হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
আবদুল আউয়াল ঠাকুর
চলমান হত্যাকা- নিরোধে পরিচালিত অভিযানের সফলতা নিয়ে ইতোমধ্যেই বড় ধরনের প্রশ্ন উঠেছে। দেশের বিভিন্ন মহল এ ধরনের অভিযানকে মূলত গ্রেপ্তার বাণিজ্য বলে উল্লেখ করেছে। অন্যদিকে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের হাজার হাজার নেতা-কর্মী আটক হলেও সরকারি হিসেবেই ‘জঙ্গি’ আটকের যে বিবরণ দেয়া হয়েছে তা রীতিমতো হাস্যকর। অভিযান সম্পর্কে ব্যাপক সমালোচনা হলেও সরকারের কর্মকা-কে দ্ব্যর্থহীন সমর্থন দিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী। একইসঙ্গে একশ্রেণীর আলেমের কথিত ফতোয়াকেও সমর্থন করেছেন ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী। দিল্লির জামে মসজিদের ইমামের মতের সাথে একমত না হলেও দিল্লি কেন এবং কী কারণে আলোচ্য ফতোয়াকে সমর্থন করল সেটি যেমনি ভাববার রয়েছে তেমনি ভাববার রয়েছে চলমান সংকট নিয়েও। দেশের অনেকেই যেমনটা বলছেন তেমনি যারা গুপ্তহত্যায় নিহত হয়েছেন তাদের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, ক্রসফায়ার সমস্যার কোনো সমাধান নয়। এই আলোচনা আরো তুঙ্গে উঠেছে মাদারীপুরে কলেজ শিক্ষকের ওপর হামলার ঘটনায় জনতার হাতে আটক গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিমের পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে। সচেতন সমাজ বন্দুকযুদ্ধের এই কাহিনী মানতে নারাজ। তারা এ ঘটনাকে পরিকল্পিত হত্যাকা- বলে অভিহিত করেছেন। এ নিয়ে সঙ্গতকারণেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। এর বাস্তব ও যুক্তিসঙ্গত কারণও রয়েছে। ওইদিন পর্যন্ত বিগত সাড়ে তিন বছরে কথিত বন্দুকযুদ্ধে এবং পুলিশের হেফাজতে ৪৫৬ জন নিহত হয়েছেন। এই বিবরণ প্রকাশিত হওয়ার পর এ পর্যন্ত আরো অন্তত ২০ জন অনুরূপ ঘটনার শিকার হয়েছেন। প্রতিটি ক্রসফায়ারের গল্পই অভিন্ন। বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত কথিত বন্দুকযুদ্ধের একটি ঘটনাতেও প্রতিপক্ষের কাউকে আটক করতে দেখা যায়নি। দায়িত্বে অবহেলার জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নিতে দেখা যায়নি। দেখা যাচ্ছে, ঘটনায় যিনি নিহত হন তিনিই ক্ষতিগ্রস্ত হন। এক আলোচনায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সভাপতি সুলতানা কামাল বলেছেন, মানুষ আমাদের বলছে, যাদের ক্রসফায়ার দেয়া হচ্ছে তারা অন্যের মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। অতএব তাদের মানবাধিকার নেই। এই যে একটা বোধ সমাজে চলে আসে, যেনতেনভাবে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হবে। এটা কোনো আধুনিক গণতান্ত্রিক সুশাসনসম্পন্ন রাষ্ট্রের লক্ষ্য নয়।
ক্রসফায়ার অর্থাৎ বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের বিষয়টি যেমনি বাংলাদেশে নতুন নয়, তেমনি এর আলোচনাও একমাত্রিক নয়। কথিত টার্গেট কিলিং যেমনি বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, তার বিপরীতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নামে যা করা হচ্ছে সেটিও মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ মাত্র। এতে সমস্যার সমাধান হচ্ছে, না সমস্যা তীব্রতর হচ্ছে সে ভাবনা জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। ইতিহাসের পর্যালোচনায় বলা যায়, স্বাধীন বাংলাদেশে সিরাজ সিকদারকে দিয়েই প্রথম ক্রসফায়ারের গল্পের শুরু। তখনকার পরিস্থিতিতে হয়তো মনে করা হয়েছিল তাকে মেরে ফেললেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সময় প্রমাণ করেছে, এখন এ ধরনের সমস্যা অনতিক্রমণের পর্যায়ে চলে এসছে। যারা এসব দমনে নানা প্রক্রিয়া গ্রহণ করছেন বা গ্রহণের কথা বলছেন তারা সম্ভবত প্রচলিত নিয়মবিধিতেই এসব নিয়ে কথা বলছেন। অথচ তারা ভাবছেন না যে প্রচলিত নিয়মবিধিতেই সমস্যার জন্ম হয়েছে। এবারও এ ধরনের কর্মপন্থা এবং এর আগেও যখন এসব করা হয়েছে তখনও বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ ধরনের অভিযান পরিচালনায় যে ধরনের যোগ্যতা ও দক্ষতা প্রয়োজন তা সংশ্লিষ্টদের নেই। অনেকে আবার সমস্যার সমাধানে রাজনৈতিক সমাধানের ওপরও গুরুত্ব দিয়েছেন। এসব প্রাসঙ্গিক আলোচনায় যেসব বিষয় গুরুত্বের সাথে উঠে এসেছে তার মধ্যে ধর্মীয় বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। চলমান অর্থে বাংলাদেশে জঙ্গি বলতে ধর্মীয় বোধ সম্পর্কিত বিষয়কেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। হয়তো সে কারণেই ফতোয়ার দ্বারস্থ হতে হয়েছে। পবিত্র ধর্ম ইসলাম সম্পর্কে নতুন কোনো আলোচনার অবকাশ নেই। এক্ষেত্রে সর্বোত্তম মডেল হচ্ছেন আল্লাহর রাসূল (সা.)। তিনি তাঁর জামানায় যেভাবে ইসলাম প্রচার করেছেন যেভাবে ইসলামবিরোধী শক্তির মনজয় করে পরাভূত করেছেন সেটাই চিরদিনের জন্য সর্বোত্তম পদ্ধতি। তাঁর জামানাতেও তার মুখনিসৃত মধুর বাণী শোনার পরেও অনেকেই ইসলামের পতাকাতলে আসার সৌভাগ্যবান হতে পারেনি। সেজন্য তিনি কাউকে হত্যা করেননি এমনকি অভিসম্পাদও দেননি। ইসলামের সত্যবাণী প্রচারের জন্য যারা তাঁকে জন্মভূমিতে হত্যা করতে চেয়েছিল মক্কা বিজয়ের পর তিনি তাদেরকেও নিঃশর্ত ক্ষমা করে দিয়েছেন। ক্ষমা, ভালোবাসা, ঔদার্য্য মহত্ব দিয়েই তিনি ইসলামকে বিজয়ী করেছেন। এক্ষেত্রে সহনশীলতার কোনো বিকল্প নেই। এসব সৃষ্টির যিনি মালিক তিনি আল্লাহ কি যারা তার বিরোধিতা করছে তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন না দিচ্ছেন ? এ নিয়ে বিশদ আলোচনার জায়গা এটি নয় বিধায় এভাবেই শেষ করতে চাই যে, যারা নিজেরা বা নিজেদের মতো করে টার্গেট হত্যাকা- করছে তারাও মূলত বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ই করছে। আবার এদের প্রতি অসহিষ্ণু হয়ে যারা গ্রেপ্তারের পর হাতে আটক থাকা অবস্থায় ক্রসফায়ারে নিহত হচ্ছে তারাও বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হচ্ছে। কোনটি আগে কোনটি পরে হচ্ছে সে আলোচনায় না গিয়েও এটা বলা যায়, সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে ক্ষমতাসীনদেরই আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন জরুরি। যারা ক্ষমতায় থাকেন তারা যদি আইন না মানেন তাহলে অন্যদের মানতে বলা হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়। মানবাধিকার কর্মীরা মূলত সে প্রশ্নই তুলছেন। আরো একটি ব্যাপার ভাববার রয়েছে। যাকে ক্রসফায়ার দেয়া হচ্ছে জীবিত থাকতে আইনের সহায়তা পেতে পারছে না অথচ তার জবানবন্দিকেই আবার বিবেচনায় নিয়ে অন্য মামলা এগোচ্ছে। সম্প্রতি ফাহিমের জবানবন্দি নিয়ে কথা উঠেছে। বলা হয়েছে তার কথা ধরে পুলিশ এগোচ্ছে। সঙ্গতকারণে প্রশ্ন হচ্ছে, এ বক্তব্যের ভিত্তি কী? এটা তো ১৬৪ ধারার বক্তব্যও নয়। যেভাবে সাজানো হচ্ছে সেভাবেই জনগণকে শোনানো হচ্ছে। এটি বিচারের সংস্কৃতি নয় বরং এক ধরনের বিচারহীনতারই অংশ মাত্র। এখানে আরো উল্লেখ করা দরকার, আলোচ্য অভিযানের সময়েই কিন্তু সরকারি দলের অভ্যন্তরে মারাত্মক রাজনৈতিক বিতর্ক উঠেছে। এর সাথে এর কোনো সস্পর্ক