হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মোহাম্মদ আবদুল গফুর
অবশেষে তিনি চলে গেলেন। চলে গেলেন না ফেরার দেশে। গত ২৫ জুন শনিবার সন্ধ্যা রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর হিসেবে কার্যরত আমার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়র ফোনে দুঃসংবাদটি প্রথম শুনি। কেন যেন বিশ্বাস হতে চাইছিল না। ফোন দিলাম অফিসে। রিপোর্টিং বিভাগ থেকে জেনে নিশ্চিত হলাম।
অনেক দিন থেকেই তার শরীর ভালো যাচ্ছিল না। এক বছরেরও বেশি সময় হবে তার শরীর খারাপের খবর শুনে গে-ারিয়ায় তার নিজের বাসায় দেখা করতে গিয়েছিলাম। তার শরীর দুর্বল কিন্তু তিনি নিজে এসে আমাদের সাথে পাশাপাশি বসে অনেক কথাবার্তা বলেছিলেন। তখন তার কাছ থেকে জেনেছিলাম আরেকটি দুঃসংবাদ। সরকার নাকি তার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে দিয়েছে। ২৫ জুনের পর তাকে নিয়ে সরকারকে আর উদ্বিগ্ন থাকতে হবে না।
মরহুম মওলানা মুহিউদ্দীন খানের প্রধান পরিচিতি ছিল একজন আলেম হিসেবে। কিন্তু তাকে শুধু আলেম বা মাওলানা বলা হলে সবটুকু বলা হবে না। আলেম হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন লেখক ও সাংবাদিক। তদুপরি তিনি ছিলেন একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তার সাথে ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতার সূত্র ধরে বলতে পারি, তিনি মুসলিম বাংলার সাংবাদিকতার জনক মরহুম মওলানা আকরম খাঁকে জীবনের আদর্শ হিসেবে মনে করতেন। তবে এ দুজনের মধ্যে কে কোন ব্যাপারে কতটা সফল হন তার তুলনামূলক বিচার করলে দেখা যাবে, একজন সাহিত্যিক ও সাংবাদিক হিসেবে মরহুম আকরম খাঁর সাফল্য অনেক বড় হলেও তার ব্যক্তিগত চিন্তাধারা মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর অংশের আকিদার সাথে সঙ্গতিশীল না হওয়াতে ধর্মীয় ক্ষেত্রে তা তেমন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তবে সাহিত্যিক ও সাংবাদিক হিসেবে তিনি অসামান্য প্রতিভার অধিকারী হওয়াতে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশাল সাফল্যের অধিকারী হন।
অপরদিকে মরহুম মওলানা মুহিউদ্দীন খানের সাথে বৃহত্তর মুসলিম সমাজের ধর্মীয় আকিদার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা না থাকাতে এ ব্যাপারে তার সাফল্য বিশাল। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে মাওলানা আকরাম খাঁ প্রতিষ্ঠিত দৈনিক আজাদ বাঙালি মুসলমানদের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্রে যে অসাধারণ ভূমিকা পালনের সুযোগ লাভ করে তার মূলে ছিল সে সময়ের বৈশিষ্ট্য, যা মরহুম মওলানা মুহিউদ্দীন খান পাননি। মওলানা মুহিউদ্দীন খানের জন্ম ১৯৩৪ সালে। তার কর্মজীবন শুরুই হয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর। সুতরাং ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের সুযোগ তার জীবনে কখনো হয়নি বললেই চলে।
তবে স্বাধীনতা অর্জনের চেয়েও স্বাধীনতা রক্ষা ও স্বাধীনতাকে সার্থক করে তোলার সংগ্রামকে যদি অধিক কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা যায় তা হলে এক্ষেত্রে মরহুম মওলানা মুহিউদ্দীন খানের অবদানকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ব্রিটিশ শাসনের অবসানে আমরা প্রথমবারের মতো স্বাধীনতা লাভ করলেও সে স্বাধীন রাষ্ট্রে দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলাকে পাশ কাটিয়ে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পাঁয়তারা শুরু হলে তার বিরুদ্ধে যে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন শুরু হয়, তাতে স্বাভাবিকভাবেই অংশ নেন বাংলাভাষী লেখক ও সাংবাদিক মওলানা মুহিউদ্দীন খান। এই সূত্রে ভাষা আন্দোলনের স্থপতি সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের সাথেও গড়ে ওঠে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
