হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মেহেদী হাসান পলাশ
বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতে ইদানীং মাঝেমধ্যেই শিরোনাম দেখা যায়, কোথাও নেই বিএনপি। সরকার, সংসদ, রাজপথ কোথাও নেই বিএনপি- জামায়াত ইত্যাদি। গত ২৬ জুন দৈনিক ইনকিলাবের একটি আলেখ্যর শিরোনাম ছিলো : ‘কোথাও নেই বিএনপি: আমরা সবাই আওয়ামী লীগ বাহে’। বর্ণিত শিরোনামগুলোতে বিএনপি-জামায়াত জোটের বর্তমান বাস্তবতার প্রতিফলন বিধৃত্ত, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বিএনপি বাংলাদেশের বৃহত্তম দুইটি রাজনৈতিক দলের অন্যতম। সারাদেশে তার কোটি কোটি সমর্থক রয়েছে। প্রতিষ্ঠার ৩৮ বছরে দলটি ৪ বার নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেছে, ১৩ বছর ক্ষমতায় থেকেছে। বর্তমান মেয়াদ বাদ দিলে বিএনপি বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল রাজনৈতিক দল। কিন্তু ২০০৬ সালে ১/১১ নামক টর্নেডোর পাকে পড়ে বিএনপি সেই যে খেই হারিয়ে ফেলেছে আর ঘুরে দাঁড়ানোর রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে না। বিএনপির এই ব্যর্থতার কারণে সারাদেশে বিএনপির লাখ লাখ কর্মী ও সমর্থকে গুম, খুন, নির্যাতন, হামলা, মামলার শিকার হয়ে সীমাহীন ক্ষতির শিকার হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া নিজেও। মা হারিয়ে, সন্তান হারিয়ে, স্বামীর স্মৃতিধন্য বসতভিটা হারিয়ে পুত্র, পুত্রবধূ, পৌত্রীবিহীন নিঃসঙ্গ জীবনের এক দশক কাটছে তার। এর মধ্যেই বিভিন্ন মামলায় অসুস্থ শরীর নিয়ে প্রায়ই আদালতে হাজিরা দিতে হয়। ব্যক্তিগতভাবে দল ও দেশের জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করা সম্ভব তার অনেকটাই করেছেন তিনি। তবু এর প্রভাব পড়ছে না দল পরিচালনা ও আন্দোলনে।
খবরে প্রকাশ, দলের কিছু সিনিয়র নেতা ও গুলশান অফিসের কিছু কর্মকর্তার বিশ্বাসঘাতকতার ফলে দল পরিচালনা ও আন্দোলন কোথাও সফলতা দেখাতে পারছে না তিনি। বিশ্বাসঘাতক নেতা ও কর্মকর্তারা মিলে সিন্ডিকেট তৈরি করে খালেদা জিয়াকে জিম্মি করে ফেলেছে এমন খবরও প্রকাশিত হয়েছে সংবাদপত্রে। এই সিন্ডিকেট ভেঙে দলের কমিটি গঠনও করতে পারছেন না তিনি। একদিকে দলকে শক্তিশালী করে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলা অন্যদিকে বিশ্বাসঘাতক, বিতর্কিত, নিষ্ক্রিয় নেতাদের সরিয়ে তরুণ, মেধাবী ও ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করে আগামী দিনের বিএনপি গঠন করতে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পরামর্শকে মূল্যায়ন করতেও পারছেন না তিনি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আন্দোলনে সাফল্য না আসায় বলা হয়েছিল দলগুছিয়ে পুনরায় রাজপথে ফিরবে বিএনপি। এর মধ্যে যাদের বিশ্বাসঘাতকতায় আন্দোলনে কাক্সিক্ষত সাফল্য লাভ হয়নি তাদের দল থেকে অথবা গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হবে। এ লক্ষ্যেই সামনে নিয়ে আসা হয় কাউন্সিলকে। কাউন্সিলকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে বিএনপি ইউপি নির্বাচনে যথেষ্ট মনোযোগী হতে পারেনি।
