যেভাবে ৫০০
ক্লাব ফুটবলে গোলের প্রায় সব রেকর্ডই তার দখলে। এবার সেই লিওনেল মেসি উঠে গেলেন আরেক উচ্চতায়। বার্সেলোনার জার্সি গায়ে ৫০০ গোলের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন মেসি।
আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ গোলদাতা
ফুটবলার ম্যাচ গোল
লিওনেল মেসি ১১২ ৫৫
গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা ৭৮ ৫৪
হার্নান ক্রেসপো ৬৪ ৩৫
ডিয়েগো ম্যারাডোনা ৯১ ৩৪
সার্জিও আগুয়েরো ৭৬ ৩৩
হাসান সোহেল
‘সেরাদের সেরা’ শব্দটি মেসির নামের সাথেই যায়। আর এটা নিয়ে প্রশ্নও নেই খোদ তার শত্রুরও। তা না হলে শতবর্ষী কোপার সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার কাছে যুক্তরাষ্ট্রের ৪-০ গোলে হারার পরও কোচ জার্গেন ক্লিন্সম্যান তার দলের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেননি। কারণ মেসি এবং আর্জেন্টিনার এই দলের বিপক্ষে হারে লজ্জা নেই বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। অথচ গত বুধবার সকালে অনুষ্ঠিত ম্যাচের আগে কতোইনা হুংকার দিয়েছিলেন ক্লিন্সম্যান। যুক্তরাষ্ট্র দেশের মাঠে খেলবে বলেই হয়তো এতোসব হুংকার ছিলো ক্লিন্সম্যানের। তবে এর উত্তর যেন খেলার মাঠেই দিবেন বলে পণ করেছিলেন ফুটবল ইতহাসের ‘দ্যা গ্রেট’। স্বাগতিক কোচ জার্গেন ক্লিন্সম্যানের সব উচ্চ বাচ্য থামাতে মেসির আর্জেন্টিনা এদিন সময় নিলো মাত্র তিন মিনিট। মেসির যে জাদুকরী পাস থেকে লাভেজ্জি হেডের মাধ্যমে গোল করেন তা দর্শকরা মনে রাখবে লাভেজ্জির হেডকে নয়, জাদুকরের শৈল্পিক পাসকে। আর ম্যাচের ৩২তম মিনিটে আসে মেসির সেই জাদুকরী মুহূর্ত। যেন নিক্তির মাপে এক দুর্দান্ত ফ্রি-কিক। নিখুঁত লক্ষ্যে বলকে অবতরণ করানো। আর তাতেই দেশের হয়ে ইতহাস গড়েন বার্সা তারকা। ভেঙ্গে ফেলেন ফুটবল বিশ্বে ‘বাতিগোল’ খ্যাত আর্জেন্টিনার এতোদিনের সর্বোচ্চ গোলদাতা বাতিস্তুতার রেকর্ড। দীর্ঘদিন দেশের হয়ে সর্বোচ্চ ৫৪ গোলের মালিক ছিলেন গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা। কিন্তু এবারের কোপা কোয়ার্টারে ভেনিজুয়েলার বিরুদ্ধে এক গোলে সেই রেকর্ড ছোয়ার পর সেমি ফাইনালে গোল পেয়ে বর্তমানে ১১২ ম্যাচে ৫৫ গোল করে আর্জেন্টিনার হয়ে করা সর্বোচ্চ গোলদাতা এখন লিওনেল মেসি।
ম্যাচের বয়স যখন ৩২ মিনিট। তখনই মেসির সেই রেকর্ডের সাক্ষি আমেরিকার হিউস্টনের এনআরজি স্টেডিয়াম। বল পায়ে ঝড়ের বেগে যুক্তরাষ্ট্রের ডি বক্সে ঢুকছিলেন আর্জেন্টাইন আধিনায়ক। তাঁকে থামাতে অবৈধ পথই বেছে নিতে হল স্বাগতিক ডিফেন্ডারদের। ফাউল করেই থামানো হল তাঁকে। ঠিক যেমনটি আগের দিন বলছিলেন কোচ জেরার্ডো মার্টিনোÑ মেসিকে থামাতে দলগুলো ন্যায়-অন্যায় বহু পথ বেছে নেয়, কিন্তু থামাতে পারে কি? এদিনও থামানো যায়নি ফুটবল জাদুকরকে। আগত্য ফাউলে প্রাপ্ত ফ্রি-কিক থেকে যে গোলটা করে গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে ছাড়িয়ে আর্জেন্টিনার সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা হলেন, তাতে প্রতিপক্ষ গোলরক্ষকও হয়তো অবিভুত। এমন শৈল্পিক গোল দেখার ভাগ্যও বা ক’জনের ভাগ্যে জোটে! ৩০ গজ দূর থেকে এমনভাবে বল ভাসিয়ে জালে পাঠালেন, সেখানে ব্রেডলি গুজান কেন বিশ্বের যে কোন গোলরক্ষকেরই সাধ্যাতীত এই বল প্রতিহত করা।
