যেভাবে ৫০০
ক্লাব ফুটবলে গোলের প্রায় সব রেকর্ডই তার দখলে। এবার সেই লিওনেল মেসি উঠে গেলেন আরেক উচ্চতায়। বার্সেলোনার জার্সি গায়ে ৫০০ গোলের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন মেসি।
হাবীব বাপ্পি
চুরানব্বই বিশ্বকাপে আব্বার কাঁধে চড়ে গিয়েছিলাম আরেক পাড়ায় সাদা কালো টেলিভিশনে খেলা দেখতে। চারিদিকে তখন ম্যারাডোনার জয়জয়কার। ভাবতাম, ফুটবল খেলোয়াড়দের ‘ম্যারাডোনা’ নামেই ডাকা হয়। আর ক্রিকেটের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে কেনিয়ার বিপক্ষে সেই ঐতিহাসিক জয়ের স্মৃতি। রেডিওর মাধ্যমে সেদিন আকরাম-আতাহার-বুলবুল-শান্ত-রফিকদের জয়ের সাক্ষি হয়েছিলাম। এরপর বাংলার সেই নায়কদের ছবি সেটে রেখেছিলাম ঘরের দেওয়ালে।
অধিকাংশের মতো আমারও খেলাধুলার প্রতি দুর্বলতা সেই ছোটোবেলা থেকেই। তবে টেলিভিশনের মাধ্যমে বৈশ্বিক বড় আসরের সাথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ ছিল কম। এমনিতেই অজপাড়া গাঁ, তার উপর বাড়িতে ছিল না টেলিভিশন। মাঝে মাঝে আত্মীয়ের বাড়িতে টেলিভিশনের সামনে বসার সুযোগ হতো। রিমোট গুতিয়ে তখন স্পোর্টস চ্যানেল অন্বেষণে নামতাম। অধিকাংশ সময়ই ভাগ্যে জুটত ধারণকৃত খেলা। তবুও দেখতাম। বেশি দেখতাম ইএসপিএন চ্যানেল। সুন্দর সব ধারণকৃত ফুটবল ম্যাচ দেখানো হতো তাতে। বিশেষ করে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ (পরে জেনেছি)। ভালো লাগত ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড নামের একটি ক্লাবের খেলা। কারণটাও স্পষ্ট-সেই দলে ছিল একজন তরুণ ক্ষিপ্রগতির খেলোয়াড়। বল পায়ে গেলেই তাকে দেখতাম প্রতিপক্ষের রক্ষণকে এলোমেলো করে দিতে। তখনই ভক্ত হয়ে গেলাম লাল দুর্গের সেই ৭ নম্বরধারীর। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো তার নাম। পরবর্তীতে বিশ্ব ফুটবলে যিনি হয়েছেন ৩ বার বর্ষ সেরা ফুটবলার।
এভাবেই এক সময় ভক্ত হয়ে গেলাম ইউরোপিয়ান ফুটবল আর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর। কিন্তু, যেদিন প্রথম দেখলাম লিওনেল মেসিকে (এর আগে তার নামই শুনেছি সেভাবে দেখা হয়নি), সেই প্রথম দেখাতেই সেদিনই ফুটবল জাদুকরের জাদুর বাক্সে বন্দি হয়ে গেলাম। দিন তারিখ, এমনকি মেসির সেদিনকার প্রতিপক্ষের নামও মনে নেই। শুধু মনে আছে লম্বা চুলওয়ালা ছোট্ট এক ক্ষিপ্র বালককে। দেখেছিলাম বল পায়ে প্রতিপক্ষের গোলমুখে ঢুকবার কি আদম্য স্পৃহা তার! দেখেই আমার মনে শান্ত পুলকিত এক ক্ষীণ অনন্দধারা বয়ে গেল। বুঝলাম এ আর সবার চেয়ে আলাদা! বল পায়ে নৃত্যের তালে ডি-বক্সে ঢুকতে চাওয়ার যে আদম্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সাহস তার মধ্যে সেদিন দেখেছিলাম এমনটা আমি বিশ্বের অন্য কেনো খেলোয়াড়ের মধ্যে দেখিনি। রোনালদোর জন্য দুঃখ হয়, সে মেসির সমসাময়িক বলে। সময়টা ভিন্ন হলে নিশ্চিতভাবে রোনালদোই হতো তার সময়ের সেরা খেলোয়াড়। আবার এটাও মাঝে মাঝে মনে হয়, রোনালদোর ভেতর থেকে সেরাটা বের করে আনার কৃতিত্বও অনেকটা মেসির। মেসিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আপ্রাণ একগুয়েমি প্রচেষ্টাই রোনালদোকে করেছে আরো শাণিত, আরো পরিণত, আরো ক্ষুরধার।