১৯ মার্চ বিএনপির ৬ষ্ঠ কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সম্পন্ন হয়েছে। নানা কারণে কাউন্সিলে বিএনপি কমিটি গঠন করতে পারেনি। দায়িত্ব দেয়া হয় দলীয় চেয়ারপার্সনকে। তিনি ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন ও একনেতা এক পদ ভিত্তিতে দলীয় নতুন কমিটি গঠনের দিকে অগ্রসর হন। এর মধ্যে তিন দফায় কিছু কিছু পদ পুনর্গঠন করেছেন- তাতে ত্যাগীদের মূল্যায়নের চেষ্টা চোখে পড়েছিল। কিন্তু ওখানেই থমকে আছে। এর মধ্যেই সাড়ে তিন মাস পার হয়ে গেছে, বিএনপি এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে পারেনি। কবে নাগাদ পারবে তারও কোনো সীমারেখা দেখা যাচ্ছে না। শোনা যাচ্ছে, নতুন কমিটিতে যাদের বাদ পড়ার সম্ভাবনা আছে বা গুরুত্বপূর্ণ পদ হারানোর সম্ভাবনা আছে তারা একজোট হয়ে সিন্ডিকেট গঠন করেছে। এর সাথে এক নেতা এক পদ নীতির কারণে যাদের গুরুত্বপূর্ণ পদ হারানোর ঝুঁকি রয়েছে তাদেরও ইন্ধন রয়েছে। এই দুই গ্রুপের মিলিত সিন্ডিকেট নতুন কমিটি গঠনের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। এই সিন্ডিকেটের কারণে তারেক রহমানের অনেক জোরালো পরামর্শও কার্যকর করতে পারছেন না খালেদা জিয়া। অনেকেই আছেন, বিতর্কিত কর্মকা-ের কারণে আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন কিংবা দল ক্ষমতায় গেলে মন্ত্রিসভায় ডাক নাও পেতে পারেন বলে আশঙ্কা করেন তারাও চান না বিএনপি শক্তিশালী হোক। এর বাইরে আরো একটি গোষ্ঠী আছে যারা ক্ষমতায় থাকতে দুর্নীতির মাধ্যেমে অবৈধ টাকার পাহাড় জমিয়েছেন তারাও সম্পদ রক্ষায় সরকার বিরোধী শক্ত অবস্থান তো নিতে পারছেনই না বরং সরকারি ইশারায় পরিচালিত হচ্ছেন। বিএনপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সহকর্মী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা সম্প্রতি বিএনপি থেকে বেরিয়ে গিয়ে তৃণমূল বিএনপি নামে নতুন দল গঠন করে এমন ভাষায় বিএনপির সমালোচনা করছেন যাতে সরকার দল সমর্থকদেরও লজ্জা পাওয়ার কথা।
বিগত বছরগুলোতে খালেদা জিয়ার একের পর এক আন্দোলনের ডাক দিলেও বিএনপির এই দুর্নীতিবাজ সাবেক মন্ত্রী-এমপিরা রাস্তায় নামেননি। অথচ গুলশান অফিসসহ দলীয় প্রেস ব্রিফিং, ইনডোর আলোচনা সভায় তাদের দাপটে ত্যাগী নেতারা অসহায় থাকেন। রাজনৈতিক কোনো চ্যালেঞ্জ না থাকায় তাদের প্রায়শ দেখা যায়, দুর্নীতির টাকায় পরিবার-পরিজনসহ উন্নত দেশগুলো ঘুরে বেড়াতে আর সেসবের ছবি ফেসবুকে আপলোড করতে। দেশ, জনগণ, দল বা দলীয় নেতাকর্মীদের কষ্ট, দুর্ভোগ তাদের স্পর্শ করে না। এদিকে টানা ১০ বছর ক্ষমতার বাইরে শুধু নয়, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে বিএনপির নেতাকর্মীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তার উপর আন্দোলন, দলীয় কর্মসূচির অনুপস্থিতি, দল ও সিনিয়র নেতাদের দিকনির্দেশনাহীন অবস্থায় তাদের মধ্যে গভীর হতাশার সৃষ্টি করেছে। হামলা, মামলা, নির্যাতন মোকাবেলা করতে করতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া এবং সহসা কোনো আলোর দিশা দৃষ্টিগোচর না হওয়ায় নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিএনপি স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতা করে চলতে শুরু করেছে। সংসার, সন্তান ও সম্পদের নিরাপত্তায় এদের অনেকেই বাধ্য হয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টা করছে। অনেকে আবার অর্থনৈতিকসহ অন্যবিধ সুবিধার বিনিময়ে আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতা করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত ইউপি নির্বাচনে এর প্রভাব প্রবলভাবে প্রকৃষ্ট হয়। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ইউপি নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বার প্রার্থীদের পক্ষে অনেক স্থানেই তৃণমূল বিএনপি নেতাকর্মীরা কাজ করেনি। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বিভিন্নস্থানে তারা আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে। এই প্রক্রিয়ার সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিএনপির জন্য ভয়াবহ হতে পারে। কিন্তু সে সবে কারো কোনো খেয়াল নেই।