তা ছাড়া তার প্রতিষ্ঠিত মাসিক মদীনার মাধ্যমে তিনি দেশে ধর্মীয় সাহিত্য উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে বিশাল অবদান রেখেছেন তা জাতি কখনো ভুলতে পারবে না। ইসলামী আদর্শের পত্রিকার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে বহু পত্রিকার নামই উল্লেখ করা যায়। কিন্তু মাসিক মদীনার মতো এত দীর্ঘদিন ধরে একটানা প্রকাশনার রেকর্ড অনেকটাই বিরল। এর পুরা কৃতিত্ব এককভাবে মওলানা মুহিউদ্দীন খানের প্রাপ্য। দেশের একজন নেতৃত্বস্থানীয় আলেম হওয়া ছাড়াও এই মাসিক মদীনার সম্পাদক হিসেবেই ছিল মওলানা মুহিউদ্দীন খানের প্রধানতম পরিচিতি। বিশেষ করে মাসিক মদীনার প্রশ্নোত্তর বিভাগে বিভিন্ন জটিল প্রশেরœ যেসব জবাব তার কলমে বেরিয়ে এসেছে তা ইসলামী বিষয়ে তাঁর অসাধারণ পা-িত্যেরই পরিচয় বহন করে।
আসলে তিনি নিজেও ছিলেন ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা হতে ফারেগ হওয়া মেধাবী শিক্ষার্থীদের অন্যতম। আমাদের দেশের অধিকাংশ আলিয়া পাস ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব যে কোনো একটি বিষয়ে কামেল ডিগ্রি অর্জন করেন। কিন্তু মাওলানা মুহিউদ্দীন খান এক্ষেত্রেও ছিলেন অনন্য। তিনি হাদিস ও ফিক্হ এ দুটি বিষয়ে কামেল ডিগ্রি অর্জনের কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন। ফলে যে কোনো ধর্মবিষয়ক প্রশ্ন বা মাসলার সঠিক জবাব যোগানো সহজ হতো তার পক্ষে। আগেই বলা হয়েছে, ধর্মীয় ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টতার পাশাপাশি তিনি রাজনীতি জগতেও পদচারণা করেছেন। তবে তার রাজনৈতিক কর্মকা-ের প্রধান বিষয়বস্তু অপরিহার্যভাবে জাতির বৃহত্তর কল্যাণ এবং ইসলামী আদর্শকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতো। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রশক্তির রক্তচক্ষুর পরোয়া না করে তিনি তার ঈমানী দায়িত্ব পালন করতেন। এ কারণে তিনি মাঝে মাঝেই ইসলামবিরোধী সরকারের রোষানলে পতিত হতেন। যার আভাস আমরা ইতিপূর্বে দিয়েছি।
আমরা আগেই বলেছি, তার জীবনের আদর্শ মরহুম মওলানা আকরম খাঁ হলেও সময়ের ব্যবধানের কারণে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের সৌভাগ্য তার হয়নি। তবে স্বাধীনতাকে সার্থক করে তোলার লক্ষ্যে স্বাধীন পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশে ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তার উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। এ লক্ষ্যেই তিনি ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংস্থা তমদ্দুন মজলিসের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এককালে মজলিসের নিয়মিত আলোচনা সভা মাসিক মদীনার বাংলাবাজার অফিসে এবং পুরানা পল্টনে তাঁর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হতো। তাছাড়া তিনি দীর্ঘদিন ধরে তমদ্দুন মজলিসের বিভিন্ন কর্মকা-ে পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা দান করেন।
তমদ্দুন মজলিসের সদস্য কর্মীদের হাতেকলমে আদর্শিক শিক্ষাদানের লক্ষ্যে বার্ষিক শিক্ষাশিবির অনুষ্ঠানের যে ব্যবস্থা রয়েছে, একবার মরহুম মওলানা মুহিউদ্দীন খানের ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানাধীন তার নিজ গ্রাম আনসারনগরে সে শিক্ষাশিবির আয়োজিত হয় এবং তিনি নিজে তার যাবতীয় তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করেন।
এ ছাড়াও আমার ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে নানা পর্যায়ে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। অনেকেই জানেন না তমদ্দুন মজলিসের আহ্বানে অনার্স পরীক্ষার দুই মাস আগে ১৯৫০ সালে মজলিসের সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে যোগদানের কারণে আমার এমএ ডিগ্রি অর্জন ১২ বছর পিছিয়ে যায়। এর মধ্যে ১৯৫৮ সালে আমি বিয়ে করায় সংসারের প্রয়োজনে আমার চাকরি নিতে হয়। সে সময় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পূর্বসূরি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম (ইসলামী একাডেমি)-এর সুপারিনটেনডেন্টের চাকরি গ্রহণ করি।ওই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম (ইসলামী একাডেমি)-এর ডিরেক্টর ও ডেপুটি ডিরেক্টর ছিলেন যথাক্রমে ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকেশন খ্যাত আলহাজ এটিএম আবদুল মতিন ও মওলানা মুহিউদ্দীন খান। মওলানা মুহিউদ্দীন খান তার গে-ারিয়ার বর্তমান বাসভবন নির্মাণের পূর্বে এক পর্যায়ে শান্তিনগরে একটি বাসায় তিনি কিছু দিন ভাড়া থাকতেন। সে সময় আমার পরিবারের সঙ্গে তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের ইন্তেকালের খবর শুনে আমার স্ত্রী বহুক্ষণ ধরে বেদনার্ত ভাষায় সেসব বিষয়ে স্মৃতিচারণ করেন।
