পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
চুক্তি হয়েছিলো জার্মানি পৌঁছে দেয়ার। দালালচক্র লিবিয়া পৌঁছে দেয় সজীবকে। সেখান থেকে স্পিডবোটে ভূমধ্যসাগরে ভেসে গ্রিস। একই বাহনে গ্রিস থেকে পাড়ি জমায় জার্মানি। কিন্তু ইটালি পৌঁছে আর যাওয়া সম্ভব হয়নি জার্মানি। ফেরত আসতে হয় গ্রিসে। সেখাইনে এক শরণার্থী শিবিরে ঠাঁই হয় বাংলাদেশি অভিবাসী সজীবের। এ পর্যন্ত যেতে দালালচক্রকে দিতে হিয়েছে ১০ হাজার ৭শ’ ডলার। এখানে দুঃসহ জীবন কাটছে তার।
দালালচক্র তাকে গ্রিস পৌঁছ দিলেও দেয়নি কোনো কাজ। অনাহারে-অর্ধহারে কাটছে তার দিন। বাংলাদেশে বেসরকারি চাকরি ছেড়ে রঙিন স্বপ্নে বিভোর সজীব ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে পাড়ি দিয়েছিলেন ইউরোপ। ভাগ্য বিড়ম্বিত এই সজীবের মতোই হাজারো বাংলাদেশি সজীব আটকে আছেন ইউরোপের শরণার্থী শিবিরগুলোতে। দেশ থেকে টাকা পাঠালে তারা খেতে পান। নয়তো থাকতে হয় উপোস। আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তারা দেশেও ফিরত পারছেন না।
ভাগ্য বদলের রঙিন স্বপ্নে বিভোর হাজার হাজার এক তরুণ পাড়ি জমান ইউরোপ-আমেরিকায়। সাগর-মরু পাড়ি দিয়ে তাদের কেউ পৌঁছেছিলেন গন্তব্যে। কেউবা চলে গেছেন ভিন্ন গন্তব্যে। সলিল সমাধি হয়েছে কারোর। কেউবা ধুঁকে ধুঁকে মরেছেন আফ্রিকার তপ্ত মরুতে। বিপদসংকূল শত সহস্র কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়ার পর তাদের এই ভেবে অনুধাবন হয়- হায় আমরা কি ভুল করেছি! এ কোন অনিশ্চয়তায় এসে পড়লাম। দেশে স্বল্প আয়ের চাকরি- ব্যবসা-বাণিজ্য আর পরিবার-পরিজন ছেড়ে এ কোন্ নরক যন্ত্রণার মধ্যে পড়লাম। কিন্তু অনুধাবনের এ পর্যায়ে এসে তাদের কিছুই করার থাকছে না। তাদের কেবলই দেশে ফেরার আকুতি। অনেকে সুযোগ পেয়ে নিজ দেশে ফিরছেন দলে দলে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ২ হাজার ৮০০ জন বাংলাদেশি ইতালিতে প্রবেশ করেন। পরের বছর বাংলাদেশি ইউরোপ প্রবেশকালে আটক হয়ে লিবিয়া কারাগারে রয়েছেন। কোন একক দেশ থেকে ইউরোপে প্রবেশের ক্ষেত্রে সংখ্যার হিসেবে এটাই সর্বোচ্চ।
আফ্রিকা ও আরবের বিভিন্ন দেশ থেকে তুরস্ক কিংবা গ্রিসে নৌপথে লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর কিংবা আটলান্টিক মহাসাগর স্পিডবোট কিংবা ট্রলার দিয়ে পাড়ি জমানোর সময় সলিল সমাধি হয়েছে অনেকের। সাহারা মরুভূমি হয়ে পর্তুগাল ঢোকার চেষ্টাকালে সাহারা মরু ভূমির দুর্গম পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অনাহারে অনেকে মৃত্যুও কোলে ঢলে পড়েছেন। এমন মৃত্যু উপত্যকা পাড়ি দিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর তীরে ডিঙি ভিড়াচ্ছেন হাজার হাজার বাংলাদেশি।
ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সে তারা থিতু হলেও দেশে ফিরে আসা ঝুঁকি তাদের সব সময়ই তাড়া করে। অর্থনীতির বৈশ্বয়িক মন্দা, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অভিবাসী সংক্রান্ত আইন সংশোধনসহ নানা কারণে বাংলাদেশি অভিবাসীদের ফের আসতে হচ্ছে। পৃথিবীর সর্বত্র এখন অভিবাসীদের ভয়াবহ দুর্দিন। বিশ্বের ২৫০ মিলিয়ন অভিবাসীর মধ্যে বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ। এর মধ্যে ২৫ লাখ অভিবাসী রয়েছেন- ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপানে। তারা দেশে ও বিদেশে নানা রকম হয়রানি ও হুমকির মধ্যে জীবন যাপন করছেন।
স্পেনের মাদ্রিদে দীর্ঘদিন ধরে বসবাসরত বাংলাদেশি অভিবাসী মুজিবুর রহমান জানান, ২০১৮ সাল থেকে ইরোপের দেশগুলো অবৈধ অভিবাসী সম্পর্কে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। আজকাল ইউরোপের অবস্থান আর আগের মতো নেই। দিন দিন সবকিছু কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। ৫-১০ বছর, এমনকি যারা এক যুগ ধরে ইউরোপে পড়ে আছেন তাদেরও কোনো কাগজপত্র হচ্ছে না। বৈধ হতে পারছে না। দেশেও ফিরতে পারছেন না। ভালো কাজ মিলছে না। মিললেও ভাষাগত অজ্ঞতার কারণে কাজ টিকছে না। বিভিন্ন সরকার পরিবর্তন হচ্ছে। সেই সঙ্গে বদলে যাচ্ছে সেসব দেশের অভিবাসন নীতি। এর শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশি অভিবাসীরা। মুজিবুর রহমান বলেন, স্টুডেন্ট ভিসা, বৃত্তি, উচ্চতর প্রশিক্ষণের নামে ইউরোপ এসে যারা থেকে যান, তারাও একসময় অবৈধ হয়ে পড়েন। এমন সংখ্যাই ইউরোপীয় দেশগুলোতে বেশি। তবে বছর দুই ধরে ‘অবৈধ অভিবাসী’রাই ইউরোপীয় শাসকদের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যান দপ্তর ‘ইউরোস্ট্যাট’ বলছে, গত ৮ বছরে ৯৩ হাজার ৪৩৫ জন বাংলাদেশি ইউরোপের দেশগুলোতে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে। তবে সেখানকার বিদ্যমান ইমিগ্রেশন আইনের কারণে তাদের নিজ দেশে ফেরতও পাঠানো যাচ্ছে না।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র তথ্য অনুযায়ী ২০১৪ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ১৭ লাখ ৬৬ হাজার ১৮৬ জন ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ অভিমুখে যাত্রা করেন। এর মধ্যে অন্তত: ১৫ হাজারের মতো মৃত্যু হয়। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টাকারী দেশের তালিকায় শীর্ষ ১০ এর অষ্টমে রয়েছে বাংলাদেশের স্থান।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পশ্চিম ইউরোপ এবং ইউরোপ ইউনিয়ন অনুবিভাগের মহাপরিচালক আন্দালিভ ইলিয়াস জানান, ইউরোপে অবৈধ অভিবাসীদের প্রকৃত কোনো পরিসংখ্যান নেই। ইউরোপে কোনো সীমান্ত রেখা না থাকার কারণে ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো একেক সময় একেক তথ্য দেয়। তবে প্রায় ২ লাখ অবৈধ অভিবাসীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে চায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এ লক্ষ্যে ৩ বছর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৮টি দেশ এবং বাংলাদেশ মধ্যকার স্ট্যান্ডার্ড অপারেশন প্রসিডিউর (এসওপি) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। আইনগত প্রক্রিয়ার কারণে তাদের এখনো ফেরত পাঠাচ্ছে না ইইউ। তবে এ চুক্তির আওতায় ইতিমধ্যে ১৯০ জনকে ফেরত পাঠিয়েছে ইইউ। এদের মধ্যে ১৬০ জনকে ফেরত পাঠিয়েছে জার্মান।
পশ্চিমে বাংলাদেশি অভিবাসীদের দুরবস্থা নিয়ে উদ্বেগে আছেন জনশক্তি বিভাগ এবং অভিবাসন বিশেষজ্ঞরাও। তাদের মতে, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিশ্বের ১৬০টি দেশে জনশক্তি রফতানির কথা বলা হয়। অথচ ১৪৪টিতেই পরিস্থিতি চরম হতাশাজনক। নতুন যেসব শ্রমবাজার সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য সফলতা নেই। পুরনো বাজারও ধরে রাখতে পারছে না। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ, চেষ্টা, লবিং, কূটনৈতিক তৎপরতা ও আন্তরিকতার অভাবে বাংলাদেশের শ্রমবাজার একের পর এক হাতছাড়া হচ্ছে। বিকল্প শ্রমবাজার খোঁজা হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকারকে সতর্ক মনোযোগ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
অভিবাসন বিষয়ক আইনজীবী শেখ সালাহউদ্দিন আহমেদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো অভিবাসন নীতি হালনাগাদ করছে। এটি অভিবাসীদের জন্য উদ্বেগের বটে। আমাদের সরকারকে এ বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে। সতর্ক ভূমিকা পালন এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘ব্র্যাক’র অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরীফুল ইসলাম হাসান জানান, বাংলাদেশ থেকেই সবচেয়ে বেশি মানুষ বিদেশ যায় অথচ আয় করে সবচেয়ে কম। কারণ তাদের দক্ষতা নেই। যে দেশে যাচ্ছেন সে দেশ সম্পর্কে ধারণা নেই। অজ্ঞতার কারণে তারা বিপদে পড়েন। বিব্রত হয় ওই দেশটির প্রশাসনও। এতে বাংলাদেশি শ্রমিক সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া অবৈধ পথে যারা ইউরোপ-আমেরিকা যাচ্ছেন তাদের বিষয়ে দেশগুলোর সরকার আরো কঠোর হচ্ছে। তাদের গ্রেফতার করে প্রচলিত আইনে বিচারের মুখোমুখি করছে। দেশেও ফেরত পাঠাচ্ছে।