সরকার একের পর এক ইস্যু সৃষ্টি করছে, একের পর এক সঙ্কট তৈরি করছে। কিন্তু তা থেকে বিএনপি কোনো রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে সক্ষম হচ্ছে না। ১/১১-এর পর ফখরুদ্দীন- মইনুদ্দীন সরকার দাবি করেছিল জাতীয় উন্নয়নের ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে। তাকে লাইনে তোলাই তাদের প্রধান কাজ। কিন্তু ঐ সরকারের লাইনে তোলা ট্রেনে এখন দেশবাসী হিন্দিতে ইন্ডিয়ান রেলওয়ে লেখা দেখতে পাচ্ছে। ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দীন সরকার দাবি করেছিল হাওয়া ভবনে ৫ বছরে ১৩ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে। কিন্তু খবরে প্রকাশ ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই সরকারের আমলে সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। কিন্তু বিএনপি এই ইস্যুকে জাতির সামনে তুলে ধরতে পারেনি। শুধু এই একটি নয়, সোনালী ব্যাংক, হলমার্ক, ডেসটিনি, বেসিক ব্যাংক ইত্যাদির অর্থলোপাটের মতো বহু চাঞ্চল্যকর ইস্যু তুলে দিলেও বিএনপি তা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকা হ্যাকিংয়ের বিষয়টিও কাজে লাগাতে পারেনি। তবে এই ইস্যুটি তারা কাজে লাগাতে পারেনি না লাগাতে চায়নি তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কেননা, বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক চুরির ঘটনায় বিএনপি একটি তদন্ত কমিটি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সাথে দেখা করে তাদের দিক থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলো জানানো হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি কি তথ্য পেয়েছে বা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নিকট বিএনপি কি তথ্য দিল তা দেশবাসীকে জানানো হলো না। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতেও বিএনপির নীরবতা দৃষ্টিকটু। সামাজিক গণমাধ্যমগুলোতে বলা হলো: বিএনপি নিজেই চায় না সরকার বিব্রত হোক, সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষায় দায় বিএনপি নিয়েছে যেন। বলা হয়েছে, এমন অনুগত বিরোধী দলই আওয়ামী লীগ সরকারের টানা দুই মেয়াদে নিরুপ্রদব শাসনের সহায়ক শক্তি। বিএনপি এখন এতটাই অনুগত যে, সরকার অনুমতি নিয়ে তারা রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিচালনা করে, সমাবেশ করে। সরকার অনুমতি না দিলে করে না। প্রকৃতপক্ষে দেশে এখন সরকারি দলের নামও আওয়ামী লীগ, বিরোধী দলের নামও আওয়ামী লীগ। বিএনপি-জামায়াতের ব্যর্থতায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হতে পেরেছে।
বিগত দশম জাতীয় নির্বাচন ঠেকাও আন্দোলনে ব্যর্থতার দায়ে ঢাকা মহানগর বিএনপিকে ঢেলে সাজানোর অংশ হিসেবে খোকা-সালাম কমিটিকে বাদ দিয়ে গত বছরের জুলাই মাসে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে আহ্বায়ক এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেলকে সদস্য সচিব করে ৫২ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এক মাসের সময়সীমা বেঁধে দেয়া রাজধানীর সব থানা ও ওয়ার্ড কমিটি গঠনের লক্ষ্যমাত্রা বিগত এক বছরেও সম্পন্ন করতে পারেনি ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি। ৫ জানুয়ারির