রয়েছে কিনা সেটিও একেবারে বিবেচনার বাইরে রাখার বোধহয় তেমন কোনো সুযোগ নেই। আরো একটি বিষয় বিবেচনায় রাখা দরকার যে, কথিত জঙ্গি বা এ ধরনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ বা এ ধরনের দেশগুলো এমনকি পাশ্চাত্যের অনেক দেশ যা করছে তার থেকে আলাদা বৃটেন। বোধকরি বৃটেন যা করেছে বা করছে সেটি তাদের নাগরিকদের অধিকতর নিরাপত্তা বিধানে যথেষ্ট কার্যকর অবদান রাখছে। যেভাবেই ব্যাখ্যা করা যাক না কেন প্রচলিত ব্যবস্থায় সুবিচার পাওয়ার যে অধিকার নাগরিকদের স্বীকৃত তা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই বৃটেনের পরিস্থিতিতে গুণগত সাফল্য এসেছে। সে বিবেচনায় যদি বাংলাদেশের ক্রসফায়ারের গল্পকে মূল্যায়ন করা যায় তাহলে বোধকরি যে কেউ একমত হবেন যে, বিচার না পাওয়ার বা এক ধরনের পক্ষপাতিত্ব অথবা কোনো কিছু গোপন করার প্রবণতাই প্রকৃতপক্ষে পরিস্থিতি এরূপ করে থাকতে পারে।
বিশ্বব্যাপী বর্তমানে যে শ্রেণীর মুসলমানদের জঙ্গি বলে অভিহিত করার প্রবণতা চলছে তাকে সার্বিক বিবেচনায় না নিয়ে বর্তমান বা বিদ্যমান সমস্যার সমাধানের চিন্তা অর্থহীন। এ কথা একবার সবারই ভাবা দরকার কেন এবং কী কারণে নিজ দেশে ফিলিস্তিনিরা পরদেশি হয়ে গেছে। যে আন্তর্জাতিক পরিকল্পনার অংশহিসেবে তাদের ভূমিতে তারা অধিকার হারিয়েছে তা নিরোধে আন্তর্জাতিক মহল এ পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আন্তর্জাতিক অভিভাবক বলে পরিচিত জাতিসংঘ আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের জানমালের নিরাপত্তারও কোনো ব্যবস্থা করতে পারেনি। সেখানকার মায়েরা তাদের সন্তান জন্ম দেয়। দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় এ ছাড়া আর কোনো পথ তাদের নেই। এ সত্য প্রচারিত হওয়ার পরেও বিশ্ব মানবাধিকার কর্মীরা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের মদদদাতা ইহুদিদের বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। উপরন্তু ফিলিস্তিনিদের যারা সমর্থন করত তাদেরকেই নির্র্মূল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিশ্বকে ইহুদির জন্য নিরাপদ করতে দেশে দেশে যে ধরনের সমস্যা বর্তমানে দেখা যাচ্ছে তার সবগুলোর প্রকৃতির মধ্যেই এক ধরনের বঞ্চনার প্রসঙ্গ রয়েছে। যারা কথা বলছেন তারা কিন্তু সেদিকে দৃষ্টি দিচ্ছেন না। বরং নিজেদের সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের নামে সংকটকেই আরো ঘনীভূত করছেন। একদিকে আলোচনার কথা বলছেন অন্যদিকে ড্রোন হামলা করে মানুষ হত্যা করছেন। এতে বিশ্বাস ও আস্থার যে সংকট তৈরি হচ্ছে সেটাই বর্তমান প্রেক্ষিতে বিবেচ্য। যারা শালিস করতে চাচ্ছেন বা এ ধরনের প্রবণতাকে গ্রহণযোগ্য মনে করছেন তারা কার্যত তালগাছ নিজের কাছে রেখেই তা মানাতে চাচ্ছেন। এটা বিরোধের মীমাংসা না উসকে দেয়ার প্রবণতা সেটিও ভাববার রয়েছে। অন্যদিকে যা ঘটছে তার সাথে কোথায় কোন মহল জড়িত সে বিষয়ও ভাবনার বাইরে রাখার কোনো সুযোগ নেই। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের ঘটনার সাথে বাংলাদেশের প্রেক্ষিত কতটা মিলবে বা মেলানো যাবে সে বাস্তবতাও একটি বড় প্রশ্ন। ঘটনার যারাই দায় স্বীকার করুক না কেন চলমান ঘটনার উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি নিয়ে ইতোমধ্যেই নানা আলোচনা উঠেছে। এসব আলোচনায় সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা এবং রাজনৈতিক সমীকরণের যে আলোচনা করা রয়েছে বোধকরি সে ভাবনায় যুক্ত করার রয়েছে আরো অনেক কিছু। বাংলাদেশে রাজনৈতিক