গত ১৪ জানুয়ারি মার্কিনযুক্ত রাষ্ট্র থেকে ৩১ বাংলাদেশির ফেরত আসার দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি বলেন, শুধু তারাই নন-বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক বাংলাদেশি ফেরত আসছেন। দালাল দ্বারা প্রতারিত হয়ে তারা ইচ্ছের বিরুদ্ধে সেদেশে প্রবেশ করেছিলেন। ৫ থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করে তারা এসব দেশে পাড়ি দেন। ফেরত আসা প্রবাসীদের খাবার-পানিসহ নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার কাজ করছে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম।
প্ররোচিত হয়ে বিদেশ না যাওয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়ে শরিফুল হাসান বলেন, বৈধ কাগজপত্র না থাকা বাংলাদেশিদের ইউরোপের দেশগুলোও ফেরত পাঠাচ্ছে। তবে এসব বাংলাদেশির দেশে পুনর্বাসনের জন্য আর্থিক সহায়তাও দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
যুক্তরাষ্ট্র- ফেরত ব্যক্তিরা জানান, ২৫ লাখ টাকার বিনিময়ে তারা ব্রাজিল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের চেষ্টা করেন। পরে সেখানকার পুলিশ তাদের আটক করে। কারাভোগের পর তাদের দেশে পাঠিয়ে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পুলিশ তাদের আটক করে দেশে ফেরত পাঠায়। এর আগে গত ২১ নভেম্বর একই কারণে ২৫ বাংলাদেশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত আসেন।
এদিকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিশ্বের ১৬০টি দেশে বাংলাদেশিরা শ্রমিক হিসেবে যাচ্ছেন। এর মধ্যে ১৪০টি দেশের পরিস্থিতি নাজুক। নতুন ৬০টি দেশে গত ৬ বছরে ৩০ হাজারের বেশি জনশক্তি রপ্তানি করতে পারেনি বাংলাদেশ। এমন অবস্থায় নতুন করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবৈধ লাখ লাখ শ্রমিক চরম বিপাকে পড়েছেন। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এসব শ্রমিককে হয় দেশে ফিরতে হবে, না হয় বন্দীশিবিরে কাটাতে হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে জনশক্তি রফতানির পথ সংকোচনের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্র আয়ের এই দ্বিতীয় প্রধান খাত চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে।
অভিবাসী সে দেশে থেকে যেতে পারলে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতেন। অথচ সর্বস্ব হারিয়ে দেশে ফেরার পর অভিবাসীদের পুনর্বাসনে নেই সরকারি কোনো উদ্যোগ। তবে কিছু বেসরকারি উদ্যোগটিও আশাব্যঞ্জক। ইউরোপ থেকে ফেরত আসা অভিবাসীদের পুনর্বাসনে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক এবং আইওএম যৌথভাবে ‘প্রত্যাশা’ নামে একটি প্রকল্প চালাচ্ছে।
প্রকল্পের আওতায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ৫ শতাধিক ইউরোপ ফেরত বাংলাদেশিকে জরুরি সহায়তা দিয়েছে। এর মধ্যে জার্মানি থেকে ১০৪, প্রিস থেকে ১৩১, ইতালি থেকে ৯২, যুক্তরাজ্য থেকে ১৬, ফ্রান্স থেকে ৯ জন, সাইপ্রাস থেকে ৯ জন, অস্ট্রিয়া থেকে ৪ জন এবং বেলজিয়াম থেকে ফেরত আসা ২ জনকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এর বাইরে পোল্যান্ড, রোমানিয়া, পর্তুগাল, পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, লাটভিয়া ও এন্তোনিয়া থেকে ফেরত আসা বাংলাদেশিও রয়েছেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।