Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অর্থপাচার ও আত্মসাৎ মামলা এসকে সিন্হাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে প্রস্তুত চার্জশিট

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

অর্থ পাচার এবং আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এসকে সিনহা)সহ ১১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল বুধবার কমিশন সভায় তদন্ত প্রতিবেদনের অনুমোদন দেয়া হয়। শিঘ্রই এটি চার্জশিট আকারে আদালতে দাখিল করা হবে জানা গেছে। মামলার এক আসামি ইতিমধ্যেই মারা যাওয়ায় তার নাম চার্জশিটে থাকছে না। তবে তদন্তে ফামার্স ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলম চিশতির সম্পৃক্ততা বেরিয়ে আসায় তাকেও আসামি করা হয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখিত আসামিরা হলেন, ফার্মার্স ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম শামীম, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাবেক ক্রেডিট প্রধান গাজী সালাহউদ্দিন, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায় সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক মো. জিয়া উদ্দিন আহমেদ, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট শাফিউদ্দিন আসকারী, ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. লুৎফুল হক, টাঙ্গাইলের ব্যবসায়ী মো. শাহজাহান, একই এলাকার নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা, সান্ত্রী রায় ওরফে সিমি ও তার স্বামী রণজিৎ চন্দ্র সাহা। ৪ কোটি টাকা আত্মসাতে জড়িত থাকার অভিযোগে এসকে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে এ চার্জশিট দিচ্ছে দুদক।

তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ব্যাংক থেকে ভুয়া ঋণের নামে ৪ কোটি টাকা উত্তোলন করেন। ওই অর্থ ব্যক্তিগত হিসাব থেকে অস্বাভাবিকভাবে নগদে, চেক বা পে-অর্ডারের মাধ্যমে অন্য হিসাবে স্থানান্তর, রূপান্তর এবং আত্মসাৎ করেন। আসামিরা ওই অর্থ নিজেদের ভোগদখল ও তার অবৈধ প্রকৃতি উৎস, অবস্থান গোপনের মাধ্যমে পাচার বা পাচারের প্রচেষ্টায় সংঘবদ্ধভাবে সম্পৃক্ত হন। কথিত ব্যবসায়ী শাহজাহান ও নিরঞ্জন ফার্মার্স ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ৪ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছিলেন।

সেই অর্থ রনজিৎ চন্দ্র সাহার হাত ঘুরে বিচারপতি সিনহার বাড়ি বিক্রির টাকা হিসেবে খাতা-কলমে দেখিয়ে তার ব্যাংক হিসাবে ঢোকানো হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, রেকর্ডপত্র, সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, জনৈক মো. শাহাজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর ফার্মার্স ব্যাংক গুলশান শাখায় পৃথক ২টি চলতি হিসাব খোলেন। (যার নম্বর ০১১১১০০১৫৬৩৪১ ও ০১১১১০০১৫৬৩৪৯)।

পরদিনই ফার্মার্স ব্যাংক গুলশান শাখায় মো. শাহাজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা পৃথকভাবে ২ কোটি টাকা করে ৪ কোটি টাকার ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য ঋণ আবেদন করেন। ওই ব্যাংকে হিসাব খোলা এবং ঋণ আবেদনপত্রে তারা দু’জনই তাদের ঠিকানা হিসেবে বাড়ি নং-৫১, রোড নং-১২, সেক্টর-১০, উত্তরা আবাসিক এলাকা উল্লেখ করেন। তদন্তে বেরিয়ে আসে, এ বাড়ির মালিক সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।

ঋণ আবেদনের বিপরীতে জামানত হিসেবে রনজিৎ চন্দ্র সাহার স্ত্রী সান্ত্রী রায়ের নামে সাভারে ৩২ শতাংশ জমির কথা উল্লেখ করেন। তারা দু’জন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার পূর্ব পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ। মো. শাহাজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহার ওই ঋণসংক্রান্ত আবেদন দুটি কোনো রকম যাচাই-বাছাই, রেকর্ডপত্র বিশ্লেষণ ও ব্যাংকের কোনো নিয়ম-নীতি না মেনে শুধু গ্রাহকের আবেদনের ওপর ভিত্তি করে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঋণ প্রস্তাব তৈরি করে তাতে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা স্বাক্ষর করেন।

ব্যাংক শাখার ম্যানেজার মো. জিয়াউদ্দিন আহমেদসহ শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা শাখার অপারেশন ম্যানেজার লুৎফল হক ও ক্রেডিট ইনচার্জ শাফিউদ্দিন আসকারী এ প্রক্রিয়াটি তড়িঘড়ি সম্পাদন করেন। পরে ম্যানেজার মো. জিয়াউদ্দিন আহমেদ হাতে হাতে ঋণ প্রস্তাবটি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে যান। ক্রেডিট কমিটির কর্মকর্তা স্বপন কুমার রায়ও ওই ঋণ প্রস্তাব দুটি যাচাই-বাছাই ছাড়া তাতে অফিস নোট তৈরি করে স্বাক্ষর দেন। তিনি তা ক্রেডিটপ্রধান গাজী সালাহউদ্দিনের কাছে নিয়ে যান।

গাজী সালাহউদ্দিনও কোনো ধরণের যাচাই-বাছাই ছাড়াই তাতে স্বাক্ষর করে ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম শামীমের কাছে নিয়ে যান। ফার্মার্স ব্যাংকের ঋণ পলিসিসংক্রান্ত বিধি অনুযায়ী ঋণ দুটির প্রস্তাব অনুমোদন করার ক্ষমতা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ছিল না। অথচ তিনি এ সংক্রান্ত ঋণ প্রস্তাব দুটি অনুমোদন করেন। এছাড়াও ফার্মার্স ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ে ঋণ অনুমোদন জন্য নথি উপস্থাপিত করা হলে নথির নোটাংশে হাতে লেখা হয়, ‘দ্যোস ফর হি হ্যাজ বিন রিসিভিং সাচ সাপোর্ট ফরম মি. এসকে সিনহা, চিফ জাস্টিস হাউস, কাকরাইল ঢাকা, অ্যান্ড টু কন্টিনিউ স্কয়ার আপ বিজনেস মি. এসকে সিনহা’।

পরবর্তীতে ওই নোট পরিবর্তন করে নতুন নোট তৈরির পর তাতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ এমডি স্বাক্ষর করেন। ব্যাংকটির তৎকালিন চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলম চিশতি (বাবুল চিশতি) ঋণটি অনুমোদন করেন। এ প্রক্রিয়ায় ঋণ মঞ্জুর হওয়ার পরের দিন ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর মো. শাহাজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহার আবেদনের ভিত্তিতে ঋণ হিসাবে অনুমোদিত ৪ কোটি টাকার পৃথক দুটি পে-অর্ডার সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নামে ইস্যু হয়। পরে এসকে সিনহার নামীয় সোনালী ব্যাংক সুপ্রিম কোর্ট শাখার হিসাবে (হিসাব নং-৪৪৩৫৪৩৪০০৪৪৭৫) ৯ নভেম্বর ওই ৪ কোটি টাকা জমা হয়।

বিভিন্ন সময়ে অস্বাভাবিক ক্যাশ, চেক ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে তিনি (এসকে সিনহা) বিভিন্ন ব্যক্তিকে দিয়ে ওই হিসাব থেকে টাকা উত্তোলন করেন। এর মধ্যে শাহজালাল ব্যাংক উত্তরা শাখায় তার এক ভাইয়ের নামে থাকা হিসাবে (হিসাব নং- ৪০০৮১২১০০০৪৯০৪২) দুটি চেকের মাধ্যমে ২৮ নভেম্বর যথাক্রমে ১ কোটি ৪৯ লাখ ৬ হাজার ও ৭৪ লাখ ৫৩ হাজার টাকা স্থানান্তর করা হয়। পরে ওই হিসাব থেকে বিভিন্ন সময়ে ক্যাশ/চেকের মাধ্যমে ওই টাকা উত্তোলন করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আসামি রনজিৎ চন্দ্র সাহা ব্যাংকে উপস্থিত থেকে ঋণ আবেদন দ্রুত অনুমোদনের জন্য প্রধান বিচারপতির নাম করে প্রভাব বিস্তার করেন। এছাড়া ঋণ আবেদনকারী নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা রনজিৎ চন্দ্র সাহার ভাতিজা এবং মো. শাহজাহান মি. রনজিৎ চন্দ্র সাহার ছোটবেলার বন্ধু তারা দু’জনই অত্যন্ত গরিব দুস্থ। তারা কখনও ব্যবসা-বাণিজ্য করেননি। তাদের কোনো ব্যবসা নেই। সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তার ঘনিষ্ঠ রনজিৎ চন্দ্র সাহার মাধ্যমে তাদের ভুল বুঝিয়ে ব্যাংকের কাগজপত্রে স্বাক্ষর করে নেয়ার ব্যবস্থা করেন। যা দন্ডবিধির ৪০৯, ৪২০, ১০৯ ধারা, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা এবং ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪(২) ও (৩) ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।

গতকাল দুদকের মহাপরিচালক (বিশেষ অনুসন্ধান-তদন্ত) সাঈদ মাহবুব খান সাংবাদিকদের জানান, শিঘ্রই এটি চার্জশিট আকারে আদালতে দাখিল করা হবে। সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা এসকে সিনহার বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে একটি মামলা করেন। এটিও তদন্ত করে দুদক। তবে মামলাটি তদন্তে অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় এ মামলা থেকে এসকে সিনহাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। বরং মিথ্যা দিয়ে মামলা করায় উল্টো ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার বিরুদ্ধেই দুদক মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানান দুদক মহাপরিচালক।

প্রসঙ্গত: সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং কিছু পর্যবেক্ষণের কারণে ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে ২০১৭ সালের অক্টোবরে ছুটিতে যান তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা। পরে বিদেশ থেকেই তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন।

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অর্থপাচার

৬ মার্চ, ২০২১
৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১
২৭ ডিসেম্বর, ২০১৮

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