে উৎসাহী অনুচরদের এক বিরাট মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে তিনি পেশোয়ারে প্রবেশ করেন এবং ‘আকোডা খটকে’ শিখ বাহিনীকে পরাজিত করেন। কিন্তু তার দলভুক্ত ইয়ার মোহাম্মাদ খান দুররানী ও তার ভ্রাতা হঠাৎ করে দলত্যাগ করলে ‘সাইদোর’ যুদ্ধে তিনি পরাজিত হন।
তারপর ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি পেশোয়ার দখলে সমর্থ হন। কিন্তু দুররানী ভ্রাতৃদ্বয় ও সীমান্তের খানদের বিশ্বাসঘাতকায় তিনি নিরুৎসাহ হয়ে পড়েন এবং সেখান হতে কাশ্মীর গমনের মনস্থ করেন। কাশ্মীরের পথে তিনি শিখ বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হন এবং ‘বালাকোটের’ যুদ্ধে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ও তার সহচর শাহ মোহাম্মাদ ইসমাঈল শাহাদাত বরণ করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
তিনি এবং তার সহচরা ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রদূত। তারপর তার সশস্ত্র সংগ্রামের সমাপ্তি ঘটলেও তার সংস্কার আন্দোলন বন্ধ হয়ে যায়নি। তার শিষ্য সহচরগণ ভারতের বিভিন্নস্থানে প্রচারকার্য চালাতে থাকেন। তারা ইংরেজ সরকারের অধীনে চাকরি না করে ব্যবসার দ্বারা জীবিকা অর্জনের নীতি গ্রহণ করেছিলেন। যার ক্রমধারা দীর্ঘকাল যাবত অব্যাহত ছিল।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।