বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
বিচারে বিলম্ব বিচার অস্বীকারের শামিল, এ রকম একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে। বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে, এটিও মশহুর একটি প্রবাদ। বিচার যথাসময় না হওয়ার পরিণাম কী হয়, এসব প্রবাদে সেটাই তুলে ধরা হয়েছে।
একটি সমাজ ও রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ রাখে না। সুশাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্তই হলো ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। আমরা সুশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলি, ন্যায়বিচার কায়েমের কথা বলি, অথচ বাস্তবে এ দু’টির অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। এখন সুশাসনের স্থলে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর শাসন চলছে, যা নিয়ে সমালোচনার অবধি নেই। একটা বিচারহীনতার সংস্কৃতিও ধীরে ধীরে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে।
বিচারব্যবস্থা ও বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে নানামুখী প্রশ্ন রয়েছে। প্রথমত, লাখ লাখ মামলা বিচারের অপেক্ষায় পড়ে আছে বছরের পর বছর, এমন কি যুগের পর যুগ। এসব পড়ে থাকা মামলার বিচার সম্পন্ন হতে কত বছর লাগবে, কেউ বলতে পারে না। দ্বিতীয়ত, সুবিচারপ্রাপ্তি নিয়ে বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে সংশয় দিন কে দিন বাড়ছে। এর কারণ, বিচারকদের একাংশের মধ্যে নৈতিক স্খলন লক্ষ্য যায়। অর্থ ও অন্যবিধ লোভের বশবর্তী হয়ে তারা অন্যায় রায় প্রদান করেন।
তৃতীয়ত, বিচারকাজে দলবাজির প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। মুখ চিনে রায় দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। চতুর্থত, ক্ষমতাশীনদের বিচারপ্রতিক্রিয়া বা বিচারিক কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করার প্রবণতা বেড়েছে। পঞ্চমত, বিচারব্যবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে অন্যায়, ঘুষ ও দুর্নীতি বেড়েছে। ষষ্টত, উদ্দেশ্যমূলক বা হয়রানিমূলক মামলা এবং মিথ্যা মামলা দায়েরের প্রবণতা ও সংখ্যা বেড়েছে। সপ্তমত, বিচারক নিয়োগসহ অন্যান্য নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, অযোগ্যরাও অনেকে বিচারকাজে বিভিন্ন পদধিকার লাভ করেছেন। ফলে ক্ষেত্র বিশেষে বিচারের পরিবেশ ও মানে ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
বর্ণিত পরিবেশ-পরিস্থিতিতে যথাসময়ে ন্যায়বিচার পাওয়া আসলেই অত্যন্ত কঠিন। একটা সমাজ ও দেশে ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে এত সমস্যা, সংশয় ও অনিশ্চয়তা যদি থাকে, তবে সেই সমাজ ও দেশ ঠিকমত বিকশিত হতে পারে না। নিঃসন্দেহে এ অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
আমাদের মনে রাখা দরকার, বিচারের মালিক আল্লাহ। চূড়ান্ত বিচার তিনিই করবেন। দুনিয়ায় যারা বিচারক, আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবেই তারা বিচারকার্য পরিচালনা করেন। তারা কিভাবে বিচার করবেন, কিভাবে বিচারপ্রার্থীরা বিচার প্রার্থনা করবেন, সাক্ষীরা কিভাবে সাক্ষ্য প্রদান করবেন ইত্যাদি সম্পর্কে আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে নির্দেশনা দিয়েছেন।
বিচারক, বিচারপ্রার্থী ও সাক্ষীর পক্ষে অন্যায়, মিথ্যা বা অসত্যের আশ্রয় নেয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ প্রসঙ্গে শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের একটি উক্তিও স্মরণীয়। তিনি বলেছেন: ‘বিচারালয় খোদার দরবার, বিচারের মালিক খোদা, মানুষ তাহার প্রতিনিধি হিসেবে বিচারাসনে বসে। সেখানে মিথ্যার স্থান নেই।’
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূণ লক্ষ্য। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা মানব কল্যানে অপরিহার্য। আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে রাসূলকে প্রমাণ, কিতাব ও ন্যায়নীতি প্রেরণের উদ্দেশ্য যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাতা জানিয়ে বলছেন: নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলগণকে প্রেরণ করেছি স্পষ্ট প্রমাণসহ এবং তাদের সঙ্গে দিয়েছি কিতাব ও ন্যায়নীতি, যাতে মানুষ সুবিচার করতে পারে। (সূরা হাদিদ : ২৫)।
ন্যায়বিচার সম্পর্কে আল্লাহর নির্দেশ হলো: নিশ্চয়ই আল্লাহ নির্দেশ দিচ্ছেন, তোমরা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং সদাচারণ করো। (সূরা নাহল : ৯০)। আল্লাহপাক আরো বলেছেন: তোমরা সুবিচার কারবে, তা তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় করো। তোমরা যা করো আল্লাহ তার সম্পর্কে খবর রাখেন। (সূরা মায়িদা : ৮)। এই আয়াতেই শুরুতে আল্লাহ সাক্ষ্য দান সম্পর্কে বলেছেন: ন্যায় সাক্ষ্যদানে তোমরা অবিচল থাকবে। এ বিষয়ে তিনি আরো বলেছেন: তোমরা সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশ্রিত করো না এবং জেনে শুনে সত্য গোপন করো না। (সূরা আল বাকারাহ : ৪২)।
আল্লাহতায়ালা ন্যায়বিচার ও সত্য সাক্ষ্য প্রদানের বিষয়ে আরো বিস্তৃত করে বর্ণনা করেছেন পবিত্র কোরআনের অন্য একটি আয়াতে। যেখানে তিনি বলেছেন: হে ইমানদারগণ তোমরা ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাক, আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষদান করো, তাতে তোমাদের নিজের বা পিতামাতার অথবা নিকটবর্তী স্বজনের ক্ষতি হয় তবু। কেউ যদি ধনী কিংবা দরিদ্র হয় তবে আল্লাহ তাদের শুভাকাক্সক্ষী তোমাদের চাইতে বেশি।
অতএব, তোমরা বিচার করতে গিয়ে রিপুল কামনা-বাসনার অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বলো কিংবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজকর্ম সম্পর্কেই অবহিত। (সূরা নিসা : ১৩৫)।
বিশ্বের ইতিহাসে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে এমন স্পষ্ট, স্বার্থহীন দিকনির্দেশনা আর কোথাও নেই। আল্লাহপাকের এ কালামের কোনো তুলনাই হয় না। সম্ভবত এ কারণেই এই শাশ্বত বানীটি, যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্র হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ মুখে ইস্পাতের সাইনবোর্ডে খোদাই করে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
বলা বাহুল্য, সর্বাবস্থায় ও সর্বক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হতে এখানে তাকিদ দেয়া হয়েছে। আমাদের দেশসহ গোটা বিশ্বে আল্লাহনির্দেশিত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হোক, শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক, এই কামনাই করি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।