বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা ও হত্যাকান্ডের বিচারে ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক সাত আসামীকে ফাঁসির দন্ড দিয়েছেন। একজনকে দিয়েছেন খালাস। ২০১৬ সালের ১ জুলাই এই লৌহমর্ষক হামলা ও হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। হামলাকারী সন্ত্রাসীরা ২০ জনকে হত্যা করে, যাদের ১৭ জনই ছিলেন বিদেশি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে হামলায় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী সবাই নিহত হয়। পরে হামলার সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িতদের কয়েকজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হয়। বিচারে যে সাতজনের ফাঁসির দন্ড দেয়া হয়েছে তারা ওই ঘটনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল বলে সাব্যস্ত হয়েছে।
এতবড় ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে জড়িতদের এরকম দৃষ্টান্তমূলক সাজাই হওয়া উচিত। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মিডিয়ায় এই রায়ের বিবরণ গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়েছে। সন্তোষ ও অভিনন্দন জানানো হয়েছে রায়ের প্রতি। এ সংক্রান্ত খবরের সঙ্গে আদালতে উপস্থিত আসামীদের ছবিও বহু মিডিয়ায় প্রকাশিত বা সম্প্রচারিত হয়েছে।
ছবিতে আসামীদের যে দৈহিক ভাষা লক্ষ্য করা গেছে, তাতে কেউ কেউ অতিশয় বিষ্মিত হয়েছেন। তাদের চেহারায় কোনো ভীতি-সংশয় কিংবা অনুশোচনার ভাব ও বিমর্ষতা দেখা যায়নি। যেন এ ধরনের রায়ের জন্য তারা প্রস্তুতই ছিল। সম্পূর্ণ বিকারহীন আসামীদের দু’জনের মাথায় আইএস-এর পতাকার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ টুপি দেখে অনেকেই যারপরনাই অবাক হয়েছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে, হামলার জন্য নব্য জেএমবিকে দায়ী করা হলেও ওই সময় আইএস হামলার দায় স্বীকার করেছিল।
তাছাড়া হামলার সময়ও জঙ্গীরা আইএস-এর কালো পতাকা ও কালো স্কার্প ব্যবহার করেছিল। এসব আলামত সত্তে¡ও সরকারের তরফে সব সময়ই বলা হয়েছে, সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আইএস-এর কোনো সম্পর্ক বা সংশ্লিষ্টতা নেই। না থাক, তবে তারা যে আইএস’র দ্বারা অনুপ্রাণিত, তাতে বোধকরি সন্দেহ নেই। স্বভাবতই এখানে তাদের মোটিভেশনের বিষয়টি এসে যায়।
ধর্মের নামে, জিহাদের নামে, বেহেশতের নামে তাদের এমনভাবে মোটিভেট করা হয়েছে যে, তাদের বিবেক অকেজো হয়ে গেছে এবং মানবিক বোধ-বিবেচনা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। তা না হলে কি তারা ওই রকম নির্মম ও নৃশংসভাবে নিরিহ-নির্দোষ মানুষ হত্যা করতে পারে? পারে কি এ রকম বেপরোয়া ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে?
যুক্তরাষ্ট্রের লন্ডন ব্রিজে গত ২৯ নভেম্বর এক সন্ত্রাসী হামলায় একজন নারী ও একজন পুরুষ নিহত ও তিনজন আহত হয়েছে। পাকিস্তানী বংশোদ্ভ‚ত উসমান খান দিনে-দুপুরে ছুরি নিয়ে হামলা চালিয়ে এই হতাহতের ঘটনা ঘটিয়েছে। হামলার সময় তার গায়ে ভুয়া সুইসাইড ভেস্ট পরা ছিল। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে তাকে হত্যা করে। উসমান খান একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী।
লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে বোমা হামলা ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার দায়ে একটি আদালত তাকে ১৬ বছরের কারাদন্ড দেয়। আল কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে সে ওই হামলার প্রস্তুতি নেয়। ওই সময় বিচারক তাকে ‘ভয়ংকর জিহাদী’ হিসাবে অভিহিত করেন এবং তার মুক্তি না দেয়ার পক্ষে মত দেন। পরবর্তীকালে তাকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দেয়া হয়। শর্তের মধ্যে ছিল, সর্বক্ষণ অবস্থান শনাক্তকারী ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস পরে থাকতে হবে এবং সন্ত্রাসে জড়িতদের সরকারি পুনর্বাসন কর্মসূচীতে অংশ নিতে হবে। এরকম একটি কর্মসূচীতে অংশ নেয়ার পর সে লন্ডন ব্রিজে পথচারীদের ওপর ছুরি-হামলা চালায়।