পর থেকে শুরু হওয়া সরকারবিরোধী আন্দোলনের মাঠেও নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে এ কমিটি। পাশাপাশি মহানগর বিএনপিকে ঢেলে না সাজানোর খেসারত দিতে হয়েছে বিগত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে। প্রতিপক্ষের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি এ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। বর্তমান কমিটি গঠনের পর দায়িত্বশীল নেতারা রাজধানীর ৪৯টি থানা ও প্রায় ১০০টি ওয়ার্ড কমিটির একটিও সম্পন্ন করতে পারেননি। শুরুর দিকে এসব থানা ও ওয়ার্ডে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ১৫টি সাব-কমিটি গঠন করেন সংগঠনটির নেতারা। কিন্তু এসব কমিটির কোনো কার্যক্রম তখন থেকেই দৃশ্যমান ছিল না। এরপর আন্দোলনের অজুহাত দিয়ে পুরো সময় পার করেছেন তারা। এখন তারা মামলা আর গ্রেফতার আতঙ্ককে সামনে টেনে আনছেন। ঢাকা মহানগর বিএনপির সঙ্গে দলের অঙ্গসংগঠনের কোনো সমন্বয় ছিল না শুরু থেকেই। এ জন্য দায়িত্বশীল নেতারা কোনো পূর্ব প্রস্তুতিও গ্রহণ করেননি। এছাড়া জোটের শরিক দলগুলোর সঙ্গেও কোনো প্রকার যোগাযোগ কিংবা পরামর্শ পর্যন্ত করেননি তারা। আন্দোলনের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে সংগঠনের চেইন অব কমান্ডও নির্ধারণ ছিল না। এ কারণে সংগঠনের শীর্ষ নেতারা মামলা ও গ্রেফতার আতঙ্কে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেলে নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে তৃণমূল নেতাকর্মীরা। এমনকি আত্মগোপনে থাকাবস্থায়ও কোনো নির্দেশনা পর্যন্ত দেননি তারা। অনেক ক্ষেত্রে কর্মীদের বিপদের সময়েও পাশে দাঁড়ানোর মতো মনোভাব বা ইচ্ছার প্রতিফলন দেখা যায়নি তাদের মধ্যে।
এর আগের কমিটির দায়িত্বশীল খোকা-সালাম অন্তত রাজধানীর তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। তাদের চিনতেন। বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তাদের কাছে যেতে পারতেন। অর্থনৈতিক কিংবা মামলাজনিত সমস্যার জন্য সহযোগিতা পেতেন। কিন্তু বর্তমান কমিটির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসের সঙ্গে তৃণমূল নেতাকর্মীদের দূরত্ব দীর্ঘদিনের। তার চারপাশে নিরাপত্তার নামে যে বলয় রয়েছে তার কারণেও অনেক নেতাকর্মী মির্জা আব্বাসের কাছে যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। তিনি নিজের প্রভাব ধরে রাখার জন্য কমিটির অন্য সদস্যদের কাজ করতে বাধা দিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে সদস্য সচিব হাবিব উন নবী খান সোহেলকে শুরু থেকেই কোণঠাসা করে রাখেন বলে কয়েকবার মহানগর কার্যালয়ে তালা মেরে রাখা হয়। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে বিগত দিনে। এদিকে বর্তমান কমিটির অনেক সদস্যের নামে রয়েছে কমিটি বাণিজ্যের অভিযোগ। থানা কমিটি ও ওয়ার্ড কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে অনেক নেতা আর্থিক লেনদেন করেছেন বলেও বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ ওঠে। এমনকি তল্পিবাহক কমিটি গঠনের চেষ্টাকালে হামলা-ভাঙচুরের মতো ঘটনাও ঘটে গত বছর। কিন্তু এতকিছুর পরও তারা একটি থানা ও ওয়ার্ড কমিটি গঠনের ঘোষণা দিতে পারেনি। আবার মহানগরের সব নেতাকর্মীকে ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলন কিংবা রাজনীতিও উপহার দিতে পারেনি। ৫ মে, ২৯ ডিসেম্বর ও ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর প্রবল আন্দোলনের সময় বিএনপির মহানগর কমিটির ভূমিকা ছিল বিশ্বাসঘাতকের।