ফয়সালা বলতে যদি কেবলমাত্র একটি নির্বাচনী ভাবনার কথা ভাবা হয় তাহলে বিষয়টি মনে হতে পারে যারা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাচ্ছেন তারাই হয়তো এসব করাচ্ছেন। সরকারের কোনো কোনো মহল তাই বলছেন। বাস্তবতা হচ্ছে দেশে যত ধরনের সংকট এমনকি পরিবহন নিয়েও যে সংকট চলছে তাও মূলত সরকারি দলের মধ্যেই। দেশের গণতন্ত্রপন্থিদের তো কোথাও কোনো অবস্থানই নেই। যে কোনো অভিযানে বা যা কিছুই হোক তাদের ওপর দিয়েই বয়ে যাচ্ছে নির্যাতনের বন্যা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে এমনকি ভবন ধসে পড়লেও তার দায় তাদের ওপর বর্তাচ্ছে। সে বিবেচনায় সব যদি তারাই করে থাকবে তাহলে ঘটনার সময়ে তাদের আটক করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ব্যর্থ হচ্ছে কেন? সে বিবেচনায় রাজনৈতিক ফয়সালার অর্থ একরকম দাঁড়ায়। ২০১৪ সালের অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সূত্র ধরে যারা ক্ষমতায় রয়েছেন তারা তো নির্বাচনের কথা বলাকেও জঙ্গি বলে বিবেচনা করেন। এখন তাহলে এর ফয়সালা কী? ক্রসফায়ারে ফাহিমের মৃত্যুর পর ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সরকারের ভূমিকাকে সমর্থন জানিয়েছেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারকে নয়, জনগণকে সমর্থন জানাতে আহ্বান জানিয়েছেন ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রীর মানবাধিকার বিরোধী এই সমর্থন এলো বাংলাদেশে কথিত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা চেয়ে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কোনো কোনো নেতার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনার পর। এ ধরনের হস্তক্ষেপ কামনা একটা স্বাধীন দেশের জন্য কতটা কাক্সিক্ষত সে ব্যাপারে কিন্তু আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চুপসে গিয়েছিল। হয় তারা এ নিয়ে কথা বলতে সাহস পাননি অথবা ভিন্ন কোনো বিষয় রয়েছে। যদি চলমান আক্রমণ প্রবণতাকে এই বাস্তবতার আলোকে দেখতে হয় তাহলে অবশ্যই কে বা কারা এর সাথে জড়িত তার একটি ভিন্ন সূত্র-উৎসের সন্ধান পাওয়ার কথা। যেহেতু এ নিয়ে নিরপেক্ষ কোনো তদন্ত হয়নি তাই আগ বাড়িয়ে কিছু বলা হয়তো সঙ্গত নয়। সে ক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় হচ্ছে, অভিযান চলাকালেই একশ্রেণীর আলেমের ফতোয়া কেন আদায় করা হলো ? প্রাসঙ্গিক আলোচনায় একজন আলেম জানিয়েছেন, আলোচ্য উদ্যোক্তা সমাবেশ ডেকে দুই-তিনশ মানুষের বেশি সমবেত করতে পারেননি অথচ এক লাখের স্বাক্ষর জোগাড় করে ফেললেন। বিষয়টি ভাববার। বিবিসির সাথে সাক্ষাৎকারেও অনুরূপ আশঙ্কাই ব্যক্ত করেছেন অনেকে। তারা এর সঠিকতা, যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ভারতে মুসলমানদের নাগরিকত্ব নিয়ে যেখানে সংকট দেখা দিচ্ছে, মিথ্যা অপবাদ দিয়ে যেখানে মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে সেখানে বাংলাদেশের এক শ্রেণীর আলেমের ফতোয়াকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর এই সমর্থন প্রমাণ করে সংকটের সমাধান নয় বরং সংকট আরো প্রলম্বিত করার অপপ্রয়াসই হয়তো সক্রিয় রয়েছে। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক ফয়সালার অর্থ যদি হয় যে প্রক্রিয়ায় ভারতীয়দের স্বার্থরক্ষা চলছে তার আরো সম্প্রসারণ করা তাহলে ভিন্ন কথা। আর যদি এর অর্থ হয় একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা তাহলে এর অর্থ ভিন্ন দাঁড়াবে। রামকৃষ্ণ মিশনে এসে বিএনপি নেতারা দেশে গণতন্ত্রহীনতাকেই সন্ত্রাসের কারণ বলে অভিহিত করেছেন। তারা মনে করেন ঐক্যবদ্ধভাবে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব। এই যে ঐক্যবদ্ধতার প্রসঙ্গ তার সাথে চলমান বাস্তবতা মেলালে বোধকরি অর্থ একটু ভিন্ন দাঁড়াবে। তাহলে বুঝতে হবে নির্বাচন এবং চলমান সন্ত্রাসী প্রক্রিয়া সমান্তরাল নয়। দুটি ভিন্ন বিষয়। অভিযোগের আঙ্গুল যাদের দিকেই তোলা হোক না কেন বিএনপি কিন্তু বিষয়টি আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে যে, আরো গভীরে যেতে হবে। উপরি কাঠামো থেকে যা বলা হচ্ছে বা বলার চেষ্টা হয়ে থাকুক সমস্যা যদি কার্যত থেকে থাকে তাহলে তা কোথায় তা শনাক্ত করা জরুরি। যখনই ঘটনা ঘটে তখনই শীর্ষমহল থেকেও বলা হচ্ছে, দেশে কোনো জঙ্গি নেই। তাহলে আবার জঙ্গিবিরোধী অভিযান কেন? আবার যদি জঙ্গি থেকে থাকে তাহলে তাদের গ্রেপ্তারে বাধা কোথায়? যদি তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব না হয় তাহলে অহেতুক ভিন্ন মতালম্বীদের এই আটক কেন? এসব প্রশ্নের কোনো কার্যকর জবাব পাওয়া যায়নি কোথাও। পুলিশ প্রধান যখন বললেন, চাঁদাবাজি হচ্ছে না, তারপরের দিনই একটি ইংরেজি দৈনিকে গ্রেপ্তারের চরিত্র নিয়ে যে বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে তা দেখে বোধকরি পুলিশ প্রধানের নিজেরও বিস্মিত হওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।
যে কোনো সংকটের সমাধান খুঁজতে হলে অবশ্যই তার গোড়ায় যাওয়াই যৌক্তিক। চলমান সংকটের কারণ সংকটের প্রকৃতি নিরূপণে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রচলিত ভাবনা। যে চোখে একে দেখা হচ্ছে তা স্বচ্ছ নয়। আবার নিজেদের চোখেও দেখা হচ্ছে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত যতগুলো ঘটনা ঘটেছে তার প্রতিটির পেছনেই রয়েছে শোষণ বঞ্চনার প্রতিবাদ। সমাজতন্ত্রের সাথে বৈজ্ঞানিক যুক্ত করে দেয়ার মতো বিভ্রন্তিকর রাজনীতিও এদেশে স্বল্পকালের জন্য জনপ্রিয় ছিল। এটা কতটা সমাজতন্ত্রের জন্য কতটা প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বোধকরি তা আর নতুন করে আলোচনার সুযোগ রাখে না। সে সময়ের গণবাহিনী নির্বিচার গণহত্যা চালিয়েও কথিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি বরং এখন এসে আওয়ামী লীগের সাথেই হাত মিলিয়েছে। এর রাজনৈতিক মূল্যায়ন যাই হোক বাস্তবতা হচ্ছে, সময় পাল্টিয়েছে। কমরেড সিরাজ সিকদারের হত্যার মধ্য দিয়ে যেমনি অন্যরা নিরাপদ হননি তেমনি ’৭৫-এর পরিবর্তনও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। হত্যা, গুপ্তহত্যা, রাজনৈতিক হত্যা সমাধান নয়। হত্যা হত্যাকে ত্বরান্বিত করে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও যে সমস্যার কথা বলা হচ্ছে তার সমাধান করতে হলে প্রচলিত কাঠামোর বাইরে বেরুতে হবে। সংকটের প্রকৃত কারণ অনুধাবন করে তা নিরসনে কার্যকর ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। এক ধরনের জোড়াতালি গোঁজামিল দিয়ে অনেক দিন ধরে চালানোর চেষ্টা হচ্ছে। এতে যে কোনো কাজ হচ্ছে না সে কথাই প্রমাণ করছে বারবার। যারা ধর্মের কথা বলছেন তাদেরকে বুঝতে হবে মনজয় করা ছাড়া ধর্ম প্রচারের কোনো সহজ রাস্তা নেই। বিচারকে যারা প্রহসনে পরিণত করেছে তাদের বুঝতে হবে, সমাজে ন্যায়বিচার না থাকলে জনগণের মধ্যে যে আস্থার সংকট তৈরি হয় তা কার্যত অসন্তোষে রূপ নেয়। এটাই সামাজিক নৈরাজ্য। এ থেকে মুক্তি পেতে ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।