এখন প্রশ্œ একজন শুধু একজন ফুটবলারকে সার্থক হতে কী কী যোগ্যতা লাগে? শিরোপা? সে তো দলীয় প্রচেষ্টার ফসল। আমার মতে ব্যক্তি খেলোয়াড়কে বিচার করা উচিত তার নিজস্ব ফুটবল শৈলী দিয়ে। তার দক্ষতা, বলের দখল, দুর্বোধ্য সব পাস দেওয়ার ক্ষমতা, বলের নিয়ন্ত্রণ, ড্রিবলিং, ফ্রি-কিক ইত্যাদি দিয়ে। এছাড়া গোলের সুযোগ তৈরি, বলকে শেষ লক্ষ্যে পাঠিয়ে দেওয়া এগুলোর মিলিত ফলই হলো একজন সেরা খেলোয়াড়ের আসল পরিচয়। যিনি এই কাজগুলোতে যত বেশি দক্ষতার পরিচয় দেন তিনি ততো বেশি সার্থক। আর এই দিকগুলোই মেসিকে অন্যদের চেয়ে যোজন যোজন দূরত্বে এগিয়ে রেখেছে। মাত্র ২৯ বছর বয়সেই নিজেকে তিনি এমন উচ্চতায় নিয়েছেন এর আগে যা পারেনি বিশ্বের কোনো ফুটবলার।
হাঙ্গেরির বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ফুটবলে মেসির অভিষেক। দিনটা অবশ্য তিনি ভুলে যেতে চাইবেন। দ্বিতীয়ার্ধে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে নেমেই দেখেছিলেন লাল কার্ড! তবে তাতে তাঁর ক্যারিয়ারটা থমকে যায়নি, হয়েছে দীর্ঘ সময়ের। এ সময়ে একমাত্র আর্জেন্টাইন খেলোয়াড় হিসেবে হয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ (৫৫টি) গোলদাতা। কনমেবল অঞ্চলের বাকি ৯ দলের বিপক্ষেই গড়েছেন গোল করার রেকর্ড। আর্জেন্টিনার হয়ে গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার সাথে যৌথভাবে এক বছরে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ডও তাঁর (১২টি)। বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার সবচেয়ে কম বয়সী গোলদাতাও মেসি (২০০৬ বিশ্বকাপে সার্বিয়া ও মন্টেনেগ্রোর বিপক্ষে)। লাতিন অঞ্চলে সবচেয়ে কম বয়সে (২৭ বছর ৩৬১ দিন বয়সে) ১০০ ম্যাচ খেলার রেকর্ড গড়েছেন তিনি। জিতেছেন রেকর্ড পাঁচবার ব্যালন ডি’অর (২০০৯, ২০১০, ২০১১, ২০১২ ও ২০১৫)। ২০১৪ ফিফা বিশ্বকাপে হয়েছেন সেরা খেলোয়াড়। ক্লাবের হয়ে তাঁর অর্জনগুলো না হয় নাই বললাম।
এরপরও মেসি খেলোয়াড় হিসেবে ‘ব্যর্থ’! পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেলেও চিলির বিপক্ষে কোপা আমেরিকার শতবর্ষীর ফাইনালে হারের পর এই উচ্চারণটা বিশ্বময় উচ্চারণ হয়েছে লাখো-কোটিবার। এর আগেও তিনবার দলকে ফাইনালে নিয়েছেন মেসি। কিন্তু শিরোপা ছুঁয়ে দেখা হয়নি। এটাই তাঁর ব্যর্থতা। দেশের হয়ে শিরোপা জিততে না পারা। কিন্তু বার বার কেন এমন হচ্ছে? পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত, আদম্য, অপ্রতিরোধ্য খেলার পর ফাইনালে এসেই কেন এমন মুখ থুবড়ে পড়ছে আর্জেন্টিনা আর মেসি? কারণ যাই হোক, এর জন্যে শুধু মেসি কেন একা সমালোচিত হবেন? আসলে গনমাধ্যমের বিকৃতি উপস্থাপন আর কিছু আবেগী অন্ধ ফুটবল ভক্তদের কাছেই আজ ‘মেসি ব্যর্থ’। শুধু শিরোপা অর্জনই যদি একজন ফুটবলারের সফলতা মাপনের চাবিকাঠি হয়, তাহলে তো চ্যাম্পিয়ন দলের ১১ জন ফুটবলার বাদে বিশ্বের সব খেলোয়াড়ই ব্যর্থ!
