পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
‘তুমি কি দেখেছো কভু, জীবনের পরাজয়- দুখের দহনে করুণ রোদনে তিলে তিলে তার ক্ষয়’। ৬০-এর দশকে ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের লেখা ও কণ্ঠশিল্পী আব্দুল জব্বারের দরদী কণ্ঠে গাওয়া চলচ্চিত্রের এ গানের বাস্তব দৃশ্যই যেন দেখা গেল চট্টগ্রাম নগরীর ঝাউতলা সরদার বাহাদুর নগরের বিহারি ক্যাম্পে। দীর্ঘ ৪৮ বছর ধরে নাগরিক সকল সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত হয়ে সেখানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন ‘আটকে পড়া পাকিস্তানিরা।’ একই দৃশ্য নগরীর অন্য ক্যাম্পগুলোরও। চট্টগ্রামের বিভিন্ন ক্যাম্পে ২০ হাজারের মত বিহারি অবর্ণনীয় কষ্ট, দুর্ভোগ আর অনিশ্চয়তাকে সাথী করে জীবন পার করছেন।
কবুতরের বাসার মতো ছোট্ট ঘরে এক একটি পরিবারের বসবাস। নেই ন্যুনতম নাগরিক সুবিধা। ছোট খাট পাতার পর ঘরে আর কোন জায়গা অবশিষ্ট নেই। সেই খাটের নীচে কাপড়-চোপড়, রান্না করার চুলা। শিশু আর নারীরা কোন মতে ঘরে ঘুমানোর সুযোগ পেলেও পুরুষদের ঘুমাতে হয় রাস্তায় কিংবা ভবনের ছাদে। শীত, গরম আর বৃষ্টিতে বন্যপশু পাখির মতো তাদের জীবন। অবর্ণনীয় কষ্ট দুর্ভোগ আর যন্ত্রণাকে সাথে নিয়েই তাদের দিনযাপন। জরাজীর্ণ ভবনে আড়াইশ পরিবারের বসবাস। বাসিন্দারা জানালেন, ঘরে ঢোকার গলি এত সরু কেউ মারা গেলে লাশ বের করতে কষ্ট হয়।
আদালতের নির্দেশনায় জাতীয় পরিচয় পত্র-এনআইডি পেয়েছেন তারা। তবে এখনও অনেক অধিকার পাননি তারা। তাদের পাকিস্তান পাঠিয়ে দেওয়ার কথা ছিলো। কাউকে পাঠানো যায়নি। এদেশের নাগরিক হিসাবে গ্রহণ করে নেয়ারও আশ্বাস দেয়া হয়েছিলো। সে আশ্বাসও বাস্তবায়ন হয়নি। ৪৮ বছরেও তারা কোন পরিচয় পাননি। পুনর্বাসনের উদ্যোগও আলোর মুখ দেখেনি।
ক্যাম্পে যারা প্রবীণ তাদের দিন শেষ-পুর্নবাসন, আর অধিকার চেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে ক্লান্ত তারা। জীবন সায়াহ্নে এসে ঈমান আমল নিয়ে পরপারে যাওয়ার প্রস্তুতি তাদের। তবে যারা বয়সে তরুণ তারা নাগরিক অধিকার চান। পড়ালেখা করে সরকারি চাকরির নিশ্চয়তা চান। তাদের আকুতি- ‘আমরাও মানুষ, আমাদেরও বেঁচে থাকার মত সুযোগ সুবিধা পাওয়ার অধিকার আছে।’
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এসব ক্যাম্পে আছেন বিহারিরা। নগরীর ঝাউতলা স্কুল ক্যাম্পের ১১টি সেক্টর ছাড়াও পাহাড়তলী, ডিজেল কলোনী, ফিরোজশাহ, হালিশহর, রৌফাবাদ ও হামজার বাগের ক্যাম্পে বিহারিদের বসবাস। উর্দু ভাষাভাষী মুসলমান এই জনগোষ্ঠি পাকিস্তানি নয়, তারা এসেছেন ভারতের বিহারসহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে। ভারত বিভক্তির এসব মুসলমানরা ভারত থেকে এ অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেন। তাদের বেশিরভাগই চাকরি করতেন রেলওয়েতে। তৎকালীন রেলওয়ের টেকনিক্যাল পদে তাদের অবদান ছিল।
ক্যাম্পের পাশে ছোট্ট একটি দোকান চালান সাজ্জাদ হোসেন (৬৫)। জানালেন-তার বাবা সাফায়াত হোসেন আসাম বেঙ্গল রেলওয়েতে চাকরি করতেন। থাকতেন চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে রেলওয়ের কোয়ার্টারে। তাদের আদি নিবাস ভারতে বিহার রাজ্যের সাফরা জেলায়। ১৯৪৭ সালের পর পরিবার নিয়ে তিনি চলে আসেন পাহাড়তলীতে। হালিশহরে বাড়ি করে বসবাস শুরু করেন। তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ওই বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হন তারা। জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নেন সর্দার বাহাদুর নগর স্কুল ক্যাম্পে। স্বাধীনতার পর ‘আটকে পড়া পাকিস্তানি’ হিসাবে তারা এই ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। ছয় মাস পর ক্যাম্প থেকে বের হলে সাফায়াত হোসেনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। সাজ্জাদ হোসেনের পাঁচ ভাই আর চার বোন ও মা এই ক্যাম্পে বসবাস করতে থাকেন।