এসব নেহায়েত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়ের ক্ষুদ্র পরিসরের বাইরে মরহুম মওলানা মুহিউদ্দীন খান ছিলেন একজন জাতীয় পর্যায়ের নেতৃত্বস্থানীয় আলেম ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তবে দেশের অন্য অধিকাংশ আলেমের মতো তিনি তার কর্মকা- শুধু বাংলাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। পাকিস্তান আমলে ইনামুল্লাহ খানের নেতৃত্বে করাচিকেন্দ্রিক যে মোতাসারে আলমে ইসলামী নামক সংগঠন গড়ে ওঠে তার পূর্বপাকিস্তান শাখার দায়িত্বে ছিলেন মওলানা মুহিউদ্দীন খান। শুধু তাই নয়, পরবর্তীকালে সউদি আরব কেন্দ্রিক যে রাবেতা আলমে ইসলামী নামক আন্তর্জাতিক সংস্থা গড়ে ওঠে তারও অন্যতম সদস্য ছিরেন মরহুম মওলানা মুহিউদ্দীন খান। সে নিরিখে বলা যায়, তাঁর কর্মকা- শুধু বাংলাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তা বিস্তৃত হয়েছিল আন্তর্জাতিক পরিম-লেও।
তবে তিনি যদি তার কর্মকা- আন্তর্জাতিক পরিম-লে ছড়িয়ে নাও দিতেন যদি তিনি মাসিক মদীনা সম্পাদনা, অন্যান্য ইসলামী গ্রন্থাদি রচনা ও প্রকাশনার মধ্যেও নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতেন তবুও তিনি অমর হয়ে থাকতেন তার এসব কাজের উচ্চ মানের কারণে। তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ “জীবনের খেলাঘরে” যারা পাঠ করেছেন তারাই বলবেন তিনি একজন উচ্চমানের সাহিত্যিক ছিলেন এবং ওই গ্রন্থ তার সাক্ষী। এ ছাড়া তিনি অসংখ্য গ্রন্থ রচনা ও সম্পাদনা করেছেন, সেসবের গুরুত্বকেও কোনোভাবেই ছোট করে দেখার উপায় নেই। সর্বোপরি তিনি বিশ্ববিখ্যাত তফসির গ্রন্থ মুফতি শফী (র.)-এর ‘তফসিরে মারেফুল কোরআন’ অনুবাদ করে বাংলা অনুবাদ সাহিত্যকে যেভাবে অসামান্য উচ্চতায় তুলে দিয়েছেন তা এক কথায় অনন্য ও অসাধারণ।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমভাবে সুপরিচিত মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের মতো একজন ইসলামী ব্যক্তিত্বকে আমরা এমন এক সময়ে হারালাম যখন তার মতো গুণীজন ও সাহসী ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন ছিল আগের চেয়ে অনেক বেশি। কারণ দেশি-বিদেশি ইসলামবিরোধী অপশক্তির মধ্যেকার অশুভ আগ্রাসী আতাতের ফলে শতকরা ৯০ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত এ দেশটিতে ইসলামী আদর্শের ভবিষ্যৎ আজ নানাভাবেই বিপন্ন। এই পরিপ্রেক্ষিতে তার জীবনের শেষ প্রান্তে তিনি বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করেন, যা শেষ অবধি সফলতার মুখ দেখেনি। তাই মরহুম মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের ফেলে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব আমাদেরকেই সাহসের সাথে পালন করতে হবে। আমরা সে দায়িত্ব পালন না করলে কবরে শুয়েও তার আত্মা শান্তি পাবে না। আমরা তার পরলোকগত আত্মার শান্তি কামনা করি তার রুহের মাগফিরাত প্রার্থনা করি মহান আল্লাহতায়ালার কাছে। তার শোকাহত পরিবার-পরিজনের প্রতি জানাই আন্তরিক সহানুভূতি ও সমবেদনা। শেষ করার আগে যে কথাটি পুনরায় আমার শ্রদ্ধেয় পাঠকবৃন্দকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই তা হলো যতই আমরা মরহুমের জন্য শোক প্রকাশ করি না কেন, যিনি গেছেন তিনি আর কিছুতেই ফিরে আসবেন না। এটাই জগতের নিয়ম। তাই তার জন্য আমাদের শোক প্রকাশ তখনই সার্থক হবে যখন তার ফেলে যাওয়া কাজগুলো আমরা একনিষ্ঠতার সাথে সম্পন্ন করার সংকল্প গ্রহণ করতে পারব। আল্লাহপাকের কাছে আমরা সেসব দায়িত্ব পালনের তৌফিক কামনা করি। মহান আল্লাহ তার রুহের মাগফিরাত ও শান্তি দান করুন। আমিন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।