বিজয় দিবসের কবিতা
তুমি বাংলা ছাড়ো আবদুল হাই শিকদাররক্তচোখের আগুন মেখে ঝলসে যাওয়া আমার বছরগুলোআজকে যখন হাতের মুঠোয়কণ্ঠনালীর খুনপিয়াসী
মার্চে যখন গোটা দেশ ফুঁসছে , এরপর বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ দেয়া ভাষণে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইঙ্গিত পেয়ে একের পর এক বিদেশী গণমাধ্যমকর্মীরা সংবাদ সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশে ভিড়তে শুরু করে। অধিকাংশ বিদেশি গণমাধ্যমকর্মীরা শাহবাগের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ওঠেন। তাদের মধ্যে ছিল অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ সহ বিভিন্ন দেশের সাংবাদিক। ২৫ মার্চ পাকবাহিনীর নির্মম গণহত্যার পরিকল্পনা আগে থেকেই চুড়ান্ত ছিল। বিদেশি সাংবাদিকরা যাতে গনহত্যার কথা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিতে না পারে সেজন্য তাদের ওপর আগে থেকেই নজরদারি ও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরু করার আগে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী সকল বিদেশি সাংবাদিককে জোরপূর্বক হোটেলে আটকে রাখে। রাতের আধারে কী ঘটতে যাচ্ছে কেউ ভাবতেও পারেনি। হোটেলের ভেতর বন্দী অবস্থায় তারা মুহুমুর্হু গুলির শব্দে আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন বিদেশি সাংবাদিকরা। নিজেদের জীবনের কথা না ভেবে তারা সেদিন ভেবেছিলেন নিরস্ত্র, অসহায় বাঙ্গালীর কথা। চেষ্টা করেও সেদিন তারা হোটেল থেকে বের হতে পারেননি।
নিউইয়র্ক টাইমসে ২৯ মার্চ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উঠে আসে তাদের কথা, “পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হুমকি দিয়েছে, হোটেল থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করা হলে সাংবাদিকদের গুলি করা হবে। ” ওই প্রতিবেদনে সাংবাদিকদের হুমকি দেয়া পাকিস্তানি এক সৈনিকের জবাব এভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়, “উই ওয়ান্ট ইউ টু লীভ বিকজ ইট উইল বি ঠু ডেঞ্জারাস ফর ইউ। ইট উইল বি ঠু ব্লাডি। ”বিশ্বের জনপ্রিয় এ সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে প্রকাশ হয়ে যায় বাংলাদেশের নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ, জুলুম, নির্যাতনের কথা।
সারা দুনিয়া জুড়ে বিবেকবান মানুষ স্ব স্ব অবস্থান থেকে প্রতিবাদ করতে শুরু করেন। অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক ডব্লিউ জে অডারল্যান্ড অস্ত্রহাতে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন। ৭০ বছরের প্রবীণ ফরাসি দার্শনিক আঁদ্রে মালরো যুদ্ধে যাবার ঘোষণা দিয়ে মুক্তি সংগ্রামে মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করেন। কিউবা বিপ্লবের মহানায়ক ফিদেল কাস্ত্রো আগে থেকেই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর কাছের মানুষ। ছিল গভীর বন্ধুত্ব। তিনি বাংলার স্বাধীনতার প্রশ্নে দৃঢ় অবস্থান নেন।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তৎকালীন বিরোধী নেতা লর্ড হ্যারল্ড উইলসন দাবি তোলেন বঙ্গবন্ধুর মুক্তি না দিলে পাকিস্তানকে যেন সকল প্রকার সহায়তা বন্ধ করে দেয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকা পাকিস্তানের পক্ষে থাকলেও আমেরিকার তৎকালীন কনসাল জেনারেল আরচার ব্লাড অসহায় বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে ছিলেন। তথ্যচিত্র নির্মাতা লিয়ার লেভিন ভালোবাসার তাড়নায় ছিলেন মজলুম বাংলাদেশী মানুষের পক্ষে। মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ তার কবিতায় ফুটিয়ে তোলেন অবর্ণনীয় দুর্দশাচিত্র ৷ ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতায় কবি লেখেন -
লক্ষ শিশু দেখছে আকাশ অন্ধকার
উদর স্ফীত, বিস্ফারিত চোখের ধার
যশোর রোডে-বিষণ্ন সব বাঁশের ঘর
ধুঁকছে শুধু, শক্ত মাটি নিরুত্তর।
লক্ষ পিতা ভিজছে শীতল বৃষ্টিতে
লক্ষ মাতা দুঃখ দেখে দৃষ্টিতে
লক্ষ ভাইয়ের হৃদয় ভরা যন্ত্রণা
লক্ষ বোনের নেইতো ঘরের সান্তনা......