তাদের সাথে এক চাচাও থাকতেন। দেশ স্বাধীনের পর তিনি ফিরে যান বিহারে। কিন্তু তারা ছোট থাকায় বিধবা মা সন্তানদের নিয়ে স্বদেশে ফেরত যেতে পারেননি। বর্তমানে সাজ্জাদ হোসেনের পাঁচ ছেলে মেয়ে উচ্চশিক্ষিত। এক ছেলে এমবিএ পাস, চাকরি করেন নামকরা একটি বিদেশি বিমান সংস্থায়। অপর ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। তিন মেয়ে মাস্টার্স পাস করেছেন। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট দুই মেয়ে পড়ালেখা শেষ করে বেকার। টিউশনি করে পরিবারের খরচ জোগান।
ক্যাম্পের প্রবীণ সদস্যরা জানান, স্বাধীনতার পর প্রথম দুই বছর তারা ক্যাম্পে বন্দি ছিলেন প্রাণভয়ে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসলে তারা কাজের সন্ধানে বের হন। ছোটখাটো কাজ করেই কোনমতে জীবিকা নির্বাহ করতেন। পুরুষেরা রাজমিস্ত্রি, যোগালি কিংবা বিভিন্ন ছোট ছোট কারখানায় শ্রমিকের কাজ করতেন। নারী ও শিশুরা আচার বানানো এবং কাপড়ে ফুল তোলার কাজ করতেন। ৮০-এর দশক পর্যন্ত পড়ালেখা করেনি কেউ। এরপর এনজিও পরিচালিত একটি স্কুল হয় ক্যাম্পে। সেখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ ছিল। বর্তমানে ক্যাম্পে বঙ্গবন্ধু বিদ্যাপীঠ নামে একটি হাই স্কুল আছে। ক্যাম্পের বাসিন্দাদের ছেলে মেয়েরা প্রায় সবাই পড়ালেখা করছে। যারা হতদরিদ্র তারা পড়ালেখা থেকে বঞ্চিত।
পেটের দায়ে শিশুকাল থেকেই শ্রমিকের কাজ করছে তারা। কাপড়ে নকশা তোলা বা কারচুপির কাজে পারদর্শী এখানকার শিশুরা। পাপ্পু বুটিক হাউসের মালিক পাপ্পু জানান, একসময় প্রায় সব ঘরেই কারচুপির কাজ হত। তবে এখন ওই ব্যবসাও মন্দা। পড়ালেখা করে অনেকে ছোটখাটো চাকরি করছে। স্বামী-স্ত্রী দুজনে চাকরি করে সংসার চালাচ্ছে এমন পরিবারও আছে। কয়েকজন যুবক জানান, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়ালেখা করেও তারা সরকারি চাকরি পাচ্ছেন না। তাদের জাতীয়তা সনদে ঠিকানা ‘বিহারি ক্যাম্প’। আর এ কারণে তারা অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
বিহারিদের নেতা মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করেছি। তিনি আমাদের পুনর্বাসনের কথা বলেছেন। কিন্ত সেই আশ্বাস এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। এনআইডি কার্ড দেয়া হলেও অন্যান্য নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত ক্যাম্পের বাসিন্দারা। জরাজীর্ণ একটি দোতলা স্কুল ভবনে আড়াই শতাধিক পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ১৯৫২ সালে নির্মিত ভবনটি যেকোন সময় ধসে পড়তে পারে। ক্যাম্পের বাসিন্দাদের জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হলেও কয়েকদিন পরপর তা কেটে দেয়া হচ্ছে। আছে গ্যাস ও সুপেয় পানির সংকট। তিনি বলেন, মানবেতর জীবন থেকে এই ক্যাম্পের ২০ হাজার মানুষ মুক্তি চায়। # ১০/১২/১৯ইং
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।