বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
দিগ্বিজয়ী আমির তৈমুর লং ছিলেন এক বিচিত্র চরিত্রের অধিকারী, দুঃসাহসী শাসক, বিশ্ব বিখ্যাত চেঙ্গীজ খানের দৌহিত্র। তৈমুর সমরকন্দের নিকটবর্তী ‘কুশ’ নামক স্থানে ১৩৩৬ ঈসায়ি সালে জন্মগ্রহণ করেন।
তার পিতা তরগাই ছিলেন গোত্রের সর্দার, তিনি ইসলামের সূফিয়ানা মনস্কের লোক হওয়ায় গোত্রের নেতৃত্ব তৈমুরের পিতার কাছ থেকে তার চাচা হাজি বরলাসের নিকট চলে যায়। তৈমুরের জীবনের সূচনা হয় একজন সাধারণ বীর সৈনিক হিসেবে। তার মাতা শৈশবেই মারা যান। তৈমুরের গোত্রের নাম ছিল ‘বারলাস’। এটি তুর্ক তাতারিদের অংশ ছিল এবং এ বংশের নাম ছিল ‘গোর্গানি’ কিন্তু সংখ্যা ও কীর্তির দিক থেকে তাতারিদের মধ্যে তাদের অসাধারণ কোনো গুরুত্ব ছিল না। তৈমুরের উর্ধ্বতন পুরুষ আমির গোর্গান যৌবন কালে ‘খাতা’ নামক এলাকার ‘মোগল’ সৈন্য বাহিনীর নেতা ছিলেন, তিনি এ বাহিনী হতে আলাদা হয়ে এশিয়া মাইনর এলাকায় বসতি স্থাপন করেন। সমরকন্দ ও তার আশে পাশের এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করেন।
কিন্তু এ সাম্রাজ্য দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। তৈমুরের পিতা তরগাই পর্যন্ত যখন আসে, তখন কেবল ‘শহরে সবজ’ এ গোত্রের অধিকারে ছিল। চেঙ্গীজ খানের আইন ছিল ‘পরস্পরে মিলেমিশে নিজেদের মধ্য হতে একজনকে নেতা মনোনীত করা।’ তার পৌত্রগণ এ আইন অমান্য করলেই সাধারণ তাতারিরা বলত, ‘বাদশাহ কেবল চেঙ্গীজের বংশধরগণের মধ্যে হতে হবে।’
তৈমুর তার সময়ে এ রীতি বন্ধ করার চেষ্টা করেননি এবং নিজের প্রণীত আইনে একজন আনুষ্ঠানিক বাদশাহকে বার্ষিক সালামী পেশ করতে থাকেন। কিন্তু পরবর্তী ঘটনাবলি প্রমাণ করে যে, খাঁটি চেঙ্গীজী বংশের শাহজাদাগণের এ গর্বও তৈমুরের পরবর্তী বংশধারাগুলোতে স্থানান্তরিত হয়। তৈমুর নিজের এবং নিজের পুত্রদের শাদী মোগল শাহজাদীগণের সঙ্গে করেন এবং পরবর্তী কালেও এ ধারা অব্যাহত থাকে। রক্তের সাথে রক্ত মিলিত হতে থাকে এবং তারা মোগল নামে কথিত হতে থাকে।
সম্রাট বাবর, যিনি হিন্দুস্থানে মোগল বংশীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা নামে খ্যাত তৈমুরের পঞ্চম অধস্তন পুরুষ ছিলেন। বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে তাতার ও মোগল এক হয়ে যায় এবং আমির তৈমুর মোগলদের এ পর্যায়ের প্রথম পুরুষ।
তৈমুর ১৭ বছর বয়সে পিতার অনুমতিক্রমে এশিয়া মাইনরে গমন করেন। তার সঙ্গে ছিল একজন খাদেম ও কয়েকটি ঘোড়া। উদ্দেশ্য, তার ভাগ্য নির্ণয়ের উপায় খোঁজ করা। তিনি আমির কাজগানের খেদমতে উপস্থিত হন। তার সৈন্য বাহিনীর একটি সাধারণ পদে তৈমুরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তখন মধ্য এশিয়ার রাজনৈতিক অবস্থা ছিল অনিশ্চিত। উত্তর পর্বতমালার পেছনে অবস্থিত ‘হেসারুল মালিক’ নামক স্থানে চুগতাই বংশের মোগল খান উক্ত এলাকাকে নিজের রাজত্ব মনে করতেন। কিন্তু কিছু দিন থেকে তার আচরণ দস্যু-ডাকাতের রূপ ধারণ করেছিল।
তিনি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোর ব্যবস্থাপনা ও পরিণতির প্রতি দৃষ্টিপাত করার পরিবর্তে এবং অধিবাসীদের উন্নয়ন কল্যাণ না করে মাঝে মধ্যে দলবলসহ পর্বতমালা হতে অবতরণ করে রাজস্ব উসূল করতেন এবং বিদ্রোহের অভিযোগ করে সমগ্র এলাকায় লুটপাট করে চলে যেতেন। মোগল খানের এ অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণ বিদ্রোহী হয়ে উঠে এবং এশিয়া মাইনরসহ বিভিন্ন স্থানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। মোগল খানদের উৎপাত বন্ধ করার জন্য আমির কাজগাণের দৃষ্টি তৈমুরের প্রতি পড়েছিল। বীরত্ব, যোগ্যতায় মুগ্ধ হয়ে ‘এক হাজারি’ পদ প্রদান করেন এবং তৈমুরের সাথে তার কন্যাকে বিয়ে দেন।
তৈমুরের সাহায্যে এশিয়া মাইনরে আমির কাজগাণের শক্তি ও প্রভাব বৃদ্ধি পায় এবং কাজগাণের সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করে। তৈমুরের বীরত্বপূর্ণ ভ‚মিকার ফলে আফগানিস্তানের হিরাত সহজেই আমির কাজগাণের অধিকারে আসে। হিরাতের শাসন কর্তাকে বন্দি করা হলে কাজগাণ তাকে মুক্তি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছিলেন, কিন্তু এ ব্যাপারে সর্দারগণের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়, তারা তার মৃত্যুদন্ড চায়। কিন্তু তৈমুর কাজগাণের প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য হিরাতের বন্দি শাসনকর্তাকে গোপনে পলায়নের সুযোগ করে দেন এবং তাকে হিরাত পর্যন্ত পাহারায় পৌঁছে দেন।
এ খবর প্রতিপক্ষের সর্দারগণের কাছে পৌঁছালে তারা কাজগাণকে আকস্মিক হত্যা করে পালিয়ে যায়। তৈমুর কাজগাণের কাফন দাফন শেষ করে হত্যাকারীদের সন্ধানে বের হন এবং উত্তরের পর্বত মালার চ‚ড়ায় ধরে ফেলেন এবং সেখানেই তাদের হত্যা করেন এবং তাদের মস্তক কেটে নিয়ে প্রত্যাবর্তন করেন।
তৈমুরের জীবনে শুরু হয় আরেক পরীক্ষা ও অন্ধকার যুগ। পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করে চুগতাই খানের শরণাপন্ন হতে। এটি তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও কৌশলটি ছিল সময়োপযোগী এবং এক বিরাট বিপর্যয় হতে রক্ষা পান। এ সুযোগে তিনি মোগলদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। মোগল তাকে তমান বাশী (দশ হাজারি) পদ মর্যাদা দান করে সমরকন্দের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। মোগল খান সুযোগ বুঝে আবার এশিয়া মাইনরে পূর্বের ন্যায় নির্যাতন শুরু করেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।