Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাতে ফ্লাইওভার ভয়ঙ্কর

অন্ধকারে সক্রিয় সিএনজিচালিত অটোরিকশা চক্র

খলিলুর রহমান | প্রকাশের সময় : ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০১ এএম

রাতের আধাঁরে রাজধানীর ফ্লাইওভারগুলোতে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে। বিশেষ করে গত ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত রাজধানীর ফ্লাইওভার থেকে চারটি লাশ উদ্ধারের পর জনমনে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ছিনতাইকারী কাজে বাধা দেওয়ায় তাদের হত্যা করে ফ্লাইওভারে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আর ওইসব কাজে একটি সিএনজি অটোরিকশা চক্র জড়িত বলে জানায় সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যে ওই চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরে তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য। তবে ওই চক্রের বাকি সদস্যদের গ্রেফতার করতে অভিযান অব্যাহত আছে বলে জানান আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

ফ্লাইওভারগুলোতে সরজমিন ঘুরে ও আশপাশে বসবাসকারী বাসিন্দাদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, সন্ধ্যার পর থেকে রাত যত গভীর হয় ফ্লাইওভারগুলো তত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে। তবে অনেক সময় ফ্লাইওভারের ওপর রাতে বাতি জ্বলে না। আর এই সুযোগে অপরাধী ও যৌন কর্মীরা ফ্লাইওভার দখল করে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এভাবে রাত যত গভীর হয় অপরাধীরা তত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেন।
বিশেষ করে রাজধানীর মহাখালী, বনানী, মালিবাগ-মগবাজার, কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় ফ্লাইওভার সন্ধ্যার পর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত যানজট লেগে যায়। এ সময় টানা পার্টির সদস্যরা সক্রিয় হয়ে উঠে। তারা জ্যামে পড়া গাড়ি থেকে মোবাইল ও ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে উধাও হয়ে যায়। আর ওইসব ফ্লাইওভারগুলোর ওপর বাতিও জ্বালানো হয় না। গত মঙ্গলবার রাতে ফ্লাইওভারগুলো এমন দৃশ্য দেখা গেছে।

মগবাজার মোড়ের বাসিন্দা বাবু আহমদ। তিনি ফ্লাইওভার সংলগ্ন একটি ভবনের ছয়তলায় বসবাস করেন। সেই সুবাধে রাতে ফ্লাইওভারের দৃশ্য দেখতে পান নিয়মিত। তিনি দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, ফ্লাইওভারগুলো উদ্বোধনের পর কয়েক মাস বাতি জ্বলছিল। এরপর থেকে বাতিগুলো জ্বলে না।

অভিযোগ রয়েছে, মালিবাগ, হাতিরঝিল, মহাখালী, মগবাজার ফ্লাইওভারে মাসে অর্ধশতাধিক ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটে। এছাড়া যাত্রাবাড়ী মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে ছিনতাইয়ের পাশাপাশি ডাকাতির ঘটনাও ঘটে।

হানিফ ফ্লাইওভারের পার্শবর্তী কাজলা এলাকার বাসিন্দা রবিউল ইসলাম দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, গত কয়েক দিন আগে রাত দুইটার দিকে হঠাৎ করে ফ্লাইওভারের থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় নেমে আসেন ব্যক্তি। ফ্লাইওভারের নিচেই এসেই একটি চায়ের দোকানের পাশে ঢলে পড়েন। এ সময় স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান।
অজ্ঞাত ওই ব্যক্তির বরাত দিয়ে রবিউল ইসলাম আরো জানান, ওই ব্যক্তি ট্রাকভর্তি গরু নিয়ে ঢাকায় আসছিল। কিন্তু ফ্লাইওভারে ওপর উঠার পর ডাকাত দলের সদস্যরা তাকে কুপিয়ে ট্রাক নিয়ে পালিয়ে যায়। পরে তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় ফ্লাইওভারের নিচে আসেন।

এদিকে কুড়িল বিশ্বরোড এলাকার ফ্লাইওভারগুলো ঘুরে দেখা গেছে, সন্ধ্যার পর থেকে যৌনকর্মীরা ফ্লাইওভারের ওপরে ও নিচে অবস্থান নেয়। রাতভর তারা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। বিশেষ করে কুড়িল বিশ্বরোডের শেওড়া বাজার এলাকায় যৌনকর্মীদের আনাগুনা সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে।
ওই এলাকার চা দোকানী লুকমান মিয়া দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, দীর্ঘ দিন থেকে রেল লাইনের পার্শবর্তী ফ্লাইওভারের নিচে ও ওপরে সন্ধ্যার পর থেকে যৌনকর্মীরা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও ফ্লাইওভারের ওপরেও তারা অবস্থান নিয়ে ছিনতাইসহ নানা ধরনের অপরাধ করে থাকে।
ফ্লাইওভারে ছিনতাইয়ের অভিনব কৌশল : ফ্লাইওভারগুলোতে অভিনব কৌশলে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। কখনো কখনো মোটরসাইকেল বাহকের কাছ থেকে ছিনতাইয়ের ঘটনায় কয়েকটি মোটরসাইকেল দিয়ে ব্যারিকেড দেওয়া হয়। আবার অনেক সময় ফ্লাইওভারের দুই পাশ থেকে সাদা নাইলনের সুতা ধরে রাখে। সেই সুতাতে মোটরসাইকেল আটকে যায়।

এ সুযোগে আগে থেকে দুই পাশে অবস্থান নেওয়া কয়েকজন এসে সর্বস্ব ছিনিয়ে নেয়। এ ধরনের ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহীরা গুরুতর জখমও হন। এছাড়াও নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে সিএনজি যোগে যাত্রীদের নিয়ে এসেও ফ্লাইওভারে ওপর তাদের সর্বস্ব ছিনিয়ে নেওয়া হয়। আর এ সময় বাঁধা দিয়ে তাদের হত্যা করে লাশ ফ্লাইওভাবে ফেলে দিয়ে চলে যায় ছিনতাইকারীরা। সম্প্রতি এমন বেশে কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে।

জানা গেছে, গত ৫ জানুয়ারি রাত সোয়া ১টার দিকে মগবাজার ফ্লাইওভারের ওপর সোনারগাঁও প্রান্ত থেকে মিজানুর রহমান নামের এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে রাত আড়াইটার দিকে একই ফ্লাইওভারের রেইনবো ক্রসিং থেকে সোনারগাঁও প্রান্তে দিকে যাওয়ার পথে ফ্লাইওভারের ওপর রেলিং ওয়াল ঘেঁষে একটি মানিব্যাগ উদ্ধার করা হয়। পরে সেটার মধ্যে একটি জাতীয় পরিচয়পত্র ও জব আইডি কার্ড উদ্ধার করে পুলিশ। পরে আইডি কার্ডের ছবির সাথে আর মুখের মিল পাওয়াতে লাশর পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়।

পুলিশ জানায়, নিহত মিজানুর রহমানের গ্রামের বাড়ি ল²ীপুর জেলার সদর উপজেলার ছবিলপুরে। তার বাবা আমির হোসেন পেশায় মুদি দোকানদার। আর তিনি রাজধানীর শেওড়া পাড়া এলাকায় একটি মেসে থাকতেন এবং এশিয়ান ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করতেন। শুধু তাই নয়, লেখাপড়ার পাশাপাশি রাজধানীর বনানীস্থ হোটেল ‘গোল্ডেন টিউলিপ’ এর ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ শাখায় ওয়েটার হিসেবে কাজ করতেন। সেখানে চাকরি করে লেখাপড়ার খরচ চালানোর পাশাপাশি অবশিষ্ট টাকা মুদি দোকানদার বাবাকে দিতেন তিনি।
শুধু মিজানুর রহমানের লাশ নয়, পুলিশের তথ্যমতে গত ১০ ডিসেম্বর থেকে ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন ফ্লাইওভার থেকে আরো তিনটি লাশ উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে গত ১০ ডিসেম্বর কুড়িল ফ্লাইওভার থেকে আক্তার হোসেন নামের এক স্বর্ণকার, ৩১ ডিসেম্বর খিলক্ষেত ফ্লাইওভার থেকে অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়। এখনো তার পরিচয় সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
এছাড়া ৩ জানুয়ারি কুড়িল বিশ্বরোড সংলগ্ন ফ্লাইওভার থেকে মনির হোসেন নামের আরেক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়। তবে প্রত্যেকটি হত্যাকান্ডের ধরন প্রায় একই। তাদের সবাইকে গলায় গামছা বা মাফলার পেঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে জানায় পুলিশ।