উইরোপে এখন চলছে উয়েফা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন্সশিপের লড়াই। লক্ষ করলে দেখা যাবে, সেখানে কিন্তু মেসির মতো এমন ধারাবাহিক পারফর্ম করা তারকা খেলোয়াড় খুঁজে পাওয়া দুস্কর। গোল মেশিন খ্যাত রেবার্ট লেভান্দভস্কি? যে এখনো গোলমুখই খুঁজে পায়নি! রোনালদো? যারা এখনো আসরে টিকে আছে ভাগ্যগুণে! মুলার? পগবা? ভার্ডি? কই কাওকেই তো ক্লাবের সেই চেনা রুপে দেখা যাচ্ছে না (বৃহস্পতিবার পর্যন্ত)।
আসলে বারবার শেষ ধাপে এসে আর্জেন্টিনার ব্যর্থতার প্রধান কারণ হলো প্রত্যাশার মাত্রাতিরিক্ত চাপ। শিরোপা পেতেই হবে, শিরোপা তোমাদেরই পাওয়া উচিত, কারণ তোমাদের আছে একজন বিশ্বসেরা খেলোয়াড়, তোমরাই ফিফা র্যাংকিংয়ের এক নম্বর দল, ফুটবলে তোমাদের এত অতীত ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও ২৩ বছর ধরে কেন এই শিরোপাক্ষরা? সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় দলে থাকা সত্ত্বেও কেন তোমরা শিরোপা জিততে পারেবে না? আর মেসি? যদি একটি শিরোপা নাই জিততে পারল তাহলে তো কিসের সর্বকালের সেরা? সর্বকালের সেরা হতে হলে দেশের হয়ে এই জিততে হয় ঐ জিততে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি...। এই যে তাঁকে বা তাঁদেরকে নিয়ে গনমাধ্যমের যে বিকৃত প্রকাশ, এটাই তাদের কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে প্রত্যাশার পাহাড়সম চাপ। পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেলেও যে চাপে শেষ ধাপে এসে নুয়ে পড়তে হয় তাঁদের, আরো ছোট করে বললে তাঁকেÑলিওনেল মেসিকে।
অনেক গণমাধ্যমে দেখা যায়, নামী সব ফুটবল বোদ্ধাদের সমালোচনা। পান থেকে চুন খসতে দেন না তারা। শুরু হয় কতক বিকৃত কিন্তু যৌক্তিক উপস্থাপন। ঐ সব গণমাধ্যমের সাথে তাল মেলায় আমাদের উপমহাদেশের গণমাধ্যমও। বিশেষ করে মেসি আর রোনালদোকে নিয়ে। ব্যবসায়িক দিক বিবেচনায় ইংলিশ ঘরোয়া লিগ তো স্প্যানিশ লিগের কাছে মার খাচ্ছে শুধু ঐ দু’জন খেলোয়াড়ের কারণেই, আরো চোট করে বললে মেসির কারণে। যাকে অনেক চেষ্টা তদবির করেও ইংল্যান্ডে আনা সম্ভব হয়নি। সেই চাপা ক্ষোভ তো আছেই। এরপর তারা উদ্ভাবন করল সমালোচনার নামে আধুনিক অত্যাচার যন্ত্র, যা তৈরি করে ভয়ানক মানসিক ব্যাধি। শুধু ফুটবলার নয়, জয় পরাজয়ের যেকোনো প্রশ্নে যদি কেই এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়, তাহলে যুদ্ধে নামার আগেই সে হেরে বসে। এটাই স্বাভাবিক। বিশাল প্রত্যাশার পাহাড় তাকে ধরাশায়ী করে ফেলে। ঠিক এই বিশাল বোঝা বইতে বইতে ফুটবল জাদুকর আজ ক্লান্ত। যে কারণেই আজ তাঁর এতো অভিমান। চলে যাওয়া।
কিন্তু যেতে চাইলেই কী কাউকে যেতে দেওয়া যায়? গেল সোমবার মেসির সেই অবসর সিদ্ধান্তের ঘোষণা শুধু ক্রিড়াঙ্গনই নয় জাত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে গ্রহের অতি তুচ্ছ শ্রেণীর সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে দেশের রাজা পর্যন্ত সব শ্রেণীর মানুষের মনকেই বন্দী করেছে এক করুণ বিরহজালে। প্রিয় খেলোয়াড়কে যে আর দেখা যাবে না আকাশি-নীল-সাদার ডানায় প্রজাপতি নৃত্য করতে, ফুটবল মাঠের ঐ বিশাল ক্যানভাসে পাবলো পিকাসোর রং-তুলির সেই শেষ আচড়টাই এখন কে দেবে! ফুটবল বিধাতা কি তাঁকে কানে কানে বলে গিয়েছিল যে, ‘তোর ঐ শৈল্পিক ফুটবলে শিল্প রচনা সম্ভব, চ্যাম্পিয়ন শিরোপা নয়’?
কারণ যাই হোক, এই ঘোষণার মধ্যদিয়ে বিশ্বময় যে বিরহ-রাগ অভিমানী বাজিয়ে দিয়েছেন তাতে শুধু আর্জেন্টিনায় নয়, ভৌগোলিক সীমারেখার গোন্ডি পেরিয়ে সেই বিরহ রাগে এখন প্রশান্ত, স্থির, বিহ্বল পুরো বিশ্ব। আজ তাই অভিমানীকে ফেরাতে মানুষের বিহ্বল মনের এই গোপন আকুতি যদি শেয়ারবাজার ধসের মতো পরিমাপ করা যেত, তাহলে নিশ্চয় এর চূড়ান্ত হিসাবটাও পৌঁছে দেওয়া যেত অভিমানীর কাছে। আজকের প্রযুক্তির যুগে কিছুটা হিসাব তো করাই যায়। ভক্তরা তাই ফেসবুক, টুইটারসহ সব ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানাচ্ছেন তাদের প্রাণের আকুতি, গ্রহের সব মানুষের তৃষাতুর চাহনীর ভাষাও আজ একÑযেও না মেসি, ফিরে এসো।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।