কি ভাবছিলেন মেসি ঐ অবিশ্বাস্য ফ্রি-কিকের সময়? ‘আমি দাঁড়িয়ে সবকিছু বিশ্লেষণ করে দেখছিলাম। ভালো একটা স্ট্যান্স নিতে চেয়েছি, যেন রানআপের সময় পিছলে না যাই। এরপর প্রতিরোধ দেয়ালটা দেখলাম, দেখলাম গোলকিপার কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। তারপর ঠিক করলাম বলটা কোথায় পাঠাব’ বলছিলেন মেসি। এই শট দিয়েই দেশের হয়ে গাবিগোলের করা ৫৪ গোলকে পিছনে ফেলে দেশের সর্বকালের সর্বোচ্চ (৫৫টি) গোলদাতার আসনে বসেন মেসি। আর্জেন্টিনার হয়ে মেসির গোল এখন ৫৫টি, বাতিগোলের ৫৪টি। কিন্তু লক্ষ্য যার আরো বড় সেখানে এই রেকর্ডও যেন তাঁর কাছে মনে হল তুচ্ছ, ‘এত দূর আসতে পেরে আমি আনন্দিত, রেকর্ডটা পেয়েও। তবে আমরা এখানে এসেছি অন্য কিছুর জন্য।’ তবুও এই অর্জনে স্বতীর্থদের অবদানের কথা স্বীকার করে বার্সা তারকা বলেন, ‘স্বতীর্থদের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। এর জন্য আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।’ কোচ জেরার্ডো মার্টিনোও খুশি রেকর্ডটা বিশ্ব সেরা খেলোয়াড়ের দখলে থাকায়। তিনি বলেন, এমন একটি রেকর্ড ‘বিশ্ব সেরা’ খেলোয়াড়ের অধিকারেই থাকা উচিৎ। মার্টিনো-‘এটা দারুণ যে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা।’
অথচ এক সময়ে নিন্দুকেরা কতো কিছুই না বলতো- মেসি দেশের জন্য খেলে না। আর তাদের জবাব দিতেই হয়তো এবারের কোপায় শুরু থেকেই মেসি যেন আরও পরিণত, আরো দুর্বার, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অথচ শান্ত অবিচল। যদিও ফুটবল বিশ্বে মেসির শ্রেষ্টত্ব নিয়ে কারো কোন দ্বীমত নেই। মেসির ক্লাব বার্সিলোনার সাবেক কোচ পেপ গার্দিওলা তার এক উক্তিতে বলেছিলেন- ‘মেসিকে নিয়ে লেখার চেষ্টা করবেন না, তাকে বর্ণনা করার চেষ্টা করবেন না। শুধু তার খেলা দেখুন’। তাইতো মেসিকে নিয়ে গার্দিওলা একেক সময়ে একেক মন্তব্য ছিলো। কখনো ‘সর্বকালের সেরা মেসি’ ‘পৃথিবীর সেরা ফুটবলার মেসি’ ‘ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড় মেসি।’
মেসির সাথে কারো তুলনায় ‘মেসি’ কখনো কান দেননি। এটা নিয়ে কখনো ভাবেনও না বলে একাধিকবার বলেছেন। তবে তাঁর সাথে যাকে প্রতিদ্বন্দী ধরা হয় সেই ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো এবং মেসিকে নিয়ে ব্রাজিলীয়ান সেনসেশন নেইমার এক মন্তব্যে বলেছেন, ‘আমি রোনালদোর সাথে এক মৌসুম খেলার চেয়ে মেসির সাথে ১ ম্যাচ খেলাকে বেশি দাম দিব।’
গত দুই বছরে দুটি বড় টুর্নামেন্টের ফাইনালে খেললেও কিছু না পাওয়ার হতাশা নিয়ে দেশে ফিরতে হয়েছিল আর্জেন্টিনাকে। টানা তৃতীয়বার ফাইনালে ওঠার পর অধিনায়ক লিওনেল মেসি আশা করছেন, এবার আর শিরোপা ফসকে যাবে না।
ম্যাচ শেষে ২৮ বছর বয়সী মেসি বলেন, ‘এখানে আসার সময় আমাদের লক্ষ্য ছিল আরেকটি ফাইনাল খেলা এবং আমরা তা পেরেছি।’ অথচ পিঠের চোটের কারণে এবারের টুর্নামেন্টে আর্জেন্টিনার প্রথম ম্যাচে মাঠেই নামতে পারেননি মেসি। তাকে ছাড়াই বর্তমান চ্যাম্পিয়ন চিলির বিপক্ষে ২-১ গোলে জিতেছিল জেরার্দো মার্তিনোর দল। গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে ৬১ মিনিটের সময় বদলি হিসেবে মাঠে নেমে মাত্র ২৬ মিনিটের মধ্যে অসাধারণ এক হ্যাটট্রিক করে পানামার বিপক্ষে দলকে ৫-০ গোলের জয় এনে দেন বার্সেলোনার তারকা এই ফরোয়ার্ড। ফাইনালে ওঠার আগ পর্যন্ত খেলা ৫ ম্যাচে মোট ১৮টি গোল করে আর্জেন্টিনা। যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে ম্যাচে আর্জেন্টিনার হয়ে সর্বোচ্চ গোলের (৫৫) রেকর্ড গড়া মেসি সব মিলিয়ে এই টুর্নামেন্টে করেন ৫ গোল।
কোপা শুরুর আগে থেকেই চলছিল ‘কানাঘুষা’। বাতিস্তুতার রেকর্ড ছুয়ে ফেলতে যাচ্ছেন বর্তমান সময়ের সেরা খেলোয়াড় লিওনেল মেসি। বাতিস্তুতাও জানিয়েছিলেন, অন্য কেউ তার রেকর্ড ভাঙ্গলে অভিনন্দন জানানো আগে চিন্তা করে দেখবেন। কিন্তু সেটা যদি হয় লিওনেল মেসি। তাহলে তাকে তিনি অগ্রীম অভিনন্দন জানিয়ে রাখতে চান। আর্জেন্টিনার কোচ জেরার্ডো মার্টিনো গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, এবারের কোপা আসরেই বাতিস্তুতার রেকর্ড ছুয়ে ফেলবে মেসি। এ ব্যপারে আশাবাদী তিনি। মেসি ভক্তরাও বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত ছিল। তাদের শুধু প্রশ্ন ছিল, সেটাকি ফাইনালের আগেই হবে? এত মানুষের আশা আসলে ভঙ্গ করেননি লিওনেল মেসি। এ পর্যন্ত যা ঘটেছে মার্টিনো তাতে খুশি হলেও অবশ্য নিজের দলকে সেরার তকমা দিবেন শিরোপা জয়ের পর, ‘ঐ ম্যাচ (ফাইনাল) দিয়েই আমাদের প্রমান হবে আমরা সেরা, না কি সেরা নয়।’
শতবর্ষী কোপার এ আসরে এ পর্যন্ত দলের খেলায় সন্তুষ্ট পাঁচ বারের বর্ষসেরা এই ফুটবলার। ‘প্রথম দিন থেকেই আমরা বিষয়গুলো দুর্দান্তভাবে করেছি। এখানে (ফাইনালে) থাকা আমাদের প্রাপ্য বলেন- মেসি।
যদিও অসাধারণ খেলে ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠলেও জার্মানির কাছে ১-০ গোলে হেরে শিরোপা জয়ের স্বপ্ন ভেঙেছিল আর্জেন্টিনার। এর পর গত বছরের কোপা আমেরিকার ফাইনালে স্বাগতিক চিলির কাছে টাইব্রেকারে হেরে গিয়েছিল তারা। ১৯৯৩ সালের কোপা আমেরিকা জয়ের পর আর কোনো শিরোপার মুখ দেখেনি আর্জেন্টিনা। এখানেই মেসির অতৃপ্তি। তাই মেসির বিশ্বাস ২৩ বছরের শিরোপা-খরা এবার ঘুচবে। আর্জেন্টিনা ট্রফি না জেতা পর্যন্ত দাড়ি কাটবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মেসি বলেন- ‘আমি আশা করি, এটা আর ফসকাবে না। গত কয়েক বছর ধরে আমরা যে কাজ করছি এর জন্য সাফল্য আমাদের প্রাপ্য।’ ইস্ট রাদারফোর্ডে বাংলাদেশ সময় আগামী সোমবার ভোর ৬টায় ফাইনালে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ গতবারের চ্যাম্পিয়ন চিলি। নিজেদের ইতিহাসে প্রথম টানা দ্বিতীয় ফাইনালে উঠে গেল চিলি। এবার তাদের টানা দ্বিতীয় শিরোপা জয়ের ইতিহাসের হাতছানি। কিন্তু মেসির আর্জেন্টিনাও মরিয়া, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। জমজমাট ফাইনালই তাই দিচ্ছে পূর্বাভাস।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।