এছাড়াও গত বছর ২৬ আগস্ট মালিবাগ ফ্লাইওভারে গলাকেটে হত্যা করা হয় পাঠাও চালক মিলনকে। একই বছর ২৮ মে ফ্লাইওভারের মালিবাগের অংশ থেকে বস্তাবন্দি এক নারীর দুই হাত ও দুই পা উদ্ধার করা হয়।
পুলিশের ধারণা, একটি সংঘবদ্ধ চক্র অপরাধমূলক এ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তবে ওই চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে গত ২৩ জানুয়ারি টঙ্গি থেকে নূরুল ইসলাম এবং গাজীপুর ও তুরাগ থেকে আবদুল্লাহ বাবা ও জালাল নামের দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়।
পুলিশ জানায়, গ্রেফতার হওয়া সবাই একটি সংঘবদ্ধ ছিনতাই চক্রের সক্রিয় সদস্য। তাদের মধ্যে নূরুল ইসলাম পেশায় সিএনজি অটোরিকশা চালক। সিএনজি অটোরিকশা চালানোর আড়ালে সে ছিনতাই চালিয়ে যেত। শুধু তাই নয়, নূরুলসহ আটজন মিলে রাজধানীতে সিএনজি অটোরিকশা কেন্দ্রিক দুটি ছিনতাইচক্র গড়ে তুলেছে। ওই চক্রের সদস্যরা রাত আটটার পর রাজধানীর আশুলিয়া, আব্দুল্লাহপুর, উত্তরা, গুলশান, ভাটারা, খিলক্ষেত, বাড্ডা, মহাখালী, তেজগাঁও, রামপুরা, ৩০০ ফিট, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, সাইনবোর্ড এলাকায় ছিনতাই কাজ করে থাকে।
ওইসব এলাকা থেকে সিএনজি অটোরিকশা যোগে যাত্রী নিয়ে এসে ফ্লাইওভারে আসে। এক পর্যায়ে সিএনজি অটোরিকশা থামিয়ে যাত্রীর কাছ থেকে টাকা, মালামাল নিয়ে সিএনজি নিয়ে পালিয়ে যায়। এভাবে সূর্যোদয় পর্যন্ত চলে তাদের এ কার্যক্রম।

ছয় মাসে ছয়শত ছিনতাই : পুলিশ জানায়, ওই চক্রের সদস্যরা প্রায় ৪ বছর থেকে ছিনতাই কাজ করছে। তাদের মধ্যে অনেকেই ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার ছিনতাই করছে। গত ছয় মাসে ওই চক্রের অন্যতম সদস্য নূরুল ইসলাম রাজধানীতে মোট ৬০০ ছিনতাই করেছে। রাত আটটায় বের হয়ে তাদের মধ্যে অনেকেই সূর্যোদায় পর্যন্ত সর্বোচ্চ ছয়টি ছিনতাই করার রেকর্ডও রয়েছে।

ছিনতাইয়ে বাধা দিলেই হত্যা : ছিনতাইকারী ওই চক্রের সদস্যরা অভিনব কৌশলে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। যাত্রীর জন্য তারা রাজধানীর বিভিন্ন বাস স্ট্যান্ড, জনবহুল এলাকায় ওঁৎ পেতে থাকে। এক পর্যায়ে যাত্রীদের ফ্লাইওভারে নিয়ে ছিনতাই করে। আর যারা বাধা দেয়; তাদের মেরে ফেলা হয়। এভাবে মিজান, আক্তার, মনিরকে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়াও ছিনতাইয়ের পর অজ্ঞান বা অর্ধমৃত অবস্থায় ৩০ থেকে ৪০ জন যাত্রীকে ওই চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন ফ্লাইওভার বা নির্জন অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানে নিয়ে গিয়ে সিএনজি থেকে ফেলে দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে ৮ থেকে ১০ জনের মত বাস বা ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যান। তবে ওই চক্রের বাকি সদস্যদের গ্রেফতার করতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ছিনতাই চক্রের সদস্যদের বেশ কয়েকটি হত্যার সাথে সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে ওই চক্রের কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা কাকে কিভাবে হত্যা করেছে সেই বর্ণনাও দিয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার সহকারী পরিচালক সুজয় সরকার ইনকিলাবকে জানান, ওই চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করতে পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব সদস্যরা অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ফ্লাইওভার


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