শক্তিশালী ও নিজস্ব মিডিয়ার সমর্থনের অভাব বিএনপি সবচেয়ে বড় দুর্বলতাগুলোর একটি। সরকার বিএনপির আন্দোলন, কর্মসূচি ও বক্তব্য নিজস্ব মিডিয়ার সাহায্যে এমন বিতর্কিত করে তোলে যে, দলটি যাইই করুক ভালোর চেয়ে তার মন্দ সমালোচনায় বেশি শুনতে হয়। ফলে আন্দোলনের পক্ষে জনমত গড়ে ওঠে না। ক্ষমতায় থাকতে বেশ কিছু শক্তিশালী গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা করলেও দলীয় মালিকরা রাজনীতি ও আদর্শের চেয়ে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দেয়ায় সেসকল মিডিয়া উল্টো বিএনপির জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলের মধ্যে রাজনৈতিক আদর্শের চর্চা না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আদর্শিক এই শূন্যতায় ত্যাগী নেতৃত্বের বদলে ভোগী নেতৃত্বের জন্ম হয়েছে যারা আন্দোলন করতে ভয় পায়, জেলে যেতে ভয় পায়, পুলিশ দেখলে ভয় পায়। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো গাইতে শেখেনি:
‘এই শিকল পরা ছল
মোদের এই শিকল পরা ছল
এই শিকল পরেই
শিকল তোদের করবো রে বিকল’।
জেলখানাকে রাজনীতিবিদদের সেকেন্ড হোম বলা হয়। কিন্তু বিএনপির দুর্নীতিবাজ নেতারা জেলখানাকে কবরের মতো ভয় পায়। অথচ আমাদের জাতীয় কবি শিখিয়েছেন জেলখানাকে কিভাবে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে হয়:
‘তোদের বন্ধ কারায় আসা
মোদের বন্দী হতে নয়
ওরে ক্ষয় করতে আসা
মোদের সবার বাঁধন ভয়
এই বাঁধন পরেই বাঁধন ভয়কে
করব মোরা জয়’।
প্রশ্ন হচ্ছে, এমন পরিস্থিতিতে কি করবে বিএনপি? নেতারা কতদিনে দল গোছাতে সক্ষম হবেন? দলটি কি সরকারি বিরোধী কোনো জোরালো আন্দোলন করবে? সরকার পতন আন্দোলন করবে? নাকি সরকারের স্বাভাবিক মেয়াদান্তে নির্বাচন করবে? বিএনপিকে তার বক্তব্য ও অবস্থান জনগণের কাছে পরিষ্কার করতে হবে। তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য জনগণের সামনে থাকতে হবে। বর্তমান যে অগণতান্ত্রিক শাসন জাতির উপর প্রলম্বিত হচ্ছে এর দায় বিএনপিরও কম নয়। বিএনপির দুর্নীতিবাজ নেতারা এর জন্য দায়ী। এই দুর্নীতিবাজ নেতারাই এক সময় বিএনপিকে রাজনৈতিক ইস্যুতে রাস্তায় নামার পরিবর্তে আদালতে নিয়ে গিয়ে চরমভাবে ডুবিয়েছে। আদালতে ডোবার পর রাজপথে না ফিরে দলকে নিয়ে গেছে আন্তর্জাতিক সাহায্যের দ্বারে। ভাবখানা এমন, আন্তর্জাতিক শক্তি বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। কিন্তু জাতীয়বাবাদী শক্তির যে কোনো বিদেশী বন্ধু হয় না রাজনীতির এই সাধারণ ধারাপাত তারা ভুলে গেছে। ফলে মোদী ভরসা কুহকিনী হয়েছে, হিলারিও তাই হতে বাধ্য। সে কারণে বিএনপিকে বিদেশীমুখিতা, বিদেশ নির্ভরতা ভুলে দেশের অভ্যন্তরীণ শক্তিগুলোর দিকে মনোযোগী হতে হবে। দেশের জনগণের উপর, নিজ দলীয় শক্তির উপর ভরসা করতে হবে। সে লক্ষ্যে দক্ষ, যোগ্য ও ত্যাগী নেতৃত্ব সৃষ্টিতে দলের মধ্যে আদর্শিক চর্চা বাড়াতে হবে। জনগণের ইস্যু নিয়ে, জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলতে হবে, আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। দেশের মধ্যে, জনগণের মধ্যে বিএনপি চাহিদা ও অপরিহার্যতা গড়ে তুলতে হবে। জনগণ বিএনপির পাশে এসে দাঁড়ালে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিদেশী শক্তির উপর আর নির্ভরতা থাকবে না। বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও অগ্রগতির জন্য একটি শক্তিশালী বিএনপি অপরিহার্য।
email:[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।