এই ঘটনায়ও দেখা গেছে, এমনভাবে ধর্মের নামে উসমান খানকে মোটিভেট করা হয়েছে বা সে মোটিভিটেড হয়েছে যে, সন্ত্রাসী হামলার ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার অভিযোগে বড় রকমের সাজা হওয়ার পরও তার বোধদয় হয়নি। সরকারের পুনর্বাসন কর্মসূচীতে অংশ নেয়ার পরও তার মানসিক বন্ধাত্ব্য ঘোচেনি। এবার আর হামলার ষড়যন্ত নয়, সরাসরি হামলা করে সে মানুষ হত্যা করেছে। অন্ধত্ব কোন পর্যায়ে গেলে মানুষ এটা করতে পারে, সহজেই অনুমেয়। এ ক্ষেত্রেও তার অপরিসীম ঔদ্ধত্যের প্রকাশ ঘটেছে।
হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারী সন্ত্রাসী ও লন্ডন ব্রিজে হামলাকারী উসমান খান- সবাই বয়সে তরুণ। শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসর। তারা কীভাবে এ রকম অন্ধ, অবিবেচক, বর্বর ও নৃশংস ঘাতকে পরিণত হলো, এ রকম চরম উদ্ধত হলো, সেটাই প্রশ্ন। কেউ না কেউ কোনো না কোনো গোষ্ঠি বা মহল তাদের ধর্মান্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে মোটিভেট করে, প্ররোচনা দিয়ে, লোভ দেখিয়ে সন্ত্রাসী দলভুক্ত করছে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, ইসলাম ও মুসলমানদের চিরাচরিত দুশমনরা এর সঙ্গে জড়িত আছে। তারা ইসলামের নামে, ইসলামী শাসন ও খেলাফতের নামে তরুণদের বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করছে এবং সন্ত্রাসে জড়িত করছে নানা সংগঠনের নামে। সন্ত্রাসীরা বেঘোরে নিজেদের জীবন যেমন বিসর্জন দিচ্ছে, তেমনি মুসলিম উম্মাহর অবর্ণনীয় ক্ষতিসাধন করছে। ইসলামের নাম করে যারাই সন্ত্রাস করুক, মানুষ হত্যা করুক, কিংবা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করুক, তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিপদ, বিপর্যয়, দুর্নাম ও ক্ষতি কিন্তু মুসলমানদেরই বহন করতে হচ্ছে। ইসলাম ও মুসলমানদের দুশমনদের তো এটাই একমাত্র লক্ষ্য।
এমতাবস্থায়, মুসলিম উম্মাহর জরুরী দায়িত্ব হচ্ছে, সন্ত্রাসী ও সন্ত্রাসে প্ররোচণাদানকারী, পৃষ্ঠপোষকতাকারী ও সাহায্যকারী যে বা যারাই হোক না কেনো, তার বা তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। একই সঙ্গে ইসলামের মূল শিক্ষা, দর্শন, দিক নির্দেশনা ও বিধিমালার ব্যাপারে প্রচারণা চালানো। উম্মাহর আলেম-উলামা, নেতা ও বিদগ্ধ ব্যক্তিদের দায়িত্ব এক্ষেত্রে অনেক বেশি।
ইসলাম সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া নরহত্যাকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। এরচেয়ে মহাপাপ আর কিছু নেই। যারা এ পাপে পাপী, তাদের কোনো রেহাই নেই। দুনিয়াতেও না, পরকালেও না। আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে বলেছেন: নরহত্যা বা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কাজ করার জন্য কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন পৃথিবীর সকল মানুষকেই হত্যা করলো। আর কেউ কারো প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন সকল মানুষের প্রাণ রক্ষা করলো। (সূরা মায়িদা : ৩২)।
হোলি আর্টিজান বা লন্ডন ব্রিজে যারা নিহত হয়েছেন, তারা সবাই নির্দোষ-নিরীহ মানুষ। তাদের হত্যা করার এখতিয়ার, অধিকার কারো নেই। তাদের হত্যার মধ্য দিয়ে মানব জাতির অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে। এরকম মহাপাপ যেন ধর্মের নামে, সম্প্রদায়ের নামে বর্ণের নামে কেউ না করে, সেটাই আমাদের একান্ত প্রত্যাশা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।