অ্যালেন গিন্সবার্গের লেখা দীর্ঘ কবিতায় ফুটে বাংলার মানুষের ওপর চালানো দীর্ঘ নিষ্ঠুরতার কথা। তিনি কবিতার মাধ্যমে অসহায় গন মানুষের আর্তনাদ পৌঁছে দেন সারাবিশ্বে।
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতা কোন ভাবেই অস্বীকার করার সুযোগ নেই। বরং ভারতই একমাত্র দেশ যারা সবকিছু উজাড় করে সর্বপ্রথম বাংলার মানুষের পক্ষে দাঁড়ায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধে বহুমাত্রিক সহযোগিতা দেন। একদিকে বিপুল শরণার্থী চাপ, অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং, অস্ত্র সরবরাহ সহ মুক্তিযুদ্ধের সকল ক্ষেত্রেই পরম বন্ধুর মতোই পাশে দাঁড়ায় গোটা ভারত।
মাঠে নামেন বিপ্লবী ইলা মিত্র, জ্যোতিবসু, মানিক সরকারের মতো ব্যক্তিবর্গ। লেখক শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীরাও বিভিন্ন দেশ ঘুরে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আনার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। কলম ধরেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, আবু সায়ীদ আইয়ুব,পন্ডিত রবি শংকর। তাদের প্রচেষ্টা ও জর্জ হ্যারিসন-বব ডিলানের আন্তরিকতায় ৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইয়র্ক ম্যাডিসন স্কয়ারে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠিত হয়। জর্জ হ্যারিসনের ভাবনায় ছিল যে এই সময়টাই সঠিক। কারণ, প্রতিদিন হাজার হাজার শিশু মারা যাচ্ছিল এবং মার্কিন সরকার পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠাচ্ছিল। ইংল্যান্ডের এই শিল্পী লিখলেন এবং গাইলেন, ‹› সকলের কাছে মিনতি জানাই আজ আমি তাই/ কয়েকটি প্রাণ এসো না বাঁচাই› বা ‹এত যে বেদনা রাখি দূরে/ দেবে না তোমার ক্ষুধিতকে রুটি সামান্য দুটি/ মানুষগুলোকে সহায়তা দাও।’
কনসার্টে জর্জ হ্যারিসন ছাড়াও সংগীত পরিবেশন করেন , পন্ডিত রবি শংকর, বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, রিঙ্গো স্টারসহ আরও অনেকে। এই কনসার্ট থেকে সংগৃহীত ২,৫০,০০০ ডলার বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের জন্য দেওয়া হয়েছিল। জর্জ হ্যারিসনের নিজের লেখা ও গাওয়া ‹বাংলাদেশ বাংলাদেশ› গানটি কালের সাক্ষী হয়ে আছে।
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মানুষের হৃদয়ে মানবিক এ মানুষ গুলো ভাস্বর হয়ে থাকবে। তারাও মুক্তি সংগ্রামের বীর যোদ্ধা। হোক না বিদেশি, দূরত্বে দূরের তবু তারা কাছে। তারা বাংলাদেশের বন্ধু।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।