Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আমার দেখা মুক্তিযুদ্ধ

মিজানুর রহমান তোতা | প্রকাশের সময় : ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

আজ মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। বিজয়ের মাসটি অত্যন্ত গৌরবের। ৯মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের চুড়ান্ত বিজয় হয় এই দিনে। অবিস্মরণীয় বিজয়ের মাধ্যমে মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়। সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে স্মৃতিময় অতীত নিয়ে কিছু লিখতে চাই। সে সময়ের উত্তাল দিনগুলোর কথা আজো স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে। রণাঙ্গনে যুদ্ধ করিনি ঠিকই কিন্তু আমার মুক্তিযুদ্ধ দেখা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করা, খাদ্য সরবরাহ করা, পাকবাহিনীর অবস্থান ও মুভমন্টের খবর পৌছে দেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে।
আমার জন্মস্থান ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের পাশে চরমুরারীদহ গ্রাম। যেটি ইস্টিফিন নগর হিসেবেও পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি সবে নবম শ্রেণী পাশ করে ১০ম শ্রেণীতে উঠেছি। আমার সহপাঠী একই গ্রামের জোয়াদ আলীর সব সময় চলাফেরা করতাম। ক্যাডেট কলেজে পাকবাহিনীর ক্যাম্প ছিল। আমার মা মহিরণ নেছা ৭১সালের ৬ এপ্রিলে অসুস্থ্য হয়ে মারা যান। যুদ্ধের সময় ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের নিয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়াসহ নানা চিন্তাও মৃত্যুর অন্যতম কারণ। আমরা পরিবারের সবাই রাস্তার ধারের বাড়ি থেকে গ্রাম এলাকা হীরাডাঙ্গায় চাচাতো ফুফুর বাড়িতে আশ্রয় নিই। একপর্যায়ে আমি আশ্রিত বাড়ি থেকে বের হই। প্রদিদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে দেখা করা তাদের বিভিন্ন কাজে লাগা, বিভিন্ন বাড়ি থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বলে খাদ্য যোগাড় করা, সরবরাহ, পাক হানাদার বাহিনীর খবর নেয়ার কাজ করতাম বাইসাইকেলে চড়ে। স্বাধীনের কয়েকদিন আগের একদিনের একটি স্মৃতি আমার খুবই মনে পড়ে। আমাদের গ্রামের পাশে ক্যানেল। মুরারীদহ ও হীরাডাঙ্গার কাছে মাঝের ক্যানেলের ধারে মুক্তিযোদ্ধারা তেড়ে নিয়ে যায় দুই হানাদার বাহিনীর কয়েকজন সদস্য ও বিহারীকে। তারা ক্যাডেট কলেজ ক্যাম্প থেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়া। তাদেরকে ক্যানেলের পাশে কোদাল দিয়ে কুপাতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধারা। একজন বারবার বলে ওঠে ‘ছোড় দে ভাই, শেখ মুজিব সাহেবকো জয় হোগা’, ‘বাংলামে স্বাধীন হোগা’।
আমি ও আমার কয়েকজন বন্ধু কয়েকটি মাস একনাগাড়ে ছুটোছুটি করেছি হানাদার বাহিনীর মুভমেন্ট দেখে খবর দিয়েছি মুক্তিযোদ্ধাদের। আমার বাল্যবন্ধু নায়েব আলী জোয়ার্দ্দার ভারতে গিয়ে ট্রেণীং নেন। আমরা ক’জন থেকে যায় এলাকায়। কতটা নিষ্ঠুর ছিল হানাদার বাহিনী। কখনো আমাদের গ্রামে ও আমতলা মুক্তিযোদ্ধারা ঘোরাঘুরি করেছে এমন খবরের ভিত্তিতে বাড়িঘর জ্বালাও পোড়াও করতো। লোকজনকে ধরে নিয়ে করতো মারধর। সেদিনের দুঃসহ স্মৃতিগুলো মোটেও ভুলবার নয়। আমার বন্ধুরা সার্টিফিকেট নিতে বলেছে কয়েকবার। ততটা ম্যাচুরিটি না আসায় গুরুত্ব দেয়নি আমি জোয়াদ আলী,শরাফত চাচা, গোলাম বারী। বন্ধু নায়েব আলী জোয়ার্দ্দারসহ মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ গ্রহণকারী আমরা একদল দামাল ছেলে বিজয়ের পরক্ষণে আড্ডায় বসতাম আরাপপুর বাসস্ট্যান্ডে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মকবুল ভাইয়ের বাসা এলাকায়। সেখানে কোথায় কীভাবে হানাদার বাহিনী, রাজাকার, আলবদর, বিহারীদের পরাস্ত করা হতো তার গল্প হতো।
ঝিনাইদহ শহর ও আশেপাশে হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করার নানা কৌশলের কথা আজো মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। বিজয়ের বিজয় র‌্যালীতে অংশগ্রহণসহ সকল কর্মকান্ডে আমি ও জোয়াদ সক্রিয় ছিলাম। ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে প্রথমবর্ষে ভর্তির সময় আরাপপুরের আলিম ভাই, তৈয়ব আলী জোয়ার্দ্দার, বন্ধু নায়েব, জয়নাল, হাদী, জোয়াদ, আসলামসহ অনেকেই কলেজ ক্যাম্পাসে স্মরণীয় একটা অনুষ্ঠান করি বিজয় উৎসবের। ভুলিনি কোনদিন ভুলবো না মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিলগুলোর নানা স্মৃতি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন